#ধারাবাহিকগল্প
#লড়াই
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী
গাড়িতে উঠে ফয়সল আবার মোবাইলে ইন্টারনেটে ওর পেপারসগুলো তৈরী করতে লাগলো। সায়মার ছেলের দিকে তাকিয়ে গর্বে বুকটা ভরে উঠলো। জন্মের আগেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়াতে জীবনে সায়মা বাবার ভালবাসা পায়নি। এতে অবশ্য ওর কষ্ট হয় না। বরং মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান হিসাবে গর্ব বোধ করে।
স্বামীর ভালবাসাও কপালে জোটেনি। সায়মা নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে। প্রবাদ আছে অতি বড় সুন্দরী না পায় বর অতি বড় ঘরনী না পায় ঘর। আজ ফয়সলের বাবার কথা মনে হচ্ছে। তবে ছেলেটা ওর সব দিক পূর্ণ করে দিয়েছে। ফয়সল ওর বাবার মতো হয়নি। ওর বাবা সায়মার কদর বুঝেনি। তাই হাতের লক্ষী পায়ে ঠেলে দিলো।
রিয়াদ সায়মার সাথে প্রতারণা করার পর সায়মা বিয়ে করতে চায়নি। ও তখন কলেজে চাকরি করে। ওর আশ্রয়দাতা আছিয়ার হাসবেন্ডের বন্ধু মানুষ জামান সাহেব। উনি ভার্সিটির প্রফেসর ছিলেন। উনার দুই ছেলে ছিলো। বড় ছেলে চল্লিশবছর বয়সে হার্টএটাক করে মারা যায়। আর ছোটো ছেলে ইন্জিনিয়ার রাশেদ। উনি বিদ্যুৎউন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করতেন। সায়মাকে রাশেদের বাবা ছোটো ছেলের বউ হিসাবে পছন্দ করলেন। সায়মার সবটা জেনে ওকে বউ করে ঘরে তুললেন। সায়মা নিজেকে অনেক বড় ভাগ্যবতী মনে করলো। রাশেদ দেখতেও বেশ পুরুষালী। বলিষ্ঠ গঠন। ছ,ফিট লম্বা।কিন্তু বাসর রাতে সায়মার স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেলো। রাশেদ এসে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সায়মার দিকে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না।
পরদিন সায়মা ঘুম থেকে উঠার আগেই রাশেদের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে বসলো।
সায়মা ঘুম থেকে উঠে দেখে রাশেদ পাশে নেই। ও ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে এসে দেখে রাশেদের ভাবী খুব যত্নসহকারে রাশেদকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। ওরা খেয়াল করেনি সায়মা এসে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদের ভাবীর নাম মর্জিনা। মর্জিনা রাশেদকে বললো,
—-ছোটোভাই নতুন বউয়ের সোহাগে ঘুম কেমন হলো?
—ওর দিকে আমি ফিরেও তাকাইনি। শুধু বাবার মন রক্ষার্থে ওকে বিয়ে করেছি। তাও বাবা যদি ইমোশনালি ব্লাকমেইল না করতো তাহলে ওকে বিয়েই করতাম না।
সায়মা আস্তে করে সরে গিয়ে রুমে চলে গেলো। ওর চোখ দুটো নোনা জলে ভরে গেলো। ও ভাবছে ওর সাথেই কেন বার বার এমন হয়? আর এও বুঝলো ওর কপালে ভালই দুর্গতি আছে। রাশেদ নাস্তা খেয়ে অফিসে চলে যাওয়ার পর মর্জিনা সায়মা আর ওর শ্বশুরকে টেবিলে নাস্তা দিয়ে ছেলেকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিলো। ছেলেকে খাইয়ে ওকে নিয়ে মর্জিনা স্কুলে চলে গেলো। সায়মার ও ছুটি শেষ হয়ে গেলে ও আবার রেগুলার রুটিনে ফিরতে লাগলো। প্রতিদিন সকালে সায়মা কলেজে যেতে লাগলো। তাই দিনেরবেলা ওর সময়টা ভালই কেটে যায়। কিন্তু রাত আসলে অস্বস্তি শুরু হয়। ইতিমধ্যে বিয়ের ছ,মাস পার হয়ে গেলো। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে শ্বশুর জামান সাহেব আর রাশেদের বড় ভাইয়ের ছেলে অর্নবের সাথে ভালই সময় কাটে। অর্নবের বয়স আট বছর। সায়মার সাথে ওর বেশ ভাব হয়েছে। খুব ভোরে উঠে সায়মা ফজরের নামাজ পড়ে নেয়। তারপর শ্বশুরকে চা বানিয়ে দেয়। নিজেও এক কাপ চা খেয়ে সকালের নাস্তা বানাতে থাকে। কাজের খালার সাহায্যে ছুটির দিনগুলোতে সকালের নাস্তা দুপুরের লাঞ্চ রাতের ডিনার সবটাই সায়মা তৈরী করে।ওর শ্বশুর জামান সাহেব বুঝতে পারছিলেন যে রাশেদ আর সায়মার সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক তৈরী হয়নি। তাই একদিন সায়মাকে ডেকে বললেন,
—-মা আমি জানি তুমি আমার ছেলেকে নিয়ে সুখী হতে পারোনি। তবে তুমি এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। এতো সহজে জীবনের কাছে হেরে যেও না।
—-বাবা আপনি মনে হয় আমার উপর খুব বেশী ভরসা করছেন।
—এতো সময় হয়ত তোমার লাগতো না বউমা। তুমি সুন্দরী শিক্ষিতা। রাশেদ খুব সহজে তোমার বশে আসতো। আসলে কি জানো ঘর শত্রু বিভীষণ।
সায়মা এই বিষয়টা নিয়ে শ্বশুরের সাথে আর কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। নিজের নারীত্বের অপমান লাগছে। তাই শ্বশুরকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সামনে থেকে চলে গেলো।
এর মধ্যে একদিন রাত্রে সায়মার ঘুম ভেঙ্গে যায়। পাশ ফিরে দেখে রাশেদ বিছানায় নেই। কৌতূহল বশত রাশেদকে খুঁজতে ডাইনিং রুমে চলে আসে। তখন ও দেখে ওর জায়ের রুমের লাইটটা জ্বালানো রয়েছে। দরজাটাও ভিজিয়ে দেওয়া রয়েছে। ও দরজা একটু ফাঁক করে দেখে রাশেদ আর মর্জিনা নিজেদের লীলাখেলায় এতো ব্যস্ত ছিলো আশেপাশে খেয়াল করার সময় ওদের নাই। ও চুপি চুপি সেখান থেকে সরে এসে নিজের রুমে শুয়ে পড়ে। ওর তখন ভীষণ কান্না পায়। ও কাঁদতে চাইছিলো না কারণ রাশেদের সাথে ওর তেমন সম্পর্ক তৈরী হয়নি। ওর তো কষ্ট পাওয়ার কথা নয়। তারপরও কেন কান্না পাচ্ছে ও বুঝতে পারছে না। ও রাশেদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। এভাবে আর চলতে পারে না। ওর জীবনটা কেন রাশেদ নষ্ট করলো এর কৈফিয়ত আজ ওকে চাইতে হবে। রাশেদ রুমে চলে আসার পর সায়মা দরজার সিটকিনিটা লাগিয়ে দিয়ে বলে আপনার সাথে কথা আছে। রাশেদ সিটকিনি লাগাতে দেখে সায়মাকে বলে,
—-কথা বলতে আবার সিটকিনি লাগাতে হয় নাকি?
—–আমি চাই না দেবর ভাবীর লীলাখেলার পাপের খবর বয়স্ক মানুষটা জেনে যাক।
—-ও এখন আমার উপর স্পাইগিরি করা হচ্ছে।
—–কারো বিরুদ্ধে স্পাইগিরি করার ইচ্ছে আমার নেই। আপনাদের লীলাখেলার সময় দরজা ভেজিয়ে না রেখে বন্ধ করে রাখা উচিত ছিলো। কারণ এ বাড়িতে একটা বাচ্চাও থাকে। ও যদি ওর দাদুর কাছ থেকে কখনও উঠে এসে নিজের মাকে চাচার সাথে শুয়ে শুয়ে প্রেমালাপ করতে দেখে তাহলে ওর মানসিকতার উপরে কি রকম চাপ পড়বে সেটাও আপনাদের ভাবা দরকার।
—-আপনার কাছে আমার জ্ঞান নিতে হবে না। একজন বুয়ার মেয়েকে আমি স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছি। এটাই তো আপনার অনেক বড় ভাগ্য। তবে আমার উপর স্ত্রীর অধিকার ফলানোর চেষ্টা করবেন না।
—-আমার জীবনটা নষ্ট করার কোনো অধিকার আপনার নাই। আমার যা ক্ষতি করার আপনি করে ফেলেছেন। এখন আমি আপনার কাছ থেকে মুক্তি চাই। আপনার স্ত্রী হয়ে জীবন পার করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আর হ্যা আপনিতো জানতেন আমি বুয়ার মেয়ে। তাহলে আমাকে বিয়ে করতে গেলেন কেন?
—-আমার সব কিছু যেন তুমি সহজে মেনে নাও। এই জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি। তারপর আমার সময়মতো একসময় ডিভোর্স দিয়ে দিবো।
—আপনি থেকে হঠাৎ তুমি তে চলে আসলেন কেন? আর আপনাদের প্লানটাও সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়েছেন।
—-তুমি বলেছি। বুয়ার মেয়ে হিসাবে তুই বলা দরকার ছিলো। এখন এই মধ্যরাত্রিতে তোমার সাথে বকবক করতে ভাল্লাগছে না। সকালে অফিস আছে। আমি এখন ঘুমোবো।
সেই রাত্রিতে সায়মার আর ঘুম আসেনি। পরদিন সকালবেলা রাশেদ অফিসে যাবার পর মর্জিনা সায়মাকে বলে,
—-নিজের ভালো যদি চাও তাহলে আমার আর রাশেদের মাঝখানে ঢুকবে না। আর আমাদের সম্পর্কের কথা যেন বাবার কানে তোলা না হয়। কথাগুলো মনে রেখো।
—-আপনার কি ধারনা বাবা আপনাদের ব্যাপারে কিছু জানে না?
চলবে