#ধারাবাহিকগল্প
#লড়াই
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী
রাত দশটার সময় সায়মার ফোনটা বেজে উঠলো।
—–হ্যালো, আপনি কি সায়মা বলছেন?
—-হ্যাঁ
—-রাশেদ আপনার কি হন?
—-আমার হাসবেন্ড
—-আমি সিটি হাসপাতাল থেকে গাজীপুর সদর থানার ইনচার্জ বলছি। আমরা আপনার হাসব্যান্ডের মোবাইল থেকে আপনার নাম্বার যোগাড় করেছি। উনি খুব ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে আছেন। উনার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। পাশে একজন মহিলা ছিলেন। উনি স্পটডেড। আপনি খুব তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসেন।
সায়মা অর্ণবকে ওর নানুর বাসায় রেখে শ্বশুরকে নিয়ে উবার ভাড়া করে গাজীপুরের পথে রওয়ানা হলো। শ্বশুর জামান সাহেব সায়মার সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে। আসলে এখানে কারো কথা বলার মতো ভাষা নেই। তবে পাপ যে কাউকে ছাড়েনা এটাই প্রমানিত হলো। সায়মা কোনো হিসাব মেলাতে পারছে না। রাশেদ ওকে রেডী থাকতে বলে মর্জিনাকে নিয়ে গাজীপুরে গেল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আদৌ ও কোনোদিন জানতে পারবে কিনা ও জানে না। একজন তো মরে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলো। আর একজনের কি অবস্থা তা একমাত্র আল্লাহপাক জানেন। সায়মার কাছে রাশেদ একবার ভালো হওয়ার সুযোগ চেয়েছিলো। সায়মাও উদার মনের পরিচয় দেওয়ার পরও ওর ভাগ্যটা কেন এমন হলো? সায়মা নিজের মনের কাছে এর উত্তর খুঁজে বেড়ায়।
গাজীপুর সিটি হাসপাতাল পৌছাতে ওদের রাত একটা বেজে গেলো। থানার ইনচার্জ হাসপাতালের অফিসরুমে ছিলেন। সায়মার হাতে মর্জিনার ব্যাগ, মোবাইল, রাশেদের ঘড়ি, মোবাইল, ল্যাপটপের ব্যাগ সব তুলে দিয়ে ওদেরকে ডেড বডি দেখাতে নিয়ে গেলেন। থানার ওসি সায়মাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
—-এই মহিলা কি আপনাদের পরিচিত?
জামান সাহেব সায়মার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ তার পারিবারিক সম্মান প্রশ্নবিদ্ধ। এই মেয়েটার বক্তব্যের উপর তার পরিবারের সম্মান নির্ভর করছে। সায়মার ওর শ্বশুরের মুখের দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হলো। জন্মের আগেই বাপকে হারিয়েছে। বাবার ভালবাসা বলতে যা বুঝায় তার কিছুটা হলেও এই মানুষটার কাছে ও পেয়েছে। শ্বশুরের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে সায়মা ওসি সাহেবকে বললো,
—-উনি আমার পরিবারের একজন। আমার বড় জা হন।
—–উনার হাসব্যান্ড আসলেন না?
—–উনি বেঁচে নেই। তাই আমার জা একটা পারিবারিক কাজে আমার হাসবেন্ডের সাথে বের হয়ে ছিলেন। তার মধ্যেই এই দুর্ঘটনা ঘটলো।
—–আপনি খুব শক্ত মানুষ। হাসবেন্ডের এই অবস্থাতেও সব কিছু স্বাভাবিকভাবে করছেন।
—–আমার তো আর কোনো উপায় নেই। আমার শ্বশুরকে তো দেখতেই পারছেন উনি মানসিকভাবে কতটা ভেঙ্গে পড়েছেন। অগত্যা আমাকেই শক্ত হতে হবে।
—-যাক আপনাদের সবকিছু জিনিস বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাশেদ সাহেবের গাড়িটা থানায় টেনে আনা হয়েছে। আপনারা একসময় এসে বুঝে নিয়েন। আর লাশ ময়না তদন্তের জন্য নিয়ে যাচ্ছি।
থানার ইনচার্জ চলে যাবার পর জামান সাহেব সায়মার হাত ধরে বললো,
—–মা তুমি আমার পরিবারের সম্মান বাঁচালে। আমার অন্তর থেকে তোমার জন্য দোয়া বেরিয়ে আসলো। তোমার মা একজন রত্নগর্ভা। তোমার মতো সন্তানকে উনি গর্ভে ধারণ করেছেন। আমি একজন প্রফেসর হয়েও আমার ছেলেকে মানুষ করতে পারিনি।
সায়মা বললো,
—-বাবা আমি শুধু আমার দায়িত্বটুকু পালন করেছি মাত্র। আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না। আমি আমার সাধ্যমত সব সামলে নিতে চেষ্টা করবো।
এ ছাড়া সায়মার আর কিই বা করার ছিলো।
এদিকে সায়মা রাশেদের শরীরের খোঁজ খবর নিতে ডাক্তারের কাছে গেলো। ডাক্তার ওকে বললো
—-বাহাত্তর ঘন্টা না গেলে আমরা কিছু বলতে পারছি না। আল্লাহর কাছে দোয়া করেন পেশেন্টের জ্ঞান যেন খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসে।
এসব টানাপোড়েনে সায়মার শরীরটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। এখানেই একজন গাইনি ডাক্তার দেখালো। টেস্ট করে জানা গেলো সায়মা কনসিভ করেছে। জামান সাহেব সায়মাকে বললো,
—-মা তোমার সমস্যাটা কি?
সায়মা বললো,
—-বাবা আপনি আবার দাদা হতে চলেছেন।
এতো কষ্টের মাঝে এই খবরটা যেন এই পরিবারের প্রাণ ফিরিয়ে দিলো। আল্লাহপাক মানুষের সবরাস্তা একসাথে বন্ধ করেন না। একটি পথ বন্ধ হলে আরেক পথ খুলে যায়। এতো অপ্রাপ্তির মাঝেও মাতৃত্বের স্বাদ যেন সায়মাকে খুশীতে ভরিয়ে দিলো।
জামান সাহেব খবরটা পাওয়ার সাথে সাথে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে ছেলের অনাগত সন্তানের মঙ্গলের জন্য দোয়া করলো।
এই হাসপাতালে সায়মা একটা কেবিন ভাড়া করলো। ওর শ্বশুর কেবিনে এসে একটু ঘুমিয়ে পড়লো। সায়মাও সোফায় বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো। আর মনে মনে ভাবতে লাগলো রাশেদ ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলার পরও কেন মর্জিনাকে নিয়ে গাজীপুরে গেলো? কি এমন ঘটলো যে ওর গাজীপুরে যেতে হলো? ও তো সব কিছু মেনেই নিয়েছিলো। রাশেদ তো ওকে ফোন করে বলে যেতে পারতো। কেন এই গোপনীয়তা ও সায়মার সাথে করলো? এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রাশেদের মোবাইলটা ওপেন করে মেসেঞ্জারে ঢুকে দেখলো, ঐ দিন মর্জিনা রাশেদকে মেসেজ পাঠিয়েছে।
“রাশেদ তোমাকে ফোন দিলাম। তুমি ফোন ধরলে না। আজ তোমার অন্য নারী মাংসের স্বাদ পেয়ে আমাকে আর ভাল্লাগছে না। তাই এখন আমাকে এভয়েড করছো। তোমাকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি তুমি যদি বিকাল পাঁচটার মধ্যে গাজীপুর বোর্ড বাজারের কাছে না আসো তাহলে আমি ওখানেই সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকবো। আমার যদি কোনো ক্ষতি হয় এই দায় তোমাকে বহন করতে হবে। আমি আজকে রাতটা থাকার জন্য একটা রিসোর্ট ভাড়া করেছি। তুমি আসার পর আমরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে রিসোর্টে উঠবো। তারপর তুমি সায়মাকে ডিভোর্স দিবে”।
এর উত্তরে রাশেদ লিখেছে”সায়মা আমার বিবাহিত স্ত্রী। আইনত এবং শরীয়ত মোতাবেক সে আমার জন্য বৈধ। তুমি মাথা ঠান্ডা করো। আমি গাজীপুরে আসছি। তুমি যদি আজ অর্ণবের মা নাহতে আমি হয়ত তোমার কথা মতো গাজীপুরে যেতাম না”।
সায়মা শুধু ভাবছে রাশেদ তো ওকে জানাতে পারতো।
কলাবাগান বশিরউদ্দিন রোডে সায়মার শ্বশুর বাড়ি। ওর শ্বশুর ওখানে তিন কাঠা জমির উপর পাঁচতলা ভিত দিয়ে আপাতত ডুপ্লেক্স করেছে। বাহাত্তর ঘন্টা পর রাশেদের জ্ঞান ফিরে আসলো। কিন্তু রাশেদ মাথায় আঘাত পেয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললো। শরীরের কোমর থেকে নিচের অংশটা অবশ হয়ে আছে। তবে নিয়মিত ফিজিওথেরাপী করলে হয়ত সুস্থ হয়ে যেতে পারে আবার নাও হতে পারে। যাই হোক ভাগ্যের লেখন খন্ডানো যায় না। ছেলের জ্ঞান ফিরে আসার পর জামান সাহেব মর্জিনার লাশের দাফন কাফনের জন্য লাশ নিয়ে কলাবাগানে চলে আসলো। হাসপাতালে সায়মা একাই থাকলো। সায়মাকে দেখলে রাশেদ ফ্যাল ফ্যাল করে সায়মার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর অঝোরে চোখের পানি ফেলে। সায়মার এখন আর কোনো অনুভূতি কাজ করে না। দায়িত্বের খাতিরে রাশেদের সেবা যত্ন করে যায়। পনেরোদিন হাসপাতালে থেকে রাশেদকে নিয়ে বাড়ি চলে আসে। রাশেদের সেবাযত্নের জন্য একজন নার্স রেখে দেয়া হয়। সায়মা কলেজে জয়েন করে ওর স্বাভাবিক রুটিনে ফিরে গেলো। অর্ণবকে ওর নানা নানী সায়মার কাছে দিলো না। অর্ণব ওর নানা বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতে লাগলো। সায়মাও নিজের দায়িত্বের খাতিরে সকালে একবার আর রাতে একবার এসে রাশেদের শরীরের খোঁজ খবর নিতো। নার্স ঠিক মতো ওর দায়িত্ব পালন করছে কিনা সেদিকেও নজর রাখতো। নির্দিষ্ট সময়ের পর সায়মার পুত্র সন্তানের জন্ম হলো। সায়মা কলেজে থাকলে সায়মার শ্বশুর নাতী ফয়সলকে রাশেদের পাশে শুইয়ে দিতো। রাশেদের চোখ মুখ আনন্দে ঝলমল করতো।
বছর দুই এভাবে থাকার পর রাশেদের শরীর আবারও খারাপ হয়ে গেলো। ওকে আইসিইউ তে ভর্তি করা হলো। কিছুদিন পর রাশেদ মারা গেলো। রাশেদ মারা যাবার পর সায়মা রাশেদের ঘরটা ক্লিন করতে গিয়ে একটা ডায়েরী পেলো।। ডায়েরীতে সায়মা ওর প্রশ্নের কিছু উত্তর খুঁজে পেলো।
চলবে