#ধারাবাহিকগল্প
#লড়াই
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী
ফোনটা তুলে সায়মা বললো,
—–হ্যালো বড়মা, তোমাদের শরীর ঠিক আছে তো?
—–আল্লাহর রহমতে শরীর ঠিক আছে। আমাদের নিয়ে এতো চিন্তা করিস কেন? তোর আসতে কি দেরী হবে?
—– তোমরা ছাড়া আমার আছেটা কে? তোমাদের নিয়েই আমার ভাবনা। একটু দেরী হতে পারে। তুমি আর মা খেয়ে নাও। ফয়সল ভার্সিটি থেকে ফিরেছে?
—-না, ও এখনও ফেরেনি।
—-তোমরা আর অপেক্ষা করো না। খেয়ে নাও। ওষুধ খেতে হবে।
ফোনটা রেখে সায়মা ওর পিয়ন মজিদ মিয়াকে ডেকে পাঠিয়ে বললো,
—–মজিদ ড্রাইভারকে গাড়িটা বের করতে বলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দুটো বাজে। কলেজ ছুটি হয়ে গেছে। হাতের কাজ গুছিয়ে সায়মা বাড়ির পথে রওয়ানা হলো।
মেয়েদের জীবনটা যেন লড়াইয়ের ময়দান। প্রতিমূহুর্তে লড়াই করে যেতে হয়।
সায়মা আবার অতীতের ভাবনায় ডুবে গেলো। ভার্সিটিতে পড়ার সময় রিয়াদের সাথে সায়মার প্রেম হয়। দুজনের খুব গভীর প্রেম ছিলো। রিয়াদ জানতো সায়মার বাবা একজন কৃষক ছিলো। সায়মারা ঢাকায় ওদের এক আত্মীয়ার বাসায় আশ্রিত থেকে লেখাপড়া করছে। অপরদিকে রিয়াদের পরিবার বেশ উচ্চবিত্ত। বাবা মা দুজনেই সচিব ছিলেন। সায়মা আর রিয়াদ একসাথে ভালো রেজাল্টসহ গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলো।
সেদিন ছিলো ফাগুনের প্রথম দিন। ভার্সিটিতে রিয়াদ সায়মাকে বললো,
—-সায়মা কাল তুমি রমনা পার্কের রেস্টুরেন্টে বিকাল পাঁচটায় এসো। তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে।
—-কি কথা রিয়াদ? আমার তো এখুনি শুনতে ইচ্ছা করছে। একটু বলা যাবে কি?
—কালকেই বলব। আজ একটু বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।
রিয়াদ চলে যাবার পর সায়মা ভাবছে রিয়াদ হয়ত ওকে বিয়ের কথা বলবে। ও তখন রিয়াদকে নিয়ে অনেক কিছু ভাবতে লাগলো। ওদের বিয়ে হবে খুব সুন্দর সংসার হবে। এসব ভাবতে ভাবতে রিকশা করে বাসায় চলে আসলো।
পরদিন সায়মা একটা নীলরঙের জর্জেটের শাড়ি পড়ে খোঁপায় বেলী ফুলের মালা গুঁজে চোখে কাজলের রেখা টেনে ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে ঠিক বিকাল পাঁচটায় রমনার রেস্টুরেন্টে পৌছে গেলাে। রিয়াদ আগে থেকেই ওর জন্য অপেক্ষা করছে। রিয়াদ ওর দিকে না তাকিয়ে বললো,
—-কি খাবে বলো?
—-খাবারের কথা এখন থাক। তুমি কি বলবে বলো আমার আর তর সইছে না।
রিয়াদ জানে সায়মা ওকে খুব ভালবাসে। কিন্তু রিয়াদের আজ কিছু করার নাই। ওকে আজ কথাগুলো বলতে হবে। রিয়াদ দুই কাপ কফির অডার করে সায়মার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“let’s break up saima.আমরা আর একসাথে থাকতে পারবো না। তোমাকে যেহেতু আমার আর ভালো লাগে না তাই আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ রেখো না। এটাই আমাদের শেষ দেখা।
রিয়াদের মুখে এই কথাগুলো শুনে সায়মা আকাশ থেকে পড়লো। ওর মাথায় কোনো কিছু ঢুকছে না। চার বছরের গভীর প্রেম ভেঙ্গে যেতে পারে না। ওর মনে হচ্ছে রিয়াদ ওর সাথে মজা করছে। তাই রিয়াদকে বললো,
—আমি জানি রিয়াদ তুমি আমার ভালবাসার পরীক্ষা নিতে অনেক অদ্ভুত রকমের মজা করো। কিন্তু প্লিজ রিয়াদ আমাদের সম্পর্ক নিয়ে মজা করো না। আমি এটা নিতে পারছি না।
খুব কঠিন গলায় রিয়াদ বললো,
—-আমি কোনো মজা করছি না। আর যাই হোক একজন কাজের বুয়া আমার শাশুড়ী হতে পারে না। তুমি জানতে আমার বাবা সচিব। কিন্তু তুমি তোমার পরিচয় আমার কাছে গোপন করেছিলে।
—-রিয়াদ আমি হয়ত তোমাকে এটা বলিনি যে জীবনের প্রয়োজনে আমার মাকে হয়ত কিছুদিন লোকের বাড়িতে কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু আমাদেরও জমিজমা ছিলো। কিছু হলেও সহায় সম্পদ ছিলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শত্রুসেনারা আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। কিছু নদীর পেটে গিয়েছে। তোমাকেতো বলেছি আমি নিম্মমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে।
—-তোমার সাথে কথা বলে আমি সময় নষ্ট করতে পারবো না। আমার সময়ের অনেক দাম। আজ আমার এনগেইজমেন্ট। ওর নাম সাবাহ। ওর বাবাও সচিব। বিয়ের পর আমরা দুজনে আমেরিকায় পড়তে যাবো। দোয়া করো। আমি আসি।
গট গট করে হেঁটে রিয়াদ চলে গেলো।
সায়মা টলতে টলতে সেদিন বাড়িতে ফিরেছিলো। ও ঠিক বুঝেছে রিয়াদ সবটাই প্লানমাফিক করেছে। ও আসলে কোনদিন সায়মাকে ভালই বাসেনি। শুধু সময়টাকে পার করেছে। সত্যিকারের ভালবাসা থাকলে কখনও সায়মাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারতো না। সায়মা সেদিনের পর থেকে একদিনের জন্যও এই অপমান ও ভুলতে পারেনি। মাস্টার্সে পড়ার সময় সায়মার জীবনে এই ঘটনা ঘটে। এমনকি সায়মা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো তখন ওর বড় মা আছিয়া খাতুন ওকে বললো,
—–যে তোমাকে কোনদিন ভালবাসেনি তার জন্য নিজের জীবনটা শেষ করে দিতে চাইছো। আর যে তোমাকে গর্ভে ধারন করে জন্ম দিয়ে তিল তিল করে নিজের রক্ত পানি করে বড় করে তুললো তারজন্য তোমার কোন ভালবাসা রইলো না। এই তোমার শিক্ষা। নিজ ইচ্ছায় ভালবাসলো আবার নিজ ইচ্ছায় ছুড়ে ফেললো। ওতো একটা প্রতারক। তুমি কেন একজন প্রতারকের জন্য নিজের জীবন নষ্ট করবে?
সায়মা তখন ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-মা তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি আর কোনোদিন এই পাপ করবো না।
শেফালী বেগম মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
—-তোরে তো আমি এই শিক্ষা দেই নাই। যে সামান্য ঝড়ে তুই ভেঙ্গে পড়বি। আর আত্মহত্যা করা মহাপাপ। সারাজীবন এই কথাটা মনে রাখবি। আল্লাহপাককে প্রতি মূহুর্তে স্মরণ করবি।
তারপর থেকে সায়মা নিজে শক্ত করে ঘুরে দাঁড়ালো। কৃতিত্বের সাথে মাস্টার্স কমপ্লিট করে কলেজে চাকরি নিলো।
গাড়ি বাসার কাছে পৌঁছে যাওয়াতে ড্রাইভারের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো।
—-ম্যাডাম গাড়ি কি এখনি গ্যারেজ করবো?
—-আমি আবার একটু বের হবো।
সায়মা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ডোর বেলটা চাপ দিলাে। শেফালী বেগম দরজা খুলে বললো,
—-হাতমুখ ধুয়ে আয়। টেবিলে খাবার বেড়ে দিচ্ছি।
—-মা ফয়সল ফিরেছে?
—-হ্যা,এই মাত্র ফিরলো। ও বাথরুমে ফ্রেস হতে গিয়েছে।
খাবার টেবিলে সায়মা ছেলেকে বললো,
—বাবা আমার সাথে একটু বের হতে পারবি। তোকে নিয়ে একটু বাইরে যাবো।
—-যাওয়া যায় মা। আজ কোনো ব্যস্ততা নেই। মা আমার মনে হয় স্কলারশিপটা হয়ে যাবে। ভার্জেনিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে মেইল পাঠিয়েছে। ভার্সিটি গিয়ে আজ কাগজগুলো স্যারদের কাছে সই করে এনেছি।
—-আল হামদুলিল্লাহ। খুব ভালো খবর বাবা। আমি এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম। আল্লাহর কাছে অনেক শোকরিয়া। তুমি দু,রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিও।
—-ঠিক আছে আম্মু। রাতে এশার নামাজের সাথে পড়ে নিবো।
খাবার শেষ করে মা ছেলে জরুরী কাজে বাইরে বের হয়ে গেলো।
চলবে