#ধারাবাহিকগল্প
#লড়াই
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী
—–আমার সাথে রাশেদের সম্পর্ক আছে বুড়ো জানে। তবে সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু সেটা হয়ত উনি জানেন না। তাই তোমায় সাবধান করছি তুমি চোখে যা দেখবে ঐ বুড়োকে বলতে যেও না তাহলে তোমার ক্ষতি হবে।
—–আপনি আমাকে হুমকি কেন দিচ্ছেন। আমার তো রাশেদের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। আমি তো এখানে আর একমূহুর্ত থাকতে চাই না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কবে এই এখান থেকে মুক্তি পাব সেই অপেক্ষায় আছি। তবে আমি ভাবছি আপনারা বাবাকে জানালেই পারতেন। আমার জীবনটা নষ্ট হতো না।
—–তুমি কি ভেবেছো উনাকে আমরা জানাইনি। কিন্তু উনি এই সম্পর্ক মানতে চাননি।
—-আপনাদের এই সম্পর্কে যে পাপ হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছেন? কথায় আছে পাপ তার বাপকে ছাড়ে না। আপনাদের কারনে আমার জীবনটাও নষ্ট হলো। আপনার একটা বাচ্চা আছে। সে যখন মা আর চাচার অবৈধ সম্পর্কের কথা জানতে পারবে ওর জীবনটাও হুমকির মুখে পড়বে। প্রতিটি মানুষ তার মাকে আদর্শ ভাবে। এতোগুলো মানুষের দীর্ঘশ্বাস বয়ে নিয়ে তার সাথে আরও পাপ কামাই করে হয়ত আপনারা দুজনেই ধ্বংসের পথে পা বাড়িয়েছেন। এখন বুঝতে পারছে না। সময় হলে বুঝতে পারবেন।
—–তুমি শিক্ষক হয়েছো বলে সবাইকে ছাত্র ভেবো না। তোমার কাছে আমার জ্ঞান নিতে হবে না। আমি জানি ভালবাসায় কোনো পাপ নেই।
—–আপনারা বিয়ে করে নিলেই পারতেন। বিবাহ বর্হিভূত পরকীয়া সম্পর্কে যে পাপ হয় সেটাতো জানেন?
—-তোমার কি ধারণা আমি আর রাশেদ সেই চেষ্টা করিনি। ঐ বুড়ো রাশেদকে বলেছে আমাকে বিয়ে করলে উনি রাশেদকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবে। তাই আমার বিয়ে করার ইচ্ছা থাকলে রাশেদ সাহস পায়নি। আজ না হোক কাল আমরা বিয়ে করে ফেলবো। অর্ণবকে আমরা দার্জিলিং এর বোডিং স্কুলে পড়াবো। তাই আমাদের ব্যাপারে ও কিছুই জানতে পারবে না। তোমার সাথে বকবক করতে গেলে আমার ছেলের স্কুল দেরী হয়ে যাবে।
মর্জিনা স্কুলে চলে যাবার পর সায়মা ভাবতে লাগলো মানুষ কি করে তার পাপবোধ হারিয়ে ফেলে। পাপের বেনোজলে ডুবে গিয়ে নিজের দুনিয়া এবং আখের দুটোকেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়ে দেয়।
শ্বশুরের সাথে সকালের নাস্তা সেরে সায়মা রুমে চলে গেলো। আজ ওর কলেজে যেতে ইচ্ছে করছে না। ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখে মর্জিনা ফোন দিয়েছে। সায়মা একটু অবাক হলো। মর্জিনাতো সহজে ফোন দেয় না।
—-হ্যালো,সায়মা আমি অর্ণবকে নিয়ে আমার বাবার বাড়িতে গেলাম। আব্বা হঠাৎ স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। হয়তো কয়েকটা দিন থাকতে হবে। তুমি ওদিকটা সামলে রেখো।
—–ঠিক আছে। আপনাকে এদিকটা নিয়ে ভাবতে হবে না।
ফোনটা রেখে সায়মা ওর শ্বশুরকে খবরটা জানিয়ে দিলো। তারপর দুপুরের রান্না সেরে লাঞ্চ করে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলো। গতরাতে সায়মার একদম ঘুম হয়নি। ওর খুব অস্থির লাগছে। ও ভাবছে ভাগ্য ওকে আজ কোথায় নিয়ে এসেছে। সায়মাদের বাড়িতে সবাই জানে সায়মা রাজরানি হয়ে সংসার করছে। ও প্রফেসর আছিয়া খাতুনকে কিছু বলতে পারেনি। উনি তো সায়মার ভালোই চেয়েছেন। ভালো থাকা সায়মার কপালে লেখা নাই। রাশেদের ব্যাপারে সব কিছু জানলে উনি খুব কষ্ট পাবেন। সায়মার শ্বশুরও উনার কাছে ছোটো হয়ে যাবে। সায়মা আছিয়া খাতুনকে বড়মা বলে ডাকে। এই মানুষটার কাছে সায়মার অনেক ঋণ। সায়মা উনাকে আর নিজের কষ্টের কথাগুলো বলতে চায় না। যত উনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবেন ঋণের বোঝাটাও বেড়ে যাবে। সায়মা একাই ওর দুর্ভাগ্যকে মোকাবেলা করবে।
সেদিন অনেক রাতে রাশেদ বাসায় ফিরে আসলো। সায়মা রাশেদকে বললো,
—-টেবিলে খাবার দিবো?
—–না, আমি রাতে কিছু খাবো না। শরীরটা জ্বর জ্বর লাগছে। ওষুধের বক্সে নাপা ট্যাবলেট আছে। আমাকে একটু এনে দাও।
সায়মা ট্যাবলেট আর পানি এগিয়ে দিলো। রাশেদ ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো। মধ্যরাতে গোঙ্গানীর শব্দে সায়মার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। রাশেদের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর মুখ দিয়ে গোঙ্গানীর মতো শব্দ করছে। সায়মা গায়ে হাত দিয়ে দেখলো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। ও তাড়াতাড়ি মাথায় জলপট্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করলো। পুরো শরীর ভেজা টাওয়েল দিয়ে মুছিয়ে দিলো। সকালের দিকে ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেলো। সায়মার সেবা যত্নে রাশেদ বেশ তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে গেলো। সায়মার আচরণে রাশেদ বেশ অবাক হলো। সায়মা ওকে অবহেলা করতেই পারতো। কিন্তু ও সেটা না করে নিজের দায়িত্বটুকু পালন করে গেলো। সায়মার এই ব্যবহারে রাশেদ অনুশোচনার আগুনে পুড়তে লাগলো। ওর মন সায়মার কাছে ফিরে আসতে চাইলো। সায়মার প্রতি ও আস্তে আস্তে দুর্বল হতে লাগলো। কিন্তু সায়মার ওর ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। নিজের সাথে রাশেদ অনেক বোঝাপড়া করে একসময় সায়মাকে ডেকে বললো,
—–আমি জানি তুমি আমাকে ঘৃনা করো। তারপরও আমাকে ক্ষমা করে শুদ্ধ জীবনযাপনের জন্য একবার সুযোগ দেওয়া যায় না। আমি তোমাকে ভালবেসে তোমার সাথে সংসার করতে চাই।
সায়মা বললো,
—-এ আপনার ক্ষনিক মোহ। আমি এই কয়দিন আপনার কাছাকাছি ছিলাম বলে আমার প্রতি আপনার একটা মোহ তৈরী হয়েছে। এটা ভালবাসা নয়। আপনার প্রেয়সী বাড়ি চলে আসলে এক মূহুর্তে আপনার সব মোহ ভেঙ্গে যাবে।
—-সায়মা আমি আর মরিচিকার পিছনে ছুটতে চাই না। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।
রাশেদ সায়মার হাত ধরে ক্ষমা চাইলো। রাশেদের চোখ দেখে সায়মার মনে হলো ও সত্যিই ফিরে আসতে চাইছে। সায়মা রাশেদকে বললো,
—-আমাকে একটু ভাবতে সময় দিন।
রাশেদ সায়মাকে কোনো জোড়জবরদস্তি করলো না। পুরোটাই সায়মার উপর ছেড়ে দিলো। সায়মা মনে মনে ভাবলো পাপ করে আল্লাহপাকের কাছে সমস্ত অন্তর সঁপে দিয়ে প্রার্থনা করলে আল্লাহপাক ক্ষমা করে দেন। ওতো আল্লাহপাকের সৃষ্ট অতি সামান্য একজন মানুষ। ওর মনে হয় রাশেদকে একবার সুযোগ দেওয়া উচিত। আসলে সোনার চামচ মুখে নিয়ে সায়মার জন্ম হয়নি। তাই জীবনের চড়াই উৎড়াই গুলো ওকে মেনে নিতেই হবে। কথাটা শুনতে খারাপ লাগে কিন্তু এটাই জীবনের চরম বাস্তবতা। সায়মা নিজের পরিচয় নিয়ে কখনও হীনমন্যতায় ভুগে না। ও তো কাজের বুয়ার মেয়ে এটাতো মিথ্যা নয়। আল্লাহর রহমতে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছে এই শোকরানার কোনো শেষ নেই। একজীবনে সবাই সবকিছু পায় না। ও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে কিন্তু পরিপূর্ণভাবে একজন ভালবাসার মানুষ ওর ভাগ্যে জুটলো না। এটা নিয়ে এখন ওর কোনো আফসোস নেই।
এরপর আস্তে আস্তে সায়মার সাথে রাশেদের সুন্দর দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে উঠলো। রাশেদের বাবাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু মর্জিনা মনে মনে অবাক হলো
রাশেদ আগের মতো ওকে আর ফোন দিয়ে খোঁজখবর নেয় না। কালে ভদ্রে রাশেদ ওকে ফোন দেয়।ও মনে মনে অস্থির হয়ে গেলো। মর্জিনা পনেরোদিন বাবার বাড়িতে থেকে শ্বশুর বাড়িতে ফিরে আসলো। রাশেদের পরিবর্তনটা ও মেনে নিতে পারছিলো না। ও ভাবছে কি এমন ঘটলো রাশেদ এভাবে পাল্টে গেলো। অথচ ওর শ্বশুর কত চেষ্টা করেছে রাশেদকে ওর কাছ থেকে ফিরিয়ে নিতে পারেনি। মর্জিনা সায়মাকে আর সহ্য করতে পারছিলো না। মনে মনে ফন্দি আঁটতে লাগলো।
সায়মার কয়েকদিন ধরে শরীরটা ভালো লাগছিলো না। রাশেদ ডাক্তারের কাছে সায়মাকে দেখানোর জন্য এপয়েটমেন্ট করলো। সেদিন অফিসে যাওয়ার সময় সায়মাকে ডেকে বললো,
—-সায়মা আমি অফিস থেকে আজ তাড়াতাড়ি ফিরবো। তুমি রেডী হয়ে থেকো ডাক্তারের কাছে যাবো।
মর্জিনা পাশ থেকে ফোড়ন কেটে বললো,
—-তোমার বউ কি ছোটো খুকী যে একা একা ডাক্তারের কাছে যেতে পারবে না। চাকরিটা যখন সামলাতে পারছে ডাক্তারের কাছেও একা যেতে পারবে। তোমাকে অফিসের কাজ ফেলে ছুটে আসতে হবে না।
—-তুমি কেন আমাদের স্বামী স্ত্রীর মাঝখানে ঢুকছো। আমাদের ব্যাপার আমাদেরকে সামলাতে দাও।
এই কথা বলে রাশেদ অফিসে চলে গেলো। মর্জিনা এই অপমান হজম করতে পারলো না। ও সায়মাকে ডেকে বললো,
—সায়মা অর্ণবকে দেখে রেখো আমি একটু বাইরে যাবো। বিকালের আগেই ফিরে আসবো।
মর্জিনা বারোটার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধা হলো। মর্জিনা কিংবা রাশেদ কেউ বাসায় ফিরে আসলো না। সায়মা ওদের দুজনের ফোনটা বন্ধ পেলো। বুকের ভিতরটা অজানা ভয়ে কাঁপতে লাগলো। এদিকে রাশেদের বাবাও অস্থির। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। পুলিশে খবর দিবে কিনা তাও বুঝতে পারছে না।
চলবে