#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি
~ আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
পর্ব-৪
বর্ষামুখর চোখে বসে আছে মুশরাফা। গালে পাঁচ আঙুলের দাগ। এই দাগটা স্পষ্ট জানান দিচ্ছে তার রূপসী গালে শক্তিশালী হাতের আঘাত লেগেছে, আঘাতটা ইচ্ছেকৃত। মুশরাফার মাথাটা নিচু, চোখ মুখে ফুটে উঠতে শুরু করেছে গম্ভীরর্য।
প্রিয়জন যখন মূল্য বুঝে না, তাকে অপদস্ত করার চেষ্টায় মত্ত থাকে। তখন মানুষের জীবন কতটা ভয়ানক হয়? কতটা দূর্বিষহ হয়? মাত্রাটা পরিমাপ করা যায়? যায় না বোধহয়। মুশরাফা করতে পারল না।
মুশরাফার যেই গুন, যেই স্বভাব ফরিদা পারভীনকে বারংবার মুগ্ধ করেছে, সেই স্বভাবই মুশরাফার পরিবারের প্রতিটা সদস্যের মনে মুশরাফার জন্য বিতৃষ্ণা, বিরক্তি, ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। মুশরাফার এই চমৎকার ব্যক্তিত্ব ভীষণ অপছন্দ সবার। বাইরের সবার চোখে তার এই ব্যক্তিত্ব মুগ্ধতার পর্দা টানতে পারলেও ঘরের একজন মানুষের চোখে কিংবা মনে ও মুগ্ধতার পর্দা টানতে পারেনি। বরং এই ব্যক্তিত্বের কারণেই সে তার পরিবারের কাছে অবহেলিত, অপছন্দনীয় ।
মুশরাফার জন্মটা উচ্চবিত্ত পরিবারে। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের রক্তে আধুনিকতা মিশে গেছে। যুগের সাথে তাল মিলে চলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সেখানে মুশরাফার মতো মেয়ে, যার কাছে আধুনিকতা নয় শালীনতাই মূখ্য বিষয়। এমন অধুনিকতার স্পর্শহীন মেয়ের ঠিকে থাকা সত্যি কঠিন।
পাশের মসজিদ থেকে এশারের আযান ভেসে এলো। মুশরাফা উঠে দাঁড়াল। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল।
রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে রাগে ফোঁসফোঁস করছে বড়োবোন সাফা। বয়সটা ত্রিশের ঘরে আটকে আছে। নিজেকে প্রসাধনীর সাথে এমনভাবে সাজিয়েছে বয়সটা কমে গেছে অনেকটা। রাগে চোখ জোড়া রক্তিম আকার ধারণ করেছে। সুশ্রী চেহারায় কঠোরতার প্রলেপ । তার কঠিন দৃষ্টি মুশরাফার পানে। বোনকে উঠে দাঁড়াতে দেখে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
‘ আমি ভালোভাবে জিজ্ঞেস করছি রাফা, তুই কি সত্যিই যাবি না?’
মুশরাফা থামল। পিছু ফিরে স্পষ্ট সুরে জানাল,
‘আমি আমার সিদ্ধান্ত আগেই জানিয়ে দিয়েছি আপু। আমি সেজেগুজে এত গুলো পুরুষের সামনে যেতে পারব না। আমার উত্তর ‘না’ ই থাকবে। ‘
সাফার রাগটা বাড়ল তরতর করে,
‘আমার চাচী শ্বাশুড়ি বড়োমুখ করে তোর ব্যাপারে কথা বলেছেন। ছেলে দেখেছিস? ভীষণ হ্যান্ডসাম। নিজের বিজনেস সামলায়। বাবা ফিল্ম ডিরেক্টর, মা আইনজীবী। ব্যাকগ্রাউন্ড সব হাই কোয়ালিটি। ওরা যে তোর মতো জঙ্গলীর জন্য সমন্ধ এনেছে এটাই তোর ভাগ্য। নাহলে কোথায় তুই, কোথায় ওরা! আজ ওরা তোকে দেখার কথা। রেস্টুরেন্টে এসে গেছে। তোকে রেডি করিয়ে রেস্টুরেন্টে নিব। ডিনারের ফাঁকে দেখাদেখি পর্ব শেষ হবে। এখন তুই বলছিস যাবি না! উনাকে ফিরিয়ে দিলে শ্বশুরবাডিতে আমার মান সম্মান কিছু থাকবে না। তোকে যেতেই হবে। কোনো কথা শুনব না আমি, এই শাড়িটা পরে আয়, আমি সাজিয়ে দিব। ‘
সাফা বোনের হাতে একটা শাড়ি তুলে দিল। রাফা শাড়িটায় চোখ বুলাল। টিস্যু কাপড়ের ভারি কাজের শাড়ি। এই শাড়িটায় শরীর দেখা যাবে। স্লিভলেস ব্রাউজ, হাত পুরো বেরিয়ে আসবে। সাফাকে বলতে শুনেছে,পাত্র পক্ষের সাথে সাফার স্বামী, শ্বশুর, দেবর, চাচা শ্বশুর, তাদের দুই ছেলে সবাই থাকবে। এই শাড়ি পরে সে এত গুলো ছেলের সামনে যাবে ও! কতটা নির্লজ্জ ভাবনা! কীভাবে ভাবতে পারল সাফা! শাড়ি দেখেই লজ্জা লাগছে মুশরাফার। বিয়ে করতে হলে কি এভাবে শরীর প্রদর্শন করতে হবে? অন্যথায় বিয়ে হবে না? না হোক, এত নির্লজ্জতায় নামার চেয়ে শালীনভাবে ঘরে বসে থাকাই বোধহয় ভালো। শাড়ি থেকে চোখ ফিরিয়ে বোনের পানে চেয়ে বলল,
‘ একটা মেয়ের বিয়ের কথা আগানোর আগে তার মতামত নিতে হয়। পাত্র সম্পর্কে তাকে জানাতে হয়, ছবি কিংবা বায়োডেটা দেখাতে হয়। সব শুনে মেয়ে যদি মত দেয় তবেই পাত্রপক্ষকে আমন্ত্রণ জানাতে হয়। যেহেতু বিয়েটা তার, একটা মানুষের সাথে সে থাকবে সারাজীবন। তাই এখানে তার সিদ্ধান্তই মুখ্য। সে বিয়েতে মত অমত প্রকাশ করার অধিকার রাখে। এতে জোর করার সুযোগ নেই পরিবারের। ধর্মে আটকা পড়বে তারা। মেয়ের অমত থাকা সত্ত্বেও পরিবার যদি জোর করে মেয়েকে বিয়ে দেয় তবে সেই বিয়ে হবে না। তোমার আনা সমন্ধ আমার পছন্দ হয়নি। এ বিয়েতে আমার মত নেই। পাত্রীর অমতে তাকে জোর করে বিয়ের দেয়ার চেষ্টা করা উচিত হচ্ছে না তোমার। তোমরা পাত্র সম্পর্কে, তাদের আসার ব্যাপারে আমাকে জানাও নি। জানালে আমি আগেই ‘না’ বলে দিতাম। তখন তোমাকে নিজের সম্মানের কথা ভাবতে হতো না। ‘
মুশরাফার স্পষ্টবাদীতায় সাফার চেহারা কঠিন থেকে কঠিনতর হলো। তবুও সে রাগকে প্রাধান্য না দিল না। বলল,
‘ কেন পছন্দ হয়নি? পাত্রকে দেখেছিস তুই? দেখতে শুনতে চমৎকার। কোনো দিক দিয়ে ফেলে দেবার মতো নয়। ছেলেকে এক দেখাতেই পছন্দ হবে তোর, আমি নিশ্চিত। দাঁড়া আমি ছবি দেখাই। ‘
সাফা ফোন ঘেটে একটা সুদর্শন যুবকের ছবি দেখাল বোনকে। এক সেকেন্ড তাকিয়ে দৃষ্টি ফেরাল মুশরাফা। ছেলের বেশভূষায় আধুনিকতার ছোঁয়া। মুশরাফার খোঁজা জীবনসঙ্গীর কোন গুনাবলি চোখে পড়েনি তার মাঝে।
মুশরাফা বিনয়ের সাথে বলল,
‘কারো খারাপ দিক তুলে ধরা আমার পছন্দ নয়। প্রতিটা মানুষের জীবন পরিচালনার ধরণ ভিন্ন। একেকজনের একেকরকম। এই পাত্রের আর আমার জীবনধরণ ও ভিন্ন। আমার জীবনসঙ্গীর কোন গুনাবলি খুঁজে পাচ্ছি না তার মধ্যে। আমি সঙ্গীর রূপ, কিংবা টাকা দেখছিনা। আমি দেখছি ব্যক্তিত্ব, চরিত্র। রূপ আমাকে আকর্ষণ করে না, ব্যক্তিত্ব আমাকে আকর্ষণ করে। আমি আমার মতো কাউকে চাইছি। এই পাত্র আমার মতো নয়। তাই আমি ইতিবাচক উত্তর দিতে পারছিনা।’
‘ভালো কাউকে তোর পছন্দ হবে না তো, তোর পছন্দ হবে তোর মতো ক্ষ্যত কাউকে। নিজে তো ক্ষ্যত, পছন্দ ও করিস ক্ষ্যত। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ, কেমন গাঁইয়্যা ভূত লাগছে তোকে! স্মার্টনেস মানে বুঝিস? বুঝিস না। গাঁইয়্যা ভূতরা বুঝবেও না। আমার দিকে তাকিয়ে দেখ, কতটা স্মার্ট লাগছে আমাকে! রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ হা করে তাকিয়ে থাকে, ফিসফিস করে, আমার প্রশংসা করে। আর তোকে কেমন লাগছে দেখ! বস্তির মেয়ের মতো লাগছে। জ /ঙ্গি/র মতো চলাফেরা তোর। তোকে বোন বলতেও আমার লজ্জা লাগে। ‘
রাগে গরগর করতে করতে বলে গেল সাফা। রূপের অহংকার তাকে মাটি ছুঁতে দেয় না। মুশরাফা নিজের দিকে তাকাল। ওর গায়ে ঢিলেঢালা সেলোয়ার-কামিজ। শরীরের ভাজ বুঝা যাচ্ছে না। সুতোর ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টানানো। নিজেকে পরখ করে ভ্রু কুঁচকাল, ওর ড্রেসাপ জ/ ঙ্গি/ বা বস্তির মতো লাগছে কোনদিক দিয়ে! আর বস্তিতেতে যারা থাকে তারা কি মানুষ নয়? তাদের পোশাক পরা যাবে না! নিজের পোশাকে খারাপের কিছু দেখল না মুশরাফা। এটাকে নৈতিকতার চোখে দেখলে শালীন মনে হবে। আধুনিকতার চোখে দেখলে ক্ষ্যত মনে হবে। সাফা আধুনিক মানুষ, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি তার। তাই ক্ষ্যত লাগছে।
মুশরাফা এবার সম্মুখে দাঁড়ানো স্মার্ট মানুষটার দিকে নজর দিল। মুখে প্রসাধনীর আঁচ, কালার করা চুল কার্ল করে ছেড়ে দিয়েছে। গলায় জ্বলজ্বল করছে হীরের হার। নেটের একটা শাড়ি পরেছে সাফা। বুকের ভারি কাজটা বুক ঢাকলেও পেটটা ঢাকতে পারেনি। আঁচল টেনে কয়েক ভাজ করে নাভিটা ঢেকেছে মাত্র। বাদবাকি কার্ভগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
এটা স্মার্টনেস! আধুনিকা মানে কি শরীর প্রদর্শন করা? সাফার ভাষায় হয়তো তাই। মুশরাফা বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ স্মার্ট হতে গিয়ে যদি কার্ভ দেখাতে হয়। নিজের শরীর, রূপ প্রদর্শন করতে হয় তবে আমার এই স্মার্টনেসের দরকার নেই। স্মার্ট হওয়ার চেয়ে বস্তির ক্ষ্যত পোশাকে গাঁইয়্যা হয়ে থাকা ভালো। নির্লজ্জ থেকে শুদ্ধতা ভালো। আমি শুদ্ধ থাকতে চাই, শুদ্ধ কাউকেই চাই। এমন স্মার্ট কাউকে আমার প্রয়োজন নেই। ‘
পরোক্ষভাবে নির্লজ্জ উপাধি পেয়ে চটে গেল সাফা। তেড়ে এসে সজোরে চড় বসাল মুশরাফার গালে। খপ করে হাত ধরে বলল,
‘বেশি লাই দিয়ে মাথায় তুলছে তোকে। তোর মত গাইঁয়্যাকে পিটিয়ে সোজা করা উচিত। আমাদের মতো হাই সোসাইটিতে বাস করে, তুই এমন ক্ষেত হয়ে চলবি। তা তো হবে না। সমাজে একটা স্ট্যাটাস আছে আমাদের। তোকে নিয়ে বের হলে চোখ দেখাতে পারি না। মানুষ হাসাহাসি করে। আমাদের সাথে থাকতে হলে আধুনিক হতে হবে তোকে। এইসব ক্ষেত পোশাক ছাড়তে হবে। আধুনিকতা শিখতে হবে। এই শাড়িই পরতে হবে তোকে। আমি পরিয়ে দিব তোকে। তারপর নিয়ে যাব সবার সামনে। দেখি তোর এই কথা তখন কোথায় যায়!’
ওয়াশরুমের সামনে থেকে আবার রুমের মাঝে নিয়ে গেল মুশরাফাকে। মুশরাফা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল,
‘আমি যাব না কারো সামনে শরীর প্রদর্শন করতে। ‘
সাফা বাধন শক্ত করল। রেগে চিৎকার দিয়ে বলল,
‘যাবি না মানে একশোবার যাবি। আমি ও দেখব, তুই কিভাবে না গিয়ে থাকতে পারিস। ‘
সাফা চেঁচিয়ে মাকে ডাকল। লায়লা আঞ্জুমান প্রবেশ করলেন ঘরে। পোশাক আশাকে আধুনিকতার চাপ। পরনে জর্জেট শাড়ি। কাধ অবধি বব কাট চুল, কালই পার্লার থেকে হেয়ার স্টাইল চেঞ্জ করে এসেছেন। ফেসিয়াল করা মুখে প্রসাধনীর চাপ। মেক আপের উপর ভাসছে গম্ভীর্য ভাব। অভিজাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষিকা তিনি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়ে চলতে পছন্দ করেন।
মুশরাফার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকালেন লায়লা। তিন মেয়ে, এক ছেলের মধ্যে এই মেয়েটাকে তার খুব একটা পছন্দ নয়। মেয়েটা তার চালচলনের মাধ্যমে মন থেকে উঠে গেছে। কেমন গাঁয়ের মেয়েদের মতো থাকে, স্মার্টনেস নেই। কিসব পোশাক পরে! এ বয়সী মেয়েরা স্মার্ট হয়ে চলবে, সেজেগুজে থাকবে, পার্লারে যাবে। আধুনিকতার ছোঁয়া ফুটে উঠবে তার মাঝে। কথাবার্তায় চালচলন মানুষকে আকর্ষণ করবে।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলবে। তা না কেমন মুখচোরা হয়ে বসে থাকে ঘরে, সাজগোজের বালাই নেই। কারো সাথে দেখা দেয় না। বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরে না। সেজেগুজে কোন অনুষ্ঠানে যায় না। শপিং করে না, একবার শপিং করে এক বছর চালায়। পোশাক আশাকের ঠিক ঠিকানা নেই। কীসব পরে, দেখলেই ঘা ঘিন ঘিন করে। বাড়ির কাজের মেয়েও ওর থেকে সুন্দর ড্রেসাপে থাকে। বাইরে বের হতে গিয়ে আবার কীসব জুব্বা তুব্বা পরে, চোখ ছাড়া কিছু দেখা যায় না। দেখলেই ভ্রু কুঁচকে আসে, ভয় লাগে। সন্দেহ হয়, এটা তার মেয়ে তো! উপচে পড়া আধুনিকতা গায়ে মাখিয়ে তারা যখন বের হন, তখন মুশরাফাকে এদের সাথে দেখে তার বান্ধবীরা কিভাবে যেন তাকায়। আড়ালে হাসাহাসি করেন। এই খালাম্মা ধরনের মেয়েটা লায়লার! কতজন তো বলেই দেয়, এটা তোর মেয়ে! তুই এত স্মার্ট, তোর এত ব্যাকডেটেড! এত অসামাজিক! বিশ্বাস হয়না।
বিশ্বাস তো লায়লার ও হয়না। মেয়েটা যে কার মতো হলো! মেয়েটার জন্য কোন টান কাজ করে না। মনে হয় না, এটা তার মেয়ে। এখন বিয়ে দিয়ে পার করতে পারলেই বাঁচা যাবে।
লায়লা আঞ্জুমান রুমে প্রবেশ করে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ ও এখনো রেডি হয়নি কেন!’
সাফা বিরক্তভরা স্বরে বলল,
‘ তোমার মেয়ে নতুন নাটক শুরু করেছে। সে রেডি হবে না। কারো সামনে যাবে না। ‘
লায়লা আঞ্জুমান রেগে গেলেন। রাগত স্বরে বললেন,
‘কতগুলো টাকা খরচ করে রেস্টুরেন্ট বুক করেছি। পাত্রপক্ষ অলরেডি রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেছে। তোর বাবা তাদের সাথে আছে। এখন যদি তুই না যাস, বিষয়টা কতটা খারাপ দেখাবে? মান সম্মান থাকবে কিছু? কোন কথা নয়, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। বেশিক্ষণ লাগবে না, ডিনার করেই ফিরব আমরা। ‘
মুশরাফা আশাহত চোখে তাকাল। এই পরিবারে একটা মানুষ নেই ওকে বুঝার, ওকে কথা বলার। এই আধুনিক সমাজে ওর উপস্থিতি বেমানান। কেউ ওকে বুঝার চেষ্টা করেনা। মামা মামী ওকে যতটা বুঝে তার একভাগ ও যদি তার মা বাবা তাকে বুঝত তবে তাকে প্রতিনিয়ত এত কষ্ট পেতে হতোনা। মা বাবা, ভাই, বোন সবাই আধুনিকতার দাশ, কেউ বুঝেনা তাকে। এমন কি তার ছোটো বোন, যার বয়স সবে পনেরো তারও অপছন্দের তালিকায় পড়ে মুশরাফা। মিশে না তার সাথে। মুখ কুঁচকে প্রায়ই বলে, আপু তোমার ড্রেসিং চেন্স বদলাও, তোমাকে দেখতে ক্ষ্যত লাগে। একটু স্মার্ট হও। এত ব্যাকডেটেড কেন তুমি! এত মানুষের মাঝেও সে একা। মুশরাফার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তুমি তো আমার মা। তুমি অন্তত আমাকে বুঝার চেষ্টা করো!’
লায়লা আঞ্জুমান গম্ভীর স্বরে বললেন,
‘ আমাকে তোমার মা মানলে শাড়ি পরে তৈরি হয়ে নাও। আমি তোমার খারাপ চাই না । সমন্ধটা ভালো, তুমি সুখে থাকবে।’
‘রূপ আর টাকা সুখ আনে না। আমার রূপ কিংবা টাকার দরকার নেই। আমার স্মার্ট কাউকে চাই না, সুশীল মনোভাবী কাউকে চাই। আমার মতো কেউ। তোমাদের মতো কাউকে আমার জীবনে চাপিয়ে দিকে সে আমাকে মেনে নিতে পারবে না। যেমনটা তোমরা পারছো না।’ কাতর স্বরে জানাল মুশরাফা।
লায়লা আঞ্জুমান ব্যঙ্গ করে বললেন,
‘তোর মতো কাউকে খুঁজতে হলে বস্তিতে যেতে হবে। গাঁইয়া বস্তির ছেলেকে তো তোর পছন্দ। অসম্ভব। আমি এমন ছেলে গ্রহন করব না। আমার লেভেলের কাউকে বিয়ে করতে হবে তোকে। যাকে আমি মাথা উঁচু করে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারব, কোন গাঁইয়্যা ভূতকে না। মাথা থেকে সরিয়ে ফেল। তৈরি হয়ে নে। কথা বাড়াস না মুশরাফা। যেতে তো তোকে হবেই। সব আয়োজন হয়ে গেছে, এখন পিছু হাঁটা যাবে না। ‘
মুশরাফার স্বর নরম হলো,
‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, আমাকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করো না। কবরে আমাকে একাই যেতে হবে। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবে না, আমাকে আগুনে জ্বলতে হবে। আমি আগুন ভয় পাই, আমাকে আগুনে ফেলো না। প্লিজ মা!’
মুশরাফার কথা শোনার সময় কোথায় লায়লার? তিনি আয়নায় নিজেকে দেখতে ব্যস্ত। পাত্রপক্ষের সামনে তাকে স্মার্ট দেখাবে তো! দেখার মাঝে জোর গলায় ডাকলেন, ‘জায়ফা?’
খানিক পরেই ওয়েস্টার্ন পোশাক পরিহিত একটা কিশোরী এসে দাঁড়াল দরজায়। বলল,
‘ডেকেছিলে মম?’
লায়লা আদেশের সুরে বললেন,
‘দুজনে মিলে মুশরাফাকে তৈরি করাও । আমার লিপস্টিকের কালারটা একটু হালকা হয়ে গেছে। গাঢ় করে আসি। এসে যেন তৈরি দেখি ওকে।’
জায়ফা সায় জানাল। লায়লা চলে গেলেন। জায়ফা বসল মেক-আপ নিয়ে। সাফা দাঁড়াল শাড়ি নিয়ে।
মুশরাফা চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে মাঝে। কোনভাবে নড়ানো গেল না তাকে। তার জেদের উপর সাফার হাত চলল বেশ। তাও নাড়ানো গেল না। লায়লাকে ডাকা হলো, রেগেমেগে ছুটে এলেন তিনি। তিনজনে জোরাজোরি করল মুশরাফার সাথে। বিশেষ লাভ হলো না। মুশরাফা অনড়। শক্ত, স্পষ্ট গলায় বলল,
‘ তোমরা আমাকে ভালোবাসো না। কিন্তু আমি নিজেকে ভালোবাসি। আমি কোনভাবেই নিজের ক্ষতি করতে পারব না। তাদের সাথে চলতে গিয়ে আমাকে বেহায়া হতে হবে। এই বিয়ে করলে আমাকে পথভ্রষ্ট হতে হবে, ধর্মকর্ম থেকে দূরে যেতে হবে। যার পরিণতি হবে জাহান্নাম। আমি জেনেশুনে নিজের এতবড় ক্ষতি করতে পারিনা। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও। আমার আল্লাহর উপর ভরসা আছে, তিনি আমার জন্য ভালো কাউকে রেখেছেন। তোমরা আমাকে জোর করো না, আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না। আমি যাব না।’
মুশরাফার পরিবারকে ধর্মবিমুখ বলা যায়। মুশরাফা ছাড়া কাউকে জায়নামাজে দাঁড়াতে দেখা যায় না। মুশরাফার বাবা কালেভদ্রে জুম’আ পড়েন। তাও যখন ব্যাবসায়িক অবস্থা খারাপ হয় তখন। ভাই তাও পড়েনা। ইসলামের কোন রীতিনীতি তারা পালন করেন না। ধর্মীয় বুলি তাদের ভাবান্তর করেনা। এবারও করল না। তারা অনড় তাদের সিদ্ধান্তে। মান সম্মান বাঁচাতে হলে মুশরাফাকে নিয়ে যেতে হবে। সাফা শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখাতে পারবে না, ছোটো হয়ে যাবে। লায়লা আঞ্জুমান হুংকার ছাড়লেন,
‘আর একটা কথা বলবি, তোর জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলব মুশরাফা। চুপচাপ তৈরি হয়ে নে। তোর এসব খেজুরে আলাপ শোনার সময় নেই আমার । কথা বাড়ালে আমার হাত উঠবে।’
মুশরাফা তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ধর্ম তাকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অধিকার দিয়েছে। উত্তম জীবনসঙ্গী বাছাই করার অধিকার দিয়েছে তাকে। অধিকারটা যদি আল্লাহ কতৃক হয়, তবে বাবা মা বাধা দেয়ার কে? কেউ না। আল্লাহ তাদের এই অধিকার দেন নি।
লায়লা আঞ্জুমান মেয়ের জেদ দেখে চুলের মুঠো ধরলেন। টেবিলের উপর স্কেল ছিল, শরীরের যত শক্ত ছিল তা প্রয়োগ করে স্কুল ভাঙলেন । মুশরাফার সাদা চামড়া লাল হলো। দাগ পড়ে গেল। কয়েক জায়গায় রক্তকণা ও দেখা গেল। শরীর জ্বলছে, কিন্তু মন জ্বলছে না। সে নির্বিকার। অবিচল, অসাড় দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে দোয়া পড়ছে। শরীরের ব্যাথাকে ভুলতে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, আল্লাহ আমাকে এরচেয়ে উত্তম প্রতিদান দিবেন। ধৈর্য রাখ রাফা। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।
ক্লান্ত হয়ে লায়লা আঞ্জুমান হাতের বাধন আলগা করলেন। মুশরাফা নড়ে উঠল। মায়ের বাধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বলল,
‘ প্রসঙ্গ যেখানে আল্লাহ ও তার রাসূলের বিধানের সেখানে বাবা মা কেউ নয়। ধর্মীয় ব্যাপারে আমি কোনো আপোষ করব না। মেরে ফেললেও না। তাই আমাকে মেরে নিজের হাত ব্যাথা করবেন না। আমার অসুস্থতা আমি সহ্য করতে পারলেও আপনার অসুস্থতা আমি সহ্য করতে পারব না। মা হিসেবে আমি আপনাকে ভালোবাসি। পরবর্তীতে আগে আমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমার সাথে পরামর্শ করবেন। আল্লাহ আপনাকে সঠিক পথ দেখাক। নামাজের সময় হয়েছে, আমাকে নামাজ পড়তে হবে। যাই। ‘
দ্রুততার সাথে ওয়াশরুমে চলে গেল মুশরাফা। লায়লা আঞ্জুমানের রাগের মাত্রা বাড়ল, ইচ্ছে করল মেয়েকে গলা টিপে মেরে ফেলতে। গলার কাটা হয়ে বিধেছে। কোন অলক্ষুণে এই মেয়েকে জন্ম দিয়েছেন!
মুশরাফা বের হওয়ার অপেক্ষা করল তারা। ঘন্টা পেরুলেও বের হয়নি মুশরাফা। সাফা দিশেহারা হয়ে রুম পায়চারি করতে লাগল। মুশরাফা বের হলেই টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবেন।
এদিকে মুশরাফা দরজা কাছে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ। শরীর জ্বলছে, ব্যাথা বাড়ছে। যন্ত্রণা অসহনীয় হচ্ছে। এটা তো আজকের নতুন নয়, নিজেকে ধর্মের পথে এনেছে প্রায় যুগ হচ্ছে। যন্ত্রণার বয়স ও যুগ পেরিয়ে গেছে। পুরো শরীরে মারের দাগ। ওকে আধুনিক করার কম প্রয়াশ করে তার পরিবার। স্কেল, বেত, লাঠি, সব উঠেছে শরীরে। চড়, লাথি যেন নিত্য খাবার ওর। তবুও সে এখানে পড়ে আছে। কারণ তার বিশ্বাস একদিন সুদিন আসবে। আল্লাহ তার জীবনে এমন কাউকে পাঠাবে যে তার জীবন রাঙিয়ে দিবে। সুখের ভারে এই কষ্ট ভুলিয়ে দিবে। এবার আসুক সে, অনেক তো হলো। সহ্য ক্ষমতাও পুরিয়ে আসছে, আর কত? এবার আসুক সে, আগলে নিক তাকে।
•
বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ হলো জাওয়াদের। কলিংবেল চাপার আগে সময় দেখল, ১২: ৪২মিনিট। একটা বাজতে চলল, আজ বোধহয় একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। মা ঘুমিয়ে গেলেই হয়, জেগে থাকলে কথা শুনাবে নিশ্চিত। কলিংবেল না চেপে এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলল। নিঃশব্দে রুমে যেতে গিয়ে থামতে হলো। কোথা থেকে সামনে এসে দাঁড়ালেন মায়মুনা আক্তার। চোখ মুখ দেখেই বুঝা গেল, ভদ্রমহিলা বেশ রেগে আছে। জাওয়াদকে অসহায় দেখাল। হাসার চেষ্টা করল।
নিষ্পাপ ভঙিতে সাফাই গাইল,
‘অফিস থেকে ফেরার পথে বন্ধুর বাসায় গিয়েছি। আড্ডার মাঝে সময় কিভাবে গেল টের পাইনি। আর হবে না মা।’
মায়মুনার রাগ পড়ল না। চোখ রাঙিয়ে বললেন,
‘আর হবে না, কথাটা গত পাঁচ বছর ধরে শুনছি। হচ্ছে তো। কবে থামবে? বয়স হয়েছে, এবার আমাকে একটু শান্তি দে। তোর কারণে শান্তির ঘুমটাও নামে না চোখে। কবে ঠিক হবি তুই?’
‘সত্যিই আর হবে না মা। রাগ করো না।’ করুণ স্বরে বলল জাওয়াদ। মায়মুদা রাগের সাথে বললেন,
‘যা ইচ্ছে তা কর। আমি কিছুই বলব না। আমার কথার কোন মূল্য নেই যখন, তখন বলে লাভ কী। ‘
জাওয়াদ মাকে ভীষণ ভালোবাসে। মায়ের রাগটা তার সহ্য হয়না। মায়ের রাগ ছাড়াতে বলল,
‘ তোমার কথাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। ‘
‘ তা তো দেখতেই পারছি কেমন মূল্যবান। ঠিক হতে বললাম ঠিক হচ্ছিস না, বিয়ে করতে বলছি তাও রাজি হচ্ছিস না। ‘ মায়মুনার স্বরটা অভিমান মাখা।
জাওয়াদ বোধহয় এই কথার অপেক্ষায় ছিল। সে সময় না নিয়ে বলল,
‘ আমি রাজি।’
‘কী রাজি!’ অবাক হলেন মায়মুনা।
‘বিয়ে করতে রাজি।’ মিনমিনে স্বরে বলল জাওয়াদ। মায়মুনার চেহারা থেকে অভিমান স্বরে গেল । খুশির রেখা দেখা গেল। বিগলিত হাসি দিয়ে বললেন,
‘আমি কালই ঘটকের সাথে কথা বলব।’
‘লাগবে না।’
‘কেন? পছন্দ আছে তোর?’
আকস্মিক একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরল জাওয়াদকে। মায়ের চোখে চোখ রাখতে পারল না। চোখ সরাল, হাটা ধরল। যেতে যেতে বলল,
‘অনিকের বিল্ডিংয়ের একটা মেয়েকে ভালো লেগেছে। কথা আগাতে পারো।’
থামল না, সোজা রুমে এসে পড়ল। ছেলের সুমতি দেখে মায়মুনার খুশিরা বাধনহারা। দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। বাড়ি দিয়ে বললেন,
‘ঠিকানা দিস। আমি শীঘ্রই কথা বলব।’
জাওয়াদ উত্তর দিল। আনন্দের দল স্বর ঘিরে ধরেছে। কথাটথা আসছে না। ঠোঁটের কোণে হাসিটা চওড়া হচ্ছে। চোখে ভাসল রাফার লাজুক চেহারা।
চলবে…
গল্পের চরিত্র নির্ধারণে লেখিকার কিছু ভাবনা থাকে। সেই ভাবনা মাফিক আগাবে গল্প। অধৈর্য হবে না। ধৈর্য ধরে পড়ুন। আশাহত হবেন না।