#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১১
“কে এখানে?”
ফিসফিসিয়ে কিছুটা জোরে বলার চেষ্টা করে আগন্তুক লোকটা। প্রতিত্তোরে কোনো উত্তর পায় না সে। অন্ধকারে কিছু দেখা সম্ভব নয়। মনে হচ্ছে বাড়ির মেইন সুইচ অফ করে দেওয়া হয়েছে। এসিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আগন্তুক লোকটি এগোবে নাকি পিছাবে সেটা বুঝছে না। শুধু আশেপাশে হাতড়ে যাচ্ছে সে। হাতের মুঠো শক্ত করে পা টিপে টিপে আন্দাজে হাঁটতে গিয়ে কোনোকিছুর সাথে বাড়ি খায় লোকটা। সাথে সাথে ঝনঝন শব্দ হয়ে উঠতেই ভড়কে যায় সে। শুনতে পায় মোহের ভয়ার্ত কন্ঠ।
“ক…কে? কে এখানে?”
কি বলবে ভেবে পায় না লোকটি। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। একদিকে বিপদের আশংকা আরেকদিকে মোহের ঘুম ভাঙা নিয়ে বেশ চিন্তিত সে। এসময় মেয়েটার ঘুম ভাঙা কি খুব দরকার ছিল? মাথাতে কিছু না আসাতে পকেট হাতড়ে স্প্রে জাতীয় কিছু বের করে লোকটা। মুখে বেঁধে নেয় রুমাল। হাতড়ে বেডের কাছে যেতেই মোহের পায়ের স্পর্শ লেগে যায় তার। চিৎকার দিয়ে ওঠে মোহ।
“চোর, চোর! আবার চোর এসেছে।”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় আগন্তুক লোকটি। কি করে উঠবে কিছুই মাথায় ঢোকে না তার। তার কি হাঁসা উচিত নাকি কাঁদা উচিত। ব্যাপকভাবে ফেঁসে গেছে সে। ধপ করে বসে আন্দাজ করে মোহের গাল চেপে ধরে নিজের মুঠোতে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“আর কত চোর বদনাম দেবে? যার জন্য চুরি করি সে-ই বলে চোর? চোর তো তুমি। মনচোর।”
মোহ ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করে যেখানে-সেখানে হাত চালিয়ে যাচ্ছে। লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। মুখ থেকে ‘উম উম’ শব্দ বের হচ্ছে। মোহের ঠোঁটে কিঞ্চিৎ স্পর্শ করে লোকটা ধীর কন্ঠে বলে,
“ছটফট করতে নেই। তোমার সাথে এমন কিছু করব না যে ছটফট করতে হবে। আমার কথা শোনো। আমি তোমায় মারতে না বাঁচাতে এসেছি। তুমি হয়ত নিজের মোহ দ্বারা আমাকে মেরে দিয়েছো বহু আগে। কিন্তু আমি আমার মোহময়ী নারীকে বাঁচাতে এসেছি।”
লাফালাফি থেমে গেল মোহের। লোকটার কথাতে কি সুন্দর শীতলতা। চোর-ডাকাতের কথাতে এতো শীতলতা হয় তা জানা ছিল না মোহের। তাই সে হতভম্ব। ঘরের বাইরে থেকে একটা বিকট শব্দ এল। চমকে উঠল মোহ এবং আগন্তুক লোকটিও। আবারও নিজেকে ছাড়াতে ব্যকুল হয়ে পড়ল মোহ। উপায়ন্তর না পেয়ে নিজের অন্যহাতে থাকা ছোট্ট স্প্রে মোহের একেবারে মুখ বরাবর স্প্রে করে দিতেই শরীরে জোর কমে আসে মোহের। মাথা ঝিম ধরে যায়। সেই মূহুর্তে তার সাথে এক ভয়াবহ কাজ করে বসে আগন্তুক লোকটি। গালে নিজের ঠোঁটের ছোঁয়া লাগিয়ে দেয়। মোহ কেঁপে উঠে মৃদু চিৎকার দিয়ে বলে,
“বেয়াদপ, রাস্কেল লোক ছাড়ুন। আই উইল কিল ইউ। কে আছো? চো…”
শেষ কথাটা মুখ দিয়ে বের হলো না মোহের। নেতিয়ে পড়ল আগন্তুক লোকটির বুকে। মাথাটা চেপে ধরে বেডে শুইয়ে দিল মোহকে লোকটি। শুকনো কন্ঠে বলল,
“তোমাকে ছোঁয়ার লোভ সামলাতে পারি না আমি। এই সামান্য ছোঁয়ার জন্য কত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে সেটা হয়ত তোমার জানা নেই। কিন্তু তোমায় এতটুকু ছুঁয়ে ভালোবাসার তৃষ্ণা মেটেনি আমার। তোমায় সম্পূর্ণরূপে আর সম্পূর্ণ অধিকারে পেতে চাই। কিন্তু…! ভাগ্য যেন অন্যকিছু লিখে রেখেছে।”
পায়ের শব্দ কানে তীক্ষ্ণভাবে এসে ঠেকে আগন্তুকের। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ায় সে। সে আন্দাজ করতে পারছে কে আসছে। ফোনটা বের করে ফোনের ফ্লাশ লাইট অন করতেই খুলে যায় দরজা। দরজার ওপাশ থেকেও তীব্র আলোতে চোখ বন্ধ হয়ে আসে আগন্তুকের। দরজার ওপাশের অবয়বটা আরো কাছে আসে আগন্তুকের। চোখ খোলে লোকটা। সামনের অবয়বটা স্পষ্ট হতেই চমকে ওঠে সে।
“তুই এখানে কি করছিস? এসব কিছু কেন করছিস? তুই তোর বাড়ি থেকে চলে এলি আর কাউকেই কিছু না বলে এবাড়িতে ঢুকে পড়লি। কেউ দেখলে কি হবে ভেবেছিস?”
“কে দেখবে? কেউ দেখার মতো অবস্থায় আছে? সবাইকে সুন্দরভাবে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছি। কিন্তু তুই এখানে এত রাতে কেন?”
আগন্তুক লোকটা আমতা আমতা করতে থাকে। তার সামনের অবয়বের হাতে লোহার লাঠি। মুখশ্রী বড্ড হিংস্র হয়ে উঠেছে। অবয়বটি নিজের হিংস্রতা বজায় রেখে আগন্তুকের উদ্দেশ্যে বলে,
“আমি জানি তুই এখানে কেন এসেছিস। মোহকে তুই আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে চাস?”
আগন্তুক লোকটি নিরব। সামনের মানুষটাকে শান্ত করতে হলে তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করা যাবে না। অবয়বটি হাতে লাঠি তুলে মৃদু চিৎকার দিয়ে বলে,
“বল! তুই তো বলেছিলি মোহকে আমার কাছে এনে দিবি। তাহলে তুই কেন আমার সাথে ডাবল গেম খেলছিস?”
“খেলছি না ডাবল গেম আমি। ভাই, তুই শান্ত হ দেখ…”
“শান্ত তো হতে চাই। কিন্তু তুই শান্ত হতে দিচ্ছিস না।”
আগন্তুক লোকটির মাথায় আঘাত করে ফেলে তার ভাই। লোহার লাঠি সরাসরি গিয়ে কপালের ডান পাশে লাগে আগন্তুকের। কপালে হাত দিয়ে নিচে পড়ে যায় লোকটা। কপাল দিয়ে বেয়ে পড়ে রক্ত। অসার হয়ে আসে হাত-পা। উপুড় হয়ে পড়ে আছে সে। এবার পাগলপ্রায় হয়ে বেশ পিশাচের ন্যায় লোহার লাঠিটা দিয়ে একের পর এক আঘাত পড়ে লোকটার পিঠে। ব্যথায় কেঁপে উঠলেও ঠোঁট কামড়ে সহ্য করে সে। ক্লোরোফমের স্প্রে টাও কোথাও একটা ছিটকে চলে গেছে।
“স্টপ দিস ভাই।”
বেশ কষ্ট করে বলে আগন্তুক। কিন্তু সে যেন পাগলে পরিণত হয়েছে। এক পর্যায়ে লাঠি ছুঁড়ে ফেলে দিলেও আগন্তুকের কাছে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসে সে। চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে আলো ধরতেই দেখে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে তার ভাইয়ের মুখ। কপাল ও গাল বেয়ে থুঁতনি থেকে টুপটুপ করে পড়ছে লাল বর্ণের তরল পদার্থ। যাকে বলে রক্ত। সেই রক্ত দেখে পিশাচের মতো হেঁসে নিজের হাতে রক্ত ভরিয়ে বলে,
“রক্ত না আমার খুব ভালো লাগে।”
আগন্তুক লোকটি কোনো কথা বলার মতো অবস্থাতে নেই। পিঠে ভীষণ জ্বালাপোড়া করছে তার। রাগ তড়তড় করে বাড়ছে। শুধু একটি বিশেষ কারণে তাকে কিছু বলছে না লোকটি। সহ্য করে যাচ্ছে সবটা। রাগটা বেশিক্ষণ হয়ত দমাতে পারবে না সে। হাতে রক্ত ভরিয়ে মোহের ঘরের ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল সেই আগন্তুক লোকটির ভাই। মুখে হাসি দিয়ে কি যেন লিখতে থাকল সে। অন্যদিকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে আগন্তুক লোকটা। সারা শরীর যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে। তবুও তার ভাইকে নিয়ে এখান থেকে যেতে হবে নয়ত বড়সড় অঘটন ঘটতে সময় লাগবে না। উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে সে খেয়াল করে তার ভাই লিখা শেষে মোহের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যতটা এগিয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্ক রাগে যেন ফেটে যাচ্ছে তার। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে উঠে বসতে সক্ষম হলো আগন্তকটি। ফোনের ফ্লাশ লাইটের সাহায্যে হাতে ক্লোরোফম স্প্রে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে।
“কত সুন্দর তুমি, মোহ! আমি তোমাকে চেয়েছি তাতেও সবার সমস্যা। বাট তোমাকে ছলে বলে যেভাবেই হক আমারই হতে হবে।”
ধীর পায়ে হেঁটে বেডের কাছে এসে থামে লোকটি। নিজের ভাইকে সপাটে চড় বসিয়ে দেয় সে। রাগে ফোঁস করতে করতে গালে হাত দিয়ে তাকায় তার ভাই। তাকে আবারও মারতে নিয়ে এবার গাল বরাবর ঘুষি মেরে বসে আগন্তুকটি। ছিটকে পড়ে তার ছোট ভাই। তার শার্টের কলার ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে আগন্তুক লোকটি চোখমুখ লাল করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“ছোট থেকে অনেককিছু করেছি তোর জন্য। যা চেয়েছিস তাই পেয়েছিস। সীমা অতিক্রম করিস না। আমার এই মধুর আচরণের খোলস থেকে বের করিয়ে আনিস না। আমার আসল রুপ তিক্ত। এতোটাই তিক্ত যে তুই ভাবতেও পারছিস না।”
আচমকা ল্যাম্পশিট জ্বলে ওঠে রুমের। এসি চলতে শুরু করে। হয়ত মেইন সুইচ কেউ অন করে দিয়েছে। এখানে থাকা আর কারোর পক্ষেই ঠিক না। রুমাল বেঁধে রাখা লোকটি তার ভাইয়ের ওপর স্প্রে করতেই ঢলে পড়ে তার ভাই। তাকে টানতে টানতে কোনোমতে মোহের রুম থেকে বেরিয়ে আসে আগন্তুকটি।
সকালবেলা এক তীক্ষ্ণ শব্দ কানে এসে ঠেকে মোহের। চোখমুুখ জড়িয়ে নড়েচড়ে ওঠে সে। চোখ মেলতে চাইছে না। না চাওয়া সত্ত্বেও চোখ জোর করে খুলল মোহ। তার ফোনটা বাজছে। কোনোমতে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে সে। চোখে এখনো তীব্র ঘুম। মাথাটা যেন ঝিমঝিম করছে। মাথা দাঁড় করাতেও পারছে না সে। ঘুম ঘুম চোখেই হাতড়ে ফোন নিয়ে রিসিভ করে মোহ। চোখ বন্ধ করেই আন্দাজে ফোন রিসিভ করে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে,
“হ্যালো? হুস দিস?”
“মোহ আমি জুহি! এখনো ঘুমোচ্ছিস?”
“হু। কেবল উঠলাম। কি হয়েছে বল?”
“তুই কিছু জানিস না এখনো? কি হয়ে যাচ্ছে? ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কত বড় ঝামেলা হয়েছে জানিস কিছু? তোর ধারণা আছে?”
জুহির অস্থিরতা শুনে ঘুম ছুটে গেল মোহের। জুহির কথায় গভীর মনোনিবেশ করল সে। উৎকণ্ঠা হয়ে প্রশ্ন করল,
“কেন কি হয়েছে?”
“তো…তোর আর… ”
থেমে যায় জুহি। মোহের বুঝতে বাকি থাকে না তাকে নিয়েই কিছু ঘটেছে। আসল ঘটনা জানার জন্য ছটফট করে সে।
“কি হয়েছে বলবি তো! হেয়ালি করিস না তো।”
“তোর কিছু ছবি ভাইরাল হয়েছে। বিশেষ করে টিভিতে দেখাচ্ছে। সেখানে ছবিতে তুই আর তোর ওই কাজিন। কাল যাকে দেখলাম সে আছে। যদিও এটা নরমাল বিষয়। কিন্তু বড় ঘরের হওয়ার সুবাদে তুই আর তোর কাজিন এদিক থেকে ছাড় পাসনি। সামান্য কিছু ছবি দিয়ে তিল থেকে তাল বানিয়ে ফেলেছে রিপোর্টাররা। করিম আঙ্কেলের মেয়ে হওয়ার কারণে তোকে নিয়ে মেতে গিয়েছে সবাই। প্লিজ নেটের খবরের ওয়েবসাইট গুলোতে দেখ।”
তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দেয় মোহ। মাথায় যেন বাজ পড়েছে তার। দ্রুত গতিতে নেট অন করে খবরের ওয়েবসাইটে যায় সে। সেখানে যেতেই চোখ কপালে উঠে যায় তার। চোখমুখ লাল হয়ে আসে। রাগে চোখে টলটল করে পানি। তার আর স্বচ্ছের ছবি। সেখানে স্বচ্ছের কোলে রয়েছে মোহ। তারমানে কাল ভার্সিটির ক্লাসের পরের ঘটনা। এটার ছবি কেউ তুলে নিয়েছে। তার পাশেই আবারও সেই রেস্টুরেন্টের বাহিরের ছবি। যেখানে স্বচ্ছ মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে মোহের পায়ে হাত দিয়ে আছে। ক্যাপশনে বড় বড় করে লিখা, ‘মা-বাবা মারা যাবার পরে কি নিজের কাজিনকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিলেন করিম আনবীরের একমাত্র মেয়ে মোহ আনবীর?’
বিস্তারিত পড়ার রুচি জাগল না তার। ফোনটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এবার নিজের চুল টেনে ধরল সে রাগে। এবার প্রচন্ড রাগ লাগছে স্বচ্ছের ওপর। কে বলেছিল তাকে এতো দরদ দেখাতে? কে বলেছিল? রাগে-দুঃখে বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে এবার তার দৃষ্টি গেল ঘরের পরিবেশে। এলোমেলো জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ফ্লোরে বেশ খানিকটা রক্ত! গতকালকের রাতের কথা মনে পড়লেই আঁতকে উঠল সে। যতটুকু মোহের মনে আছে তা হলো সেই আগন্তুক লোকটি তার গালে চুমু খেয়েছিল আর কি যেন বলছিল। কথাটি মনে পড়তেই গালে হাত গেল তার। সজোরে ঘষতে থাকল গাল। এমন করতে করতে নজর গেল ড্রেসিং টেবিলে। রক্ত দিয়ে কিছু লিখা।
“যেই নারীর ওপর আমার দৃষ্টি একবার পড়ে। তার নিস্তার নেই। তোমারও নেই।”
চোখ খিঁচে চিৎকার দিল মোহ। একি হচ্ছে তার সাথে? সবটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন?
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]