একটুখানি_সুখ #আনিশা_সাবিহা পর্ব ২৬

0
522

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৬

স্বচ্ছ নিজের হাতটা মোহের দিকে বাড়িয়ে তার দিকে আশাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মোহ বসে বসে হাত কচলে আশেপাশে তাকিয়ে যাচ্ছে। আবার একবার স্বচ্ছের দিকে তাকাচ্ছে। আয়মানের সঙ্গে তার বিচ্ছেদের পর তার ভয় করছে অন্যকারোর সাথে স্বপ্ন দেখার কথা ভাবতে। যদি স্বচ্ছও তার মতো হয়? আর মোহ ভুলে যায়নি স্বচ্ছের সঙ্গে অনেক মেয়ের সম্পর্ক! এসব ভেবে মনে আগমন হয় বিষণ্নতার। মোহ স্বচ্ছের হাতে হাত রাখে না। একটা মেয়ের কাছে সব থেকে বেশি যন্ত্রণার প্রিয়মানুষের অন্য মেয়ের সঙ্গে। এটা যেন মৃত্যু সমান যন্ত্রণার। মুখ ঘুরিয়ে মোহ ধীর কন্ঠে বলল,
“আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন? আমাদের বিয়ে একটা বাধ্যবাধকতার সূত্রে গাঁথা? হয়ত ভুলে যাচ্ছেন। আমি মনে করিয়ে দিই। নাকি এটা ভুলে যাচ্ছেন আপনার অন্য একটা লাইফ আছে। সেখানে অসংখ্য মেয়ের আনাগোনা।”

“আমার জীবনে, আমার শয়নেস্বপনে, আমার প্রতিটা নিশ্বাসে শুধু একজন রমনীর আনাগোনা। যাকে আমি বিয়ে করেছি। শুধু তারই আনাগোনা। আমার কোনোকালে কোনো মেয়ে মনে ধরেনি। ধরবেও না।”

কান থেকে শুরু করে হৃদয় পর্যন্ত ছুঁয়ে গেল কথাগুলো। অবাধ্য মোহের মন ও তার চোখজোড়া আবারও স্বচ্ছের দিকেই দৃষ্টি রাখল। স্বচ্ছের হেলদোল নেই কোনো। সে এখনো নির্বিকার ভঙ্গিতে তার বাড়িয়ে আছে এউ আশায় যে মোহ হাত বাড়িয়ে তার হাতে হাত রাখবে। মোহ অস্ফুটস্বরে বলে,
“তাহলে আপনার নয় নম্বর গার্লফ্রেন্ড বলেছিলেন? তবে এতোদিন…”

চোখ দিয়ে ইশারা করে মোহকে থামিয়ে স্বচ্ছ নিজ থেকে বলে,
“একটা কথা বলো! আমি যে তোমার ভার্সিটিতে গেছিলাম আর তোমায় বলেছিলাম যে আমি আমার আট নম্বর গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এসেছি। সেদিন পাঁচ মিনিটের মাঝে কি করে ওর সাথে দেখা করে আবার তোমাকে বাইকে উঠিয়ে পুলিশের কাছে গেছিলাম। গার্লফ্রেন্ড ম্যানেজ করা পাঁচ মিনিটের ব্যাপার স্যাপার নয়। তাই না?”

কিছুটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে মোহের মস্তিষ্কে চাপ দিতেই মনে হলো সত্যিই তো! কিভাবে এতো দ্রুত সব কিছু ঘটল? স্বচ্ছ কেনই বা তার গার্লফ্রেন্ডকে ছেড়ে দিয়ে এসে তাকে বাইকে তুলে নিবে? আদোও তার কোনো গার্লফ্রেন্ড নামক কিছু ছিলই না? মূহুর্তেই চোখ বড় বড় করে তাকায় মোহ। লোকটা কি মিথ্যুক! তাকে এতোদিন বোকা বানিয়ে গেছে? স্বচ্ছ মোহের রিয়েকশন দেখে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসে। তারপরেই হাসিটা মিলিয়ে যায় তার। এখনো হাতে হাত রাখেনি মোহ। আদেও কিন্তু মোহের মনে এক টুকরো অনুভূতিও জায়গা করে নিতে পারেনি স্বচ্ছ? ভাবতেই চোখমুখের রঙ পাল্টে যায় তার। গলা খাঁকারি দিয়ে হাত নামিয়ে রাখতেই খপ করে তার হাতটা চেপে ধরে মোহ। আর কিছুটা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,

“হাত নামিয়ে নিতে বলেছি আপনাকে? কেন হাত নামিয়ে নিচ্ছেন? আপনি তো দেখছি ভারি বজ্জাত লোক! বিয়েটা তো আমার সিদ্ধান্তেই হয়েছে। তাহলে কেন রাজি হবো না আপনাকে জড়িয়ে থাকতে? আপনি চাইলেও আর ছাড়ছি না আপনার হাত। বিয়ে নামক সম্পর্ককে সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দিতে জানে মিসেস. আহিয়ান স্বচ্ছ। আমি প্রথমে এই অগোছালো, উগ্র মি. আহিয়ান স্বচ্ছকে গোছালো করে তুলব। মি. আহিয়ান স্বচ্ছ বড্ড অগোছালো! এই অগোছালো মানুষটাকে গুছিয়ে নিতে হবে তো।”

স্বচ্ছ হেঁসে মোহের হাত কোমলভাবে জড়িয়ে ধরে আচমকা চুমু খেয়ে ফেলে তার হাতে পিঠে। কিছুটা চমকে উঠে আশেপাশে তাকায় মোহ। চোখেমুখে লাজুকতার সীমানা নেই। সেই মূহুর্তটাই বন্দি হলো তিহানের ক্যামেরাতে।

সবেমাত্র গাড়ি এসে থামল স্বচ্ছের বাড়ির সামনে। ভার মুখে মাথা উঠিয়ে গাড়ি থেকে সামনের বাড়িটা দেখে নেয় মোহ। এমনটা নয় যে এই প্রথমবার সে বাড়িতে প্রবেশ করছে। এর আগে বহুবার এই বাড়িতে এসেছে সে। আজকের ব্যাপারটা পুরোপুরি ভিন্ন। আগে মামার বাড়ি হিসেবে বহুবার স্বাচ্ছন্দ্যে আসাযাওয়া করেছে সে। কিন্তু আজকে কেমন যেন অস্বস্তি ভর করেছে তার মনে। কারণ এটা তার একমাত্র গন্তব্য। আজ থেকে এটা তার একমাত্র ঠিকানা। নিজের বাড়ি, নিজের স্মৃতিভরা সেই বাড়ি যেখানে মা-বাবার সঙ্গে রয়েছে অসংখ্য আনন্দময় স্মৃতি সেই বাড়িটা থেকে বিদায় নিয়ে এসেছে সে। সারা রাস্তা নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে ফুলে গিয়েছে তার চোখমুখ। ফর্সা নাকের ডগা লাল চেরিফলের ন্যায় হয়ে উঠেছে। চোখের পাতায় এখনো পানি স্পষ্ট। স্বচ্ছ আজকে শুধু তার কান্না দেখেছে। এসব ব্যাপারে কি শান্তনা দিয়ে কান্না থামানো যায় জানা নেই স্বচ্ছের। কারণ নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্য একজনের বাড়িকে নিজের বাড়ি বানিয়ে নেওয়ার কঠিন পরিস্থিতিতে সে পড়েনি। কারণ সে জানে কাজটা বেশ কঠিন। যা মেয়েরা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় সারাজীবন পার করে দেয়।

সকলে নেমে গেল গাড়ি থেকে বেশ দ্রুত। ঢক গিলে বসে রইল মোহ। পাশে রয়েছে স্বচ্ছ। স্বচ্ছের এক দূর সম্পর্কের কাজিন সোহা গাড়ি থেকে নেমেই মোহের পাশের দরজা খুলে দিয়ে বলল,
“ভাবি নামবে না?”

“হু!”
ছোট্ট করে শব্দ করে স্বচ্ছের দিকে তাকায় মোহ। তার সত্যিই অদ্ভুত লাগছে বাড়িতে প্রবেশ করতে। এই অস্বস্তির চোটে জ্ঞান হারাবে না তো? মোহের ঠাঁই বসে থাকা দেখে স্বচ্ছ এগিয়ে এসে বলে,
“বিলিভ মি! এক কয়েক সেকেন্ড এখানে বসে থাকলে আমি চেরীফল ভেবে তোমার নাকের ডগায় কামড় দিয়ে ফেলব।”

বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় মোহ। অন্যদিকে সোহা খিলখিল করে হাসছে স্বচ্ছের কথায়। লোকটার মুখে লাগাম নেই? মোহ তেতে উঠে বলে,
“আপনি কি ড্রিংকস করে বিয়ের আসরে গেছিলেন? সেখানেও অদ্ভুত কথাবার্তা আবার এখানেও?”

“তো কি করব আমি? খিদে পেয়েছে? কাছে কাছে এমন সুন্দর নাকের ডগায় চেরীফলের মতো থাকলে কি লোভ সামলানো যায় নাকি অদ্ভুত!”

“খিদে পেয়েছে? ওই বাড়িতে আসার আগে পাহাড়ের সমান প্লেটে আপনাকে খাবার দেওয়া হলো আর আপনি এই পর্যন্ত আসতেই খিদে পেয়ে গেল?”

“বাই এনি চান্স, তুমি কি আমায় খাবারের খোঁটা দিচ্ছো? এখন কি শ্বশুড়বাড়ি খাবারের জন্যও কথা শুনতে হবে?”
ভ্রু উঁচিয়ে ক্ষীণ সুরে বলে স্বচ্ছ। ওমনি লজ্জা ও অস্বস্তি জানালা দিয়ে পালিয়ে রাগ ভর করে তার মনে। স্বচ্ছের হাতেই এক চাপড় মেরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“আপনি… আপনি একটা…অসহ্যকর!”

বলেই গাড়ি থেকে নেমে যায় মোহ। সোহা এসব কর্মকান্ড দেখে হেঁসেই চলেছে। পেটে খিল ধরে যাচ্ছে তার। হাসতে হাসতেই বলল,
“আ…আমি কি ভাবিকে ধরব? ভাইয়া যে কান্ড শুরু করেছে আমি হাসতে হাসতে এখানেই পড়ে যাব।”

“ভালো করে খাওয়াদাওয়া না করলে এটাই হয়। দিন দিন এমন শুঁটকি মাছের মতো হয়ে যাচ্ছিস কয়েকদিন পর তোকে তোর ভাবির মতো অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হবে। তুইও খা আর তোর ভাবিকেও খাওয়া যে কয়দিন আছিস। আদারওয়াইজ আমার পাশে তোর ভাবিকে দেখতে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ!”

আবারও চোখ রাঙিয়ে তাকায় মোহ। বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু আত্মীয়রা মোহকে দেখবার জন্য। মোহ বেরিয়েও যেতে পারছে না। ধীর গতিতে পায়ের ধাপ ফেলছে সে। পেছন দেখে তা লক্ষ্য করে স্বচ্ছে বলে ওঠে,
“বলছিলাম না সোহা? দেখ, খেতে পারে না সেকারণে হাঁটতেও পারছে না। ছোট ফুপি খেতে দেয় না তাই না?”

“কারণটা অন্য। অযথা নিজের মতো করে একটা কারণ বের করবেন না তো।”
চোখ রাঙিয়ে কড়া কন্ঠে কথাটা স্বচ্ছের দিকে ছুঁড়ে দেয় মোহ। প্রায় সদর দরজার কাছাকাছি চলে এসেছে সে। পাশেই হাঁটছে স্বচ্ছ। সামনে সোহা। এসব শুনে স্বচ্ছের দূর সম্পর্কের চাঁচি বলে ওঠেন,
“স্বচ্ছ, এতোই যখন তাড়া তুই তখন ওকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে আয় না! নতুন বউ তো তাই ঘরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে।”

মোহ শুকনো ঢক গিলে স্বচ্ছের দিকে তাকিয়ে মানা করে এসব করতে। স্বচ্ছ তা পাত্তা না দিয়ে চাচির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেঁসে বলে,
“বলছেন কোলে নিতে?

চাচি মাথা নাড়াতেই আর এক মূহুর্ত দাঁড়ায় না স্বচ্ছ। তুলে নেয় মোহকে দুহাত দিয়ে কোলে। ধড়ফড়িয়ে উঠে স্বচ্ছকে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে মোহ। আকুতির সুরে বলে,
” সবার সামনে কি শুরু করেছেন?”

স্বচ্ছ কর্ণপাত না করে মোহকে নিয়েই প্রবেশ করে বাড়িতে। সকলে বিষয়টা নিয়ে হৈচৈ আর হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছে। মোহ তো পারছে না উড়ে যেতে বা মাটির নিচে ঢুকে যেতে। এবার স্বচ্ছ নিচুসুরে বলে ওঠে,
“তাহলে কি বলছো? সবার আড়ালে এসব করতে?”
“আপনার সাথে কথা বলাই বেকার!”
মিনমিন করে কথাটুকু বলেই নিজের মুখ ঢেকে ফেলল মোহ।

এতোক্ষণ এসব থেকে বেশ বিরক্ত আর ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফেটে পড়ছিলেন মিসেস. রেবা। মোহকে স্বচ্ছ সোফায় বসিয়ে দিতেই দ্রুত স্বচ্ছের কাছে এগিয়ে গিয়ে সকলের আড়ালে বললেন,
“আমার ঘরে আয় এক্ষুনি।”

সকলে মেতে উঠল নতুন বউকে নিয়ে। এই ফাঁকে মুখটা গম্ভীর করে মিসেস. রেবার ঘরের দিকে পা বাড়ায় স্বচ্ছ। তার মায়ের রুমটা ছিল খোলা। তাই কিছু না বলেই ঘরে ঢুকে পড়ে সে। সঙ্গে সঙ্গে মিসেস. রেবা ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন,
“পেয়েছিস শান্তি? পেয়েছিস মোহকে? এখন বল সৌমিত্র কোথায়? কি করেছিস ওর সাথে?”

“রিল্যাক্স মা। ও আমারও ভাই। এমন কিছু করিনি ওর সাথে যার কারণে তোমায় হাইপার হতে হবে।”

“এখনো বলছিস কিছু করিসনি। আজ তুই যা কান্ড করলি! সেটা যদি একবার সৌমিত্রের কানে যায় ও কতটা অসুস্থ হয়ে পড়বে জানিস তুই? জানিস তো! তুইই তো ছোটকাল থেকে ওকে সামলে এসেছিস। এখন দুইদিনের এক মেয়ে তোর কাছে বড় হয়ে গেল? তুই আমার ছেলে। তোর কাছ থেকে আমি এটা আশাও করিনি।”

স্বচ্ছ মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শোনে। অতঃপর বিদ্রুপাত্মক কন্ঠে বলে,
“ওর সব অন্যায় আমি মেনেছি মা। আর সায় দিতে ইচ্ছে করে না। আমি চাই না পাপের বোঝা বাড়াতে। আজ মোহকে ভালো লেগেছে ওর। কিন্তু কাল যখন মোহ ওর কাছে পুরোনো হয়ে যাবে তখন অন্যসব মেয়ের মতো মোহেরও কি একই অবস্থা হবে? ও তোমার এক ছেলের মোহ হলেও তোমার অন্য ছেলের ভালোবাসা হয়ে উঠেছে। তাকে ছাড়া সবটা অপূর্ণতায় ভরে ওঠে আমার। তুমিও আমার সঙ্গে গেম খেলেছো। তাহলে কেন বাদ যাব? তোমার সঙ্গে আমি কোনো তর্কে জড়াতে চাই না।”

“সৌমিত্র কোথায়?”

“ও যেখানে থাকে সেখানেই আছে। অনেক আগে ওকে ওর জায়গায় পৌঁছে দিয়েছি। খোঁজ নিয়ে দেখো। সে এখন পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।”
বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে বসে স্বচ্ছ। মিসেস. রেবা রাগে চোখমুখ জড়িয়ে ফেলেন। ড্রেসিংটেবিলে থাকা সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দেন উনি। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আসছে উনার। কোনদিকে যাবেন উনি? তার দুই ছেলে তো দুই মেরুর হয়ে উঠছে!

চলবে….

[বি.দ্র. আজকে প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে সময় কেটেছে আমার। একটু সময় পাইনি টাইপিং করার। সময় পাওয়া মাত্র বসেছি টাইপিং করতে। তাই দিতেও দেরি হয়ে গেল। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here