#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৩
পাহাড়ি পরিবেশ। সোনালী রোদ্দুর ছুঁয়েছে পরিবেশ। দমকা হাওয়া মাঝে মাঝেই প্রকৃতিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। চোখ জুড়িয়ে যাবেই যাবে। জায়গাটা বান্দরবান। গাড়ি ছুটে চলেছে। গাড়ির পেছনের সিটে জানালার ঘেঁষে বসে রয়েছে মোহ। চোখে বড় বড় করে রাস্তার আশেপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছে সে। ঠোঁটে হাসির রেশ। মাঝে মাঝে প্রসারিত হচ্ছে ঠোঁট আবার প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যের কারণে আপনা-আপনি হা হয়ে যাচ্ছে ঠোঁটজোড়া। বান্দরবান আসার ইচ্ছেটা অনেক আগে থেকেই ছিল মোহের। প্ল্যানিং ও হয়েছিল এখানে আসার পরিবারের সকলে মিলে। তবে হারিয়ে গেল মোহের পরিবার। একটা ঝড়েই মুষড়ে পড়তে হলো তাকে। হঠাৎ করেই এই ইচ্ছেটা পূরণে হতভম্ব সে। তার চেয়ে দশগুন বেশি খুশি। চেহারাটা খুশিতে ঝলমলে হয়ে উঠেছে যেন। পাশেই সিটে ঠেস লাগিয়ে বসে আছে স্বচ্ছ। মেরুন রঙের শার্ট ওপরে কালো রঙের কোট পরিহিত স্বচ্ছের ওপরে নাহলেও হাজারবার আঁড়চোখে তাকানো হয়ে গেছে মোহের। তবুও এই সুদর্শন পুরুষের সৌন্দর্য যেন কমার নয়। বারংবার চোখজোড়া যেখানেই পৌঁছায়। স্বচ্ছের একপাশের চুল দিয়ে প্রায় তার বাম চোখ ঢেকে যাচ্ছে। সেটা খেয়াল করে মিটমিটিয়ে হাসে মোহ। স্বচ্ছ চোখ বুঁজে আছে বুকে দুহাত গুটিয়ে। সারারাত মোহ ঘুমিয়ে এসেছে তার বুকে। স্বচ্ছ তখন নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিল। কখনো মোহের মাথায় হাত বুলিয়েছে, কখনো ইচ্ছেমতো চুমু খেয়ে গেছে আবার কখনো কানে বা নাকে ফুঁ দিয়ে ডিস্টার্ব করেছে। এখন তার চোখজোড়া আর মানছে না বুঁজে এসেছে।
জানালার বাহির থেকে নজর সরিয়ে আবারও ঘাড় বাঁকিয়ে স্বচ্ছের দিকে তাকায় মোহ। চোখ বুঁজে আছে লোকটা। রাতের কথা একটুআধটু মনে আছে মোহের। একবার তো স্বচ্ছ কামড় দিয়েছিল মোহের নাকে। এবার তারই প্রতিশোধ নেওয়ার ফন্দি আঁটছে মোহ। সামনের ড্রাইভারকে ভালোভাবে দেখে নেয় মোহ। ড্রাইভার নিজমনে গাড়ি ড্রাইভ করতে ব্যস্ত। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্বচ্ছের দিকে আস্তে করে এগিয়ে যায় সে। হালকা করে স্বচ্ছের দিকে হেলে গিয়ে কামড় দেওয়ার জন্য হা করতেই একচোখ খুলে ফেলে স্বচ্ছ।
“আজকাল দেখছি লাভ বাইট দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছো। ব্যাপার কি?”
বেলুনের মতো চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে সরে আসতে নেয় মোহ। কিন্তু তার আগেই ফট করেই মোহের পিঠে হাত রেখে নিজের ওপর ফেলে দেয় স্বচ্ছ। এমন আকস্মিকতায় হকচকিয়ে ওঠে মোহ। ফটাফট দূরে সরে যাওয়ার জন্য ছটফটিয়ে বলে ওঠে,
“এটা কি হচ্ছে? আমরা গাড়িতে আছি ভুলে যাচ্ছেন?”
“আমি তো ভুলছি না সুইটহার্ট। তুমি ভুলছো। গাড়িতেই ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করছিলে দেখলাম তো। এতোটাই ব্যাকুল হয়ে উঠলে যে আমার মতো ঘুমন্ত নিষ্পাপ ছেলেটার ওপরও ভালোবাসার অত্যাচার করতে চলে এলে। এখন চোখ মেললাম তো গানের সুর পাল্টে গেল? দ্যাটস নট ফেয়ার সুন্দরী!”
মুচকি হেঁসে ভ্রু উঁচিয়ে বলে স্বচ্ছ। মোহ গড়গড় করে বলে,
“আমি মোটেই আপনাকে এসব করতে এগিয়ে আসিনি। আমি তো শুধু…”
“তুমি তো শুধু কি? হা করে এগিয়ে আসছিলে কেন? তোমার মতলব আমার ঠিকঠাক লাগছে না। না জানি আমাকে একা পেয়ে কি করে বসো।”
মোহ বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। এই লোকটা কি বলে? এমন কথা শুনতেই সে নড়াচড়া ভুলেছে। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থেকে তারপরেই স্বচ্ছের বুকে কয়েকটা কিল মেরে দেয় মোহ। স্বচ্ছ তাতেও ভ্রুক্ষেপহীন। চোখ ছোট করে মেয়েটার কান্ড দেখে সে বলে,
“যাই করো না কেন এখন লাভ বাইট না দিয়ে গেলে তোমায় ছাড়ছি না।”
“আপনি পাগল হয়ে গেছেন সরুন!”
“আমার পাগলামি, আমার মুগ্ধতা, আমার মাতলামো, আমার উন্মাদনা সবটা যে একজন নারীকেই ঘিরে। সে কি সেটা বোঝে?”
ছটফটানি বন্ধ করে দেয় মোহ। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয় তার একদম সন্নিকটে থাকা ধূসর বর্ণের চোখজোড়ার পুরুষটির দিকে। কেমন যেন উন্মাদনা ছড়িছে চারিদিকে। মোহ হারিয়ে যাচ্ছে মানুষটির প্রেমে। অথচ তার সঙ্গে এমন হওয়ার কথাই ছিল না! স্বচ্ছ মোহের বাহু ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে,
“ওহ হ্যালো ম্যাডাম! হোটেলে প্রায় পৌঁছে গেছি। এভাবেই কি আমরা থাকব নাকি হোটেলেও যাব? তুমি থাকতে চাইলে আমার আপত্তি নেই।”
মোহ কিছুটা চকিতে তাকায়। সরে আসতে নিলেও সরে না সে। স্বচ্ছের দিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করে নেয়। আনমনে হয়ে স্বচ্ছের ডান গালে হাত দিয়ে বলে,
“এই দাগটা কীসের? এমন লাল হয়ে আছে কেন? মনে হচ্ছে রক্ত জমাট বেঁধে আছে!”
স্বচ্ছ হাতিয়ে নিজের গালে হাত রাখে। মোহ হাতটা সরিয়ে দেয়। ভবঘুরে হয়ে বলে,
“আবার মনে হচ্ছে কয়েকটা আঙ্গুলেরও দাগ দেখছি। কি হয়েছে?”
“কি হবে আবার? হয়ত কোনোভাবে আঁচড় লেগেছে কারো সাথে। এমনটা তো অস্বাভাবিক কিছু না।”
“আমার তো তা মনে হচ্ছে না।”
সন্দিহান হয়ে বলে মোহ। তার চোখ এখনো স্বচ্ছের গালে স্থির। যেন বেশ গভীরভাবে কেউ আঁচড় কেটেছে নাহলে মেরেছে। কিন্তু লোকটা স্বীকার করতে নারাজ। স্বচ্ছ কিছুটা আমতা আমতা করতে করতে এক সময় সরু দৃষ্টিতে তাকায় মোহের দিকে। আর নিচু সুরে বলে,
“তুমি তো দেখছি দিন দিন টিপিক্যাল ওয়াইফ হয়ে যাচ্ছো। মানে একটা জিনিস দেখো! সামান্য আঁচড়ে সন্দেহ করে ভেতরে ভেতরে কিভাবে জ্বলে যাচ্ছো তুমি। ব্যাপার কি? এটাতে সিউর থাকো তোমার বর যে কিনা একটাকে সামলাতে পারে না সে পাগল হলেও অন্য কারো কাছে যাবে না।”
“আপনি বেশি বেশি বলছেন।”
“উঁহু না! আমি এক নারীতে আসক্ত আর পরনারীতে আসক্ত হওয়ার কথা ভাববার আগেই যেন মৃত্যু হয় এই আহিয়ান স্বচ্ছের।”
গাড়ি থামে। দুজনেরই চোখে চোখে কথা বন্ধ হয়। মোহকে ছেড়ে দেয় স্বচ্ছ। মোহ মাথা নিচু করে সরে আসে। স্বচ্ছ গাড়ি থেকে নামে। সাথে মোহও নেমে পড়ে। সামনেই বড়সড় দোতালা রিসোর্ট। অবশ্য রিসোর্টের মাঝে এক অন্যরকম সৌন্দর্য আছে। সামনের করিডোর দাঁড়া সংযোগ করা ঘর। তাছাড়া সবগুলো যেন গ্রামীণ কুঠুরি। ব্যাপারটা বেশ মজার লাগল মোহের। বেশ আগ্রহের সঙ্গে দ্রুত এগিয়ে যায় হোটেলের দিকে সে। সামনের ছোটখাটো বাগান। মাঝখান দিয়ে পিচ করা সরু রাস্তা। রাস্তাটা ভিজে। কারণ সবে ভোর হয়েছে। হয়ত শিশির পড়েছে। রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে মোহ স্বচ্ছের অপেক্ষায়। পিছু ফিরে তাকায় মোহ। স্বচ্ছ নিজের মানিব্যাগ পকেটে ঢুকিয়ে আসছে সবে। শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে একটা একটা করে। অন্যমনস্ক সে। এরইমাঝে একটা লাল গাড়ি এসে দাঁড়ায়। দ্রুততার সাথে গাড়ির দরজা খুলে একটা মেয়ে নেমে পড়ে। সাথে একটা লাগেজ নামিয়ে তাড়াহুড়ো করে হাঁটতে নেয় সে। সরু রাস্তা থাকার ফলে স্বচ্ছের গায়ের সাথে মেয়েটা ধাক্কা খেতেই বেসামাল হয়ে পড়ে স্বচ্ছ। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে খুব বিরক্তির সাথে তাকায় সে। মোহেরও বিষয়টা কেমন জানি অদ্ভুত ক্ষোভ জাগালো। দ্রুত পা চালিয়ে ছুটল সেদিকে। স্বচ্ছের কাছে এসে দাঁড়ালো মোহ।
“স্বচ্ছ! হোয়াট অ্যা কোয়েন্সিডেন্স! আই কান্ট বিলিভ।”
স্বচ্ছের মুখ থেকেও বিরক্তিভাবটা কেটে যায়। ঠোঁটে ফুটে ওঠে সূক্ষ্ম হাসির রেশ। বেশ প্রফুল্ল মুখটা নিয়ে বলে ওঠে,
“রিয়ানা! আমিও বিলিভ করতে পারছি না তুমি। সিরিয়াসলি? তুমি বাংলাদেশে এসেছো? কবে? তাও বান্দরবান?”
“ইয়েস। আজই তো ল্যান্ড করলাম দেশে। কি করব যতই হক এই দেশের মেয়ে না আমি?”
কথাটা বলে হেঁসে ওঠে রিয়ানা নামক মেয়েটা। স্বচ্ছের হাসিও প্রসারিত হয়। সে যেন কত খুশি এই মেয়েটিকে দেখে। তবে মোহ বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। মেয়েটির পরনে আধুনিক পোশাক। গায়ে গেঞ্জি সাদা রঙের তার ওপর জ্যাকেট। আর সাথে জিন্স। বেশ আধুনিক মেয়ে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। হঠাৎ করেই রিয়ানা স্বচ্ছের হাত ধরে বসে। মোহও ঢক গিলে তাকায় সেদিকে। কেমন জানি লাগছে তার। অস্বস্তি না রাগ হচ্ছে নিজেই বুঝতে পারছে না। তবে হাত মুঠো করে দাঁতে দাঁত চেপে বিষয়টাকে চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে মোহ। তবুও কেন জানি তার অসহ্য লাগছে। সুন্দর পরিবেশ অসুন্দর হয়ে উঠছে। কেন?
চলবে…
[বি.দ্র. অসুস্থতা পিছু ছাড়ছে না আমার। তার ওপর সামনে পরীক্ষা। তাই পর্বটা ছোট হয়ে গেল আজকে। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]