ধারাবাহিকগল্প #লড়াই পর্ব-এক

0
676

#ধারাবাহিকগল্প
#লড়াই
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

রাইসা প্রিন্সিপাল ম্যামের রুমে অনুমতি না নিয়ে ঢুকে পড়ে তারপর উদ্ভ্রান্তের মতো
ম্যামকে বললো,
—–ম্যাম আপনার সাথে আমার একটু পারসোনাল কথা আছে।
ম্যাম ওকে বললো,
—-ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করো। ফ্রি হয়ে তোমাকে ডাকছি।
সায়মা ম্যাম হাতের কাজ গুছিয়ে গেস্টদের বিদায় দিয়ে রাইসাকে রুমে ডেকে পাঠালো। সায়মা ম্যাম একটা বেসরকারি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রিন্সিপাল। কলেজের নাম হালিমা খাতুন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। মেয়েদের নিরাপত্তার দিকে উনার সবসময় সজাগ দৃষ্টি থাকে। রাইসা অফিসরুমে এসে ম্যামের সামনে বসলো। ম্যাম ওর দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর চোখ মুখ ঠোঁট বেশ ফোলা ফোলা। মনে হয় কান্নাকাটি করেছে। সায়মা ম্যাম রাইসাকে বললো,
—–তোমার কোনো সমস্যা?
—–ম্যাম আমার হাশেম স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে।
সায়মা ম্যাম একটু চমকে উঠে রাইসাকে বললো,
—–স্যারের বিরুদ্ধে তোমার কি অভিযোগ?
—-স্যারের কাছে আমি যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি। উনি আমার স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিয়েছেন। আর হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট ভয়ঙ্কর ভাবে কামড়ে ধরেছেন।
—-তোমার কাছে কোনো প্রুফ আছে?
—–(কাঁদতে কাঁদতে)ম্যাম আমার মুখের কথা কি যথেস্ট নয়?আর আপনি আমার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে দেখেন। আমি কেন স্যারের নামে নোংরা অভিযোগ করবো? বরং এটা জানাজানি হলে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে আমি অসম্মানিত হবো? এখানে তো আমার কোনো স্বার্থ নাই। নিজের চরিত্রে আমি কেন কলঙ্কের দাগ লাগাবো?
—-তুমি স্যারের কাছে গিয়েছিলে কেন?
—–আমার প্রাকটিক্যাল খাতা সই করানোর কথা ছিলো। আমাদের ক্লাসের অন্য একটা মেয়ে জেবা আমাকে বললো স্যার আমাকে খাতা নিয়ে উনার রুমে দেখা করতে বলেছেন। তাই খাতা নিয়ে আমি স্যারের রুমে যাই। তখন স্যার আমার সাথে এই নোংরামী করেন।
এরপর সায়মা ম্যাম জেবাকে ডেকে পাঠালেন। জেবা ম্যামের রুমে আসলে ম্যাম জিজ্ঞাসা করেন,
—-হাশেম স্যার রাইসাকে ডেকে পাঠিয়েছে তুমি কি রাইসাকে বলেছো?
—-ম্যাম আমার সাথে তো রাইসার দেখাই হয়নি। এই মাত্র এখানে দেখা হলো।
—জেবা তুমি না আমাকে বললে
—হাশেম স্যার প্রাকটিক্যাল খাতা সই করানোর জন্য আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে।
—-কেন রাইসা তুমি আমার নামে ম্যামের কাছে মিথ্যা বলছো?
রাইসা অবাক হয়ে জেবার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ম্যাম জেবাকে চলে যেতে বললেন। জেবা চলে যাওয়ার পর রাইসার দিকে তাকিয়ে দেখলেন ও অঝোর ধারায় কাঁদছে। ম্যাম ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
—–আমি তোমার কথা বিশ্বাস করেছি।
রাইসা বললো,
—–ম্যাম আমি নিজের এই অসম্মান আর নিতে পারছি না। যার সাথে এই ঘটনা ঘটে একমাত্র সেই বুঝে এই রক্তাক্ত ক্ষতের যন্ত্রণা। কোনোদিন আমার এই ক্ষতের জ্বালা দূর হবে না। সারাজীবন এই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হবে। আমাদের ক্লাসের অনেক মেয়ের সাথে স্যার এই কাজ করেছে। ভয়ে মেয়েরা মুখ খুলেনা। যদি স্যার পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়। জেবা হয়ত এই কারনে আপনাকে সত্যিটা বলেনি।
—-রাইসা তুমি আমার উপর ভরসা রাখো। আমি এই ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত করবো। আমাকে একটু সময় দিতে হবে। আর এই ঘটনা তুমি আর কারো সাথে শেয়ার করো না। স্যারকে একটু এড়িয়ে চলবে। তুমিও স্যারের দিকে নজর রাখবে। এখন বারোটা বাজে। আর দুঘন্টা পর তোমাদের ছুটি হবে। তোমার মানসিক অবস্থা যেহেতু ভালো না তুমি বাসায় চলে যেতে পারো। আমি তোমার অবস্থা ভালোই বুঝতে পারছি।
রাইসা চলে যাবার পর সায়মা ভাবছে, আসলেই এই ঘটনার সুষ্ট তদন্ত হওয়া দরকার। হাশেম স্যার সম্পর্কে এরকম কানাঘুষা আগেও সায়মা শুনেছে। কিন্তু উপর মহলে হাশেম স্যারের ভালো প্রভাব আছে সেই কারনে এতো অপকর্ম করার পর শয়তানটা বেঁচে যায়। এইবার সায়মা আর কাউকে জড়াবে না। নিজেই এর ব্যবস্থা নিবে।

সায়মা নিজের জীবনের সুদুর অতীতে ফিরে গেলো। সায়মা বাবা ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ওদের বাড়ি ছিলো নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার গোলনা ইউনিয়নে। ওদের বাড়ীর পাশে বুড়ি তিস্তা নদী বয়ে যায়। সায়মাদের বেশীর ভাগ জমি বুড়িতিস্তা গিলে খেয়েছে। সব জমি নদীর পেটে গিয়ে সে সময় মাত্র চার পাঁচ বিঘে জমি ছিলো। তখন বছরে একবার চাষ হতো। ওদের জমির সাথে আরোও কিছু জমি বর্গা নিয়ে ওরা চাষাবাদ করতো।যে ফসল ওরা পেতো অনেক কষ্টে সেই ফসল দিয়ে বছর পার করতো। যার ফলে কাল্লুমিয়ার পড়াশোনা হয়নি। কোনো রকমে প্রাইমারী পাশ করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সায়মার বাবার বয়স বিশ বছর। ঐ সময় সায়মার দাদা ওর বাবাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। তখন স্বাধীনতা যুদ্ধের দামামা বেজে উঠে। দেশ মাতৃকার টানে সায়মার বাবা যুদ্ধে যেতে চায়। কাল্লুমিয়া বাপের কাছে বলে
—-বাপই মুই যুদ্ধোত যাইম।
—-বাউ পোয়াতী বউটাক থুইয়া তুই কেন যুদ্ধোত যাইস?
—বাপই তুই তো আছিস। মা আর মোর বউক দেখিস। মুই মোর বউটাক বুঝি কইম।
তারপর কাল্লুমিয়া যুদ্ধে চলে যায়। গ্রামে এই কথা আর চাপা থাকে না। এককান দুই কান হতে হতে রাজাকার কাশেমের কান পর্যন্ত পৌছে যায়। কাশেম ছিলো শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান। পাকিস্থানী মেজর জামশেদ খাঁকে কাশেম কাল্লুমিয়ার কথা বলে দেয়। তখন মিলিটারী এসে কাল্লুমিয়ার বাড়িতে হানা দেয়। কাল্লুর মা ওর বউকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী পাটক্ষেতে লুকিয়ে পড়ে। হানাদার মিলিটারীরা গুলি করে কাল্লুমিয়ার বাপের বুকটা ঝাঁঝরা করে দেয়। এরপর ওদের বাড়ী ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। কাল্লুর মায়ের চোখের সামনে স্বামীকে এভাবে রক্তাক্ত হতে দেখে। আর এতো বছরের গড়ে তোলা সংসারটাও এক নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পরে অবশ্য রাজাকার কাশেমকে মুক্তিযোদ্ধারা মেরে ফেলে। এইসব রাজাকারের জন্য অনেকের জীবনসংসার পুড়ে ছাই হয়েছে। মিলিটারীরা চলে যাবার পর কাল্লুর মা গ্রামবাসীর সহযোগিতায় কাল্লুর বাপের দাফন কাফনের ব্যবস্থা করে। কবর হয়ে গেলে পোয়াতী বউটাকে নিয়ে বালাগ্রাম ইউনিয়নে চলে যায়। নভেম্বর মাসে কোল আলো করে সায়মার জন্ম হয়। তারপর যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে বিজয়ের দিন ষোলই ডিসেম্বর নিজেদের ভিটায় ফিরে আসে। সব মুক্তিযোদ্ধারাই ফিরে আসে। কিন্তু সায়মার বাপের ফিরে আসা হয় না। দিন যায় মাস যায় বছরও চলে যায় একসময় ওরা মেনে নেয় কাল্লুমিয়া হয়ত আর ফিরে আসবে না। কোনোরকমে একটা ঘর তৈরী করে বউ আর নাতনীকে নিয়ে কাল্লুর মা আবারও জীবনে বেঁচে থাকার লড়াই শুরু করে। দুতিন বছর কোনরকমে পার হয়।কিন্তু তিস্তা আবার ভয়ঙ্করভাবে ভাঙ্গতে শুরু করে। এক রাত্রিতে ওদের ভিটা বাড়িও ভেঙ্গে যায়। তারপর ওরা ঢাকাশহরের পথে পা বাড়ায়। বস্তিতে বাসা ভাড়া নেয়। দেশের অবস্থা তখনও খুব একটা ভালো না। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ। তারপরও বেঁচে থাকার আশায় সায়মার মা শেফালী বেগম বুড়ি শাশুড়ী আর ছোটো সায়মাকে নিয়ে আবার বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু করে। এ লড়াই যেন কোনদিন শেষ হবার নয়।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here