লড়াই শেষ পর্ব

0
565

#ধারাবাহিকগল্প
#লড়াই
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী

কাঁপা কাঁপা হাতে সায়মা ডায়েরীর পৃষ্টা উল্টাতে লাগলো। হাসপাতাল থেকে চলে আসার দুদিন পর থেকে রাশেদ ডায়েরীতে লেখা শুরু করেছে। প্রথম পৃষ্টায় রাশেদ লিখেছে,

সায়মা
আমি জানি তুমি আমাকে খুব ঘৃনা করো। হাসপাতাল থেকে যেদিন তোমার সাথে বাড়ি ফিরে আসলাম সেদিন তোমার চোখে আমার জন্য ঘৃনা দেখেছি। সেদিন থেকে এই পৃথিবীতে আমার বেঁচে থাকার স্বাদ মরে গেছে। আমি মৃত্যু প্রহর গুনেছি।
তবে আমি তোমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করিনি। সেদিন মর্জিনা গাজীপুরে রিসোর্ট ভাড়া করে আমাকে বলে ও বোর্ড বাজারের কাছে মেইন রোডে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি যদি না যাই ও সারারাত ওখানেই থাকবে। অফিসে মিটিং ছিলো বলে মোবাইল বন্ধ রেখে ছিলাম। মোবাইল ওপেন করি বিকেল পাঁচটায়। ওর ম্যাসেজ দেখে আমি গাজীপুরে ছুটে যাই। ঐ সময় গাজীপুরের রাস্তায় অনেক জ্যাম। আমি সেদিন ছুটে গিয়েছিলাম অর্ণবের মাকে বাঁচাতে। যেদিন থেকে আমি তোমার সাহচর্যে এসেছি সেদিন থেকে মর্জিনা হারিয়ে গিয়েছে। কিছু কিছু জিনিস হারিয়ে ফেললে জীবনে স্বস্তি নেমে আসে।মর্জিনা ছিলো আমার সেরকম। বোর্ডবাজারে পৌঁছাতে সন্ধা সাতটা বেজে যায়। তারপর ওকে গাড়িতে তুলে বাসার পথে রওয়ানা হই। কিন্তু ও বাড়ি ফিরে আসবেনা। স্টিয়ারিং ধরে টানাটানি করার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা বাসটাকে পাশ কাটাতে গেলে গাড়িটা রাস্তার পাশে থাকা একটা বড় গাছে ধাক্কা খায়। মর্জিনার মাথাটা জোরে গাড়ির সাথে লেগে ফেটে যায়। এরপর আমার আর কিছু মনে নাই।
বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। তবে আমি তোমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করিনি।

সায়মার চোখের দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে আসলো। বুকের বাঁপাশটায় অন্তর্দহনে পুড়তে লাগলো।

এর পরের পেইজে লেখা
জানো সায়মা তোমার মা যেদিন আমাকে দেখতে আসলো আমার খুব ইচ্ছে হলো উনার কাছে মাফ চাই। কারণ আমি উনাকে কাজের বুয়া বলেছিলাম। আমার দুর্ভাগ্যে দেখো আজ আমার কথা বলার শক্তি নাই। তাই মাফ চাইতে পারলাম না। সেদিন আমার দুচোখ দিয়ে শুধু নোনা জল ঝরেছিলো। উনি আর তোমার বড় মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তুমি তখন কিচেনে উনাদের জন্য নাস্তা বানাতে গিয়েছিলে। আমি যখন এই পৃথিবীতে থাকবো না তুমি তখন আমার হয়ে উনার কাছে মাফ চেয়ে নিও।

_______

সায়মা যেদিন আমাদের বাবুটার জন্ম হয়েছিলো সেদিন খুশীতে আমার বুকটা ভরে গিয়েছিলো। কারণ তুমি আমাদের সন্তানকে পরিপূর্ণ মানুষ করে গড়ে তুলতে পারবে। তুমিতো সেই মায়ের সন্তান। আল্লাহপাকের অশেষ রহমতে তোমার মা তোমাকে রত্ন করে গড়ে তুলেছেন। ইনশাআল্লাহ তুমিও পারবে। আমি তো আস্তাকুড়ের আবর্জনা। তোমার স্বামী হওয়ার যোগ্যতা আমার ছিলো না। আমার তো মা ছিলো না। তাই পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারেনি।

______
সায়মা তুমি বলেছিলে, পাপ নাকি তার বাপকেও ছাড়ে না। আমি আমার জীবনে ঐ উপলব্ধি মৃত্যুর আগে পরিপূর্ণভাবে করে গেলাম। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।
——

সায়মা আমি তোমাকে এতো কষ্ট দেওয়া সত্বেও তুমি আমার অসুস্থতার সময় আমাকে অবহেলা কিংবা অযত্ন করোনি। ভালো হয়ত আমাকে বাসতে পারোনি কিন্তু তোমার দায়িত্ব তুমি ঠিক ভাবে পালন করে গিয়েছো। তোমার কাছে আমার কৃতঞ্জতার শেষ নেই। আমার বড় স্বাদ ছিলো তোমার সাথে ছেলে মেয়ে নিয়ে পরিপূর্ণভাবে সংসার করার। সবার সব ইচ্ছা কি পূরণ হয় বলো? হয় না। তাই আমার চাওয়াটাও অপূর্ণ রয়ে গেলো। তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। অর্ণবকে কোনদিন ওর মায়ের সম্পর্কে কিছু বলো না। মানুষ সব সহ্য করতে পারে। মায়ের কলঙ্ক নিতে পারে না।

সায়মা ডায়েরীটা আর পড়তে পারেনি। যেটুকু জানার ছিলো সেটুকু জানা হয়ে গেলে ডায়েরীটা যত্ন করে তুলে রেখেছে। ভাল হয়ত রাশেদ বাসতে পারেনি কিন্তু কোথায় যেন একটা মায়ার সুতো ছিলো। অর্ণব এসএসসি দিয়ে ও বাড়িতে ফিরে এসে সম্পত্তির দাবি করেছিলো। সায়মার শ্বশুর খুব বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন। দুটো ফ্লাের দুই নাতিকে লিখে দিয়েছিলেন। ফয়সল নাবালক হওয়ার কারনে ও সাবালক হওয়ার আগ পর্যন্ত সায়মা ঐ সম্পত্তি দেখাশোনা করবে। জামান সাহেবের যা কিছু ছিলো সমানভাবে দুই নাতিকে ভাগ করে দিয়েছেন। সায়মাকে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ও নিতে চায়নি।

শ্বশুর মারা যাওয়ার পর সায়মা আর ও বাড়িতে থাকেনি। ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু সম্ভব হয়নি। অর্ণবের সাথে ওর নানা নানী থাকতো। ওরা নানাভাবে সায়মার মায়ের পরিচয় নিয়ে অপমান করতো। আর মর্জিনার মৃত্যুর জন্য সায়মাকে দায়ী করতো। এই সব নানাবিধ কারনে ফয়সলকে নিয়ে সায়মা মায়ের কাছে চলে আসে। ফয়সল ছোটো থাকার কারনে চাকরিটা সামলাতে কষ্ট হতো। আবার সায়মার মা, বড়মাকে দেখার বাড়িতে কেউ নেউ। ওদেরও বয়স হয়েছে। প্রতিমাসে ওর শ্বশুর ফ্লাট থেকে ভাড়াটা নিয়মিত পেতো। তারপর একহাতে ফয়সলকে সায়মা আল্লাহপাকের অশেষ রহমতে বড় করে তুলেছে। অর্ণবও লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। ইদানিং মাঝে মাঝে সায়মাকে ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়। সায়মার চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। ফয়সলের ডাকে সায়মা বাস্তবে ফিরে এলো।
—কি এতো ভাবছো আম্মু। তোমাকে ডাকছি এতো কাছে থেকে যেন শুনতেই পারছো না। তোমার চোখে পানি কেন। আবার বাবার কথা ভাবছো? তোমাকে না নিষেধ করেছি আম্মু অযথা মন খারাপ করবে না।
আমরা বায়তুল মোকারমে চলে এসেছি।
—-তুই আজ আল্লাহর রহমতে স্বপ্নের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিস। সেই খুশীতে চোখে পানি এসেছো। অন্য কোনো কারণ নয়। কি অসম্ভব জ্যাম হয় এখন। কলাবাগান থেকে এখানে আসতে দুঘন্টার উপরে লেগে গেলো।
ওরা গাড়ি থেকে নেমে বায়তুল মোকারম থেকে কিছু ইলেক্টিক্যাল গুডস কিনে নিলো। তারপর বাড়ির পথে আবার রওয়ানা হলো। সায়মা গাড়িতে উঠে বললো,
—–তুই কাল আমার সাথে কলেজে যেতে পারবি?
—–মনে হয় পারবো। কাল একটু ফিরি আছি।
সায়মা বাসায় পৌঁছে তাড়তাড়ি ডিনার করে শুয়ে পড়লো। সকালে খুব ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে নিলো। তারপর ব্রেকফাস্ট করে ফয়সলকে সাথে নিয়ে কলেজের পথে রওয়ানা হলো।

এতো সকালে প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে দেখে দারোয়ান আক্কাস আলি অবাক হলো। কারণ তখনও রুমগুলো ক্লিন হয়নি। সায়মা অফিস রুমে বসে দারোয়ানকে ডেকে বললো,
—-টিচারদের রুমের দরজাগুলো খুলে দাও। আমি নতুন পর্দা বানাবো। কতগুলো পর্দা লাগবে আমায় দেখতে হবে। সবার কাছেই সায়মা বিষয়টা গোপন রাখলো। জানাজানি হলে হয়ত উদ্দেশ্য সফল হবে না।
আক্কাস রুমের দরজা খুলে দিয়ে চলে গেলো।কলেজের রুম গুলো ঝাড়ুদারকে দিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সায়মা ফয়সলকে সাথে নিয়ে ওনার কাজগুলো সেরে ফেললো। ফয়সল ইলেক্টিক্যাল কাজ কিছুটা হলেও জানে। তাই সায়মার একটু সুবিধা হলো। ফয়সল ওর কাজ কমপ্লিট করে বাসায় চলে গেলো।

রাইসা এসে সায়মার সাথে দেখা করে বললো,
—–ম্যাডাম স্যারের দৌড়াত্য মনে হয়ে আরোও বেড়েছে। স্যারকে বলছিলাম আমি উনার বিরুদ্ধে নালিশ করবো। উনি বলেছিলেন আমি নাকি কিছু করতে পারবো না।
—-রাইসা নারীদের জীবনটা এমনি। সারাজীবন লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। নিজের অধিকার আদায় করে নিতে হয়। নারীদেরকে মানুষ বলে না। বলে মেয়েমানুষ। আবার বাসে দেখবে প্রতিবন্ধিদের যেমন আলাদা সিট আছে। তেমনি নারীদের জন্য হাতে গোনা কটা সিট দিয়ে আলাদা সিটের ব্যবস্থা করে রেখেছে। কারণ এই পুরুষশাসিত সমাজে নারীকে মানুষের মর্যাদায় বসাতে কিছু নষ্ট মানসিকতার মানুষের বাঁধে। আমাদের লড়াই ওদের বিরুদ্ধে।
এই যে আমাকে দেখছো প্রিন্সিপালের চেয়ারটায় বসে আছি। আমিও জীবনে চলার পথে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছি। প্রতিবার নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করেছে। আমি সবসময় ভাবতাম হেরে যেতে আমি পৃথিবীতে আসিনি। আমাকে জিততেই হবে। প্রতিটি নারীকে তাই করা উচিত। আর একটা কথা মনে রেখো যুদ্ধে জিততে হলে দুই পা পেছাতে হয়। একটু ধৈর্য ধরো। জানোতো অপেক্ষার ফল সবসময় ভালো হয়।
রাইসা ম্যাডামের রুম থেকে বের হওয়ার পর ওর মন ও শরীরে যেন নতুন করে শক্তি সঞ্চয় হলো।

এর মাঝে কয়েক মাস কেটে গেলো। প্রফেসর হাশেম আবার তার ফর্মে ফিরে আসলো। প্রবাদ আছে কুত্তার লেজ কখনও সোজা হয় না। ওনার অবস্থাটা সেরকম। আবার নতুন শিকার ধরলেন। কিন্তু আক্রমন করার সাথে সাথে দরজায় ঠোকা পড়লো। হাশেম বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে দেখে ঘাবড়ে গেলো। ম্যাডাম মোবাইলে হাশেমের অবৈধ কার্যকলাপের ছবি দেখালো। কারণ ঐ রুমে সিসিটিভি একটা গোপন জায়গায় বসানো ছিলো। সায়মার মোবাইলে কানেকশন ছিলো। ম্যাডাম ওনাকে প্রমান সহকারে পুলিশের হাতে তুলে দিলো। কলেজের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো। মেয়েদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিটি ক্লাস রুম, টিচারদের রুম এমনকি পুরো কলেজ ক্যাম্পাস সিসিটিভির আওতায় আনা হলো। প্রিন্সিপাল সায়মা তার কর্মের জন্য শ্রেষ্ট শিক্ষকের মর্যাদা পেলো। মানুষের নীতি আর আদর্শ ঠিক থাকলে প্রতিটি লড়াই সাফল্যের মুখ দেখতে পায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here