#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ছয় |
————————
–“আমি দয়াবান মানুষ। তাই তোমায় আমার রুম ধার দিয়েছি। আমি তোমায় আমার রুম দিয়েছি বলে এই না যে তুমি আমার মাছ আর ফুল গাছে হাত দিবা! খবরদার!!”
এরকম উক্তি শুনে নওরি চমকে পিছে ফিরে তাকালো। দৃষ্টি নিচের দিকে দিয়ে দেখলো এক ছোট ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে। বয়স মিনিমাম সাত কী আট হবে। সে বর্তমানে দুই কোমড়ে হাত দিয়ে বড়ো মানুষ সাজার চেষ্টা করেছে। চোখে তার পাওয়ারের চশমা। নওরি বেশ অবাক হলো বাচ্চা ছেলেটির চোখে পাওয়ারের চশমা দেখে। এইটুকুনি বাচ্চার চোখের সমস্যা? কিছুটা আহত দেখালো নওরিকে। বড্ড মায়া হলো ছেলেটার প্রতি। কিন্তু ছেলেটি কে? ছেলেটি নওরির কোলে থাকা ফ্রিশাকে দেখে মুখশ্রীতে চিকচিক করে ফেললো। এগোতে গেলে পায়ের কাছে থাকা ব্যাগের সাথে উ’ষ্টা খেলো। ছেলেটি পরে যাওয়ার আগে নওরি ছেলেটিকে এক হাতে আগলে নিলো। অস্ফুট স্বরে বললো,
–“সাবধানে।”
সব ঠিক থাকলেও ছেলেটা উবুত হওয়ায় চোখের চশমা খুলে ফ্লোরে পরে গড়াগড়ি গেলো। কাঁচটাও শব্দ করে ভেঙ্গে গেলো। নওরি এবং ছেলেটি উভয়-ই সদ্য ভেঙ্গে যাওয়া চশমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ঠিক এরকম সময়ই নুরজাহান কক্ষে প্রবেশ করতে করতে বললো,
–“নিদ্র, কী শুনছি? তুই নাকি আবার মাজেদা খালার চশমা নিয়ে আসছিস? তোকে পইপই করে বলেছি পাওয়ারের চশমা পরলে চোখ নষ্ট হয়ে যাবে। শুনবি না আমার কথা?”
নিদ্র এবার আতঙ্কে ঘেমে-নেয়ে একাকার। মাজেদা দাদুর চশমা ভেঙ্গে গিয়েছে। মা এটা দেখলে আর মাজেদা খালা জানলে তাঁর সেই মোটা, শক্ত লাঠি নিয়ে নিদ্র’র পিছে ধাওয়া করবে। মাজেদা দাদীর বয়স বাড়লেও শক্তি এক বিন্দুও কমেনি। শুকনো ঢোঁক গিলে জিভ দ্বারা নিজের শুষ্ক অধর জোড়া ভিঁজিয়ে নিলো সে। নওরি একবার নূরজাহান তো আরেকবার নিদ্র’র দিকে তাকাচ্ছে। এর মানে কী নিদ্রের চোখে সমস্যা নয় বরং নিদ্র আরেকজনের চশমা পরেছিলো? নিদ্র নওরিকে ফিসফিস করে বলে,
–“চশমাটা একদম ভালো না। ঝাপসা দেখছিলাম।এজন্য পরে গেছি। আমি তোমার বিড়ালটাকে পরে আদর করব, এখন আমি পালাচ্ছি। ওকে?”
বলেই নুরজাহানের হাতের ফাঁক দিয়ে নিদ্র পালিয়ে গেলো। নুরজাহান নিদ্র’র দৌড় দেখেই বুঝেছে কোনো গোলমাল আছে৷ তাইতো আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কিছু খোঁজায় মনোযোগী হলো সে। নওরির পায়ের কাছে চশমা ভাঙ্গা দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি। নুরজাহানের দৃষ্টির ভঙ্গিমা দেখে নওরির হঠাৎ কলিজা শুকিয়ে এলো। আচ্ছা নুরজাহান কী তাকে দোষারোপ করবে? নিজের বাড়িতে যখন ছিলো তখন সুরভী একটা কিছু ভেঙ্গে ফেললে সৎ মাকে গিয়ে নওরির দোষ-ই দিয়ে দিত। সেই হিসেবে নওরির বড্ড ভয় লাগছে।
দেখা গেলো নওরির অনুযায়ী তেমন কিছুই হলো না। নুরজাহান রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
–“দেখেছো কান্ড? বড়ো হয়েও এর স্বভাব শুধরালো না। এখন মাজেদা খালাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কী যে করে না! ধ্যাত!”
নওরি হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। নুরজাহানের কথার উত্তরে বললো,
–“আমি পরিষ্কার করে দিই?”
–“এই না, না। তুমি আপাতত ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি বুয়াকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে নিবো।”
নুরজাহান চলে গেলো। নওরি ব্যাগ সরিয়ে ফ্রিশাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে শাসনের স্বরে বলে,
–“এখান থেকে নড়বি না একদম। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
ফ্রিশা কিছু শুনেছে বলে মনে হয় না। সে একমনে রুমের মধ্যে থাকা মাছভর্তি একুরিয়ামের দিকে তাকিয়ে আছে। মাছের খুদা পেয়েছে তাঁর। তাঁজা মাছের ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করলো সে।
———
নুরজাহান হচ্ছে নওরির মায়ের ঘনিষ্ঠ, প্রিয় বান্ধুবী। কিছু সম্পর্কে থাকে না আত্মার? তেমন-ই ছিলো দুজনের বন্ধুত্ব। দুর্ভাগ্যবশত নুরজাহানের বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। তাই সে অন্য শহরে চলে যায়। সেখানেই পড়াশোনা শুরু করে। দূরে গেলেও দু’জনের বন্ধুত্ব কমেনি এক বিন্দুও। নুরজাহানের দুই ছেলে এক মেয়ে। বড়ো ছেলে তুষার প্রবাসী। মেজো মেয়ে সারিফা এবং ছোট ছেলে নিদ্র। সৎ মায়ের সংসার থেকে নওরিকে সে বারংবার তাঁর কাছে চলে আসতে বলেছিলো। কিন্তু নওরি শুনেনি। কারণটা ছিলো রাফিয়া। সে রাফিয়াকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। নুরজাহান একবার বলেছিলো নওরির নামটা সে-ই দিয়েছিলো। জম্ম হতে দেখেছে নওরিকে। নওরির পুরো নাম “নওরিয়াভ তাফরিন”। এমতাবস্থায় নুরজাহানের ব্যবহার সেই আগের মতোই মিষ্টি এবং মাধুর্যতায় ঘেরা। বড্ড অবাক লাগে, রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও বুঝি কেউ কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারে?
রাফিয়া তাকে মা!রার পর সেদিন রাতেই মনে পরে যায় নুরজাহান আন্টির কথা। নুরজাহান আন্টি মাঝেমধ্যেই নওরির বাবাকে কল করে কুশল বিনিময় করতো। এর মাঝে সুযোগ বুঝে নওরিকে নিজের কাছে রাখার প্রস্তাবও দিতেন তিনি। কিন্তু নওরির বাবা তাকে বারবার প্রত্যাখানের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
নওরির নুরজাহান আন্টির কথা মাথায় এলেও নওরি পরেছিলো দোটানায়। সে তখনও রাফিয়াকে ছেড়ে অচেনা কোথাও যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলো না। পরেরদিন ফজরের সময় নওরি তাঁর বাবার ফোন চুরি করে নিজের রুমে গিয়ে নুরজাহান আন্টির সাথে কথা বলেছিলো। নুরজাহান আন্টির কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হলেও কোথাও একটা দোটানা থেকেই যেত। পরেরদিন বাজার করে ফেরার সময় যখন প্রিতমের কথাগুলো শুনলো, তখনই নওরি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে যে সে পালাবে। পালাতে নওরি বাধ্য। কারণ, প্রিতমের কথাবার্তায় বেশ ভালোভাবেই বুঝে গেছে এই ছেলে তাকে বিয়ে করবেই। অন্তত রাফিয়াকে শিক্ষা দিতে হলেও। নওরি চাইলেই থেকে যেতে পারতো তবে সে থাকেনি। কারণ দুটো। এক, প্রিতমকে বিয়ে করলে রাফিয়ার কথা সত্যি হয়ে যেত আর দুই, নওরি কারো জন্য বলির পা’ঠা হতে চায় না। এজন্য বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়েই মাহির বাসায় চলে যায় সে। পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তও জানায়। মাহি বলেছে সন্ধ্যার পরে এ বিষয়ে আলোচনা করবে।
নওরিও রাজি হয়ে যায়। তবে মাহি এটা নিশ্চিত করে যে সেদিন রাতের মধ্যেই পালাতে হবে। কারণ, হতেও পারে প্রিতম পরেরদিন কিছু গোলমাল পাকাবে। তাই নওরিও রিস্ক নিলো না। মাহির পরিকল্পনা মাফিক সেদিন-ই পালালো।
————-
মৌসুমি মাথায় হাত দিয়ে সোফাতে বসে আছে। টিভি চললেও দৃষ্টি তাঁর মাটির দিকে। বড্ড এলোমেলো এবং চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। তার থেকে কিছুটা দূরত্বে বসেই চায়ের কাপে সুখ চুমুক বসাচ্ছে সিদ্দিক সাহেব তার যেন মৌসুমীর অবস্থা দেখে কোনরকম মাথাব্যাথাই নেই সে তার মত ব্যস্ত ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিচ্ছে সিদ্দিক সাহেব। ক্ষণিক পরপর কোণা নজরে স্ত্রীকে লক্ষ্য করছে সে। সিদ্দিক সাহেব হঠাৎ বললেন,
–“কী বেগম? পছন্দের সিরিয়াল চোখের সামনে থেকেও ফ্লোরে তাকিয়ে আছো? এ যে বড়োই আশ্চর্যজনক ব্যাপার!”
মৌসুমি নজর তুলে সিদ্দিক সাহেবের দিকে তাকালো। রাঙানো দৃষ্টি। সিদ্দিক সাহেব তড়িৎ অন্যদিকে ঘুরে যায়।
–“আপনি কী টিপ্পনী কাটছেন?”
–“ওমা! তা কেন কাটবো? তুমি কী টিপ্পনী কাটার মতো কিছু করেছো?”
মৌসুমি নড়েচড়ে বসে নাক টেনে মিনমিন স্বরে বলে,
–“যেমন বাপ তেমনই ছেলে।”
–“কিছু বললা বেগম?”
–“নাহ! আপনার মতোন মহান ব্যক্তিকে কিছু বলতে পারি? মহান যেহেতু হয়েছেন ছেলেটাকে বিয়ের কথাও বলুন। আমাকে খালে ফেলে গুহায় গিয়ে ঘুমালেই তো হবে না!”
সিদ্দিক সাহেব ঠোঁট চেপে হাসলেন। শূণ্য কাপ টি-টেবিলের উপর রেখে পত্রিকাটি হাতে তুলে নিলেন তিনি। পত্রিকার পড়ায় ধ্যান দিয়ে গমাগম স্বরে বলে,
–“তোমার কী মনে হয়? ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দিলেই ঘরে ফিরে আসবে?”
–“আসবে৷ আমার ছেলেটা অন্তত এই মা!রপিট ছাড়বে। আমি আমার একমাত্র ছেলেকে এত শত্রুদের মাঝে ফেলে রাখতে পারি না।”
–“ঠিকাছে, পারলে বিয়ে করাও। আমি কোনো পক্ষে নেই!”
নিদ্র ছুটে এসে সিদ্দিক সাহেবের গা ঘেঁষে বসলো। পরপর সিদ্দিক সাহেবের ফতুয়া খামচে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
–“বড়ো আব্বু! আমায় বাঁচাও। মা নাহয় আজ কাচা গিলে খাবে আমাকে। তুমি-ই বলো, আমি কী খাওয়ার জিনিস?”
–“কেন? আবার কী বাঁদরামী করেছিস শুনি?”
মৌসুমি পুরো কথা শেষ করতে না করতেই ভেতর থেকে কর্কশ কন্ঠে কেউ চেঁচিয়ে উঠলো,
–“ওই আমার চশমা কই রে? সুদ্দু! আমার চশমা কই? কে ডাকাতি করলো আমার চশমা?”
নিদ্র শুকনো ঢোঁক গিললো। বাঘের খাঁচাতেই এসে ধরা দিয়েছে সে? মৌসুমি চশমার কথা শুনে সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নিদ্র’র দিকে। ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে বললো,
–“মায়ের চশমা না তোর হাতে দেখেছিলাম নিদ্র? চশমা কোথায়?”
নিদ্রের এবার কপালে ঘাম জমেছে। বিন্দু বিন্দু। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে মিনমিন করে বলে,
–“তুমি তাত্তাড়ি এসে আমায় বাঁচাও নিদ্র ভাইয়া।”
–“কী হলো? কী ফিঁসফিঁস করছিস? উত্তর দে!”
–“উত্তরটি হচ্ছে আমি চশমা নিয়ে এসেছি। লিটল নিদ্রা! যাও বাসায় যাও। চাচী কিচ্ছু বলবে না তোমাকে।”
ইরা’দ এসেছে। ইরা’দকে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেলো নিদ্র। এক ছুটে ইরা’দের কাছে চলে গেলো। ইরা’দের কোমড় জড়িয়ে বলে,
–“আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম নিদ্র ভাইয়া। কই ছিলে তুমি?”
–“ভয় পাওয়ার কাজ আর করবে না। ঠিক আছে?”
নিদ্র দ্রুত গতিতে মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। ইরা’দের পুরো নাম ইরা’দ আরনাফ নিদ্র। যখন এই ভাই এসেছে তখন ইরা’দ নিদ্রকে লিটল নিদ্রা বলে ডাকে। সেই হিসেবে নুরজাহানও নাম রাখে নিদ্র। তবে ইরা’দ নিদ্রা বলে ডাকে নিদ্রকে। আর যায়হোক, ইরা’দের সার্টিফিকেট তো কেউ আর দেখতে যাবে না। থাকুক না দুটো নিদ্র। তাতেই বা কী আসে যায়? একজন নাহয় বিগ নিদ্র আর অপরজন লিটল নিদ্র। সিদ্দিক সাহেব অবশ্য এখনো ইরা’দকে নিদ্র বলেই ডাকে৷ এই স্বভাব তাঁর ভালো লাগার, ভালোবাসার।
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
————————
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
রিচেক দেয়া হয়নি। ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। দুঃখিত আজ ব্যস্ত থাকায় বেশি লিখতে পারিনি। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।