#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ০৭ |
——————–
মাজেদা বেগম হচ্ছেন মৌসুমির মা অর্থাৎ সিদ্দিক সাহেবের ফুপ্পি। তাদের বিয়েটা পারিবারিক-ই হয়েছিলো। মাজেদার ছেলে’রা যার যার মতো ব্যস্ত। তাদের কারো বউ-ই তাকে নিজের ঘরে তুলেনি। আলগা বোঝা ভেবে সকলেই ছিলো বিরক্ত। তাঁর উপর মাজেদা বেগমের কর্কশ, ধারালো কন্ঠস্বর। তেঁতো কথাবার্তা কেউ-ই মানতে পারে না। এমতাবস্থায় মাজেদা বেগম এই বৃদ্ধ বয়সে কোথাও ঠায় না পেয়ে অবশেষে মেয়ের বাড়িতে ঠায় পেলেন। ছেলে’রা তাকে বের করে দিয়েছেন এ নিয়ে দিনে অন্তত তিন বেলা করে বিলাপ করে না ব!কলে যেন পেটের ভাত তাঁর হজম হয় না। তাঁর একটি লাঠি আছে। শক্ত-পোক্ত, বেশ সুন্দর একটি লাঠি। এটা চোর তাড়াতেও বেশ কার্যকরী। মাজেদা বেগমের এই লাঠিটি মাঝে মধ্যে ইরা’দ ও নিয়ে যায়, মা!রপিটের জন্যে। এটা অবশ্য ইরা’দ এবং মাজেদা বেগমের বাইরে কেউ জানে না।
মাজেদা বেগম হাঁতড়ে চশমা খুঁজছেন বারংবার। খোঁজার মুহূর্তে হঠাৎ তাঁর হাতে চশমা ধরিয়ে দিলো ইরা’দ। মাজেদা বেগম দ্রুত চোখে চশমাটা দিয়ে দিলো। চোখে চশমা না থাকলে চোখে যেমন ঝাপসা দেখে তেমনই মাথায় চিনচিন ব্যথা ওঠে। মাজেদা বেগম চশমার এক অংশ ধরে ইরা’দের দিকে সন্দিহান নজরে তাকিয়ে জিজ্ঞাসাসূচক কন্ঠে বলে,
–“এগুলা কী!? তুই আমারে আরেক চশমা দিছোস ক্যা?”
–“আহা নানু! এক চশমায় আর কতদিন চলবা? নতুন কিছুরও তো স্বাদ নিতে হয় নাকি?”
মাজেদা বেগম কপালে দুটো ভাঁজ ফেলে বলে,
–“নতুন চশমা?”
–“হ্যাঁ, তোমার জন্যে। আমি নিজে কিনেছি। নতুন কিছুর স্বাদ নাও এবার!”
–“এইডা তো ভুল কস নাই! দেহি, আয়নাডা আন তো। আমারে ক্যামন দেহায় দেহি?”
ইরা’দ মুচকি হেসে মাঝারো সাইজের আয়নাটা মাজেদা বেগমের দিকে নিয়ে এসে বলে,
–“একদম জোয়ান হয়ে গেছো নানু!”
মাজেদা বেগম যেন ফুলে-ফেঁপে ওঠলেন। আগের চশমার কথা আগেই যেন ভুলেই গেলেন। চোখ-মুখে মিছে লাজুক ভঙ্গি এনে বলে,
–“অনেকদিন পর একখান সুন্দর কতা কইলি! যাহ, খাওয়া – দাওয়া কর, বাইরে থেইকাই তো আইসোছ!”
–“হ্যাঁ নানু। যাচ্ছি।”
বলেই ইরা’দ তাঁর রুম থেকে চলে গেলো। চশমার কথা নূরজাহান-ই প্রথমে ইরা’দকে কল করে জানিয়েছিলো বিধায় আজ রক্ষা হলো। নয়তো তুলকালাম বাঁধতো যেন আজ।
বৃদ্ধ কঠিন মাজেদা বেগমের মুখে হাসি। অমায়িক হাসি। ইরা’দ-ই একমাত্র তাকে ভালোবাসে। তাঁর খেয়াল রাখে। নয়তো আজ পর্যন্ত কেউ তো বলেনি, “চশমা বদলাও।” কিন্তু মাজেদা বেগম তো আর জানেন না ভেতরের রহস্য। মাজেদা বেগম আয়না দেখতে দেখতে হঠাৎ শক্ত হয়ে গেলেন। মুখের হাসি উধাও হয়ে গেলো তার। কাঠ কাঠ গলায় আপনমনে বিড়বিড়ালো,
–“কই আমার প্রাণের টুকরা নিদ্র আমারে কতকিছু দেয় আর ওদিকে খ!বিশ, খা!চ্চর পোলার বউগুলা কিছু দিবে তো দূর উল্টো বাড়ি থেকেই বের করে দিলো। ঠা!ডা পরবে ঠা!ডা। এই বুড়ির কথা মিলায় নিস!”
———————
নওরি রুমের এদিক থেকে সেদিক পায়চারী করছে। খেয়েছে আধঘন্টা হলো। তাঁর মস্তিষ্কে বিচরণ করছে বিরাট কৌতুহল। কৌতুহল ইরা’দকে নিয়ে। রাস্তায় আসার সময় বেশ কয়েকটি পোস্টার দেখেছে সে। সেই পোস্টার গুলোতে স্পষ্ট দৃশ্যমান ছিলো ইরা’দের বড়ো ফটো। কে এই ইরা’দ? বড্ড ভাবাচ্ছে নওরিকে। আফসোসও হচ্ছে তাঁর। কেন যে একটু পোস্টারগুলো পড়ে দেখলো না। খুদায়, তৃষ্ণায় এবং ফ্রিশার চিন্তাতে একপ্রকার কাহিল ছিলো সে। কী করেই বা এতদিকে খেয়াল করতো? ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে নওরি। গভীর নিঃশ্বাস। এর মাঝে নিদ্র এসে প্রবেশ করলো নওরির রুমে। নিদ্রকে দেখে নওরি থেমে গেলো। নিদ্র কোমড়ে দুই হাত গুঁজে এদিক ওদিক উঁকি মেরে বলে,
–“তোমার সুইট বিড়ালটা কোথায়?”
নওরি নিদ্রকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলে,
–“বারান্দায়।”
–“ওকে।”
নিদ্র বারান্দার দিকে যেতে নিলে হঠাৎ থেমে যায়। নওরির দিকে ফিরে ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে বলে,
–“ভয় পাচ্ছো কেন তুমি?”
নওরি থতমত খেয়ে যায় নিদ্র’র কথায়। নিদ্র কী রকম করে যেন তাকিয়ে আছে নওরির দিকে। নওরিকে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত নিদ্র। নওরিকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বলে,
–“ভালো কথা, নাম কী তোমার?”
–“নওরি..।”
–“নৌরি ফুল?”
–“মৌরি ফুলের কথা বলছো?”
–“না, ওটার বানান ভুল। আমার তো নৌরি ফুল-ই বলতে ভালো লাগে।”
নিদ্র’র উদ্ভট কথাবার্তায় নওরি চমকে তাকিয়ে রয়।
–“ফুলটা দেখেছো?”
নিদ্র হঠাৎ মুখ ভার করে বলে,
–“না। কখনো নৌরি ফুল দেখিনি। কোথায় পাওয়া যায়? ঘ্রাণ কেমন? তোমার মতোন? ভীতু চেহারার?”
নওরি এবারও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এই ছেলে বড্ড কথা বলে। তবে বাঁদর টাইপ না। নওরির ভালো-ই লাগছে। এই ছোট্ট সদস্যকে ভীষণ ভালো লাগছে। নওরি অমায়িক হাসি দিলো। যেন নিদ্র’র শেষোক্ত বাক্যে ভীষণ মজা পেয়েছে।
–“আসো। আমরা বসি। খুব গল্প করবো। অনেকদিন পর গল্প করার মানুষ পেয়েছি।”
—————-
ফ্রিশা দুনিয়া ভুলে বারান্দা এবং বাহিরটা দেখতে ব্যস্ত। সটান মেরে বসে পিটপিট করে সবটা দেখছে। মাঝারো সাইজের বারান্দার এক পাশে ফুল গাছে ভর্তি। বারান্দায় সিক নেই। ফ্রিশা তাই খোলা আকাশে নজর বুলাচ্ছে। আশেপাশে তাকিয়ে নতুনত্ব অনুভব করছে। আরেক দুনিয়ায় এসে পরলো নাকি? কে জানে?
——–
নওরি তাঁর কাপড়ের ব্যাগ থেকে জামা-কাপড় বের করছে। একটা জামাও ঠিক নেই। পুরাতনের ছাপ। এগুলো নওরির কত বছর আগের জামা-কাপড় তাঁর জানা নেই। চাঁদটা ভালো জামা আছে, একদম নতুন। দুইটা ইদের এবং দুইটি মাহির দেয়া উপহার। খিব যত্নে আগলে রেখেছিলো এই চারটি জামা। বাহিরে যাওয়ার পোশাক হিসেবে এই চারটি-ই ভরসা। আজ একটি পরে আসলো এখন ব্যাগে আছে আরও তিনটি। নওরি জামা-কাপড় বের করার সময় হঠাৎ দেখলো ফোনের বক্স। নওরির মস্থায় এলো ফোনের কথা। দ্রুত ফোনের বক্সটি হাতে নিলো সে। এটি মাহির দেয়া এন্ড্রোয়েড ফোন। খুব বেশি পুরাতন নয়। মূলত মাহি এই ফোনটা কেনার প্রায় ছ’মাস পরই তার এক খালু বিদেশ থেকে ফোন পাঠায়। সেজন্যে এই ফোনটি আর ব্যবহার করেনি মাহি। নওরির কাজে দিবে ভেবে নওরিকেই ফোনটি দিয়ে দেয়। নওরি নিতে চায়নি। মাহি ধমকি-ধামকি দিয়ে নওরির দিকে ধরিয়ে দিয়েছে। এবং কাঠ কাঠ গলায় বলে,
–“বোনের থেকে বোনের জন্যে উপহার। এতে এত ত্যাড়ামি করলে থা!প্পড় খাবি! তুই কেন বুঝিস না আমার ছোট বোনের জায়গাটা আমি তোকে দিয়ে দিয়েছি। তোর প্রতি আমার দয়া নেই, দয়া করে এ পর্যন্ত কিছুই দেইনি। তোর জন্যে আমার ভাবনা আপনজনের মতো। হয়তো রাফিয়ার মতো তোর আপন বোন নই, কিন্তু তুই আমার আত্মার সাথে মিশে গেছিস।”
নওরি ছলছল নয়নে মাহির দিকে তাকিয়ে ছিলো শুধু। মাহির মতো কেউ বুঝি এত ভালোবাসতে পারে বুঝি? আজ সে তাঁর এই মাহি বোনের থেকেই এত দূরে। অতীত ভাবতেই বুকের বা পাশটা চিনচিন করে উঠলো। বক্স খুলে ফোন বের করতে গিয়ে দারুণ চমকালো নওরি। এইতো, নওরির সব টাকা। এর মানে কী চুরি হয়নি টাকা? নওরির এবার সব মনে পরে যায়। ফোনের সাথেই হাতে নওরির টাকাগুলো ছিলো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফোন রাখতে গিয়ে টাকাটাও ভুলবশত এই বক্সে রেখে দিয়েছিলো সে। টিকিট মাহি কিনে দিয়েছিলো বিধায় এই টাকাগুলোর প্রয়োজন পরেনি। নওরি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। যেদিন সে রোজগার করবে, প্রথম মাসের টাকা দিয়ে সর্বপ্রথম মাহির জন্যে উপহার কিনবে। এই মানুষটা তাঁর অতি প্রিয় এবং আপন মানুষ। নওরি টাকাগুলো সহি-সালামতে রেখে ফোনটা অন করে মাহিকে কল দিলো। সিমটাও মাহির। মাহি সাথে সাথে রিসিভ করলো যেন নওরির কলের অপেক্ষায় ছিলো।
–“ফাইনালি কল দিলি। আমার তো প্রাণ বেরিয়ে আসছিলো দুশ্চিন্তায়। কেমন আছিস? ঠিকমত পৌঁছাতে পেরেছিস তো?”
নওরি আপনমনে বলে ওঠে,
–“এত কেন ভালোবাসো তুমি আমায় মাহি আপা?”
মাহি হকচকালো, চমকালো। বিস্মিত কন্ঠে শুধায়,
–“মানে?”
–“এতকিছু দিয়েছো, এত সাহায্য করেছো। ঋনের বোঝা যে বাড়িয়ে দিলে!”
–“চুপ! কিসের ঋন? সব ঠিকাছে। বড়োদের মতো কথা বললে পি!টাবো। যা প্রশ্ন করেছি তাঁর উত্তর দে।”
–“হ্যাঁ, পৌঁছিয়েছি।”
–“তোর ওই আন্টির ব্যবহার কেমন?”
–“খুব ভালো। আমার প্রত্যাশার বাইরে।”
–“যাক নিশ্চিন্ত হলাম।”
–“বাসার সবাই কেমন আছে? আমার খোঁজ করেছে?”
–“এতকিছু তো জানি না। দাঁড়া তোর ওই সুরভীর পেট থেকে সব বের করব। সব জেনে তোকে জানাবো। আচ্ছা?”
–“ঠিকাছে আপু। তুমি ভালো থেকো।”
–“তুইও ভালো থাকিস। এখন তোর নতুন লড়াই। কঠোর পরিশ্রম দ্রুত এডমিশন দিয়ে ভালো একটা পাবলিক ভার্সিটিতে ভর্তি হবি৷ তোকে ভালো থাকতে হবে রে নওরি। মানুষদের মুখে আঙুল তুকে দেখাবি তোর নতুন রূপ। ভীতগ্রস্ত মুখটা আর দেখতে চাই না আপু।”
–“ভালো কথা মনে করালে। জানো আজ,..”
–“থেমে গেলি কেন? বল!”
–“অচেনা ছেলের সাথে আজব ব্যবহার করে ফেলেছি আপা।”
বলেই সমস্ত ঘটনা খুলে বললো নওরি। সব শুনে মাহি কিছু ভেবে বলে,
–“চার দেয়ালের কষ্ট সইতে সইতে তোর মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে নওরি। এটা মোটেও উদ্ভট ব্যবহার নয়। বরং তোকে এমনটাই হতে হবে। হোক দুশ্চিন্তায় তুই তোর লিমিটেশন হারিয়ে ফেলিছিলি। বাট আই সয়্যার নওরি, তোকে এরকমটাই হতে হবে। শান্ত, ভদ্র থাকলে তোর সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।”
—————
খাবার টেবিলে নূরজাহানের পরিবারের সঙ্গে বসেছে নওরি। ইতস্ততায় হাঁটু কাঁপছে তাঁর। অস্বস্তিতে শক্ত হয়ে বসে সকলকে দেখছে সে। একসঙ্গে টেবিলে খাওয়ার অনুভূতি তাঁর প্রথম হচ্ছে। তাও আবার ভিন্ন এক পরিবারে, যেই পরিবারে নওরি বর্তমানে আশ্রিতা। লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে রয় নওরি। ফ্রিশা ডাইনিং টেবিলের নিচে নওরির পায়ে বসেছে। গাঢ় লোমে বেশ সুড়সুড়িও লাগছে তাঁর। এছাড়া নূরজাহানের হাসবেন্ডের নজর ভালো না। কী রকম অসন্তোষ ভাব তাঁর। যেন নওরিকে দেখে খুব একটা সন্তুষ্ট নয়। হঠাৎ সারিফার কথায় নওরির ধ্যান ভাঙ্গে।
–“কী হলো আপু? খাচ্ছো না?”
নওরি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
–“খা..খাচ্ছি!”
———————–
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
রিচেক দেয়া হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। লিখতে পারছি না কাল থেকে। গতকাল গল্প দেয়ার কথা থাকলেও ৬২+ এর বেশি এগোতে পারিনি। সারাদিন একটু একটু করে এইটুকুনি-ই লিখতে পারলাম। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। আপনারা রেসপন্স করবেন প্লিজ।