#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২২
“আমি তখন মেডিকেলে ইন্টার্নি করছিলাম। পড়ালেখায় বেশ মনোযোগী ছিলাম। কোনো মেয়ের দিকে তকাতাম না।প্রেম ভালোবাসায় মোটেও বিশ্বাসী ছিলাম না। মনে হত এসব পাগলের কান্ড কাহিনি।পড়াশোনার বাইরে কোনো কিছু ভাবতেই পারতাম না। নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখতাম বইয়ের গন্ডিতে। বেশ ভালোই কাটছিল আমার দিনকাল।
আমি একটা বাসা ভাড়া নিয়ে মেডিকেলের কাছেই থাকতাম।কেন জানি না হলের খাবার গলা দিয়ে নামত না। তাই আলাদা বাসা ভাড়া করে নিজেই কোনোরকমে রান্না করে খেতাম। একদিন বাসা থেকে বের হয়ে একটা বিষয় লক্ষ্য করে বেশ অবাক হলাম।
লক্ষ্য করলাম একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একা একা কী যেন বিড় বিড় করছে। এমন ভাবে বিড়বিড় করছে মনে হচ্ছে কারও সাথে কথা বলছে। মেয়েটা যে আহামরি সুন্দর ছিল তা না। তবে মেয়েটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগছিল। আশ্চর্যের একটা বিষয় হলো মেয়েটা খালি পায়ে ছিল আর হলুদ রঙ এর থ্রি পিস পড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়েটাকে খালি পায়ে দেখে বেশ অবাক হলাম। একটা মেয়ে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে তার উপর পরিপাটি কাপর-চোপর পড়া, তাই বিষয়টা কেমন জানি অদ্ভুত লাগছিল। কোনো মেয়েকে দেখে আমার কখনও অনুভূতি জাগে নি তবে সে মেয়োটাকে দেখে মনের ভেতর বেশ একটা অনুভূতি জাগল। তাই আস্তে করে মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঠিক এ মুহুুর্তে একটা চোরের আগমন ঘটল। আগে দেখতাম বাংলা সিনেমাতে নায়ক নায়িকার পাশে দাঁড়ালে নায়িকার ব্যাগ চুরে চুরি করে নিত। আর নায়িকা চিল্লানি দিতে থাকত তারপর নায়ক ব্যাগটা উদ্ধার করে নায়িকা কে দিত। অতঃপর তাদের মধ্যে প্রেম হয়ে যেত।এখন দেখি বাস্তবেও চুরের আগমণ ঘটেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় এটা ছিল যে চুরটা মেয়েটার ব্যাগটা নিয়ে দৌড় দিলেও মেয়েটা তেমন কোনো কিছুই করে নি। আমি মেয়েটাকে দেখে বোকা বনে গেলাম। কারণ এ মেয়েটার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে এতক্ষণে চোর চোর বলে চিল্লানি দিত। কিন্তু মেয়েটা বেশ শান্ত হয়েই দাঁড়িয়ে আছে ঠিক যেমনটা ব্যাগ চুরির আগে দাঁড়িয়ে ছিল। একটু সাহস করে মেয়েটার কাছে গেলাম। কাছে গিয়ে বললাম-
“আপনার ব্যাগে কী কিছু ছিল না!”
মেয়েটা গড় গড় করে উত্তর দিল
“ব্যাগে তিন হাজার টাকা,দুইটা বই,একটা খাতা,আর আমার মোবাইলটা ছিল।”
মেয়েটার জবাব শুনে আরও আশ্চর্য হলাম।এতকিছু থাকার পর মেয়েটা কিছুই করল না।মেয়েটার তো এতক্ষণে চিল্লানি দিয়ে রাস্তা উজাড় করার দরকার ছিল।অথচ মেয়েটা একটু হতাশও হল না।
একটু ভয় ও হচ্ছিল মেয়েটাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে।কারণ ঐভাবে কোনো মেয়ের সাথে আগে কখনও কথা বলে নি তো তাই।তবুও পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম-
” আপনার এতগুলো জিনিস চুরে নিল আপনার কি কোন মায়া লাগছে না?”
মেয়েটা একটা মুচকি হাসি দিয়ে হাঁটা শুরু করল।কোনো পাত্তায় দিল না আমার কথায়।আমারও বেশ রহস্যময় একটা চরিত্র মনে হলো মেয়েটাকে।তাই মেয়েটার পিছন নিলাম।মোটকথা মেয়েটার পেছন নিয়ে মেয়েটাকে এক প্রকার বিরক্তই করছিলাম।খেয়াল করলাম মেয়েটার মুখে তেমন কোনো বিরক্তরে ছাপ নেই।মনে মনে ভাবলাম এ কি আজব মেয়ে নাকি।অনেক বকবকানির পর মেয়েটা যা উত্তর দিল তা শুনে আমি একদম হতবাক।এত পাগল মেয়েও হয় জানা ছিল না।কারণ মেয়েটা উত্তরে বলল-
“আমি লেডি হিমু আর লেডি হিমুদের এমন সামান্য বিষয়ে হতাশ হলে চলবে না। চুরির পর আটকালেই কী চোরকে ধরতে পারতাম? নাহ ধরতে পারতাম না। শুধু শুধু সময় নষ্ট হত । হতাশ হলেই বা কী ব্যাগ তো ফিরে পাব না। আর বাকি রইল এত বিরক্ত করছেন তবে কেন বিরক্ত হচ্ছি না। তাহলে শুনুন লেডি হিমুরা এত স্বাভাবিক বিষয়ে বিরক্ত হয় না ।”
মেয়েটার কথাগুলো শুনে হাসিতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা আমার।আমি হাসি সামলাতে না পেরেই বেশ জোরেই হাসি দিলাম।মেয়েটা আমার হাসি দেখে আশ্চর্য না হয়েই হাঁটা শুরু করল।আমি তখন মনে মনে ভাবলাম হুম লেডি হিমুদের এমন হাসিতে আশ্চর্য হওয়া বারণ।এদিকে ঘঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেশ দেড়ি হয়ে গিয়েছে।তাই দেড়ি না করেই মেডিকেলে যাওয়ার জন্য রওনা দিলাম।
কেন জানি না শত কাজের মাঝেও মেয়েটার মুখটা ভেসে আসছিল।কেন জানি মেয়েটাকে দেখার জন্য মনটা আকুল হয়ে যাচ্ছিল।আমার মতো ছেলের একটা মেয়েকে এভাবে ভালো লেগে যাবে কখনও বিশ্বাস করতে পারতাম না।মনে হচ্ছিল এ এক অন্যরকম আমি।সারাদিন মেডিকেলে থেকে কাজ শেষে বাসায় যাওয়ার পর ও মেয়েটার মুখ অদ্ভুত ভাবে চোখে ভাসতেছিল।কোনোকাজেই যেন মন বসছিল না।পড়াশোনায়ও মন দিতে পারছিলাম না।ঐদিকে বিসিএস এর রেজাল্ট টা এখনও ঝুলে আছে।সারারাত পার করলাম এভাবে।পরদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়েই সে মেয়েটাকে আবার দেখলাম।দৌঁড়ে গেলাম মেয়েটার পাশে।
খেয়াল করলাম আজকে মেয়েটা বেশ স্বাভাবিক ভাবে বের হয়েছে।মেয়েটার স্বাভাবিক ড্রেসআপ দেখে একটু আশ্চর্য হলাম।মেয়েটাকে একটু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
“এই যে লেডি হিমু, আজকে যে জুতা পড়ে বের হলেন কারণ কী? হিমুরা তো খালি পায়ে হাঁটে।আপনার পায়ে জুতা কেন?”
মেয়েটা আমার দিকে রাগ নিয়ে তাকিয়ে বলল-
“আপনার কোনো সমস্যা?”
আমি এবার মেয়েটার চোখ দুটো খেয়াল করলাম অসম্ভব মায়া মাখা চোখ।কিসের সাথে তুলনা করলে ভালো হবে জানি না।তবে মেয়েটার চোখ গুলো আমার কাছে কেন জানি না গরুর চোখের মতো বড় বড় আর টানা টানা মনে হয়েছে।গরুর চোখে যেমন কাজল কালো রেখা থাকে তেমনি মেয়েটার চোখেও রয়েছে কাজলের ছটা। এর চেয়ে ভালো উপমা আমার কাছে জানা নেই। আমি মেয়েটার চোখ দুটো দেখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাহস দেখালাম না। কারণ কখন যে আবেগে ডুবে যায় বলা যায় না। তাই আমার চোখ দুটো নীচে নামিয়ে ফেললাম কিছুক্ষণের জন্য। তারপর নিজেকে সামলিয়ে পুনরায় মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম-
“আমার তো কোনো সমস্যা নেই। তবে কালকে এক বেশে দেখলাম আর আজকে আরেক বেশে তাই মনে প্রশ্ন জাগল আর কি।”
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
” সময় আছে আপনার কাছে।”
একটা অপরিচিত মেয়ে সময় জিজ্ঞেস করছে ব্যপারটা নিয়ে একটু চমকে গেলাম। চমকে গিয়েও নিজের চেহারায় সেটার প্রতিচ্ছবি আনলাম না। খুব ভদ্রভাবে মেয়েটাকে বললাম
“নাহ মানে আমার তো হাসপাতালে ডিউটি আছে।কিজন্য বলুন তো?”
মেয়েটা সোজা সাপটা বলল-
” নাহ আমার আজকে ক্লাস করতে ইচ্ছা করছে না। তাই ভাবলাম আপনার সময় থাকলে আপনার সাথে আড্ডা দিব এক কাপ চা খাব আর আপনার সাথে পরিচিত হব।দেখে বেশ ভদ্র লাগছে।তাই আর কী।”
মেয়েটার কথা শুনে মেয়েটাকে একটু পাগল পাগল মনে হচ্ছিল।কারণ একটা অপরিচিত ছেলের সাথে স্বাভাবিক কোনো মেয়ে চা খেতে চাইবে না। তবুও মেয়েটার সাথে এক কাপ চা খাওয়ার সুযোগটা নষ্ট করতে মন চাইল না।
আমি মেয়েটাকে আমতা আমতা করে বললাম-
“সত্যি বলতে আমার মেডিকেলটা সামনেই। আপনি চাইলে হাঁটতে হাঁটতে মেডিকেলে যেতে পারি। ঐখানে ক্যান্টিনে না হয় এক কাপ চা খাওয়া যাবে। তাহলে আমার ডিউটি তে যেতে দেড়ি হবে না।”
মেয়েটা আমার কথা শুনে খানিকক্ষ ভাবার পর বলল-
“চলুন যাওয়া যাক।”
মেয়েটাকে নিয়ে মেডিকেলের পথে রওনা দিলাম। মেয়েটার সাথে সেদিনে প্রথম রাস্তায় হাঁটলাম পাশাপাশি। এ প্রথম কোনো মেয়ের সাথে আমি এভাবে হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটা হুট করে জিজ্ঞেস করল
“হাসপাতালে কিসের ডিউটি করেন?”
“আমি ইন্টার্ন ডাক্তার তো। রোগী দেখা বলতে পারেন।”
“অহ! আপনি ডাক্তার।বাহ! ভালোই হলো কখনও কোনো অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিতে পারব।”
এ বলে মেয়েটা একটা হাসি দিল। এই প্রথম কোনো মেয়ের হাসি দেখে আমার মনে হলো হাসিটা অসম্ভব সুন্দর। খেয়াল করলাম মেয়েটার সামনের দাঁত দুখানা একটু বড়ো
বড়ো দাঁতওয়ালা মেয়ের হাসি যে সুন্দর হতে পারে ঐ মেয়েটাকে না দেখলে বুঝতাম না।আমি মেয়েটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা আমার নীরবতা দেখে আমার দিকে তাকাল।মসাথে সাথে আমি আমার চোখটা নামিয়ে ফেললাম। অল্প কিছুক্ষণ হাঁটার পর মেডিকেলের সামনে চলে আসলাম। মেয়েটাকে নিয়ে ক্যান্টিনে বসলাম। মামাকে দুই কাপ রঙ চা দিতে বললাম সাথে আদা দিয়ে। মামা চা নিয়ে আসল। চা টা হাতে নিলাম।এবার ও মেয়েটার একটা বিষয় লক্ষ্য করে বেশ অবাক হলাম। কারণ মেয়েটা কাপের থেকে চা পিরিজে ঢেলে খাচ্ছিল। বেশ শব্দ ও হচ্ছিল। শব্দ করে চা খেতে খেতে বলল-
“এভাবে চা খাওয়ার মজাই আলাদা।একটু খেয়ে দেখেন না….।”
বেশ দুটানায় পড়ে গেলাম এভাবে চা খাব কি’না এটা ভেবে।মানুষ এভাবে চা খেতে দেখলে কী ভাববে সেটাও ভাবতে লাগলাম। তবে কেন জানি না ঐভাবে চা খাওয়ার লোভটাও সামলাতে পারছিলাম না। বেশ দুটানায় পড়েও একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে মেয়েটার মতো চা খেতে লাগলাম।”
যদিও মেয়েটার মতো এত শব্দ করে চা খায় নি তবে বেশ তৃপ্তি নিয়ে চা খেয়েছিলাম। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মনে হলো এখন তো মেয়েটার পরিচয় নেওয়া হল না।
তাই চায়ে একটা চুমুক দিয়ে বললাম-
“আপনার নামটা কিন্তু জানা হল না।”
“রুপা।মোমতাহিনা সায়রা রূপা।”
আমি হাসতে হাসতে বললাম
“তার মানে হিমুর রুপা।”
মেয়টা মুখ ভার করে বলল-
“ঐ কথা আর বলবেন না।ঐ কথা বললেই গা শিউরে উঠে।হিমুর নাম আর নিবেন না।”
“কিন্তু কেন?গতকালের চরিত্র টা বেশ ভালো লেগেছে আমার।সত্যিই তো হিমু আছে সুতরাং লেডি হিমু থাকা দরকার।তবে গা শিউরে উঠে কেন?”
রুপা প্রশ্নটা শুনে মুখটা গুমরা করে বলল-
কালকে যাওয়ার পর প্রথমেই বাবার সম্মুখীন হই।বাবা আমার এ অবস্থা আর খালি হাতে দেখে জিজ্ঞেস করল-
” কী রে তোর জুতা কোথায়? তুই কি বের হয়ে আর জুতা পড়িস নি?আর খালি হাতে কোথায় গিয়েছিলি?ব্যাগ কোথায় তোর।”
আমি বাবার কথায় পাত্তা দিলাম না তেমন, কারণ লেডি হিমুদের সব কথায় পাত্তা দিলে হবে না।বাবা বারংবার প্রশ্ন করতেছে আমি কোন কথার জাবাব না দিয়ে রুমে প্রবেশ করলাম।বাবা আর তেমন প্রশ্ন করল না।বিকেল বেলা খেয়াল করলাম কতজন লোক এসেছে।আমি তেমন পাত্তা না দিয়েই ঘাপটি মেরে শুয়ে রইলাম।বাবা আসলো আমার কাছে, আমার কাছে এসে বলল-
” তোরা মা থাকলে কথাগুলো হয়ত তোর মা বলত।কিন্তু তোর মা তো আর নেই তাই আমিই বলছি।শুন মা তুই তো বড় হয়েছিস।তাই তোর জন্য একটা পাত্র দেখেছি। তারা আজকে দেখতে এসেছে।একটু তৈরী হয়ে বের হ।”
বাবার কথায় আশ্চর্য হলাম না।কারণ হিমুদের আশ্চর্য হতে হয় না।বাবা বিয়ের কথা বলায় রাজি হলাম না।কারণ হিমুরা বিয়ে করে না। বিয়ে করব না বলে শত চেষ্টা করেও বাবা আমাকে পাত্র পক্ষের সামনে নিয়ে যেতে পারল না।অগত্যা পাত্র পক্ষকে বিদায় দিতে হল।বিদায় দেওয়ার পর আমি বেশ খুশি হলাম।কারণ লেডি হিমু হিসেবে নিজেকে বেশ প্রতিষ্ঠিত মনে হয়েছিল।কিন্তু বিপত্তি ঘটল রাতে।সারাদিন তেমন কিছু খাই নি রাতে ক্ষুধায় পেট টা চুচু করছিল।আমার বাসায় আমি আর বাবা থাকায় বাবায় রান্না করে আমার জন্য।রাতে খেতে গিয়ে দেখলাম খাওয়ার মতো কিছু নেই।বাবাকে বললাম খাবার কোথায়।বাবা উত্তর দিল-
“লেডি হিমুদের না খেলেও চলে।”
প্রয়োজনীয় সব কাজ ববাই করে দেয়।তাই সব কিছু করা না দেখে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম আমার এ কাজটা করলে না যে। বাবা উত্তরে বলল-
“লেডি হিমুদের অন্য কারও সাহায্য লাগে না। ”
যখনেই যা জিজ্ঞেস করছিলাম শুধু বলছিল লেডি হিমুদের কারও সাহায্য নিতে হয় না।সারা রাত না খেয়ে বেশ শিক্ষা হয়েছে।তার উপর সব কাজ একা করেছি।তার উপর সব চুরে নিয়ে গিয়েছে।মোবাইল কেনার টাকা চেয়েছি দিল না উত্তরে বলল লেডি হিমুদের মোবাইলের দরকার হয় না।অনেক কষ্টে মোবাইল কেনার জন্য রাজি করালাম তবে বিনিময়ে এক ঘন্টা কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার শর্তারোপ করল।মোবাইল এর জন্য এটুকু করতে বাধ্য হলাম।হিমু হওয়ার শখ মিটে গিয়েছে পুরো।তাই লেডি হিমু হওয়ার চিন্তা ছেড়ে দিয়েছি।আমি রুপা চিরিত্রেই ভালো আছি।
আমি রুপার কথা শুনে একটা হাসি দিলাম।মেয়েটা সত্যিই আজব চরিত্রের। পাগলামির একটা বৈশিষ্ট্য রুপার মধ্যে আছে তা বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম।হাসতে হাসতে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম অনেক টা সময় পার করে ফেলেছি এখন উঠতে মন না চাইলেও উঠে ডিউটিতে যেতে হবে।তবে রুপার ঠিকানা টা নিয়ে নেওয়া দরকার।তাই রুপাকে বললাম-
“আপনার বাসা যেন কোথায়?আর এখন কী সাথে মোবাইল নেই।নাহ মানে আমার ডিউটি আছে তো উঠতে হবে।পরে যেন আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারি তাই ঠিকানা চাওয়া।”
লক্ষ্য করলাম রূপা চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বলল-
“সি ব্লকের ছয় নম্বর বাসাটা।আতিক সাহেবের বাসা বললে চিনবে সবাই।আতিক সাহেব আমার বাবা।আর আপাতত তো নম্বর নেই।কারণ মোবাইল তো চুরে নিয়ে গিয়েছে।তবে আজকে মোবাইল কেনার পর সিমটা তুলব।আগের নম্বরটা দিয়ে যাই।যোগাযোগ করলে ঐ নম্বরে কল করবেন ঠিক আছে?রাতে হয়তো সিমটা খুলা পাবেন।”
আমি মথায় হাত চুলকাতে চুলকাতে বললাম-
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
রুপার নম্বরটা নিয়ে মামাকে চায়ের টাকা দিতে গেলাম।চায়ের টাকা দিতে গিয়েও মেয়েটার এক অদ্ভুত বিষয় দেখে পুনরায় অবাক হলাম।কারণ আমি মামাকে দশ টাকার নোট এগিয়ে দিলাম চায়ের বিল দেওয়ার জন্য।মামা বিল টা রেখে দিল।কিন্তু মেয়েটা তার ব্যাগ থেকে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করে আমাকে দিয়ে বলল-
” এই যে আমার বিল টা।”
“বিল কেন দিচ্ছেন?আমি তো দিয়ে দিয়েছি বিল। আপনার আর বিল দেওয়া লাগবে না।”
সোজা সাপটা উত্তর আসলো
” আমি কেন আপনার টাকায় চা খাব।আমি আপনার সাথে গল্প করেছি তার মানে এই না আপনার টাকায় চা খেতে হবে।আমি আমার চা আমার টাকাতেই খাব।আমি সহজে কারও কাছ থেকে কোনকিছু নিই না।”
এ বলে রূপা রাগী চোখে নিয়ে আমার দিকে তাকাল।রূপার চোখের চাহুনিতে বেশ ভয় পেয়ে রুপার হাত থেকে পাঁচ টাকায় কয়েন নিয়ে ক্যান্টিন থেকে বের হলাম।উদ্দেশ্য ডিউটিতে যাওয়া।রুপার কাছে বিদায় নিয়ে মেডিকেলে ঢুকে গেলাম।এর মধ্যের আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আবরার আমাকে চেপে ধরে বলল-
” কী রে জীবনে তো কোন মেয়ের দিকে তাকাইতে দেখলাম না।ঐ মেয়ে কে ছিল রে?”
আমি ভ্রুটা কুঁচকে বললাম-
“এত ভালো চিনি না আজকেই কথায় হয়েছে।এর আগে গতকাল দেখছিলাম।”
আবরার আমার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে কিছুক্ষণ হা করে রইল।তার প্রধান কারণ হলো আমি কোনো মেয়ের সাথে মিশতাম না। তাই দুই দিনের পরিচয়ে একটা মেয়েকে নিয়ে চা খাব সেটা ও বিশ্বাস করতে পারছে না।
আবরারের অবস্থা দেখে বললাম-
“কিরে এভাবে হা করে আছিস কেন?মুখে মাছি ঢুকবে।”
আমার কথায় আবরারের হুঁশ ফিরে।বলার সাথে সাথে মুখটা বন্ধ করে বলল
“তুই একটা মেয়েকে দুইদিনের পরিচয়ে চা খেতে নিয়ে এসেছিস এটা তো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। এটা শুনার পর হা হয়ে থাকাটা কি অস্বাভাবিক কিছু?”
আমি আবরারের দিকে তাকিয়ে তার পিঠে একটা চাপর দিয়ে বললাম-
“বাদ দে চল।মানুষের জীবনে কখন কোনো দিকে মোর নেয় বলা যায় না।”
অবরার এক বিন্দু হেসে বলল-
” তা একদম ঠিক বলেছিস।চল এবার ডিউটিতে চল।এমনিতেও আজকে একটু দেড়ি করে ফেলেছি।
তারপর দুজন ডিউটিতে গেলাম।আর ডিউটিতে মন দিলাম।শত ব্যস্ততার মাঝেও রূপার চা খাওয়ার শব্দটা যেন কিছুক্ষণ পর পর মাথায় বাজত আর অদ্ভুত এক অনুভূতির শিহরণ দিত।”
সারাদিন ডিউটি করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরার জন্য মেডিকেল থেকে বের হলাম।তবে হেঁটে ফিরতে মোটেও ভালো লাগছিল না।তাই পনের টাকা দিয়ে একটা রিকশা ভাড়া করলাম।রিকশা নিয়ে বাসার সামনে গেলাম।রিকশাওয়ালা মামাকে টাকা দিতে গিয়ে দুইটা দশ টাকার নোট দিলাম।রিকশাওয়ালা মামা বলল-
” মামা ভাংতি দেন।আমার কাছে পাঁচ টাকা খুচরো নেই।
আমি সারা মানিব্যাগ ঘেটে কোন খুচরো পেলাম না।রুপার পাঁচ টাকার কয়েনটা শুধু পেলাম।তবুও মামাকে বললাম-
“মামা একটু আশেপাশে দেখেন ভাংতি পান কি’না।”
মামা আমার হাতে থাকা পাঁচ টাকার কয়েনটা দেখে বলল
“আপনার হাতেই তো পাঁচ টাকার কয়েন আছে ঐটা দিয়ে দশ টাকা একটা ফিরিয়ে নেন।”
কিন্তু আমার মন কয়েনটা দিতে মোটেও সায় দিল না।তাই মামাকে বললাম-
“থাক আর পাঁচ টাকা দিতে হবে না।পাঁচ টাকা রেখে দিন।”
পাঁচ টাকা বেশি পেয়ে মামা হাসতে হাসতে বলল আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘ দিন বাঁচিয়ে রাখুক।এ বলে চলে গেল।
“এসব মানুষগুলোকে খুব অল্প দিয়েই খুশি করা যায়।অল্প পাঁচ টাকা আমাদের কাছে খুব বেশি কিছু না হলেও এ মামার কাছে অনেক কিছু।তাদেরকে উচ্চশ্রেণির মানুষের মত খুব বেশি কিছু দিতে হয় না।অপরদিকে উচ্চ শ্রেণীর মানুষগুলোকে অনেক কিছু দেওয়ার পর ও এরা খুশি হয় না সহজে।আর এদের মত নিম্নবিত্ত মানুষ গুলোকে অল্প কিছুই দিলে তারা যে খুশির হাসিটা দেয় সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্য। ”
বাসায় ফিরে ভাত বসিয়ে ভাবলাম রূপার দেওয়া নম্বরটায় কল দেওয়া যাক একটু। যে ভাবনা সে কাজ।রুপাকে কল দিলাম।কল দেওয়ার পর লক্ষ্য করলাম কলটা ঢুকেছে।তার মানে নতুন মোবাইল কিনেছে।প্রথম দুইবার কল ধরে নি।তৃতীয়বার কল দেওয়ার পর ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসল।বুঝতে আর বাকি রইল না এটা রুপার কন্ঠ।রুপা বলল
“হ্যালো কে?”
” আমি অরন্য।”
রুপা শক্ত গলায় বলল-
“অরন্য কে? চিনতে পারলাম না।আর কত হাবিজাবি পরিচয়ে কল দিবি।”
আমি কিছুটা অবাক হলাম রুপা আমাকে তুই করে জাবাব দিল তাই।আমার বেশ রাগ হলো কথাটা শুনে। কারণ সকালে চা খেল আর এখনেই আমাকে চিনতে পারছে না তার উপর তুইতোকারি করছে।তবুও নিজের রাগটা নিবারণ করে বললাম-
“ঐ যে সকালে চা খেয়েছিলাম একসাথে মনে আছে?আপনি আমাকে আপনার মোবাইল নম্বরটা দিলেন।ভুলে গিয়েছেন নাকি?”
এবার রুপা একটা হাসি দিল।রুপার হাসিটার এক অসম্ভব সুন্দর শব্দ পেলাম।মুহুর্তেই মন ছুয়ে গেল।রুপা হাসি দিয়ে বলল-
“অহ! কী যে করি না আমি।আপনার সাথে এত কথা বললাম সকালে আর আপনার নামটাই জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম। এজন্যই আমি চিনতে পারছিলাম না।মনে কিছু নিবেন না।আমি তো ভেবেছিলাম সৌরভ।তাই এত রাগ রাগ গলায় কথায় বলছিলাম।ছেলেটা বিভিন্ন নাম্বার দিয়ে কল দেয় তো তাই।”
আমি অবাক হয়ে বললাম-
“এ সৌরভটা আবার কে?যার জন্য আমি বকা খেলাম।”
মেয়েটা গলাটা একটু নীচু করে বলল-
“মহা বেয়াদব একটা ছেলে। আমাকে পছন্দ করে।পাত্তা দেই না তাই বিভিন্ন নম্বর থেকে কল দেয়।”
“তা ছেলেটা কি করে?”
“ড়াশুনা করে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে। সব দিক দিয়ে ঠিকেই আছে তবে আমার ভালো লাগে না।কেন জানি না দেখলেই গা জ্বলে খুব।তা আপনার কী অবস্থা।”
“হ্যাঁ ভালো।আপনার বাসায় কে কে থাকে?”
“বাবা আর আমি।”
“আপনার মা কোথায় থাকে?”
“মা মারা গিয়েছে আমার যখন বয়স ছয় ছিল।তারপর আর বাবা বিয়ে করে নি।আমি আর বাবায় একসাথে থাকি।”
রূপার কথা শুনে বেশ খারাপ লাগল।তাই রূপাকে স্বাত্ত্বণা দিয়ে বললাম-
“আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য।আপনার কষ্টটা বাড়িয়ে দিলাম এমন প্রশ্ন করে।এজন্য দুঃখিত আমি।মনে কিছু নিবেন না।”
রুপা একটা হাসি দিয়ে বলল-
“আরে ধুর কী যে বলেন না।মনে কিছু কেন নিব?তা আপনার বসায় কে কে আছে?”
“আমরা এক ভাই এক বোন।বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে।লন্ডন থাকে।আর বাবা, মা বেশ কিছুদিন আগে চলে গিয়েছেন উপরে।ধানমন্ডি বাসা আছে দুইটা ভাড়া দিয়ে রাখি।আর এখানে মেডিকেলের পাশেই একটা বাসা ভাড়া করে থাকি।”
মেয়েটা আমার কথা শুনে ধীর গলায় বলল-
“আপনি আমার থেকেও অভাগা।বাবা, মা কেউ নেই।”
আমি এক চিলতে হাসি দিয়ে বললাম-
“আমি বাবা মায়ের আদর পেয়ে বড় হয়েছি।দুই বছর আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে দুজনেই মারা গিয়েছে।ঐযে বললাম না আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য।হয়তো এতেও ভালো কিছু রয়েছে।তা আপনি কিসে পড়েন?’
” ন্যাশনাল ভার্সিটিতে অনার্স করতেছি পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে।”
“ওহ আচ্ছা খুব ভালো সাবজেক্ট মাশআল্লাহ।”
এক, কথা,দুই কথায় অনেক কথা হতে লাগল।কথার ফুলঝুড়িতে মোহনীয় হয়ে গেল চারপাশ। ভালোবাসার স্নিগ্ধ আবেগ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল আমায়।