#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২৬,২৭
অরন্য নিজেকে সামলিয়ে নিল। শান্ত গলায় বলে উঠল
“তখন সকাল আট টা বাজে। ভিডিওটা এর মধ্যে পুরোপুরি ভাইরাল হয়ে যায়। আমি পুলিশের সাহায্য নিলাম। পুলিশ খু্ঁজ লাগাল।”
কেটে গেল আরও তিন ঘন্টা।মতিন ঘন্টা পর পুলিশ আমাকে কল করল। আমাকে দ্রূত থানায় যেতে বলল।
আমি তাড়াহুড়া করে থানায় গেলাম। গিয়ে নিজের প্রিয়তমার মৃতদেহটা দেখলাম। আমার চিনতে মোটেও ভুল হয় নি এ আমার রূপা।আমার পাগলি টা।যে নাকি সারাদিন বকবক করেই যেত আমাকে দেখলে লাফিয়ে উঠত সে ঐদিন আমাকে দেখে বলছে না আরে ইয়ার আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন?পুলিশ শুধু বলেছিল এটাই কি রূপা? আমি পুলিশের কথার জাবাব না দিয়ে রূপাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।পুলিশের বুঝতে বাকি রইল না এটাই আমার পাগলি টা।রূপাকে ধরে বলতে লাগলাম-
“আমাকে তো একটু বুঝাতে পারতে, বলতে পারতে।আমার থেকে দূরে সরে কেন গেলে?আমি তোমাকে ছাড়া কীভাবে থাকব একটাবারও ভাবলে না।সারাদিন এত বকবক করতে এত কথা বলতে একটাবারও আমাকে ভরসা করে সমস্ত কিছু বলতে পারলে না।শেষমেষ আমিই তোমাকে ভুল বুঝলাম।আমার সাথে অভিমান করার কী দরকার ছিল রূপা। আমি যে তোমায় ছাড়া থাকতে পারব না।”
পুলিশ রূপার থেকে আমাকে আলাদা করতে পারছিল না।এক প্রকার জোর করেই পুলিশ রূপার মৃতদেহটা আমার কাছ থেকে আলাদা করে নিয়ে গেল।একটু পর সবাই জানল বিষয় টা। আবরার এসে আমাকে অনেক স্বান্ত্বণা দিল। কিন্তু আমার মন তো মানছিল না।রূপাকে ছাড়া কীভাবে থাকব আমি এটা ভেবেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলাম।রূপার বাবা রূপার মৃত্যুর খবর শুনে পুরোপুরি কোমায় চলে গিয়েছিল আর কিছুদিন পরেই রূপার বাবার মৃত্যু ঘটে।কারণ রূপার বাবার একমাত্র অবলম্বন ছিল রূপা।রূপাকে হারিয়ে সে শোকটা আর কাটিয়ে উঠতে পারে নি।
রূপার ময়না তদন্ত করা হলো। ময়নাতদন্ত শেষে যখন একটা বিষয় জানানো হল তখন আমার কলিজা ভেদ করে একটা কষ্টের তীর বিদেছিল সেটা এখন মাঝে মাঝে যন্ত্রণা দেয়।কারণ পুলিশ বলেছিল রূপার গর্ভে দুই মাসের বাচ্চা ছিল।আমার বুঝতে বাকি ছিল না এটা আমার বাচ্চায় ছিল।একে তো রূপাকে হারানোর কষ্ট তার উপর যোগ হল সন্তান হারানোর কষ্ট।পুলিশকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম।সব প্রমাণ দিলাম।সৌরভের শাস্তি ও হলো।
রূপা দ্বিতীয় বার ভাইরাল হলো তবে এখন রূপাকে কেউ বকে নি।আগের ভিডিওতে যারা রূপাকে গালাগাল দিচ্ছিল হাস্যকর ব্যপার হলেও সত্যি যে পরের ভিডিওতে তারাই রূপাকে শ্রেষ্ঠ নারীর খেতাব দিচ্ছে।মানুষ পারেও।ভাইরালের জগতে এসে আমরা আমাদের হিতাহিতজ্ঞান টুকু হারিয়ে ফেলি।কোনো কিছু যাচাই না করেই যা ইচ্ছা বলতে থাকি।সেদিন আমার ও একটা ভুল ছিল আমি রূপার সমস্ত কথা না শুনেই রূপার সাথে বাজে ব্যবহার করেছি।রূপাকে বুঝার চেষ্টা করিনি।সেদিন যদি রূপাকে একটু সাহস, বিশ্বাস,আর সাপোর্ট করতাম তাহলে আর আজকে আমার অনাগত সন্তান আর প্রিয়তমা রূপাকে হারাতে হত না।
এই যে জামা বোরকা এগুলো সব রূপার জন্য কিনি।রূপাকে তো পড়াতে পারব না তাই মাঝে মাঝে অসহায় মানুষগুলোকে দেই। রূপার শোকটা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছিল।আবরার অনেক সাহায্য করেছিল।তবে রূপাকে হারানোর যন্ত্রণা টা সবসময় কুড়ে কুড়ে খেত।ঐ যে ব্রিজটা যেখানে প্রতিরাতে দৌঁড়ে চলে যাই সেখান থেকেই ঝাপ দিয়ে আমার রূপা আকাশে চলে গিয়েছিল।কেন জানি না সেখানে গেলে রূপার শেষ নিঃশ্বাস টা শুনতে পাই।কেন জানি না তার সাথে সেখানে মন ভরে কথা বলতে পারি।এভাবেই সেখানে দাঁড়িয়ে একদিন রূপার সাথে কথা বলছিলাম তখন নিরার আগমন হয়।নিরাকে সেদিন প্রথম দেখেই রূপার মুখটা ভেসে এসেছিল।সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই নিরার দিকে।এর পর পরই মনে হয়েছিল,অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়ালে কেমন হয়। তাদের একটু সাহস দিলে তো মন্দ হয় না।কারণ আমি চাই না আর কোনো মেয়ে সাপোর্ট না পেয়ে এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যাক।তারপর এ আশ্রমটা খোলা।এ আশ্রমে অনেক অসহায় নারীরা থাকে।কিন্তু তাদের গুণের অন্ত নেই।সেটা তো কতক্ষণ আগে আপনাকে দেখালামেই।
এ বলে অরন্য চুপ হয়ে গেল।তুলি অরন্যের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল
“সব পুরুষ এক না, সব পুরুষ নারীকে নিয়ে খেলে না।কিছু পুরুষ নারীকে এতটাই ভালোবাসে সেটা তুলনা করার মতো কোনো বস্তু পাওয়া যায় না।সেই কিছু পুরুষেই হয়তো বাবা হয়,ভাই হয়, যোগ্য স্বামী হয়।”
যেমন নিলয় আর তুর্জ পুরুষ আর অপরদিকে অরন্য একজন পুরুষ।দুদলের মধ্যে তফাৎ অনেক।এক দল নারীকে নিয়ে খেলে ফেলে দেয় আরেকদল ফেলে দেওয়া নারীকে কুড়িয়ে এনে সম্মানের জায়গা তৈরী করে দেয়।কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ হয়ে বসে রইল।চারদিকে তখন পিনপনা নীরবতা।
হুট করে তুলি তার ব্যাগে রাখা ছুরিটা ছুরে ফেলে দিল। ছুরিটা ফেলতে দেখে অরন্য খানিকটা বিস্মিত হয়ে বলল-
“কী ব্যাপার ছুরিটা ফেলে দিলেন যে?আমি যদি আপনাকে কিছু করে বসি তখন কি করবেন?”
তুলি আকাশের তাকিয়ে বলল
“এ ছুরিটার আর দরকার পড়বে না।চলুন যাই।”
“কোথায় যাবেন?”
“নিয়ে গেলেই তো বুঝবেন।এত কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন?”
“কোথায় যাবেন বললে ভালো হয়।আর নিরা তো এখন না খাইয়ে যেতে দিবে না।”
“পুলিশের কাছে যাব।”
“কিন্তু আপনি তো পুলিশ ভয় পান।”
তুলি অরন্যের দিকে তাকিয়ে আর্দ্র গলায় বলল
“হ্যাঁ ভয় পেতাম।কিন্তু এখন আর পাই না।অপরাধ তো আমি করি নি।আমি কেন ভয় পাব?এখানে কত অসহায় নারীরা নিজের জীবন পাল্টেছে।আমার থেকেও অসহায় যারা তারাও নিজের জীবনকে বদলাতে পেরেছে।আমি কেন পারব না?আর অপরাধীরা ঘুরে বেড়াবে আর আমি অপরাধ না করে লুকিয়ে থাকব সেটা তো হয় না।ঐসব নরপশুর হাত থেকে তো আরও অনেক মেয়েকে রক্ষা করতে হবে।আপনি ঠিকেই বলেছেন
“আমি নারী আমি সব পারি।কারণ আমি মা,আমি মেয়ে,আমি অর্ধাঙ্গিনী ”
অরন্য একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল
” এজন্যই আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি।আপনাকে এখানে না আনলে আপনার মনের পরিবর্তন হত না।সমাজ আপনাকে কখনও বদলে দিবে না।বরং সমাজকে আপনার বদলে দিতে হবে।এ সমাজ নারীদের মর্যাদা দিবে না।বরং মর্যাদা নিজের তৈরী করে নিতে হবে।”
তুলি দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলল।সত্যিই তো তুলি কেন এত ভয় পাচ্ছিল।তুলি তো কোনো দোষ করে নি।এই অসহায় নির্বাক সমাজ তুলির মতো অনেক নারীকেই শিখিয়েছে চুপ করে সহ্য করতে।তুলি মনে মনে ভাবছে আমরা নিজেরাই তো নারীদের সম্মান দিতে পারছি না। নিজেরাই তো পুরুষদের সুযোগ করে দিচ্ছি অন্যায় করার।কিন্তু কেন?এর উত্তর হয়তো কেউ দিতে পারবে না।নিজের অস্তিত্ব কেন বিলীন করে দিচ্ছি।তুলির মনের সাহসের মাত্রা বাড়ল।তুলি অরন্যের দিকে আবার তাকিয়ে বলল-
“পুলিশের কাছে কখন যাব সেটা বলেন।লড়াই করতে আমি প্রস্তুত।আর আমার বাবা মায়ের নম্বর দিচ্ছি আপনি একটু কথা বলুন।”
“আমার তো মনে হয় আপনি বললেই ভালো হয়।আপনার বাবা,মা আপনি ভালো জানেন কীভাবে বললে ভালো হবে।আপাতত পুলিশের কাছে যাই ঘটনা খুলে বলি তারপর দেখি উনারা কী বলেন।যদিও দেশের আইন ব্যবস্থা ভালো না তবুও এছাড়া উপায় নেই।”
“আপনি যা বলেন তাই হবে।আচ্ছা….”
এ বলে তুলি অরন্যের দিকে তাকাল।অরন্য ও তুলির দিকে তাকিয়ে রইল।অরন্যের চোখে তুলি যেন এক ভালোবাসার বর্শা দেখতে পাচ্ছে।নিমিষেই তুলির মন বলে উঠছে অরন্য আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।কিন্তু মুখ দিয়ে সেটা বের হচ্ছে না।একেই হয়তো বলে মন ফাটে তো মুখ ফাটে না।অরন্যের চোখে ভরসার একটা ছাদ দেখতে পাচ্ছে।তুলির খুব ইচ্ছা করছে সে ছাদের আরশ তলে যেতে।কিন্তু কীভাবে যাবে সে উপায় যেন তুলির অন্তরায়।অপরদিকে অরন্য যখন তুলির দিকে তাকিয়েছিল।রূপার সে চেনা চাহুনিটা বারবার মুখের সামনে ভেসে আসছিল।মনে হচ্ছিল অবিকল রূপার মতো কেউ অরন্যের দিকে তাকিয়ে আছে।দুটো আলাদা মানুষের চোখের চাহুনিতে এত মিল কী করে হয় অরন্য সেটা ভেবে পাচ্ছে না।কেন জানি না ঐ চোখপানে অরন্যের তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালোই লাগছে।আর রূপার কথাটা কানে বাজছে।ঐ যে রূপা বলেছিল
“আকাশের বিশালতা অণুভব করা অনেক কঠিন ব্যপার।কিন্তু আকাশের দিকে তাকালেই এর গভীরতায় নিমিষেই হরিয়ে যাওয়া যায়।জানো অরন্য ভালোবাসাটাও ঠিক একরমেই।ভালোবাসাটা শব্দটা চারটা অক্ষরের হলেও এর বিস্তৃতি অনেক।ভালোবাসার বিস্তৃতিটা একবার উপলব্ধি করতে পারলে খুব সহজেই ভালোবাসার গভীরে ডুবে যাওয়া যায়।”
দুজন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কেউ কোনো কথা বলছে না।স্তব্ধ নীরবতা বিরাজ করছে।দুজনেই দুজনকে কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু কিসের বাঁধা যেন সবকিছু আটকে দিচ্ছে।হঠাৎ পরীর মিষ্টি কন্ঠে দুজন চমকে উঠে চোখ নীচে নামিয়ে ফেলে।পরী অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল-
“মামা,মামা আম্মু ডাততেছে।”
পরীর অস্পষ্ট কথাগুলো শুনে অরন্য পরীকে কোলে তুলে নিয়ে বলল-
“চলো যাই মামা।”
এবলে তুলির দিকে তাকিয়ে বলল
” ছুরিটা ফেলে দিয়ে লাভ কী।ছুরিটা না হয় সাথে নিয়েই নিন।বাসায় না হয় সাজিয়ে রাখব।বিখ্যাত ছুরি বলে কথা।”
খামখেয়ালি কথা শুনে তুলি রেগে অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল-
” সবসময় এত প্যাঁচাল কেন পারেন বলেন তো।নিরা খেতে ডেকেছে খেতে চলুন এবার।”
অরন্য মুখ ভরে একটা হসি দিয়ে পরীকে কোলে নিয়ে হাঁটতে লাগল।তুলিও হাঁটতে থাকল।নিরার ঘরে ডুকেই অরন্য আর তুলি দেখল নিরা সব রান্না করে রেখেছে।তুলি নিরার দিকে তাকিয়ে বলল
” তুমি এত কিছু এত অল্প সময়ে রান্না কীভাবে করলে?”
পাশ থেকে অরন্য বলল-
“ও তো আর আপনার মতো খায় আর ঘুমাই না আর ছুরি নিয়ে বাহাদুরি করে না।”
তুলি চোখ গুলো বড়ো বড়ো করে অরন্যের দিকে তাকাতেই নিরা বলে উঠল-
“আরে তুলি রাগ করো না।অরন্য সবসময় এমন মজা করে।তুমিও না। ওর কথায় রাগ করো না।”
“আরে কী যে বলো তুমি, রাগ কেন করব?তোমার রান্না দেখে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।এখনেই দাও খাব।খুব ক্ষুধা লাগছে।সকালে শুধু এক মগ কফি খেয়েছিলাম।”
নিরা হাসতে হাসতে বলল
“কেন? নাস্তা করো নি কেন?”
“অরন্য রান্না করে নি।”
অরন্য পাশ থেকে বলে উঠল-
“নিজের নাস্তা নিজে রান্না করে খেলে কী পাপ হয় নাকি।মানুষের আশায় বসে থাকেন কেন?”
নিরা এক গাল হেসে বলল
” হয়েছে ভাইয়া।তোমাদের ঝগড়া না হয় বাসায় গিয়ে করো।এখন চুপচাপ খেতে বসো।”
এরপর তুলি আর অরন্য খেতে বসল।তুলি নিরার কাছে বিদায় নিতে গেলে নিরা তুলিকে ডেকে বলল-
“একটা কথা বললে কী রাগ করবে?”
তুলি একটু হেসে বলল-
“রাগ কেন করব?”
“অরন্যকে একটু মানুষ করো।আর কত একা থাকবে।পারলে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিয়ে করে ফেল।কেন জানি না অরন্য যখন তোমাকে নিয়ে এসেছে তখন মনে হয়েছিল অরন্যের মনে তোমার জন্য একটা জায়গায় তৈরী হয়েছে। মানুষটা সবার জন্য ভাবতে ভাবতে নিজের জন্য ভাবতে ভুলে গিয়েছে।”
নিরার কথাটা শুনে তুলি লজ্জায় লাল হয়ে গেল।তুলি বেশ ভালোই বুঝতে পরেছিল যে এ দুইমাসে সে অরন্যকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে।অরন্যকে বলতে না পারলেও মনে মনে সেটা বারবার অনুভব করেছে।তুলি নিরাকে জড়িয়ে ধরে বলল-
“আমি চেষ্টা করব।আমার জন্য শুধু দোআ করো।”
“সে তো সবসময় করব।”
তুলি আর নিরাকে এমন অবস্থায় দেখে অরন্য একটা কাশি দিয়ে বলল-
“এই যে আপনার কী হয়েছে?যাবেন না নাকি?”
“হ্যাঁ যাব তো চলুন।”
তুলি নিরার কাছে বিদায় নিয়ে নিরার বাচ্চাটাকে একটু আদর করে চলে আসলো অরন্যের সাথে।অরন্য তুলিকে নিয়ে আশ্রম থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিল।রিকশায় উঠে অরন্য তুলিকে বলল
“আমার মনে হয় আজকে পুলিশের কাছে না গিয়ে আগে একটা উকিলের সাথে কথা বলি।আমার পরিচিত একজন মহিলা উকিল আছে যিনি সবসময় এসব অবহেলিত মেয়েদের নিয়ে কাজ করে।তার কাছে সমস্ত বিষয়টা খুলে বলে তারপর কী করলে ভালো হবে সেটা জেনে বাকিটা করব কি বলুন?”
“আপনার যা ভালো মনে হয় তাই করুন।”
অরন্য তুলির দিকে তাকিয়ে দেখল তুলি বেশ শান্ত হয়ে বসে আছে।তুলির শান্ত চেহারা উপর পড়ন্ত বিকেলের রোদটা পড়েছে।গতিয়মান রিকশার সাথে সাথে তুলির মুখের উপর পড়ন্ত রোদটাও যেন ছন্দকার তরঙ্গাকারে এগিয়ে যাচ্ছে।বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাহস হলো না।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই মাথাটা নীচে নামিয়ে ফেলল।ইতিমধ্যে রিকশাওয়ালা মামাও রিকশার গতি ধীর করে ব্রেক চেপেছে।ব্রেক চেপে রিকশার থেকে নেমে অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল-
“মামা ভাড়াটা দিন। ”
অরন্য আর তুলি রিকশা থেকে নামল।নামার পর অরন্য ত্রিশ টাকা দিল। ত্রিশ টাকা পেয়ে রিকশাওয়ালা মামা বললেন
“পাঁচ টাকা খুচরো দেন।আমার কাছে কোন খুচরো নেই।”
অরন্য মানিব্যাগ খুঁজে মামাকে বলল-
“পাঁচ টাকা নাই মামা যা দিয়েছি নিয়ে যান।পাঁচ টাকা দিতে হবে না।”
মামা একটা হাসি দিয়ে চলে গেল।পাশ থেকে তুলি বলল-
“ব্যাগে তো পাঁচ টাকা ছিল দিলেন না কেন?’
অরন্য মানিব্যাগটা পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল
” এটা আমার প্রিয়তমা রূপার দেওয়া প্রথম কয়েন টা।এটা দেয়া যাবে না।”
তুলি কথাটা শুনে মনে মনে ভাবছে একটা মেয়ে কতটা ভাগ্যবান হলে এমন মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিল।এসব ভেবে অরন্যের দিকে তাকিয়েই রইল।অরন্য তুলিকে ডেকে বলল
“কী হলো চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন।উকিলের কাছে চলে এসেছি চলুন যাই।”
তুলি চোখটা নামিয়ে বলল
“নাহ কিছু না, চলুন।”
দুজন উকিলের কাছে গেল।তুলি প্রথমেই খেয়াল করল একটা সুন্দর মেয়ে পরিপাটি হয়ে বসে আছে।অরন্যকে দেখেই হালকা হেসে বলল
“কেমন আছেন অরন্য সাহেব?”
” হ্যাঁ ভালো আছি।”
“অনেক দিন পর আসা হলো।”
“দরকার ছাড়া তো আসা হয় না।দরকারেই জ্বালাই আপনাকে।”
“হিহিহি কী যে বলুন না।এটাকে জ্বালানো বললে বলব যে, এরকম জ্বালানো আরও পেতে চাই।তা বলুন এখন কী নিয়ে লড়তে হবে।”
অরন্য পাশে থাকা তুলিকে দেখিয়ে বলল-
“এ তুলি।এর কথায় আপনাকে মেসেজে ডিটেইলস বলেছিলাম সকাল দিকে।কী হয়েছে সমস্ত ঘটনা আজকে সকালে জানার পরেই মেসেজ দিয়েছিলাম আপনাকে।এখন সেটারেই ব্যবস্থা করতে চাচ্ছি।আর তুলি এ হচ্ছে মিসেস অধরা তোমার মামলা টা নিয়ে লড়বে।অনেক ভালো একজন উকিল।”
অধরা একটু হেসে বলল
“শুধু শুধু এত প্রশংসা না করলেও চলবে।যাইহোক আমি তুলির ব্যপার টা ভেবেছি।আমার মনে হয় প্রথমে তুলির উচিত নিলয়কে ডিভোর্স দেওয়া তারপর তুলির জামিনের ব্যবস্থা করব।জামিনের ব্যবস্থা হওয়ার পর পরই তুলি পুলিশের কাছে গিয়ে সমস্ত কিছু বলবে।আমার মনে হয় না এতে ওকে কোনো শাস্তি দেওয়া হবে।তবে আইন হাতে তুলে নেওয়ার জন্য সাময়িক শাস্তি দিতে পারে তবে আমি সেটাও মওকুফ করার ব্যবস্থা করে দিব।আমি কাগজ পত্র প্রস্তুত করে রাখব পরশুর মধ্যে।পরশু গিয়ে তুলি সব বলবে পুলিশকে।”
অরন্য আরও কিছুক্ষণ কথা বলে অধরাকে বিদায় জানিয়ে তুলিকে নিয়ে বাইরে আসল।এসে পুনরায় রিকশা করল।রিকশাতে উঠে অরন্য তুলিকে বলল
” এ উকিলেরও একটা মজার কাহিনী আছে শুনবেন?”
তুলি উৎসুক হয়ে বলল
“হ্যাঁ বলেন শুনি।”
#পর্ব- ২৭
তাহলে শুনোন-
“শুনলে এখান থেকেও আপনি অনেক শিক্ষা নিতে পারবেন।বুঝতে পারবেন নারীরা ইচ্ছা করলেই পারে লড়াই করে নিজেদের জায়গায় তৈরী করতে। এতে শুধু দরকার নারীদের বলিষ্ঠ মনোবল।”
অধরা যখন অধরার মায়ের পেটে ছিল তখন উনার বাবা চেয়েছিল যে উনার একজন ছেলে সন্তান হোক।কিন্তু সেদিন অধরার জন্ম হয়।অধরার জন্মের পর অধরার বাবা মোটেও খুশি ছিল না।অধরাকে নিয়ে অধরার মায়ের সাথে ভালোই ঝগড়া হত।অথচ এ সমাজ জানে না যে,
“মেয়ে হওয়ার জন্য মেয়েরা দায়ী না পরোক্ষভাবে ছেলেরা দায়ী।”
যাইহোক বছর ঘুরতেই অধরার মা আবার গর্ভবতী হয়।আর অধরার মায়ের কোলে একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান হয়।অধরার বাবা সেদিন অনেক খুশি হয়েছিল।সেদিন থেকেই শুরু হয় বৈষম্যের।অধরা মেয়ে হওয়ার দরুণ অধরাকে সবসময় সবকিছু থেকে বঞ্চিত করত।অধরার পরিবার কিন্তু যথেষ্ট স্বচ্ছল ছিল।
সময়ের পরিক্রমায় দুজনেরেই স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় হয় কিন্তু অধরার বাবা তার ভাইকে ভলো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয় আর তাকে ভর্তি করায় বাড়ির পাশের একটা স্কুলে।কোনোরকমে প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পার হয়।এবার হাইস্কুলে ভর্তির পালা।অধরা চাচ্ছিল বাড়ি থেকে একটু দূরে ভালো একটা হাই স্কুলে ভর্তি হতে, কিন্তু ঐ হাই স্কুলে ভ্যানে যেতে আসতে ভাড়া লাগবে, এজন্য অধরাকে ভর্তি করাতে অধরার বাবা নাকোচ করল।তবুও অধরা জিদ করে ভর্তি হলো।তবে ভর্তির টাকাটাও জোগাড় করেছে নিজের মায়ের ব্যাগের থেকে টাকা চুরি করে।সেদিন টাকা চুরির জন্য অধরার মা অধরাকে বেদরম মার মেরেছে।ভর্তির পর অধরা হেঁটেই যেত স্কুলে আর অধরার ভাই যেত ভ্যানে করে।অধরার জন্য অধরার বাবার মাসে তিনশ টাকা বাড়তি নষ্ট করাটা বেশি মনে হচ্ছিল।অথচ অধরার ভাই এর ক্ষেত্রে তা ঘটে নি।দিন যায় মাস যায় অধরার মনে হয় একটা প্রাইভেট পড়া দরকার কিন্তু সে টাকা অধরার ছিল না।কারও কাছে হাত পাতার মত অবস্থা ছিল না।কারণ অধরার বাবার যথেষ্ঠ টাকা ছিল।কারও কাছে হাত পাতলে তার বাবার মানসম্মান ক্ষুন্ন হবে তাই চাইত না।এভাবেই পড়তে পড়তে এস.এস.সি তে গোল্ডেন পায়।সেদিন অধরার বাবা অধরার প্রতি একটু যত্নবান হলেও সেটা টিকে নি বেশিদিন।
অধরার বাবা চাইত অধরা বিয়ে করে ফেলুক।কিন্তু অধরার স্বপ্ন ছিল বড়ো।তাই সে বিয়েতে রাজি হত না।আর এটা নিয়েই অধরার বাবা আর অধরার মধ্যে ঝগড়া হত।বিনিময়ে মাইর খেত।অধরার বাবা কোনোভাবেই অধরাকে কলেজে ভর্তি করাবে না
তবুও অধরা নিজের জিদটাকে বহাল রেখেছে।নিজের স্বপ্নটাকে নষ্ট হতে দেয় নি।নিজের অস্তিত্বটাকে বিলীন হতে দেয় নি।অধরার মামার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কলেজে ভর্তি হলো।তবে বইপত্র পেতনা পড়ার জন্য।কোনোরকমে বান্ধবীদের কাছ থেকে লিখে আনত।কলেজের লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়ত।বিপত্তি ঘটে পরীক্ষার সময়। তখন অধরার বাবা একটা অযোগ্য পাত্র নিয়ে আসে বিয়ে দেওয়ার জন্য। অধরা কী করবে বুঝতে না পেরে সেদিনেই লুকিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় মামার বাড়ি।অধরার মামা অবশ্য অধরাকে সাহায্য করত অনেক।সেখান থকে কোনোরকমে পরীক্ষাগুলো দেয়।পরীক্ষার পর নিজের বিবেকেই বাঁধল এ বাড়িতে আর কতদিন? তাই চলে গেল নিজের বাড়িতে। বাড়িতে যাওয়ার পর যা হওয়ার কথা ছিল তাই হলো।কপালে জুটল বেদরম পিটুনি।
তারপর অধরার মনে হলো একটা কোচিং করার দরকার ভার্সিটিতে এডমিশন টেস্টের জন্য।কিন্তু সে সুযোগ ও পায় নি।তাই ঘরে বসেই প্রস্তুতি নিতে থাকল।কিছুদিন পরেই রেজাল্ট দিল। অধরা গোল্ডেন এ প্লাস পেল।সেদিন অধরার বাবা অধরার সাথে একটু ভালোভাবে কথা বলেছিল।অধরাকে পড়াতে রাজি হয়েছিল। তবে অধরার বাবা চেয়েছিল অধরা বাড়ির কাছে ন্যাশনালে পড়ুক।কিন্তু অধরার স্বপ্ন ছিল আরও বড়ো।সে চাইত সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে।অনেক যুদ্ধ করে মায়ের কাছে কান্না কাটি করে ফরম ফিল আপের জন্য।মা কী করবে বুঝতে না পেরে নিজের নাকে পরা ফুলটা অধরাকে দিল।অধরার সেদিন মায়ের নাকের ফুলটা নিতে বুক কাঁপতেছিল কিন্তু করার কিচ্ছু ছিল না কারণ তার স্বপ্ন পূরণ করতে এটুকু স্বার্থপর হতে হবে। অধরা নিজেকে সামলে নাকফুলট বিক্রি করে ফরম ফিল আপ করে।এবার পরীক্ষার সময় বিপত্তি ঘটল ঢাকা যাওয়ার টাকা কী করে জোগাড় করবে। চিন্তা করে পাচ্ছিল না কী করবে।অবশেষে বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে ঢাকায় এসে এডমিশন টেস্ট দেয় আর চান্স পায়।
এরপর অধরার বাবা একদম পাল্টে যায়।নিজের মেয়ের সুনাম যখন মানুষের মুখে শুনল তখন অধরাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইল।
এক পর্যায়ে জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়ে আজকের এ পর্যায়ে এসেছে।আর এখন তার বাবার চোখের মনি অধরা।সেদিনের পর থেকে অধরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সমাজে সুবিধা বঞ্চিত নারীদের জন্য কাজ করবে।আর এখন তাই করছে।যে অধরাকে তারা বোঝা ভেবেছিল সে অধরায় আজকে তার বাবা মায়ের একমাত্র আশার খনি।একমাত্র আশ্রয়স্থল।
আচ্ছা একবার ভাবুন তো অধরা যদি এ সমাজের কাছে পরাজয় মেনে নিত তাহলে কী সে পর্যায়ে আসতে পারত?কতটা সংগ্রাম আর কষ্ট করে পড়েছেন চিন্তা করতে পারছেন কী?তবুও এ সমাজের কাছে মাথা নত করে নি।নিজেকে গড়ে তুলেছে।নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
নারীরা চাইলেই সংগ্রাম করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে।তাই শোষিত নারীদের নিয়েই আমাদের এ আয়োজন এ আশ্রম।এ আশ্রমের প্রতিটা মেয়ের কাছ থেকে একটা একটা শিক্ষা নিতে পারবে।নিজের মনকে শক্ত করতে পারবে।সংগ্রাম করতে পারবে।আমি চাই এ আশ্রমে একসময় শতাধিক মানুষ হোক তবে তারা যেন শোষিত হয়ে না আসে। তারা যেন আসে সমাজটাকে এগিয়ে নিতে।
অরন্য কথাগুলো বলে থেমে গেল।তুলি অরন্যের কথা গুলো শুনে ভাবতে লাগল প্রতিটা নারীর যদি এ যুদ্ধ করার সাহস থাকত তাহলে হয়তো সত্যিই সমাজটা বদলে যেত।তাহলে হয়তো নারীরা শোষিত হত না।বরং নারীর হাতের ছোঁয়ায় সমাজটা বদলে যেত।সত্যিই তো কত নারীই সংগ্রাম করে নিজের অবস্থান করেছে।সেখানে কিছু কিছু নারী কেন নিজেদের পিছিয়ে রাখছে।তুলির মনে অদ্ভুত একটা আত্নবিশ্বাসের সঞ্চার হলো। কেন জানি না আজকে তুলির বিশ্ব জয় করতে ইচ্ছে করছে।কেন জানি না ইচ্ছা করছে অনেক লড়াই করে নিজের স্থানটা তৈরী করতে।
তুলি অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল-
“সমাজ পরিবর্তনে আপনার মতো কিছু মানুষ ও দরকার যারা নারীদের সঠিক মূল্যায়ন করে।”
অরন্য হেসে জবাব দিল
“বাসায় চলে এসেছি।রিকশা থেকে নামবেন না?”
” হ্যাঁ নামছি।”
অরন্য আর তুলি রিকশা থেকে নেমে বাসায় গেল।বাসায় গিয়ে তুলি কতক্ষণ চুপ হয়ে বসে রইল।এর মধ্যেই আকাশে মেঘের গর্জন দিতে লাগল।এসময় টা কেমন জানি অদ্ভুত, এই গা ফাটিয়ে রোদ্দুর উঠছে আবার গর্জন দিয়ে মেঘ নামছে।মেঘের গর্জন শুনে তুলির ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল।এসময়টাতে তুলি আম কুড়াতো।শিলা কুড়াতো।বৃষ্টিতে ভিজে নিজেকে শীতল করত।কত মধুর সময়টাই না ছিল।আজকে খুব ভিজতে মন চাচ্ছে তুলির।মেঘ,বৃষ্টির খেলায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে মন চাচ্ছে তুলির। বেলকনিতে গিয়ে বাইরে হাত দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ধরার একটা প্রতিযোগিতায় নামল।অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভুতি জাগছে তুলির মনে।বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা হাত দিয়ে ধরে ভিতরে এনে মুখে লাগাচ্ছে।এক শীতল পরশ যেন তুলিকে আরও শীতল করে তুলছে।তুলির মুখে অজানা এক হাসি লুটোপুটি খাচ্ছে।
ঠিক এসময় অরন্য তুলির রূমে আসল।তুলিকে বরান্দায় এ অবস্থায় দেখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।তুলির চোখে মুখের আবছা হাসিটা দেখে অরন্যের মনটা কেন জানি শীতল হচ্ছিল।কেন জানি না এক অদ্ভুত ভালোবাসার পরশ পাচ্ছিল।তুলিকে দেখলেই কেন জানি না অরন্যের মনে হয় এটা রূপা।কারণ দুটো মানুষ আলাদা হলেও এদের চোখ, হাসির মধ্যে অপূর্ব মিল খুঁজে পায় অরন্য।তুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করলেও অরন্য তুলির থেকে চোখটা সরিয়ে ফেলল।কারণ অরন্য কখনও রূপার জায়গা কাউকে দিতে পারবে না।তুলিকে না ডেকেই অরন্য চলে নিতে নিল।
ঠিক এসময় তুলি পেছন ফিরে দেখল অরন্য রূম থেকে প্রস্থান নিচ্ছে।অরন্যকে দেখে তুলির ভেতর এক অদ্ভুত ভালোবাসা জেগে উঠল।কেন জানি না তুলির মন চাচ্ছে অরন্যকে ধরে চিৎকার করে ভালোবাসি বলতে।বুঝতে পারছে না তুলি কী করতে যাচ্ছে।নিজের আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে।তুলি অরন্যকে পিছন থেকে ডাক দিল-
“এই যে শুনোন।”
তুলির ডাকে অরন্য পিছন ফিরে তাকাতেই বৃষ্টির ফোঁটায় তুলির ভেজা আর্দ্র চুলগুলো দেখে চোখটা নীচে নামিয়ে ফেলল।কারণ এ চুল দেখলে অরন্য তার আবেগ সামলাতে পারবে না।তুলি অরন্যকে দেখে দৌঁড়ে অরন্যের কাছে গিয়েও থেমে গেল।অরন্যের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে বলল-
“চলুন বৃষ্টিতে ভিজি।বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ইচ্ছা করছে।”
অরন্য তুলির কথাটা ফেলতে পারল না।তুলিকে নিয়ে ছাদে চলে গেল।তুলি বাচ্চাদের মতো দৌঁড়ে ভিজতে লাগল।অরন্য শুধু তুলির দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল।টানা এক ঘন্টা তুলি বৃষ্টিতে ভেজার পর কাঁপতে কাঁপতে অরন্যকে বলল
“বৃষ্টি থেমে গিয়েছে চলুন ঘরে যাই।প্রচন্ড শীত করছে।”
অরন্য তুলিকে নিয়ে রূমে আসলো।তুলি রূমে এসেই কাপড়টা পাল্টে নিল।কাপড় পাল্টে চুল মুছতে মুছতেই তুলি কয়েকটা হাঁচি দিল।তুলি বেশ ভালোই বুঝতে পারছিল তুলির ইতিমধ্যেই ঠান্ডা লেগে গিয়েছে।ছোটবেলা থেকে তুলির একটা বদঅভ্যাস একটু বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর চলে আসে।আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না।নিমিষেই গা টা গরম হতে লাগল।তুলি কোনরকমে মাথাটা মুছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।
সাঁঝের সময় এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে অরন্য তুলিকে কয়েকবার ডেকে বলল-
“কী ব্যাপার এ অসময়ে শুয়ে আছেন কেন?”
তুলির কোনো শব্দ পেল না।অরন্য ভাবল তুলি হয়তো ঘুমাচ্ছে।কিন্তু খানিকক্ষণ পর তুলির একটু আওয়াজ শুনে তুলির কাছে এসে দেখল।তুলি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে আর কাঁপছে।তুলির মাথাটা অরন্য ধরে খেয়াল করল জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।মাথায় হাত ধরতেই তুলি অরন্যের হাতটা টেনে বুকের কাছে নিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখল।আর বলতে লাগল-
“অরন্য একটা কথা বলব আপনাকে?”
অরন্য হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলে তুলি আরও জোরে হাতটাকে ধরে রাখল।অরন্য তুলির কানের কাছে গিয়ে হালকা করে বলল
“কী করছেন কি?হাতটা একটু ছাড়ুন।”
” বলুন না একটা কথা বলব কি না?”
“হাতটা ছেড়ে কথা বলুন।”
” নাহ হাত ছাড়ব না।”
অরন্য বেশ মুশকিলে পড়ে গেল কী করবে এটা ভেবে।অরন্য যতবারেরই হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে ততবারেই তুলি হাতটাকে শক্ত করে ধরছে।তাই হাতটা ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা না করে তুলিকে জিজ্ঞেস করল
“কী বলতে চান বলুন?”
“আমি আপনাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি।প্রচন্ড রকমের ভালোবাসি আপনাকে।আপনাকে যতবারেই দেখছি ততবারেই নিজের মনের অজান্তে ভালোবাসার মানুষটাকে খুঁজে পাচ্ছি।মনে হচ্ছে আমার স্বপ্নের পুরুষটাকে খুঁজে পেয়েছি।”
তুলির এমন কথায় অরন্য একটু বিস্মিত হয়ে গেল।তুলির প্রতি অরন্যেরও একটা তীব্র টান কাজ করল।তুলির কথার জবাবে অরন্যের বেশ ইচ্ছা করছে বলতে যে,তুলি আমিও তোমায় ভালোবাসি।কিন্তু কেন জানি না অরন্যের মনে হচ্ছে এতে তার প্রাণপ্রিয় প্রিয়তমা রূপাকে ঠকানো হবে।তাই তুলিকে বলল-
“জ্বরের ঘোরে কী আবোল তাবোল বলছেন।আমি ঔষধ দিচ্ছি খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
তুলি অরন্যের হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বলল
“সত্যিই আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।”
অরন্য তুলির হাত থেকে নিজের হাতটা বেশ জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে পাশের রূমে চলে গেল।
তারপর তৈরী হয়ে ব্রিজের কাছে চলে গেল।প্রতিদিন ব্রিজের কাছে রাত এগারোটায় গেলেও আজকে অরন্য রাত আট টায় ব্রিজটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।মনে মনে রূপার সাথে কথা বলতে লাগল।কল্পনায় থাকা রূপা বলল-
“কী ব্যাপার অরন্য আজকে এত তাড়াতাড়ি আসলে যে।”
“ঘরে একদম মন টিকছে না।জানো রূপা আমার বাসায় একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছিলাম।এখান থেকেই তার সাথে পরিচয়।ওর চোখের দিকে তাকালে কেন জানি না তোমাকে দেখতে পাই।কেন এমন হয় বলতো?দুটো আলাদা মানুষের চোখের চাহুনিতে এত মিল কি করে হয় বলতে পারবে?”
“আমি যদি ঐ মেয়ের চোখ দুটোতে থাকি তুমি কি ঐ মেয়ের চোখ দুটোতে তাকিয়ে আমার সাথে কথা বলতে পারবে না?”
“কেন পারব না রূপা, অবশ্যই পারব। কেন জানি না ও তাকালে মনে হয় তুমি তাকিয়ে আছ।জানো রূপা মেয়েটা আজকে অদ্ভুত রকমের পাগলামি করেছে।আমাকে নাকি ভালোবাসে।”
“তুমি বাসো না?তোমার মন কীবলে?”
অরন্য এবার কী উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না।কারণ অরন্যেরও তুলির প্রতি একটা মায়া জন্মে গিয়েছে।অরন্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-
“আমি যা বলব সেটা শুনলে কি তুমি কষ্ট পাবে?”
“আরে বোকা কষ্ট কেন পাব?”
” নাহ মানে তুলিকে দেখলে আমার কেন জানি অদ্ভুত ভাবে তোমাকে মনে পড়ে।ওর দিকে তাকালে তোমার চোখ দুটো ভেসে উঠে।তোমার আরে ইয়ার কথাটা কানে বাজতে থাকে।মনে হয় একটা ভিন্ন চেহারার অবিকল একটা মানুষেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।এমন কেন মনে হয় জানি না।কিন্তু তোমার জায়গায় তাকে ঠাঁই দিয়ে তোমাকে কষ্ট দিতে পারব না।”
কল্পিত রূপা অরন্যের পাশে এসে দাঁড়াল। অরন্যের হাতটা ধরে বলল-
-“আমার তো মনে হয় তুমি এতদিন আমাকে বেশি কষ্ট দিয়েছ।”
“কীভাবে কষ্ট দিলাম তোমাকে।রূপা আমি কখনও তোমার জায়গাটা অন্য কাউকে দেই নি।তোমাকে আমার মনের ভিতর ধারণ করে রেখেছি সবসময়।”
কল্পিত রূপা এক রাশ হেসে বলল-
“আরে ইয়ার তুমিও না।ঠিক এ জায়গায়টাতেই তুমি খুব বড়ো ভুল করেছ।তোমার এ নিঃসঙ্গ জীবন আমাকে আরও কষ্ট দিচ্ছে।আমাকে আরও অপরাধী করে তুলছে।তোমাকে এভাবে একদম ভালো লাগে না আমার।আমি চাই তুমি নতুন করে জীবন শুরু করো।আমার মতো করে কাউকে ভালোবাস।সংসার করো।অরন্য এ একাকীত্ব কোনো সমাধান না।একা থাকলেই যে তুমি আমাকে ভালোবাসবে তা না।বরং তুমি আরেকটা মেয়ের জীবন সুন্দর করে রাঙ্গিয়ে দিয়েও আমাকে ভালোবাসতে পারো।ভালোবাসা মানে এই না তুমি সারাজীবন নিঃসঙ্গতার গ্লানি বয়ে বেড়াবে।ভালোবাসা তো সেটা যেটা
“হাজারো মানুষের ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে।যার অস্তিত্ব মনের মনিকোঠায় মিশে থাকবে।যাকে ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না শুধু অনুভব করা যাবে।”
নিঃসঙ্গতা একটা স্বার্থপরতা।তুলির চোখে আমাকে যে খুঁজে পাও বিশ্বাস করো অরন্য এটাই ভালোবাসা।তুলিকে নিয়ে সারাজীবন একসাথে থাকলেও তুলির চোখে তুমি আমাকেই দেখতে পারবে।আমাকে হারাবে না অরন্য। আমি যে তোমার অস্তিত্বে মিশে আছি।সেখান থেকে কেউ সরাতে পারবে না।তবে তোমার এ নিঃসঙ্গতা আমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে।আমি তো চাই তুমি নিজেকে ভালো রাখো।কিন্তু এ নিঃসঙ্গতা তোমাকে কুড়ে কুড়ে খেলে আমার ভালো লাগবে না।অরন্য যাও তুলির কাছে ফিরে যাও।তার নয়ন জোড়ায় আমাকে খুঁজে নাও।তোমার অস্তিত্বে থাকা রূপাকে আর কষ্ট দিও না।
এ বলে কল্পনার রূপা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।বেশ কয়েকবার অরন্য রূপা, রূপা বলে ডাকল কিন্তু কেউ সাড়া দিল না।অরন্যের মাথায় তখন একটা কথা বাজতে লাগল যাও অরন্য তুলির চোখে আমাকে খুঁজে নাও।
অরন্যের তুলির কথা মনে হতেই বাসায় ছুটে গিয়ে তুলিকে দেখে অরন্য চমকে গেল।বুকের ভেতরটা দুমরে মুচরে গেল। তুলিকেও হারিয়ে ফেলবে এটা ভেবেই বুকের ভেতরটায় কষ্টের তীর যেন ছেদ করল।