এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা লাবিবা ওয়াহিদ | পর্ব ১৪ |

0
454

#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১৪ |

—————–
নিদ্র বিষণ্ণ মনে নওরির রুমে ফিরে এলো। নওরি তখন ফ্রিশার খাওয়া দেখছিলো। হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মাথা উঁচু করে তাকালো। নিদ্রকে নজরে এলেই ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকালো নওরির। নিদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–“নানুটা একদম ভালো না।”
নওরি বেশ চমকে তাকালো নিদ্র’র পানে।
–“কার কথা বলছো নিদ্র?”
–“মাজেদা নানুর কথা৷ আমার মিছেমিছি বউটা বেড়াতে চলে গেছে। তাই ভেবেছিলাম তোমার সাথে এক্টিং, এক্টিং খেলবো। কিন্তু নানুটা লাঠি দিলো-ই না। উল্টো লাঠি দিয়ে আমায় উত্তম-মাধ্যম দেয়ার হুমকি দিয়ে দিলো।”

নওরি হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারলো না। নিদ্র এবার নাক ফুলিয়ে বুকে দুই হাত গুঁজে বেশ বড়ো বড়ো ভাব নিয়ে বলে,
–“আমি নানুকে উচিত শিক্ষা দিবো।”
–“ভুলেও না নিদ্র। ভুলে গেছো তুমি তাঁর চশমা ভেঙেছো? এটা ঠিক না।”
এবার নিদ্র নেতিয়ে গেলো। কিছু একটা করতে গিয়েও বাঁধা পেলো। ভেবেছিলো নওরির থেকে সাপোর্ট নিবে কিন্তু সে বাঁধা দিলো দিলো তো অবশ্যই সাথে চশমা ভাঙার কথাটাও স্মরণ করিয়ে দিলো। নিদ্র হালকা ঢোঁক গিললো। চশমা ভেঙেছে জানলে সত্যি সত্যি-ই মাজেদা বেগমের মোটা লাঠিটা তাঁর পিঠের হাড্ডি গুরিয়ে দিলো। নিদ্র ভয়াতুর চোখে নওরির দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো। আমতা আমতা করে বলে,
–“আ..আসলে আজকে নিদ্র ভাইয়া লাঠিটা নিয়ে গেছে তো তাই নানু দেয়নি। আমি কিন্তু একদম মন খারাপ করিনি।”
নওরির ভ্রু আরও কিছুটা কুচকালো। সন্দিহান কন্ঠে বললো,
–“উনি নিয়ে কী করবে?”
–“আরে জানো না? আমার নিদ্র ভাইয়া সেই রকম ফাইটার। ঢিশুম ঢিশুমে সেরা আমার বিগ ব্রাদার।”

নওরি নিজের অজান্তেই একটি কল্পনা করে বসলো। কল্পনা করলো মারপিট দেয়ার সময় ইরা’দকে কেমন দেখাবে? পরবর্তীতে নিজেকেও কল্পনা করে ফেললো। ইরা’দ যদি ওই লাঠি নিয়ে নওরিকে মারে? নিদ্র’র বর্ণনা অনুযায়ী লাঠিটা বেশ শক্তপোক্ত। ওটা পিঠে পরলে তো… ধুর! কী ভাবছে সে? নওরিকে কেন মারবে ইরা’দ? আশ্চর্য কান্ড! নওরি নিজের ভাবনার উপর নিজে-ই চরম বিরক্ত হয়ে পরলো।

———————–
নওরি তাঁর বোরকা খামচে হেঁটে চলেছে। বোরকাটা সারিফার সাথে নিউ মার্কেট থেকে কিনেছে৷ নওরির হাতে যতটুকু টাকা ছিলো তাঁর মধ্যে সাড়ে সাতশো টাকা দিয়ে নরমাল বোরকা কিনেছে। এমনি, এমনি নয়! দাম কষাকষি করে। বোরকা হিজাব নেবার কারণ, নিজেকে আড়ালে রাখা। খোলামেলা চলাফেরা করলে যে কেউ চিনে ফেলার সম্ভাবনা আছে। তাই আগে থেকে সতর্কতা অবলম্বন করেছে নওরি।

নওরির ঠিক পাশেই ইরাদ বেপরোয়া হয়ে হাঁটছে। প্রতিবারের মতো-ই তাঁর মুখে মাস্ক৷ নওরি কোণা চোখে সামান্য চেয়ে নজর ঘুরিয়ে ফেললো। বড্ড অস্বস্তি লাগছে ওর। কিন্তু উপায় নেই। ছাত্র-ছাত্রীর বাসা চিনতে হলে ইরাদের সাহায্য লাগবেই। এছাড়া এই শহরের কিছু-ই চেনে না নওরি। তাই আজকের দিনটা সে ঢাকা ঘুরবে, পরিচিত হবে ঢাকার অলিগলির সাথে। এতক্ষণের মধ্যে অবশ্য ইরাদ কিছু জায়গা চিনিয়ে দিয়েছে৷ গরমে জর্জরিত নওরির মুখ লাল হয়ে আছে। সূর্যের তীক্ষ্ম কিরণ তাঁর মুখে লাগছে৷ এই তীব্র গরমে আবার মুখোশ বেঁধেছে৷ কাহিল অবস্থা নওরির। নওরি নাক এবং কপাল যতটুকু মুখোশ ব্যতীত দৃশ্যমান সেসব পৃষ্ঠে জর্জেট হিজাবের একাংশ দিয়ে ঘাম মুছছে।
–“বেশি কষ্ট হচ্ছে নৌরি ফুল? ছাতার ব্যবস্থা করব?”

নওরি চমকে পাশ ফিরে তাকায়। মাথা উঁচু করতেই দেখতে পেলো ঘর্মাক্ত, চিন্তিত ইরাদকে। নওরি অস্ফুট স্বরে শুধায়,
–“কে..কেন?”
–“রোদ লাগছে না আপনার। এজন্য রোদের হাত থেকে বাঁচার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা!”

গরমে জর্জরিত নওরি কিয়ৎক্ষণ চেয়ে থাকে ইরাদের পানে। পিটপিট করে। অতঃপর আমতা আমতা করে বলে,
–“প্রয়োজন নেই। আমি ঠিকাছি। এছাড়া এভাবেই কী হাঁটব?”

ইরা’দ নওরির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই লহু কন্ঠে আওড়ায়,
–“আপনি তো বাইক আনতে দিলেন না। তাহলে হাঁটা ছাড়া আর কী করব?”

নিরাশ নওরি পুণরায় তৃষ্ণার্তের মতো হাঁটতে লাগলো। আজ হাওয়া’রাও তীব্র প্রতারণা করছে। একটু বাতাস নেই আজ। কী যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা! ইরা’দ মুচকি হেসে বলে ওঠে,
–“অবশ্য একটি উপায় আছে!”
নওরি হুট করে থেমে যায়। ইরাদের দিকে ফিরে অস্ফুট স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“কী?”

ইরা’দ ঝুঁকে এলো নওরির দিকে। একদম নওরির মুখোমুখি। নওরি চমকালো, প্রচন্ড ভড়কালোও বটে৷ আশংকায় তড়িৎ মাথা কিছুটা পিছের দিকে নিয়ে নিলো। দৃষ্টি তাঁর বড়ো বড়ো। অন্তঃস্থল প্রচন্ড কাঁপছে, কেউ যেন ঢোল পি!টাচ্ছে বক্ষস্থলে। নিঃশ্বাস গলায় আটকে হতভম্ব চাহনি নিক্ষেপ করে রইলো ইরা’দের পানে। ইরা’দ মাস্ক কিছুটা খুলে আলতো হেসে বলে,
–“রিকশায় চড়বেন? খোলা আকাশের নিচে আপনি আমি ঘুরে বেড়াবো৷ বাতাস অনুভব করবো, আলাদা জগতে হারাবো।”

নওরির চোখ কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম। বলে কী এই ছেলে? রিকশা? রিকশা মানেই তো পাশাপাশি বসতে হবে। এবার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলো নওরির। ঘনঘন নেতিবাচক মাথা নেড়ে ভয়ার্ত গলায় বলে ওঠে,
–“একদম না। কখনো না। সম্ভব না!”

নওরির এলোমেলো কথা শুনে ইরা’দ হাসতে হাসতে পুণরায় মুখে মাস্ক পরে নিলো। এদিকে ওদিক তাকিয়ে হাসছে সে। শব্দহীন প্রাণখোলা হাসি তাঁর। হাসির তীব্রতা খুব বেশি। একসময় হাসি থামিয়ে বলে,
–“এত ভয় পান আমায়? আমি বাঘ নাকি ভাল্লুক?”
–“দুটোই! পুরুষজাতিকে আমি বিশ্বাস করি না। এরা আমার জন্যে অচেনা এবং আতঙ্কের পাত্র।”
–“নিজের বাবাকেও?”

নওরি নিরব হয়ে গেলো। এর উত্তর কী দিবে সে? কী উত্তর দেয়ার প্রয়োজন? হ্যাঁ বলবে নাকি না? মনের মধ্যে হঠাৎ-ই রেষারেষি এবং দ্বন্দ্ব শুরু হলো। এই দ্বন্দ্ব মূলত তাঁর বাবাকে নিয়ে। ইরা’দকে কী উত্তর দিবে সেটা দিয়ে। একসময় ক্লান্ত হয়ে নিরব থাকলো। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
–“আমার কেউ নেই।”

নওরি পূণরায় অগ্রসর হয় সামনের দিকে। ইরা’দ সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েটার কেউ নেই মানে? ভুল শুনেছে নাকি ইরা’দ। আসলেই তাহলে মেয়েটার মধ্যে রহস্য আছে। হঠাৎ ইরা’দের মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হলো নিদ্র’র বলা কথাটি। কিসের অসুখ এই পিচ্চি মেয়েটার?

এই মাঝরাস্তায় সব জানার জন্যে ব্যাকুল হলো না ইরা’দ। বরং নওরিকে স্বাভাবিক করতে এগিয়ে গেলো। হঠাৎ হাতে টান পরায় নওরি থেমে গেলো। পিছে ফিরে দেখে ইরা’দ পকেটে দুই হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি নওরির চোখ জোড়ায়। ওই চোখের ভাঁজে ইরা’দ আজ অসহায়ত্ব এবং বেদনা দেখতে পাচ্ছে।

ইরা’দ যেমন ঝড়ের গতিতে নওরির হাত ধরেছিলো তেমন ঝড়ের গতিতে ইরা’দ হাত সরিয়েও নিয়েছে। ইরা’দের এরূপ দায়সারা ভাব দেখে নওরি উগ্র মেজাজ দেখিয়ে বললো,
–“এভাবে হাত ধরলেন কেন?”
–“প্রমাণ কী?”
নওরি থতমত খেয়ে গেলো। কী বলবে বুঝলো না। আসলেই তো! তার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। প্রমাণ ছাড়া লাগাও সম্ভব না। নওরির বোকাসোকা চেহারা দেখে ইরা’দ এক গাল হাসলো। মুগ্ধময় হাসি। নওরির মাথায় হালকা টোকা দিয়ে বলে,
–“আপনি খুব নরম প্রকৃতির মেয়ে। আই লাইট ইট। আজকাল তোমার মতো মেয়ে গলিতে গলিতে হারিকেন দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।”
–“কেমন লোক আপনি?”

ইরা’দ নওরির দিকে দুই ধাপ এগিয়ে বলে,
–“আপনার নজরে আমি যেমন, ঠিক তেমন-ই। এখন রিকশা নিচ্ছি, কোনো কথা শুনবো না।”

—————–
ইরা’দের বাহুর সাথে নওরির বাহুর সংঘর্ষণে নওরির সর্বাঙ্গ কেঁপে কেঁপে উঠছে। নওরির বাহু যেন মুঁচড়ে অবশ হয়ে পরছে বারংবার। কী এক অস্বস্তিকর অবস্থা। ঘর্মাক্ত কপাল আরও ঘেমে যাচ্ছে নওরির। বর্তমানে ইরা’দের সাথে রিকশায় বসেছে নওরি। ইরা’দ তাঁর ক্ষতি করবে না জানে, কিন্তু পুরুষ তো! নওরি বারবার সরে যাচ্ছে। একসময় ইরা’দ হুট করে নওরির হাত ধরে বলে,
–“রিকশা থেকে পরে রাস্তায় গড়াগড়ি খাবার তীব্র ইচ্ছে জেগেছে বুঝি?”
–“ছা..ছাড়ুন হাত। রিকশা থামাতে বলেন। আমি পারব না, আপনার সাথে এক রিকশায় বসতে। সম্ভব না আমার পক্ষে!”
ইরা’দ এদিকে ওদিক তাকিয়ে বলে,
–“আর মাত্র পাঁচ মিনিট। একটু কষ্ট করুন।”
–“এত দূরে টিউশনি খুঁজতে বলেছে কে?”
ইরা’দ অবাক হবার ভান ধরে বলে,
–“যার জন্যে করি চুরি, সেই বলে চোর। কে বললো দূর? বরং কাছে৷ শুধু এই সেক্টর থেকে ওই সেক্টর, দ্যাট’স ইট!”
–“আপনার মতো ব্যস্ত মানুষকে আমার পাশে বেমানান দেখায়!”
ইরা’দ অসম্ভব ভ্রু কুচকালো। এদিকে নওরি তীব্র অস্বস্তি এবং গরমে অতীষ্ঠ হয়ে কিসব বলেছে নিজেও জানে না। রিকশা চলমান অবস্থায় বেশ কয়েক জায়গায় ইরা’দের ছবির পোস্টার দেখতে পেলো সে। সেই থেকেই মূলত মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। ইরা’দ কপালে দু-তিনটে ভাঁজ ফেলে বলে,
–“আপনার জন্যে আমি হলাম ব্যস্তহীন মানুষ!”
–“কেন?”
ইরা’দ গভীর নজরে নওরির চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
–“আপনার ছায়া তো! ছায়াদের মূল কাজ হচ্ছে তাঁর প্রতিপক্ষের মানুষটির সাথে আঁঠার মতো লেগে থাকা। আমি আঁঠা না লাগালেও লাগানোর প্রচেষ্টায় রয়েছি।”

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here