এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা লাবিবা ওয়াহিদ | পর্ব ২৪ |

0
580

#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২৪ |

————————
সৈকত সাহেব নিরবে, খুব মনোযোগ সহকারে পত্রিকা পড়ছে। নূরজাহান তখন রুমে প্রবেশ করলেন। শব্দের সাথেই প্রবেশ করলেন। যেন সৈকত সাহেব তাঁর উপস্থিতি টের পান। সৈকর সাহেব অবধ্য এদিক দিয়ে নির্বাক। কোনোরকম অভিব্যক্তি তাঁর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। পূর্বের ন্যায়-ই বসে আছে সে। দৃষ্টি পত্রিকায়। নূরজাহান বিছানার এক কোণায় বসলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে পুণরায় মনোযোগ পাবার প্রচেষ্টা চালালো। ব্যর্থ হলেন না অবশ্য। চোখ তুলে একপলক তাকিয়ে আবার পত্রিকায় নজর দিলেন। নূরজাহান হালকা কাশি দিয়ে মৃদু স্বরে আওড়ায়,
–“কিছু কথা বলার ছিলো!”

–“বলো। অনুমতির কী আছে?” সৈকত সাহেবের গম্ভীর কন্ঠস্বর।
নূরজাহান বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন,
–“মেয়েটা তো পাবলিকে চান্স পায়নি। তাই আমি চাইছি প্রাইভেটেই ভর্তি করিয়ে দেই! আপনি কী বলেন?”
সৈকত সাহেব গম্ভীর নজরে তাকালো নূরজাহানের দিকে। থমথমে সুরে বলে,
–“তো করাও। আমাকে বলছো কেন? যা ইচ্ছা তা করো তোমার বান্ধবীর মেয়ের সাথে!”
–“এভাবে বলছেন কেন?”
–“কীভাবে বললাম? নাটক তো কম করছো না। এক মাস খাটালে, দৌড়ালাম; সবই তো শুধু শুধুই। এই মেয়ের কী যোগ্যতা আছে পাবলিকে পড়ার? যা মন চায় করো, আমাকে বলার কী দরকার?”
নূরজাহান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–“মেয়েটা চান্স পায়নি এটাই দেখলেন, মেয়েটা কী, কী সহ্য করেছে সেটা তো দেখেননি! মেয়েটা মানসিক দিক দিয়ে দুর্বল, তাও পরিশ্রম করেছে; চেষ্টা করেছে। নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছে। যদি ভাগ্য সহায় না হয় তাহলে কিছুই হয় না!”
–“এসব আজেবাজে কথা না বলে মূল কথায় আসো। কী বলতে চাও, জলদি বলো আর বিদায় হও!” সৈকত সাহেবের কন্ঠে একরাশ তিক্ততা, বিরক্তি।

–“বলতে চাই এটাই, মেয়েটাকে প্রাইভেটে ভর্তি করার দায়িত্ব আমরা নিয়েছি। সেহেতু টাকার ব্যাপারটাও আমরা-ই দেখবো!”
–“ঠ্যাকা পরেছে আমার? পরের মেয়ের জন্যে আমি আমার এতগুলা টাকা জলাঞ্জলি দিবো? মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? কোন কান পড়া দিলো তোমায় ওই মেয়ে?”

নূরজাহান এবার তেঁতে উঠলেন। চোখ রাঙালেন স্বামীর উদ্দেশ্যে। তেঁতো কথায় তেঁতে ওঠাটাই স্বাভাবিক। নূরজাহান চাপা হুংকার চেড়ে বললেন,
–“মুখ সামলে কথা বলেন। এই মেয়ের মায়ের জন্যে-ই আমি নূরজাহান এখনো বেঁচে আছি। সুস্থ আছি, ভালো আছি।”
সৈকত সাহেব চোখ তুলে তাকালো নূরজাহানের দিকে। নূরজাহান হাঁপাচ্ছে। তাঁর চোখ লাল, টলমলে। সৈকত সাহেব বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে পরলো। কী বলছে নূরজাহান? সৈকত সাহেব অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“মানে?”
–“মানে হলো এই, আমার গাফিলতির কারণে এই মেয়েটি আজ মা হারা।”

সঙ্গে সঙ্গে নূরজাহানের গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরলে। এবার যেন সৈকত সাহেবের বিস্ময় ছুঁয়েছে সপ্তম আসমানে। পলক না ফেলে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রয় নূরজাহানের পানে। হতবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে যেন।

নূরজাহান নাক টেনে গালের অশ্রু হাতে উল্টো পিঠে মুছে বলতে শুরু করে,
–“সেদিন আপনি আমার সাথে খুব রাগা-রাগী করেছিলেন। সকালে না খেয়েই চলে গেছেন। সেজন্য আমারও গলা দিয়ে খাবার নামেনি। খাইনি কিছু। দুপুরের দিকে মুক্তা আমায় কল করে জানায় তাকে নিয়ে হসপিটালে যেতে। তাঁর নাকি শরীর ভালো যাচ্ছে না। বমি, মাথা ঘুরায়! নানান সমস্যা। এদিকে নওরির বাবাও ছিলো অফিসে, তাই মুক্তা তার সমস্যার কথা আমাকেই জানায়। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। হসপিটাল নিয়ে গেলাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের বসতে হয়েছিলো রিপোর্টের জন্যে৷

রিপোর্ট পেয়ে জানতে পারি মুক্তা প্রেগন্যান্ট। সে কী খুশি হয়েছিলো মুক্তা। ওকে নিয়ে আমরা বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। রাস্তা পার হতে নিলে আমার মাথাটা হঠাৎ-ই চক্কর দিয়ে উঠেছিলো। হয়তো সারাদিন পেটে কিছু না পরার কারণে। মাথা ঘুরানোর ফলে আমার পা সেখানেই থেমে যায়। আশেপাশে খেয়াল ছিলো। হঠাৎ কোথা থেকে একটি বাস আমার দিকে ধেঁয়ে আসে। সেদিকে আমি তাকালাম কিন্তু নড়াচড়া সাহস পেলাম না।

ভয়ে, আশঙ্কায় রীতিমতো সজ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। মৃ!ত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম সেদিন। হঠাৎ কোথা থেকে মুক্তা এসে আমায় সরিয়ে ফেললো। কিন্তু হায় আফসোস, মুক্তা নিজেকে বাঁচানোর সময় পেলো না। বিশাল বাসটি আমার বান্ধবীকে….”

নূরজাহান আঁচলে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠে। সৈকত সাহেব সেখানেই থমকে বসে রইলো। তাঁর মুখে কোনো কথা নেই। বাকশক্তি এবং ভাবনার শক্তি উভয়-ই তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। নূরজাহান আবারও বলে ওঠে,
–“আমার কারণে মেয়েটা এতটা অবহেলিত, লাঞ্ছিত হয়েছে৷ মায়ের সাথে আরেকটি নিষ্পাপ শিশুও প্রাণ হারিয়েছে। নওরির-ই বা কতটুকু বয়স ছিলো তখন৷ যেই মেয়েটা সৎ মায়ের বি!ষ প্রতিনিয়ত গিলেছে, সেই মেয়েটার জন্যে সারা বছর কোটি কোটি টাকা ঢাললেও আমি তাঁর শূণ্যস্থান আমি পূরণ করতে পারবো না। সেই পর্যায়ে যদি আপনি আমায় টাকা না দেন, আমি নিজের গহনা বিক্রি করেও ওকে আমি পড়াবো। যদি তাও নাহয়, লোন নিবো৷ তাও এই মেয়েটাকে আমি পড়াবো!”

বলেই নূরজাহান ক্রন্দনরত অবস্থায় রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সৈকত সাহেব পূর্বের ন্যায়-ই একই জায়গায় মূর্তির মতো বসে আছে। কেটে যায় দীর্ঘক্ষণ। একসময় ভাবনায় বিভোর হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আফসোসের স্বরে মিনমিন করে বললো,
–“কেন সেদিন আমি রাগ দেখালাম?”

——————-
ইরা’দ নওরিকে পরেরদিনের কথা বললেও ইরা’দ ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পরে। এছাড়া নওরিও কোনোরকম অভিব্যক্তি দেখায়নি যার ফলে ইরা’দের কাছে মনে হলো, এই অল্প সময়ে জোর-জবরদস্তি ঠিক হবে না। তাই সময় দিলো। তবে শর্ত দিলো, একা থাকলেও খাওয়া – দাওয়া সময় মতো করতে হবে৷ নওরি না চাইতেও রাজি হতে বাধ্য হয়। একটু স্বস্তিও পেয়েছে এই ভেবে যে ইরা’দ তাকে কয়েকটা দিন একা থাকতে দিয়েছে। কোনো কিছুতে জোর করেনি।

সৈকত সাহেব এবং সিদ্দিক সাহেব, দু’ভাই মিলে মিনমিন স্বরে কোনো এক আলোচনায় ব্যস্ত। ফিসফিস দুই ভাইয়ের মধ্যে চলছেই। এমতাবস্থায় মৌসুমি হাজির হলো। মৌসুমি আসতে আসতেই সৈকত সাহেব উঠে পরলেন। বড়ো ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
–“ভাইজান তাহলে আসি। অফিসেও যেতে হবে।”

মৌসুমি দুই ভাইয়ের পানে সন্দিহান নজরে তাকিয়ে বলে,
–“দুই ভাই মিলে কীসব ফুঁসুরফুসুর করলে আর কীই-বা হলো যে আমায় দেখতেই দুই ভাইয়ের ওঠার তাড়া হলো? হ্যাঁ? সমস্যা কী?”

সিদ্দিক সাহেব কিছু বলার পূর্বেই ইরা’দ চলে আসে ঘটনাস্থলে। ইরা’দ থমথমে স্বরে বলে,
–“তাঁরা ভাই-ভাই! নানান আলোচনা করতেই পারে। তোমার আর খালামণির কথার মাঝে বাবা কখনো জিজ্ঞেস করেছে, তোমরা কী আলোচনা করছো?”

থতমত খেলো মৌসুমি! আমতা আমতা করে বললো,
–“না!”
–“তাহলে? প্রাইভেসি দাও না। থাকুক কিছু কথা তাদের মধ্যে। এই বলে অন্যের প্রাইভেসি তে তো হস্তান্তর করতে পারো না!”
–“হইছে আমার প্রাইভেসির বাপ! ঘাট হয়েছে এখানে এসে। করো তোমরা আলোচনা। আমি তৃতীয় ব্যক্তি আর কিছু বলতে আসবো না।”

বলেই ভেংচি কেটে মৌসুমি ভেতরে চলে গেলো। ইরা’দ হাসলো। সিদ্দিক সাহেবও। সৈকত সাহেব বিদায় নিয়ে চলে গেলেন৷ সৈকত সাহেব যেতেই ইরা’দ তাঁর বাবার দিকে তাকালো। সিদ্দিক সাহেব চোখ দিয়ে আশ্বাস দিতেই ইরা’দ স্বস্তি পেলো যেন।
–“বুঝিয়েছি সৈকতকে। দুই ভাই মিলেই এডমিশন ফি দিবো! তুই চিন্তা করিস না। ক্যারি অন!”

——————-
নওরির মন ভালো করার জন্যে ইদানীং সকলেই তার কাছাকাছি থাকে। হাসি-খুশি নানান গল্প করে। বিশেষ করে নিদ্র। নিদ্র যেন সঙ্গ-ই ছাড়ে না। নওরি যেদিন দরজা লাগিয়ে সারাদিন রুমে ছিলো, সেদিন ছোট নিদ্র ভীষণ ভয় পেয়েছিলো। সেই ভয়ের তাড়ায় নিদ্র নওরির থেকে খুব বেশি কারণ ব্যতীত আলাদা হয় না। আজ তো নিদ্র আধা লিটারের কোকাকোলা নিয়ে আসলো। নওরি চোখ বড়ো বড়ো করে বলে,
–“কোকাকোলা আনলে কোথা থেকে?”
–“ফ্রিজে পেয়েছি। চট করে চুরি করে এনেছি। তুমি আমি মিলে খাবো। সাবানাকেও দিবো না।”

বোতলটি রাখতেই নিদ্র’র একটি বিষয় খেয়ালে এলো। নিদ্র কপাল চাপড়ে বললো,
–“উফফ! গ্লাস আনতেই তো ভুলে গেছি। তুমি এটা রাখো, আমি গ্লাস নিতে যাবো এবং আসবো!”

বলেই নিদ্র ভোঁ দৌড় দেয়। নিদ্র’র যাওয়ার পানে তাকিয়ে নওরি সামান্য হাসলো। হঠাৎ রুমে প্রবেশ করলো ইরা’দ। ক্লান্ত, এলোমেলো ইরা’দকে দেখে নওরি বেশ চমকালো। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলে,
–“আপনি এখানে?”

ইরা’দ সাথে সাথে প্রতি উত্তর না দিয়ে ছো মেরে নওরির হাত থেকে কোকাকোলার বোতলটা নিয়ে নিলো। অতঃপর ধপ করে বিছানায় বসতেই নওরি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দূরে সরে গেলো। নওরি বিছানার-ই একপাশে বসেছিলো। ইরা’দ বোতলের ট্যাপ খুলতে খুলতে বললো,
–“আমার জন্যে? থ্যাংকস! এটার-ই দরকার ছিলো। ভীষণ ক্লান্ত! বুঝলে?”

বলেই নওরির কোনো জবাবের অপেক্ষা না করে ঢকঢক করে পুরো বোতল খেয়ে ফেললো। নওরি চোখ কপালে তুলে দেখে গেলো ইরা’দের কাহিনী। ইরা’দ পুরোটা গিলে সুখের ঢেঁকুর তুলে আবেশী স্বরে বললো,
–“আহ! শান্তি!”

নওরি দরজার দিকে তাকাতেই চমকালো। নিদ্র দুইটা গ্লাস হাতে নিয়ে ইয়া বড়ো হা করে ইরা’দের দিকে তাকিয়ে আছে। বিস্ময়ে যেন তাঁর পলক পরছে না। নওরি দুই ভাইয়ের মাঝে ফেঁসে গেলো। বুঝে গেলো বড়ো সড়ো কিছু ঘটবেই। ইরা’দেরও হুট করে নিদ্র’র দিকে চোখ গেলো। ইরা’দ ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে লহু কন্ঠে বলে,
–“পিচ্চি নিদ্র? কী হলো? মশা গিলে নেওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?”
নিদ্র কিছু বললো না। তবে মিনিটখানেকের মাঝে ঘর কাঁপানো চিৎকার দিয়ে উঠলো। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে ওঠে,
–“এই কোক আমার ছিলো নিদ্র ভাইয়া! তুমি কেন আমার কোক এভাবে খেয়ে ফেললা! তোমার নামে কোক চুরির মা!মলা করবো! এখুনই যাবো আমি পুলিশ কাক্কুদের জেলখানায়।”

—————–
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
রিচেক দেয়া হয়নি। ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here