#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২৩ |
———————
ভাগ্য আজ এক চতুর খেলা দেখালো নওরিকে। চতুরতার খেলায় নওরি যেমন হেরে গেলো তেমনই নিঃশ্ব হয়ে গেলো। নিস্তেজ, নির্বাক হয়ে রুমের এক কোণায় বসে আছে নওরি। সারা ঘর এলোমেলো, অন্ধকারাচ্ছন্ন। দরজা বন্ধ। আফসোসের সাথে বলতে হচ্ছে, নওরি কোনো পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পায়নি। একটিতে ওয়েটিং লিস্টে ছিলো, তবে সবার শেষে। সেটারও কোনো রকম আশা দেখতে পাচ্ছে না নওরি। পড়াশোনায় সেরকম মেধাবী না হলেও নওরি নিজের সবটুকু দিয়ে চেয়েছিলো যেন একটা পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পায়। উপলব্ধি করেছে, তাঁর এক মাসের পরিশ্রম-ই যথেষ্ট ছিলো না৷ আরেকটু পড়ার দরকার ছিলো। বেশি প্রত্যাশার ফল বোধহয় এমনই হয়৷ চূর্ণ-বিচূর্ণ হৃদয় নিয়ে শূণ্য দৃষ্টিতে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে নওরি। মিনমিন করে বলে ওঠে,
–“কেন আমার জীবনটা আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক হলো না বাবা? কী দোষ করেছিলাম আমি বাবা? তোমরা পাশে থাকলে হয়তো এই ব্যথা সহ্য করতাম না। তোমাদের জন্যে আমার ভেতরটা কতগুলো ক্ষ!তের সমাহার সৃষ্টি হয়েছে তা কী জানো? আমি পাবলিকে চান্স পাইনি বাবা, তোমাদের ভালোবাসাও পাইনি। সৈকত আঙ্কেলের পরিশ্রমেরও দাম পাইনি বাবা। কী করে মুখ দেখাবো তাকে?”
নওরি ডুকরে কেঁদে ওঠে। দুই হাঁটুর ভাঁজে কপাল ডুবিয়ে শব্দের সাথে কাঁদতে থাকে। আরেকবার প্রমাণিত হলো পরিবারিক মর্মতা ছাড়া একজন সন্তান কতটা অসহায় হতে পারে। কেন সময় নওরির অনুকূলে এলো না?
নওরি যখন কাঁদতে ব্যস্ত তখন ফ্রিশা বারান্দার রেলিং এ ঝুলে আছে। ছাড়লেই ধপ করে ইরা’দের বারান্দায় গিয়ে পরবে। হলোও তাই। ধপ করে গিয়ে পরেছে ইরা’দের ডিভানে। পাশাপাশি দুটো ডিভান ছিলো সিঙ্গেল। ডিভানের সামনেই বেতের টি-টেবিল। ফ্রিশা মাথা তুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো। চাহনি গোল গোল। লাফ দিয়ে ডিভান থেকে নেমে পুরো ছাদের ন্যায় বারান্দায় লাফিয়ে বেড়ালো। নানান গাছের টবে ভরপুর ছাদটি। একটা চঁড়ুই পাখিকে দেখতেই তাঁর পিছে সারা বারান্দা ঘুরে বেড়ালো। আজ যেন তাঁর আনন্দের শেষ নেই। ওদিকে নওরি কেঁদে বেড়াচ্ছে আর এদিকে ফ্রিশা উড়ে বেড়াচ্ছে।
নওরিকে কল করতে করতে ইরা’দ নিজের রুমে ঢুকলো। পরিহিত ঘর্মাক্ত শার্ট দেহ থেকে মুক্ত করে টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে নিলো ইরা’দ। চিন্তায় কপালে দু’তিনটে ভাঁজ পরেছে৷ নওরির ফোন কেন বন্ধ বলছে? আজ তো রেজাল্ট দেবার কথা।
হঠাৎ কিছু ভাঙার শব্দ শুনতে পেলো ইরা’দ। শব্দটা বারান্দা থেকেই এসেছে। কিন্তু ভাঙা শব্দের ঘটনা কী? কৌতুহলী হয়ে ইরা’দ সেদিকে এগোলো। বারান্দায় গিয়ে মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরলো। তাঁর দুইটা ফুলের টব ভেঙ্গে পরে আছে। কে ভাঙলো এগুলো? এদিকে তো কেউ আসেনি। তাহলে? কার এত দুঃসাহস? ইরা’দ আরও এগিয়ে চারিপাশে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কিছুদূর যেতেই একটা ধূসর এবং সাদা মোলায়েম কিছু দেখতে পেলো। অনেকটা লেজের মতো। কিন্তু লেজ কিসের? ইরা’দের ভ্রু কুচকে এলো। হুট করে লেজটি নড়েচড়ে উঠলো। ইরা’দ না দাঁড়িয়ে সেদিকেই পা বাড়ালো। কাছাকাছি আসতেই টবের পেছন থেকে ফ্রিশা বেরিয়ে এলো।
ফ্রিশাকে দেখে ইরা’দের মাথা ফেটে যাবাএ উপক্রম। সে তাঁর প্রিয় বারান্দায় কাউকে প্রবেশ করতে দেয়নি সেখানে কি না এই বিড়াল এসে তাঁর দুই দুইটা টব ভেঙে দিলো? মহা ব!দজাত বিড়াল তো। কিন্তু এই বিড়াল আসলো কোথা থেকে?
ইরা’দ খপ করে ফ্রিশাকে ধরে ফেললো এবং উপরে তুলে নিলো। ফ্রিশা পিটপিট করে ইরা’দের দিকে তাকালো। ইরা’দ হেসে বলে,
–“এবার কই পালাবি তুই? তোকে তো আমি এখন বারান্দা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিবো। আমার বারান্দায় এসে আমারই দুটো প্রিয় ফুলের টব ভেঙেছিস! এত সাহস?”
হঠাৎ ফ্রিশার ঘন পশমযুক্ত লেজটি ইরা’দের নাকে গিয়ে লাগলো। ইরা’দ ফট করে ফ্রিশাকে ছেড়ে দিয়ে হাঁচি দিয়ে উঠলো। পরপর চার বার। হাঁচিগুলোও মারাত্মক! এমতাবস্থায় নিদ্র আসলো ইরা’দের বাগানে। ফ্রিশা দ্রুত নিদ্র’র কাছে ছুটে গেলো। ইরা’দ ততক্ষণে পকেট থেকে টিস্যু প্যাকেট বের করে একটি টিস্যু নিয়ে নাক মুছলো। আবার আসলো হাঁচি। নইদ্র হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
–“নিদ্র ভাইয়া! জলদি উপরে আসো, নৌরি ফুল দরজা খুলছে না। মা, সাবানা অনেক ডেকেছে নৌরি ফুলকে। কিন্তু নৌরি ফুল কোনো সাড়া দেয়নি। দ্রুত এসো ভাইয়া, আমার খুব ভয় করছে!”
——————
সন্ধ্যা হয়েছে আরও কিছুক্ষণ আগে। আসমান থেকে আলোর আবছা রেখাও মিলিয়ে গিয়েছে। চারপাশে কৃত্রিম আলোয় শহর এবং শহরের প্রতিটি অলিগলি আলোকিত। ইরা’দ মই নিয়ে নওরির বারান্দায় উঠছে। অলরেডি আধঘন্টার মতো নওরিকে ডেকে এসেছে ইরা’দ। কিন্তু নওরি দরজা খুলেনি। সাড়া শব্দ করেনি। তাই বাধ্য হয়েই এই পথ অবলম্বন। খুব সাবধানে বারান্দায় উঠে গেলো ইরা’দ।
নওরির রুম এখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন। নওরি নির্জীব হয়ে বসে আছে। বারান্দার দরজা দিয়ে এক ফালি আবছা আলো অন্ধকার রুমে প্রবেশ করেছে। তবে আলোতে তীব্রতা নেই; ঝাপসা। দরজাটা একটু আগেই হালকা ফাঁক করে এসেছে সে৷ ফ্রিশা বারান্দাতেই, তাই ফ্রিশা যেন রুমে আসতে পারে এজন্য দরজা খুলেছে। নয়তো বিকালে ফ্রিশাকে বারান্দায় রেখে দরজা ভেঁজানোই ছিলো। কিন্তু নওরি কী আর জানে তাঁর বিড়াল রাণী কী কান্ড ঘটিয়েছে?
হঠাৎ বারান্দায় শব্দ হতেই নওরি নাক টেনে চোখ মুছলো। অতঃপর উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দার দিকে য্রতে যেতে বলে,
–“ফ্রিশা! খুদা পেয়েছে তোর? দেখ নিদ্র’র গাছগুলো ভাঙবি না। নয়তো…”
বারান্দায় দরজার সাথে দাঁড়াতেই নওরি থমকালো। থমকে গেলো তাঁর কন্ঠস্বরও! ইরা’দকে দেখে প্রথমে তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিলো না। কিন্তু যখন দেখলো ইরা’দ তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে, তখন দ্রুত দরজা লাগাবে এমন সময় ইরা’দ শক্ত করে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে পরে। নওরি বারবার ব্যর্থ চেষ্টা করলো দরজা লাগানোর। কিন্তু ইরা’দের শক্তির সাথে পেরে উঠলো না। যখন দেখলো শক্তি দিয়ে কাজ হচ্ছে না তখন নওরি কম্পিত স্বরে বলে,
–“দ…দরজা ছা..ছাড়ুন!”
–“আমার কথা শুনো!”
–“না, আপনি এখানে কেন এসেছেন? চলে যান। প্লিজ!”
–“আমার চোখে চেয়ে বলো!”
–“পারবো না। প্লিজ যান।”
–“জান? খুব সুন্দর মানায় তো তোমার কন্ঠে।”
ইরা’দের এরূপ রসিক বাক্য শুনে মুহূর্তের জন্য থমকালো নওরি। ইরা’দ এই সুযোগটাই কাজে লাগালো। নওরিকে ঠেলে নিজেই ঢুকে পরলো ইরা’দ। ভেতরে ঢুকে বলে,
–“এ কী হাল করেছো রুমের? অন্ধকার কেন?”
ইরা’দ কথা বলতে বলতে পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্ল্যাশ জ্বালালো। অতঃপর সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে লাইট জ্বালালো। নওরি ভেতরে এসে বললো,
–“কেন এসেছেন আপনি?”
–“মাথা ব্যথা। তোমার নরম হাতে মাথা মাসাজ করাতে এসেছি। চা হলেও আপত্তি নেই!”
–“মজা নিচ্ছেন?”
–“মজা নেবার মতো সময় হলো?”
–“আপনি প্লিজ চলে যান!”
ইরা’দ শুনলোই না যেন নওরির অনুরোধ। দায় সাড়া ভাব নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। বেপরোয়া, নির্বাক ব্যবহার। নওরি চুপ থেকে দাঁড়িয়ে রইলো। ইরা’দ পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে বলে,
–“পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স না পাওয়া মানেই কী হেরে যাওয়া নৌরি ফুল?”
নওরি থমকায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয় ইরা’দের পানে। ইরা’দ আবার টের পায়নি তো সবকিছু? সে কী জেনে গেছে নওরির পারিবারিক অবস্থা? নাহ! সেটা কী করে সম্ভব? নওরি হয়তো বেশি-ই ভাবছে। ভাবনাটি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো নওরি। ইরা’দ নিরবে চেয়ে আছে শুকনো মুখখানার পানে। নওরি পদতলে নজর আটকে বললো,
–“প্রাইভেটে অনেক খরচ। আমার এত খরচ বহনের সামর্থ্য নেই!”
–“তোমাকে কে বলেছে প্রাইভেটে শুধু টাকাওলারাই পড়তে পারবে? অসংখ্য ছেলে-মেয়ে প্রাইভেটে পড়ছে। আর পাবলিক ভার্সিটি হচ্ছে মেধার খেলা। ওখানে হার-জিত হবেই, স্বাভাবিক। এ বলে নিজেকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে রুমের এক কোণে পরে থাকবে?
তুমি-ই বলো, সময় থেমে থাকবে তোমার জন্যে? সে প্রবাহমান, চলবেই। তেমনই তোমার জীবনও থেমে থাকবে না। ধাক্কা খাবে, উঠে দাঁড়াবে; এটা জীবনেও অন্যতম মূল্যবান অংশ। ভাগ্যকে দোষ দিয়েও লাভ হবে না। কারণ, দুঃখের পরেই আছে সুখ। সেই সুখের জন্যেই এই দুনিয়ার হাজারো মানুষ ছুটে চলেছে। শুধুমাত্র একটুখানি সুখের আশায়।”
নওরি সবটুকু মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তাঁর চোখ আবারও ঝাপসা হয়ে এসেছে। কী করে বুঝাবে তাঁর ভেতরকার ক্ষ!তগুলো? ইরা’দ আবারও বলে ওঠে,
–“এডমিশনের জন্যে প্রিপারেশন নিতে তুমি সময় কম পেয়েছো, এ নিয়ে আফসোস করলে চলে? অলরেডি ওট তোমার অতীত হয়ে গিয়েছে। বর্তমান নিয়ে ভাবো। বর্তমানে কীভাবে ভালো থাকবে সেটাকে গুরুত্ব দাও। পেছনে ফেলে আসা সময় নিয়ে ভাবলে কখনোই সুখের দেখা পাবে না। বুঝেছো আমার কথা?”
নওরি আগের মতোই নিশ্চুপ। ইরা’দ বুঝলো এভাবে নওরিকে ভ্রম থেকে বের করতে পারবে না। তাই লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–“ঠিকাছে। কাল তৈরি থেকো। তোমায় নিয়ে বের হবো। আগামীকালের পুরোদিন তোমার জন্যে বরাদ্দ রইলো নৌরি ফুল। দু’জন এক সাথে পুরো শহর ঘুরবো। রাজি আছো তো? রাজি না থাকলেও কিন্তু নিয়ে যাবো। জোর করে। তখন কিন্তু কোনো অভিযোগ শুনবো না। আচ্ছা?”
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় আছি।