বোনের হাসবেন্ড এক কালে আমার অঘোষিত প্রেমিক ছিলো। হাসি মুখেই নিজের ভালোবাসার মানুষ টি কে বোনের হাসবেন্ড হতে দেখলাম! তবে আমি এমন ছন্নছাড়া ছিলাম না কখনোই। এখন যেন কেমন হয়ে গেছি। এই যে যাকে আমি ভালোবাসি যার জন্য আমার অন্তরে মায়া জাগে ,গত মাসে সে আমার খালাতো বোনের হাসবেন্ড হয়ে গেল কি না।সম্পর্কে সে এখন আমার দোলাভাই হয়। বিষয় টা বড় ই আশ্চর্য!
হাতের তর্জনী তে চোখের কার্নিশের বিন্দু জল মুছলো বেলা। সম্পূর্ণ নাম বেলাদোনা হালদার। নিজ ধর্ম নিয়ে কিছু টা অস্থায়ীত্ব ভাব বলা যায়। খ্রিষ্টান আর ইসলাম দুই ধর্মের মাঝামাঝি তে অবস্থান করে সে। এতে অবশ্য তাঁর দোষ নেই। স্বীয় ভাগ্য বিড়ম্বনায় এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির স্বীকার। নৈঃশব্দ্য তে অশ্রু বিসর্জনের এক পর্যায় নিজ গন্তব্যে পৌছে গেল। স্কার্ট এর পকেট থেকে টিসু নিয়ে ভালো করে চোখ মুছে কলিং বেল চাপলো। এক বার দু বার তিন বার কলিং চাপতেই মাঝ বয়সী অত্যন্ত সুন্দরী এক ভদ্র মহিলা দ্বার খুলে দিলেন।মাথার স্কাফ টা ঠিক করে মাথা টা সামান্য ঝুঁকিয়ে গনগনে স্বরে বলল বেলা–
” শুপ্রভাত আন্টি। আমি হালদার কুকিং এন্ড বেকিং থেকে এসেছি অর্ডারকৃত চকলেট কুকিজ আর ফ্রুট কেক ডেলিভারি দেওয়ার জন্য। ”
” ও হ্যাঁ ভেতরে আসো ডিয়ার। নিশ্চয়ই ইথান অর্ডার করেছে। ছেলেটা আমার হুট হাট যা তা করে বসে। এক বার জানালো ও না। আমি তো এখনি বের হচ্ছিলাম। কি হতো বলো তো? ”
মৃদু হাসার চেষ্টা চালালো বেলা। সে জানে না কে অর্ডার করেছে। তাকে শুধু মাত্র ই ডেলিভারির দায়িত্ব দিয়েছেন মারিয়া। ভদ্র মহিলা সব ঠিক ঠাক চেইক করে নিয়ে বিল মিটিয়ে দিলেন।
স্বভাববসত তিনি এক টুকরো কেক আর দুটি কুকিজ তুলে দিলেন বেলার হাতে। ভেজা হেসে বললেন সেগুলো খেতে। বেলা নাকোচ করতেই তিনি জোড়াজোড়ি শুরু করলেন। বেলা হতভম্ব! সাধারন ডেলিভারি গার্লের জন্য এমন আপ্যায়ন ই বা কেন?
চার টে ডেলিভারি দিয়ে মধ্য দুপুরে বেকারি তে ফিরলো বেলা। মাথা তে সার্বক্ষণিক স্কাফ পরা থাকাতেই শরীরের ঢাকা অংশ ঘেমে নেয়ে একাকার। ঘামের কারনে পিঠের অংশ টা ফুটে উঠেছে অনেক টাই। ছোট বোন এলিজা তোয়ালে এগিয়ে দিলো। বাচ্চা মেয়েটির বয়স খুব ই অল্প। সবে মাত্র দ্বিতীয় শ্রেনির গন্ডি টপকালো। দেখতে ও ভারী মিষ্টি। রূপ যেন চাঁদের আলোর মতো খসে পরে এই বয়সেই। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে এলিজা প্রশ্ন করলো।
” আপুই আমি কি এক টা কেক খেতে পারবো ? ”
” হ্যাঁ নিশ্চয়ই খেতে পারো এলিজা। কে বারণ করবে তোমায়? ”
” আন্টি আমাকে খেতে দিচ্ছিলো না। ”
কথা শেষ করে মুখ টা নিচু করে ফেললো বাচ্চা মেয়ে টি। নাকের ডগা টা ইষৎ রক্তিম বর্ণ। চোখের মনি তে অভিমান মিশ্রিত। ঠোঁট কামড়ে গড়িয়ে যাওয়া নোনা অশ্রু কনা আটকালো। কিচেন থেকে মারিয়া টুকরো করা ভ্যানিলা কেক নিয়ে এসে বলল
” আজ পাঁচ টা চকলেট কেক এর আর দু বক্স চকলেট কুকিজ এর ডেলিভারি দিতে হয়েছে বেলা।সেগুলো অন্য শহরে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে ও গ্রসারি শপে যাওয়া হয় নি। চকলেট সিরাপ শেষ প্রায়। তোমার মা ফিরে না আসা অব্দি এই টুকু তেই কাজ চালাতে হবে আমাদের। সেই কারনেই এলিজা কে চকলেট কেক দেই নি আমি। আর এটার জন্য মুখ ভার করে আছে। ”
” এক টুকরো দিলে কি ই বা হতো আন্টি? ”
মারিয়ার মুখ টা ছোট হয়ে গেল। তিনি ভেবেছিলেন বেলা তার সঙ্গ দিবে। টেবিলে ভ্যানিলা কেক রেখে খচখচ শব্দে কিচেন থেকে চকলেট সিরাপের বক্স দেখালেন। তলানি তে সামান্য ই পরে আছে। সত্যিই মারিয়ার কোনো দোষ নেই। তিনি ভালোর জন্যই এমন করেছেন। কিন্তু ছোট্ট এলিজার নাজুক মন কে বোঝাবে কি করে?
সকল দিক সামলে পরিশ্রান্ত বেলা। এমন হওয়া টাই স্বাভাবিক। জীবনে এতো কাজ করতে হয় নি তাকে। হেবা কখনোই তাকে দিয়ে এতো কাজ করান নি। সব কাজ দু হাতে সামলিয়েছেন। তবে এই বিশেষ প্রয়োজনে শহরের বাহিরে গিয়ে বেলা কে বিপদেই ফেলে দিলেন তিনি। এতো এতো কাজ করে দেহে বিন্দু মাত্র শক্তি অবশিষ্ট রইলো না আজ। হাত মুখ ধুয়ে মাত্রই চোখ বুজেছে। তবে গুটি গুটি পায়ের শব্দ শুনে ফট করে তাকালো।
কর্দমাক্ত শরীরে এলিজা ঘরে প্রবেশ করতেই বেলা ক্ষিপ্ত হলো। এলিজা কে খুব ভালোবাসে সে। তবে অপরিষ্কার হওয়া টা তাঁর নিকট খুব ই দুঃখের। বেশ বকা দিলো ছয় বছরের বাচ্চা মেয়েটিকে। এলিজা যেন অভিমানের এক মাত্র রানী। নাকের পাটা লাল করে নিয়ে বলল
” আমি আর কখনো এমন করবো না। ”
” তুমি সব সময় এমন করো এলিজা। এই বিষয় টা কিছু তেই বোঝাতে পারি না আমি। তুমি খুব ই দুষ্টু! ”
” দুঃখিত আপুই। ”
” যাও দ্রুত হাত পা ধুয়ে আসো। খুব মাথা ব্যাথা করছে আমার। ”
বিড়াল পায়ে চলে গেল এলিজা। রুদ্ধশ্বাস ফেলে ডিভানে গা এলিয়ে বসলো বেলা। পুরো শরীর নিঃসহায় হয়ে আসছে হঠাৎ ! চোখ দুটো ও কেমন লেগে যাচ্ছে বারংবার। শত চেষ্টা চালিয়ে ও চেয়ে থাকা যাচ্ছে না। স্নায়ুতন্ত্র যেন বলছে তুই পারবি না এবার। নিদ্রা তোকে স্পর্শ করবেই।
*
তুমুল বৃষ্টির শব্দে জানালা গুলো ঝাপটা দিতে শুরু করেছে। আকাশে পুরো দমে চলছে অন্ধকারের রাজত্ব কায়েম। কিছু দূর পর পর ল্যাম্পপোস্ট গুলো জ্বলে আছে মিটমিটে তারার মতো। সেগুলো কে বিশেষ কোনো নাম দেওয়া যাচ্ছে না এখন। তবে সটান হওয়ার কারনে আত্মগরিমা ফুটে উঠেছে। কাঠের কাঠামো দ্বারা তৈরি জানালা গুলো সমানে তাল মেলাচ্ছে বাতাসের সহিত। যার ঝন ঝন আওয়াজ যে কারো বিরক্তির কারন হতে পারে অবিলম্বে। এতো এতো শব্দের মাঝে ঘুম টা ভেঙে যাওয়ার ই কথা। সাথে যদি কোনো ভয়ঙ্কর স্বপ্নের দেখা মিলে তাহলে তো ঘুম ভাঙার বিশেষ প্রয়োজন।ধরমরিয়ে উঠলো বেলা। কপালের দিক টায় নোনা জল দৃশ্যমান। দীর্ঘ সময় যাবত এক ভয়াবহ স্বপ্ন দেখেছে সে। আলগোছে সমস্ত টা স্বাভাবিক করে নিয়েই এলিজা কে ডাকা শুরু করলো।
” এলিজা, এলিজা কোথায় তুমি। এদিকে আসো বোন আমার। এলিজা তুমি কি শুনতে পারছো না? ”
সাড়া শব্দ নেই! বেলার কপালের রেখা গুলো অতি সূক্ষ্ম। তবু ও কপাল কুঁচকে রাখায় মেয়েটির সৌন্দর্য্যে কেমন ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। ঝটপট দোতলায় ছুটলো সে। কাঠের সিঁড়ি হওয়ার দরুন খটখট আওয়াজ হচ্ছে পদাঘাতে। চিন্তিত মন নিয়ে উপরের রুমে চোখ বুলাতেই বুক থেকে যেন চিন্তার পাথর নেমে গেল। ঘুমিয়ে আছে এলিজা। তবে খুব ই বাজে ভঙ্গিমায়! মেয়েটি কে ঠিক করে শুয়ে দিয়ে কপালে শুষ্ক চুম্বন করলো। কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে কপাল থেকে ঠোঁট উঠালো। তখন বকেছিলো বিধায় এখন খারাপ লাগছে। কিছু খায় ও নি বোধহয়। অনেক টা সময় অতিবাহিত হলো। বেলার তৈরি প্যান কেক ভালোবাসে এলিজা। কিচেনে গিয়ে প্যানকেক বানাতে শুরু করলো তাই। ফ্রাইং প্যানে লিকুইড মিক্সচার দিয়ে কয়েক টা প্যান কেক ভেজে নিলো ঝটপট।শেষে হালকা মধু আর ফালি করে কাঁটা স্ট্রবেরি সাজিয়ে নিয়ে এলো এলিজার কাছে। মেয়েটির মুখের কোন বেয়ে নেমেছে লালার স্রোত। টিসু দিয়ে পরিষ্কার করে দিলো সেটা। আদুরে স্বরে বোনের ঘুম ভাঙালো। বিকেলের অভিমান ভুলে গেছে এলিজা। তাই প্যান কেক হাতে নিয়ে উৎফুল্লতা নিয়ে বলল
” তুমি বানিয়েছো আপুই? ”
” হ্যাঁ সোনা। কেন তোমার পছন্দ হয় নি? ”
” আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ”
গপগপ করে খাচ্ছে এলিজা। বাজ পরার শব্দ গুলো এখনো কানে পৌছায় নি। না হলে এতোক্ষণে বেলা কে জড়িয়ে বসে থাকতো সে। মেঘের গর্জন কে প্রচন্ড ভয় পায় কি না।
শহরের নিম্নচাপের কথা শুনতে পেয়েই কল করেছে হেবা। ভদ্র মহিলার কন্ঠ থেকে নির্গত প্রতি টা শব্দে চিন্তার ভাঁজ। বার বার আশ্বস্ত করছে মারিয়া। তাঁতে ও ক্ষান্ত হয় নি হেবা। এই অসময়ে বেলার কাছে যাওয়া ও সম্ভব নয়। তবু ও তিনি বললেন
” আমি যাওয়ার চেষ্টা করবো হেবা। তুমি চিন্তা করো না। ওরা নিশ্চয়ই ঠিক আছে। ”
” চিন্তা তো হচ্ছে মারিয়া। বাচ্চা দুটো মেয়ে একা রয়েছে একদম। ”
” বেলা অতো টা ও ছোট নয়। তাছাড়া বেশ বুদ্ধিমতি মেয়ে সে। নিশ্চয়ই সামাল দিতে পারবে। ”
” তাই যেন হয় মারিয়া। ঈশ্বর যেন ওদের রক্ষা করেন।”
মারিয়ার সাথে কথোপকথন শেষ করে প্রতিবেশি দের সাথে যোগযোগের চেষ্টা চালালো হেবা। এলিজা ছোট মানুষ আর বেলার কাছে ও ফোন নেই। এদিকে ল্যান্ড লাইন কাজ করছে না। কি একটা ঝামেলায় পরা গেল!
একটু একটু ভয় পাচ্ছে এলিজা। সার্বক্ষণিক বেলার পিছু পিছু ঘুরছে। মাত্র ই বাসন গুলো পরিষ্কার করলো বেলা। সেখানে ও উপস্থিত ছিলো এলিজা। ভয়ে একদম চুপসে গেছে মুখখানা। চেহারার অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছে মেয়েটার চোখের ঘুম জলীয়বাষ্প হয়ে বাতাসের সাথে হয়েছে বিলীন। ত্রস্ত চোখ গুলো তখনো তীব্র গরিমায় টানা করে তাকানো। বাসন গোছাতে গোছাতে এলিজা কে দেখে নিলো বেশ কয়েক বার।খুব ভালো করেই ফুটে উঠেছে ভীত সন্ত্রস্ত হওয়া দৃষ্টি। ইষৎ কেঁপে কেঁপে উঠছে কয়েক বার। কাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষা ই করছিলো যেন। বেলার হাত ধরে বলল
” আমার সাথে ঘরে চলো আপুই। ”
” এখন তো অনেক কাজ বাকি বোন। তুমি যাও না। ”
” না। আমি যাবো না। ভয় লাগছে খুব। ”
” আচ্ছা দাঁড়াও আসছি আমি। ”
হাত মুছে এলিজা কে নিয়ে রুমে যাচ্ছিলো বেলা। তবে কলিং এর শব্দে যাওয়া হলো না আর। রাত আট টা বাজে। এই অসময়ে কে আসতে পারে ঠাওর হলো না সঠিক। শঙ্কিত মনে আগালো কয়েক পা। ভাঙা গলায় প্রশ্ন ছুড়লো।
” কে? ”
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর নেই। বেলা আবার প্রশ্ন করলো এবারো ফলাফল শূন্য । ভয় লাগছে এবার। পাশ থেকে হাত আঁকড়ে ধরলো এলিজা। মেয়েটির সাথে দৃষ্টি বিনময় করে বেলা বলল
” কিছু হবে না এলিজা। ভয় পেও না বোন আমার। ”
দরজায় কান পেতে কথা শোনার চেষ্টা চালালো দুই বোন। তবে কোনো শব্দ নেই। এক টা দম ফেলে যেই না পথ আগাবে আবার কলিং বাজলো। বেলা এবার খুব জোড়েই প্রশ্ন করলো।
” এতো রাতে কে এসেছেন? ”
” আমি। ”
পুরুষালি কন্ঠ! বেলার বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করছে। অজানা ভয়ে এলিজা কে চেপে ধরলো নিজের সাথে। ওপাশ থেকে দরজায় আঘাত করে যাচ্ছে পুরুষ ব্যক্তি টি। নিজের সমস্ত আশংকা যেন একটু একটু করে পরিনতি পেতে চলেছে। চোখ দুটো ঝাপসা হতে শুরু করলো। কষ্ট হচ্ছে অন্তরালে। নিজের জন্য নয় ছোট বোন এলিজার কথা মনে হতেই কান্না এসে টোকা দেয়। ওপাশে থাকা ব্যক্তিটির কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। তবে সে শব্দ গুলো শ্রবণ হলো না বেলার।
তীব্র আঘাতে দরজায় লাগানো ভাঙা লক টা খুলে গেল। ওপাশ থেকে ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়সী একজন ভেতরে প্রবেশ করলো। গা থেকে আসছে হুইস্কির গন্ধ। চোখে মুখে লালসা। বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসি দিলো। ভয়ে বেলা কে জড়িয়ে ধরলো এলিজা। কোনো কিছু আন্দাজের পূর্বে ই বেলার ওপর হামলা করে বসলো লোকটা।
** অব্যক্ত প্রিয়তমা লেখার সময় একটা আলাদা দ্যুতি ছিলো আমার মাঝে। ঠিক তেমন টাই এই গল্পে অনুভব করছি। অর্থাৎ আমার অন্তর বলে যাচ্ছে পাঠক দের জন্য ভালো কিছু হবে ইনশাআল্লাহ। **
✍️
Fatema Tuz
#ফাতেমা_তুজ
#বেলাদোনা (১)
চলবে…