বেলাদোনা (১০)

0
250

#বেলাদোনা (১০)
#ফাতেমা_তুজ

সাত দিন পূর্ণ হওয়ার ঠিক দুদিন পূর্বেই ফিরে এসেছে ইথান। এই জঙ্গলের ধারে বেলা এখন রক্ষিত আমানত ফেরত দিতে এসে ইথানের গম্ভীর প্রশ্নের সম্মুখীন হলো। নাছোড়বান্দা ইথানের সাথে না পেরে উঠে, বেলা ডুকরে কেঁদে উঠলো। বলে দিলো ঘটে যাওয়া পেছনের সব টা। ইথানের চোখ দুটো নির্জীব ভাবে ভাবছে কিছু। সত্যিই তো একটা জলজ্যান্ত মানুষ কি করে উধাও হয়ে যায়! সব থেকে খারাপ লাগলো এলিজার জন্য। বাচ্চা একটি মেয়ে, যখন জানতে পারবে তখন কি কান্ড রটাবে জানা নেই। বেলার চোখের নিচে জমে থাকা ঘুম না হওয়ার বলি রেখা গুলো অনেক কিছুই বলে দেয়। ইথান বেশি কিছু জানতে চাইলো না তবে বেলা একটা প্রশ্ন করেই ফেললো–
” লুসির শরীর কেমন হীম শীতল। আমার মনে হয় ঔষধ এর রিয়্যাকশন পরেছে। ”

ইথান চট জলদি ব্যাগ টা তুলে নিলো। এতে অবশ্য বেলার কোনো হেলদোল হলো না। ইথান লুসি কে না বের করেই বলল–
” আই থিংক অলসো, থ্যাংকস অ্যা লট বেলা। আমি লুসি কে নিয়ে যাচ্ছি। দেখি চেকাপ করে। আর শোনো চিন্তা করো না। তোমার মা ভালো আছেন। ”

বেলা কে সান্ত্বনা দিয়ে চলে এলো ইথান। মুহুর্তেই এতো টা তাড়াহুড়ো করা বেলার কপালে চিন্তার সৃজন করলো। তবে বেশি ক্ষণ সে চিন্তা ধরে রাখতে পারলো না। হেবার জন্য ভীষণ মন খারাপ হতে লাগলো। বেলার সাদা হাত গুলো কেমন লালটে হয়ে গেছে। সম্ভবত এলার্জির দেখা পাওয়ার পূর্বাভাস।

লুসি কে নিয়ে সেই যে ইথান গেল আর কোনো খোঁজ খবর নেই। আজকাল এলিজা বড্ড অধৈর্য। বারবার মায়ের জন্য কান্না কাটি শুরু করে। বেলা অবশ্য উল্টো বুঝ দেয়। এ ছাড়া কোনো উপায় ও যে নেই। পুলিশের কাছে গেলে তাঁরা বলে কাজ চলছে। সেখানেই সীমাবদ্ধ তবে কোনো কাজ আদৌ কি হচ্ছে এ নিয়ে রয়েছে ভীষণ রকমের সন্দেহ। বেলা অন্যমনস্ক হয়ে বেকিং করছিলো তখনি হাতে গরম কিছুর স্পর্শ লাগলো। মেয়েটি ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো। সে শব্দে বাহির থেকে রসুই ঘরে ছুটে এলো ইথান। ফর্সা হাতে ইতিমধ্যেই কালচে রূপ ধারণ করেছে। ইথান কোনো প্রকার সময় নষ্ট না করে এন্টি সেপটিক লাগিয়ে দিলো। ব্যথার কারনে ছেলেটার মুখ ও দেখে নি বেলা। তবে যখন দেখলো এক প্রকার ভরকে গেল। বিরোধ করে ইথান বলল–
” কি হচ্ছে টা কি বেলা। নিজের খেয়াল তো রাখোই না। আর এখন ঔষধ লাগাতে ও দিচ্ছো না। ”

” আপনি কখন এলেন! ”

” অনেকক্ষণ। ”

” মারিয়া আন্টি! ”

বেলার চোখে ভয়। হেসে ফেললো ইথান। সামান্য নিচু হয়ে ফিসফিস করে বলল
” রিল্যাক্স আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড নই যে লুকিয়ে দেখা স্বাক্ষাৎ করবো। তাছাড়া ডোন্ট ওরি মারিয়া ডেলিভারি দিতে গিয়েছেন। মনে হয় না এখন আসবেন। ”

হাঁফ ছেড়ে বাচলো বেলা। তাঁর পরে লজ্জা ও পেল বেশ। ইথানের কথা টা একটু বেশিই অগোছালো করে দিয়েছে ওকে। এন্টি সেপটিক লাগানো হলে ইথান কাজে হেল্প করতে লাগলো। বেলা আর বারণ করলো না। সব টা মুখ বুঁজে দেখতে লাগলো। যেন এটা হবার ই কথা।

রাত দিন এক করে যখন বেলা কাজ করে যাচ্ছে তখনি এডমিশন টেস্ট এর রেজাল্ট বের হলো। ভীষণ খুশি হয় নি বেলা। তবে চান্স পেয়েছে এই যা। আজ হেবা থাকলে নিশ্চয়ই মিষ্টান্ন তৈরি করে খাওয়াতেন। ভদ্র মহিলার মাঝে বাঙালি সত্তার অনুভব হয়। যদি ও বাঙালি দের নিয়ে বিশেষ কিছু জানে না বেলা। তবে কোনো এক কালে স্কুলে থাকতে ডিবেট এর জন্য বাঙালি কালচার নিয়ে রিসার্চ করেছিলো। আর তখনি এই বিষয়ে জ্ঞান লাভ হয়। মাঝ রাত টা ব্যলকনিতেই কাঁটিয়ে দিলো বেলা। শেষ রাতের দিকে মাথায় আদুরে স্পর্শ অনুভব হলো। গভীর ঘুমে থেকে ও বেলা সেটা স্পষ্ট অনুভব করার ক্ষমতা রাখে। তাই তো ফট করেই যখন চোখ খুলে ফেললো তখন তাঁর সামনে বসে আছেন হেবা। বিস্ময়ে বেলার কথা হারিয়ে যায়। চোখ দিয়ে নেমে যায় সাগরের নোনা স্রোত। মা বলে সম্বোধন তো করে ঠিক ই, তবে সে ডাক কর্ণপাত হয় না হেবার।হেবার পাশ থেকে এলিজা বেরিয়ে আসে। বাচ্চা মেয়েটির নাকের পাটা লাল বর্ণ। বেলা চোখের জল আড়াল করে শুধায়–
” কোথায় গিয়েছিলে মা? এভাবে না বলে কেউ যায় বলো। কতো টা চিন্তা করেছি আমরা। দেখো কি হয়েছে আমাদের। ”

” দুঃখিত ফ্লাওয়ার। আমার বলা উচিত ছিলো। আমি ভেবেছিলাম খুব দ্রুত ফিরে আসতে পারবো। তবে এতো টা সময় লেগে যাবে ভাবতে ও পারি নি। আমি খুব খুব শোকাহত। ”

” কিন্তু কোথায় গিয়েছিলে? ”

” বিশেষ কাজে ফ্লাওয়ার। এখন উঠো তো, ব্যলকনিতেই রাত্রী যাপন করবে নাকি। ”

বেলা কে বেডে বসিয়ে খাবার আনতে গেলেন হেবা। দুই মেয়ে কে যত্ন করে আজ নিজ হাতে খাবার খাওয়াতে লাগলেন। বেলা বিনা বাক্যে খাবার মুখে তুলছে। আর এলিজা তাঁর কথার ঝুঁড়ি নিয়ে বসলো।

পুরো দুই সপ্তাহ পর আজ আবার ইথানের সাথে দেখা। বেলা ভারসিটি থেকে বের হয়েছে মাত্র। ছেলেটার বিধ্বস্ত মুখ, আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি তে চোখ আটকে যায়। ইথানের ছোট ছোট মার্বেল পাথরের মতো চোখ গুলো কোটরে ঢুকে গেছে। তুষারের ন্যায় মুখে ঘুম না হওয়ার ছাপের সাথে কালচে ভাব। বেলা নিজ থেকেই এগিয়ে গেল। ইথান কোনো কাজ নিয়ে কথা বলছে। বেলা কে দেখে ফোন নামিয়ে ফেললো। কোনো মতে হাসি ফুঁটিয়ে বলল–
” বেলা! কেমন আছো তুমি? শুনলাম আন্টি ফিরে এসেছেন। ”

” মা ফিরে এসেছেন দুই সপ্তাহ হলো। তবে আপনি কোথায় ছিলেন? দেখা নেই, খোঁজ খবর ও নেই। সোশ্যাল সাইট গুলো তে ও একটিভ নন। কোনো সমস্যা? ”

” সমস্যা কেন হবে? এমনি তেই বাসায় ছিলাম না। বললাম না মা লুসি কে মেনে নিচ্ছিলো না। ”

” সবর্দাই এমন করেন তিনি? ”

” না এখন ঠিক আছে। লুসি কে কাছে টেনে নিয়েছেন। ”

বলেই শুভ্র হাসি দিলো ইথান। চোখ দুটো উজ্জ্বলতা ফিরে পেয়েছে। তুলনামূলক লম্বা চুল গুলো কপালে অবিন্যস্ত রূপে সাজানো। বেলা কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিলো। ইথান এখন ওর পাশাপাশি হাঁটছে। বেলা নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় কিছু দূর যাওয়ার পর শুধালো–
” আপনি এই ভারসিটির স্টুডেন্ট বলেন নি কেন? ”

” বললে তো নিজ থেকে জানতে না। ”

” কে বলেছে আমি নিজ থেকে জেনেছি। ”

” নিজ থেকে জানো নি? ”

বেলা দু দিকে মাথা নাড়িয়ে ঘোর অসম্মতি দেখালো। ইথান তাঁর ঝাঁকড়া চুল গুলো হাত দিয়ে বিন্যস্ত করা শুরু করলো। তবে ঝাঁকড়া চুল কি কখনো বিন্যস্ত হয়? বেলার সাথে আরেকটু পথ যাওয়ার পর ইথান তাঁর গতিপথ ভিন্ন করার জন্য বলল
” আমি যাচ্ছি। নিজের খেয়াল রেখো। ”

” আপনার বাসা তো ঐ দিকে। ”

” কাজ আছে বেলা। না হলে এ দিকে কেন যাবো। ”

একটু লজ্জিত হলো বেলা। ইথানের জবাবদিহিতা অনেক টাই কাছের মানুষের মতো। সেই কারন টা উপলব্ধি হতেই গোটা গোটা পা ফেলতে লাগলো মেয়েটি। তাজ্জব বনে গেল ইথান। কি এমন বললো। যার ফলে পায়ের গতি বেড়ে হলো রকেট!

স্টিভেন আহত চোখে ইথানের দিকে তাকিয়ে। কন্ঠে কিছু টা নম্রতা আর অসহায়তা বজায় রেখেই তিনি বললেন
” তুমি কি আমার উপর রাগ করে থাকবে মাই সান। ”

” রাগ করি নি ড্যাড। আমার কিছু টা সময়ের প্রয়োজন। আমি এখন যেতে চাচ্ছি না। ”

” আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি তোমার মায়ের উপর রাগ করেছো। ”

” মা! এ শব্দের সাথে আমি খুব বেশি পরিচিত নই ড্যাড। তবে এটা বলতে পারি আমি আমার মায়ের উপর অভিমান করি নি কখনোই। ”

স্টিভেন এর বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। লোক টার বয়স আজ ষাটের কাছাকাছি। এই ষাট বছরের জীবনে ভুল টা ঠিক খুঁজে পেলেন না। তিনি তো ভালোই চেয়েছেন সব সময়। তবে ইথান কেন মেনে নিতে পারলো না!

বাবা ছেলে দুজনেই চুপচাপ। ঘড়ির কাঁটা ছয়ের ঘরে হেলে যাচ্ছে।ইথান এবার মুখ খুললো।
” আমাকে যেতে হবে ড্যাড। নিজের খেয়াল রেখো। পারলে ভুল গুলো দেখার চেষ্টা করো। অন্ধ হয়ে থেকো না। ”

” ইথান! তোমার থেকে জীবন বেশি দেখেছি আমি। ”

” সেটাই আমার ব্যর্থতা। যাই হোক আমি এখন যাচ্ছি। ”

” কথা গুলো মাথায় রেখো ইথান। আশা করি জীবন থেকে অনেক কিছু শিখবে। ”

” ফেলে আসা বাইশ বছরে আমি কিছুই শিখতে পারি নি ড্যাড। এখন না হয় আমি আমার মতো করে বাঁচি? আপনারা ভালো থাকবেন এটাই কাম্য। ”

গল্প টি নিয়ে আলোচনা করুন পাঠক মহলে
Fatema’s story discussion

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here