বেলাদোনা (২৩) #ফাতেমা_তুজ

0
315

#বেলাদোনা (২৩)
#ফাতেমা_তুজ

পাশাপাশি দুজন মানুষ দাঁড়ানো। একজন বেলা আর অপরজন হচ্ছে ইথান। দুজনের কেউ কথা বলছে না অনেকক্ষণ যাবত। ইথানের মনে হলো আরো কিছু টা সময় উপভোগ করা যাক। সচরাচর তো বেলার সান্নিধ্য মিলে না। তবে বুলেট এসে উতলা ভঙ্গিমায় বলল–
” সময় চলে যাচ্ছে। দ্রুত কথা শেষ করো। ঐ দিকে বেলা কে খোজাখুজি শুরু হয়ে গেছে। ”

চিন্তার রেখা কপালে জাগিয়ে বেলার পানে তাকায় ইথান। উহু নড়চড় নেই মেয়েটির। হয়তো বা কথা টা কর্ণপাত ঘটে নি। বুলেট আবার তাগাদা দিলো–
” কথা শেষ করো। আমি পাশেই আছি। ”

” হুম যাও তবে। ”

বেলা তাকালো। ছটফটে নয় শীতল তার দৃষ্টি। চুল গুলো বাতাসে উড়বে নিশ্চিত। তবে মাথায় স্কাফ।
” কাছে আসো বেলা। ”

” এখানেই ঠিক আছি। আপনি বলেন। ”

” আমার কাছে সময় নেই। তোমায় ও তো ফিরতে হবে। তাছাড়া অহেতুক কথা বাড়ানোর থেকে কথা শেষ করা বেশি প্রয়োজন। ”

” বলুন শুনছি এবার। ”

ইথানের কাছে এসেছে বেলা। দূরত্ব এক হাত সমান। প্রথমেই মেয়েটি কে গভীর দৃষ্টি তে অবলেকন করলো। তারপর ধীর হস্তে হাত বাড়িয়ে দিলো। বেলা হতভম্বের মতো প্রশ্ন করে
” কি? ”

” হাত টা দাও। ”

ইথানের হাতের তালু তে হাত রাখে বেলা। ছোট সাদা হাত খানা মুঠো তে পুরে নেয় ইথান। বেলার ঠোঁট জুড়ে স্মিত হাসি। সচরাচর বিদেশী রা লম্বা হয় বেশ। ইথান ও ব্যতিক্রম নয়। সেই তুলনায় বেলা অধিক খাটো। অবশ্য বাংলাদেশে তাকে মোটামুটি লম্বা বলা চলে। ইথানের সামনে নেহাত ই পুঁচকে মেয়ে। এই বুক সমান মেয়েটির প্রেমেই পরেছে ইথান। হাবুডুবু খায় প্রণয়ে। ঠিক কোথা থেকে শুরু করবে বোধগম্য হচ্ছে না। অবশেষে দোমনা দ্বিধা দ্বন্দ্বের অবসান ঘটলো।
” তোমার মনে আছে তোমার আমার প্রথম দেখা? ”

” হ্যাঁ মনে আছে। ”

” সেদিন আমি প্ল্যান করে দেখা করেছি তোমার সাথে। ঐ যে লুসি যে এলিজা কে আঘাত করেছিলো এটা ও সত্য। তবে সেটা ছিলো রোবট লুসি ক্যাট। সত্যি বলতে লুসির সাথে ইউ এস এ থাকাকালীন তোমার সেভাবে মাত্র একবার মাত্র দেখা হয়েছে। ”

বেলা অবাক হয়ে বলল–
” মাত্র একবার! ”

“হুম। ”

” কখন? ”

” ঐ যে আমি জঙ্গলে অসুস্থ হয়ে পরলাম। তখনি তোমার সাথে দেখা হয়েছে। ”

” কিন্তু এর আগে ও তো আমি অনেক বার লুসি কে কোলে তুলেছি। ওর শরীর গরম ছিলো তুলতুলে ও ছিলো। ”

” হ্যাঁ তাপমাত্রা আর নরম তুলো তে তুমি ওকে ধরতে পারো নি। তবে তোমার বাসা তে রাখার পর পরিচর্যার অভাবে রোবটের শীতল আর শক্ত দেহ বেরিয়ে আসে। আর তখন হয়তো তুমি সন্দেহ ও করো। ”

” সন্দেহ না তবে অবাক হয়েছিলাম। কেমন যেন লাগছিল। ”

” হুম তুমি যাতে না বুঝো তাই দ্রুত ওকে নিয়ে চলে গিয়েছিলাম। ”

বেলা একটু মনে করার চেষ্টা করলো তারপর বলল–
” ও হ্যাঁ তাই তো। আমি এতো বোকা। ”

” তুমি বোকা নও বেলা, তুমি খুব সহজ সরল আর ভালো সুন্দর হৃদয়ের মানুষ। ”

” হুম তাই হয়তো আমাকে ঠকাতে বেশি কসরত করতে হয় নি। ”

বেলার কন্ঠে অভিমান। নিজেকে সঠিক প্রমান করার চেষ্টার লেশ দেখালো না ইথানের মাঝে। সে শুধু বুকের অগ্রভাগের দীর্ঘ নিশ্বাস লুকালো। তারপর বলল–
” সহজে হয়তো আমি কাউ কে ভালোবাসি না। আমার মনে আছে স্কুল লাইফ এ একটা ই প্রেম করেছি, সেই মেয়েটা ও খুব ভালো মনের মানুষ ছিলো। তবে হঠাৎ ই একদিন হারিয়ে গেল। কেমন যেন হয়ে গেলাম। তবে ভাবি নি কেউ এক জন সত্যিই আমায় আবার বাধ্য করবে ভালোবাসতে। ”

” লাভ কি হলো। সব তো শেষ ই তাই না। ”

” তুমি চাইলেই সব শুরু হতে পারে। ”

” পারে না। ”

” কেন পারে না বেলা। তুমি আমায় ভালোবাসো আমি তোমায় ভালোবাসি দুজন মানুষ কে একত্রিত করার জন্য আর কিসের প্রয়োজন হয় বলো তো। ”

” অনেক কিছুর প্রয়োজন আছে ইথান। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন আমি খিষ্ট্রান ধর্মের অনুসারী হলে ও মূলত মুসলিম। আর সেই জন্য আপনি আমি দুজনের মিল কখনোই সম্ভব নয়। ”

বিষয় টা সত্য। ইথান নিশ্চুপ থেকে গর্জে উঠা মেঘের মতো করে বলল–
” আমি মুসলিম হলে? ”

” আপনার মাথা ঠিক আছে? ”

” আমি ঠিক আছি বেলা। প্লিজ এখন তো কোনো সমস্যা নেই। ”

” পাগল আপনি। এটা সম্ভব না। ”

” সম্ভব। তুমি চাইলে এ পৃথিবী কে হাতের মুঠো তে নেওয়া সম্ভব। বোঝার চেষ্টা করো। ”

” আপনি বোঝার চেষ্টা করেন। সবকিছু আপনার ল্যাব এ থাকা ক্যামিকেল বা যন্ত্রের মতো না। এটা জীবন। ”

ইথান বেলার হাত দুটো বুকে চেপে ধরলো। তীব্র আকুলতা নিয়ে বলল–
” তাই তো বলছি। এটা জীবন। বেলা তুমি আমার জীবনের সাথে জড়িত। তোমাকে ছাড়া বেঁচে তো যাবো তবে শেষ হওয়ার মতো করে বাঁচবো। ফিরিয়ে দিও না আমায়। প্রয়োজনে তোমার পা ধরতে রাজি। ”

” আমি শাফায়াত কে ঠকাতে পারবো না। আমায় মাফ করেন। ভুলে যান সম্পর্ক। আমি চাই না আর অশান্তি হোক। ”

” তুমি না চাইলে আমি জোড় করবো না বেলা। তুমি সুখে থাকো এই চাইবো। ”

.

ছেলের সাথে কথোপকথন করছেন রিমা বেগম। খুব গুরুতর কথা বার্তা। এই যে বিয়ে তে কজন কে নিমন্ত্রণ পাঠাবে হলুদের দিন রাতে কি রান্না হবে। অন্য ধর্মের মানুষ দের জন্য বিশেষ আয়োজন তাছাড়া কিছু গরিব দুঃখী মানুষ দের খাওয়াবেন ও। সে নিয়ে বেশ চিন্তিত আছেন তিনি। একা হাতে সব দেখা শোনা করতে হবে। একটি মাত্র ছেলে তার বিয়ের আয়োজনে কোনো ক্রুটি হওয়া চলে নাকি? অনড়গল বকবক করছেন তিনি। অথচ শাফায়াত কেবল হু হা করে যাচ্ছে। কথায় যে খেয়াল হারিয়েছে বহু পূর্বেই। সাবলীল কন্ঠে ডাকলেন রিমা। শাফায়াত চকিত হয়ে ভাব টা এমন করলো যেন অত্যন্ত মনোযোগী শ্রোতা।
” বাবা তুই কি চিন্তিত। আমি কখন থেকে বলেই যাচ্ছি। অথচ তোর ধ্যান নেই। ”

” তেমন কিছু না মা। তুমি বলো না, শুনছি আমি। ”

” আচ্ছা বলছি। ”

” হু বলো। ”

রিমা বেগম বলতে শুরু করলেন। আবারো অন্যমনস্ক হয়ে গেল শাফায়াত। আলতো হাতে ছেলের গাল স্পর্শ করেন রিমা। কষ্ট হচ্ছে ওনার। ছোট থেকে এই ছেলে টা কে বুকে আঁকড়ে বেঁচে আছেন। কখনো ফুলের টোকা ও পরতে দেন নি। সে ছেলে যদি কোনো ভাবে মনমড়া হয় তো বেশ চিন্তিত দেখায় ওনাকে। কখনো কখনো প্রেশার হাই হয়ে যায়।
” বাবা, কোনো সমস্যা? ”

” না মা। সব ঠিক আছে। তুমি বলো না। ”

” আমি তো বলছিই কখন থেকে। কিন্তু তুই যে মনযোগ দিলি না। ”

উত্তর করার প্রয়োজন মনে করে না সে। আলগোছে মাথা তুলে দেয় মায়ের কোলে। রিমা বেগম নিজে ও আর প্রশ্ন করেন না। বরং স্বযত্নে ছেলের মাথায় হাত বুলায়। ছেলে টা তার ভীষণ চাপা।

বই পড়ছে বেলা। বাংলা উপন্যাসের বই। মাত্র কয়েক মাস হলো। অথচ এর মাঝেই বাংলা কে আয়ত্তে নিয়ে ফেলেছে সে। বেশ ভালো বাংলা বলতে ও পারে। দেখা যায় আজকাল অনেকেই কনফিউশনে পরে যায়। সত্য যে বেলা বিদেশী। এই তো কয়েক সপ্তাহ আগে ও বেলা ঠিক ঠাক বাংলা বলতে পারতো না। আজ সে অনড়গল বাংলা পড়ে। নক করলো শাফায়াত।
” আসবো বেলা। ”

” আসো, নক করার কি আছে? ”

” তুমি পড়ছিলে। তোমায় বিরক্তি তে ফেলে দিলাম। ”

” তেমন টা নয়। আচ্ছা সেসব ক্লোজ। এখন বলো কি খবর। ”

” খবর তো ভালোই। মা তুমুল গতিতে কাজ করে যাচ্ছেন। নানান আয়োজন। ”

” তাই? তাহলে তো বেশ ভালো। ”

” হুম। ”

বই গুলো গুছিয়ে রাখে বেলা। শাফায়াত এক দলা হাহাকার বুকে চেপে রাখে। বেলা বলল–
” চা নাকি কফি? ”

” কফি। ”

” আচ্ছা তাহলে তো কষ্ট করতে হবে না বেশি। ”

উজ্জ্বল হাসলো বেলা। চায়ের কেটলি তে পানি গরম দিলো। তারপর বেডশীট ঠিক করলো। শাফায়াত নির্জীব ভঙ্গিতে বসে। বেলা পাশে বসলো।
” অবশেষে বিয়ে টা হচ্ছে তবে। ”

” হ্যাঁ। মাঝে তিন টে মাস চলে গেল। ”

” কি করার বলো। আঙ্কেল অসুস্থ ছিলেন। এই মানুষ টা কে রেখে বিয়ে করতাম কি করে। ”

” তাও ঠিক। তবে ”

” আচ্ছা বসো আমি দেখি কফি হলো নাকি। ”

উঠে চলে গেল বেলা। শাফায়াত চুপচাপ বসেই রইলো। সেদিন টা ওর স্পষ্ট মনে আছে। তিন মাস পূর্বে ওদের বিয়ের কথা ছিলো। বিয়ের দুই দিন আগে বেলা গেল ইথানের সাথে দেখা করতে। মেয়ে টা কে খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। পাওয়া যাচ্ছিলো না কোথাও। হঠাৎ করেই সন্ধ্যার দিকে ফিরলো বেলা। আর সেদিন রাতেই অসুস্থ হয়ে পরলেন জুলফিকার সাহেব। ভাবতেই কেঁপে উঠে শাফায়াত। বেলা কফি কাপ এগিয়ে বলল–
” কি হলো নাও। ”

” এই তো নিচ্ছি। ”

কফি খেলো দুজনে। এই সময় টুকু তে বেলাই বকবক করলো। বাংলা তে কথা বলে এখন। শাফায়াত হাসলো। বেলার জন্য কিছু প্রশ্ন বরাদ্দ রেখেছে সে। আজ তবে হয়েই যাক জবাবদিহি।
” কিছু বলছো না কেন?”

” বলবো। ”

” হু বলো তাহলে। আমিই কথা বলে যাচ্ছি ননস্টপ। আসলে বাংলা ভাষা এতো মিষ্টি। খুব ভালো লাগে আমার। ”

” তাই? ”

” হ্যাঁ।”

” আর আমাকে কেমন লাগে? ”

” তোমাকে? ”

” হু। ”

” ভীষণ ভাবে বাজে। ”
শব্দ করে হাসে বেলা। শাফায়াত কথা বললো না এবার ও। কয়েক সেকেন্ড থেমে বেলার দিকে ফিরে বসলো। বেলা তখন হাসি থামানোর চেষ্টায়।

” কিছু বলবে শাফায়াত? তোমাকে বেশ সিরিয়াস দেখাচ্ছে। ”

বেলার চোখে চিন্তার রেখা। শাফায়াত কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিললো। তারপর যা বললো এতে বেলার আকাশ থমকে গেল। বেলা দ্রুত প্রতিবাদ করে উঠলো।
” আমি ইথান কে ভালোবাসি না শাফায়াত। প্লিজ বিশ্বাস করো আমায়।”

” ছবি কিন্তু ভিন্ন বলে। ”

ঝমঝমে কেঁদে উঠে বেলা। কি বলবে এই মানুষ টা কে। কোন মুখে বলবে এতো দিন যাবত তার সাথে প্রবঞ্চনা করে এসেছে। কিন্তু বেলা তো বার বার নিজেকে নানা ভাবে রুখেছে। মন যে ইথানের জন্য আকুল হয়ে আছে। তবু ও যথেষ্ট চেষ্টা করেছে শাফায়াত কে ভালো রাখার ভালোবাসার। তবে সত্য, এই যে মন টা ইথান কেই চায়। তবে বেলা কি চায়? বেলা ও ইথান কেই চায়।

চলবে…….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here