বেলাদোনা (২৪)

0
283

#বেলাদোনা (২৪)
#ফাতেমা_তুজ

খোলামেলা ভাব নিয়ে প্রশ্ন করলো বেলা–
” শাফায়াত, আমি সত্যি টা লুকিয়েছিলাম বলে দুঃখ পেয়েছো তাই না? ”

মৌনতা বজায় রাখে শাফায়াত। বেলা তাকে ভুল বুঝে। আক্ষরিক অর্থে শাফায়াত সব সময় ই চেয়েছে বেলার পাশে থাকতে। সেটা হোক বন্ধু বা অন্যভাবে। পথিমধ্যে যখন প্রণয় জাগ্রত হয় তখনি আশাহীন ভাবে বেলা কে নিজ ভালোবাসার কথা জানান দেয়। তাছাড়া বেলা কে ভালোবাসায় জোর ও করে নি আর না করবে। সে চায় বেলা ভালো থাকুক। সেটা যে কোনো পন্থায়।
বেলা একটু নির্জনে এলো। চোখের দু ধার বেয়ে জল নেমে আসে। এতো দিনে গড়ে তোলা শক্ত পোক্ত প্রাচীর আজ ভেঙে যায় যায়। এধার ওধার তাকিয়ে বেলা শান্ত হয়। তারপর আবার কাছে আসে। শাফায়াত এর বাহু তে স্পর্শ করে। চমকায় না ছেলেটা। খুব নম্র কন্ঠে বলে–
” আমি ভুল করেছি সেটা মানি। একবার কি ক্ষমা করা যায় না? ”

” কি চাচ্ছো তুমি? ”

শাফায়াতের নিষ্ঠুর কন্ঠ। তবে বেলা খুব স্বাভাবিকতার সহিত উত্তর করলো।
” আমি চাই বিয়ে টা হোক। ”

” মন থেকে চাও? ”

” হ্যাঁ মন থেকেই চাই। ”

” জোর দিচ্ছো না তো। ”

” না। ”
বেলার শেষোক্ত কথায় কেমন যেন ভীত। শাফায়াত নৈশব্দে হাসে। শব্দ হীন হাসি তে ভরকে যায় বেলা। চোখ বন্ধ করে ফেলে কয়েক সেকেন্ড এর জন্য। মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে বলল–
” আমি সত্যিই চাই। বিশ্বাস করো। ”

” বসো। ”

” আমায় বিশ্বাস করো তো তুমি? ”

” কখনো অবিশ্বাস তো করি নি। তুমি শুধুই টেনশন করছো। ”

” ভয় হয় জানো তো। ”

আলগোছে মাথা রাখে বেলা। বুকের ভেতর টা কেমন শূন্য লাগে। ডান হাত গলিয়ে দিয়ে চুল টেনে দিচ্ছে শাফায়াত। ছেলেটার প্রতি পদে স্নেহ অনুভব করে বেলা। নিসন্দেহে শাফায়াতের প্রতি তার অনুভূতি কাজ করে। তবে সেটা শুধু মাত্র সম্মানের। অন্যদিকে ইথানের জন্য বুক টা খা খা করে। পড়ন্ত বিকেলের অপেক্ষায় অনিমেষ অতিবাহিত করে। তবে ভেতর ঘর নিষ্ঠুর ভাবে জানান দেয় এখন চলছে মধ্য দুপুর।

সিগার টানে ইথান। নেই চঞ্চলতা নেই কোনো দ্বিধা। নির্বিঘ্নে ফুটপাতে বসে পরে। বেশ কিছু মাস হলো বি ডি তে। কতো টা অসহায় হয়ে পরেছে হয়তো সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কেউ জানেন না। নিজের মাঝে ছোট এক পরিবর্তন এনেছে। তার নাম ইথান হলে ও এর সাথে যোগ হয়েছে যুবাইর শেখ। এখন সে মুসলিম। হাসে ইথান, পুরনো অভ্যাস টা বদলালো না। সিগার টানা টা একটা আর্ট। যা ইথানের থেকে ভালো বোধহয় কেউ পারবে না। অনেক গুলো সিগারেটের ফিল্টার পরে আছে। রোজ রাতে ট্রেন লাইনের ধারে এসে জমায়েত করে। ইস্পাতের তালে তালে যখন ট্রেন শব্দ করে নাচে তখন মজা লাগে ইথানের। বুলেট ও এই ছেলের সাথে পাগলামি তে পরে আছে। ইথানের বন্ধুর থেকে ভাই বেশি। হাজার হোক ভাতৃত্বের বন্ধন টা অস্বীকার করার মতো না। কতো দিন টিফিন ভাগ করে খেয়েছে। সেই ছেলে আজ অদ্ভুতভাবে ভাঙা। হৃদয় টা কম্পিত হয়।
” বাসায় চলো ইথান। ”

” পরে যাবো। তুমি যাও। ”

” আমি রেখে গেলে তুমি আর ফিরবে না।”

” না ফিরে যাবো কোথায় বুলেট? আমার নিজস্ব বলে কিছুই নেই। বাবা তো অনেক আগেই পর হয়ে গেছেন। একজন মা কে পেয়েছিলাম সে ও আমার থেকে মুখ গুটিয়ে নিয়েছে। সবাই আমায় ভুল বুঝে।”

” দুঃখ পেও না। চলো এখন। ”

” দাড়াও তো। বেলা কে দেখবো আমি।”

” এখানে বেলা কে পাবে কি করে। ”

” ও হ্যাঁ তাই তো। সে তো এখন অন্যের জন্য নিজেকে রাঙাতে ব্যস্ত। ”

খিটমিট করে হাসে ইথান। চোখ ভিজে উঠে বুলেটের। এতো কষ্ট আর নিতে পারে না। মন চায় চলে যেতে। তবে সে চলে গেলে এই পাগল টা কে সামাল দিবে কে?

বেলা আনন্দিত। শুধুই উপরে তা সত্য তবে ভেতরে তা আগুনের শিখার মতো। অন্তর জ্বলে যায় তবে মুখ খুলে না। স্মিথ তদারকি চালাচ্ছেন। জুলফিকার সাহেব ও বেশ দাপটে আছেন। বিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হবেন তিনি। বড় আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে শাফায়াত খুশি হতে পারছে না। বার বার এই ঘর ঐ ঘর চলছে। বেলার জন্য ওর মন কাঁদে। ইচ্ছে করে সব নিয়মের বেড়া ভেঙে দিতে। প্রতিবেশী রা ভীড় করছে। ওমন সুন্দর মেয়ের হাতের লাল রঙ না দেখে পেটের ভাত হজম হবে না। বেলা কে ঘিরে অনেকজন। শাফায়াত সুযোগ পাচ্ছে না। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন বসিয়ে দিলো বেলার পাশে। বেলা নিচু কন্ঠে বলল–
” এখনি সবাই মজা শুরু করবে। ”

হলো ও তাই। একজন কাকি বললেন–
” শাফায়াত বাবা দেখি বউ কে দেখার জন্য উতলা হয়ে গেছে। তা বাবাজি একটু সবুর করো। ”

” ক্যান আন্টি সবুরে কি মেওয়া ফলবে? ”

” ফললে ও ফলতে পারে। কি বল‍িস তোরা। ”

সবাই ঠিক ঠিক ধ্বনি তে জানান দিলো সহমত। তিক্ত মেজাজে উঠে গেল সে। বেলা আটকালেও পাত্তা দিলো না। হাতের মেহেদী রেখে বেলা ছুটলো শাফায়াতের দিকে। ছেলেটা কে বোঝাতে হবে।

চাঁদের আলো ছিটকে পরছে ইথানের মুখের উপর। মশ্রিন ত্বকে চাঁদ যেন ডুবে গেছে একদম। কি সুন্দর যে লাগছে তা বোঝানো কঠিন। একদল নেড়ি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। হাতে থাকা মদ এর বোতলের ক্যাপ খুলে ডুব দিলো তাতে। এক নিমিষে ই শেষ করলো অনেক টা। তারপর আবার চলতে শুরু করলো। পেছন পেছন আসছে বুলেট। মানি ব্যাগ পুরে নিয়ে বলল–
” টাকা নষ্ট শুধু শুধু। ”

” ভেবো না। সময় থাকলে ফিরিয়ে দিবো নে। ”

” আমার টাকা চাই না। তোমাকে সুস্থ দেখতে চাই ইথান।”

” আমি তো অসুস্থ নই। তাছাড়া অসুস্থ হলে আমায় হসপিটালে এডমিট করাচ্ছো না কেন। ”

” কারন– ”

” কোনো কারন নেই তোমার কাছে। শুধু শুধু পথ আটকালে। ”

” ইথান আমার কথা শোনো। ”

” আমায় এখন যেতে হবে। যাচ্ছি আমি।”

বুলেট দেখতে পায় ইথান চলছে। বিধ্বস্ত তার পথচলা। কখনো কখনো ঢুলছে, এই বুঝি মুখ থুবরে পরবে। ইথানের ভেতর মৃদু সমীরণ এসে স্পর্শ করে। ভালো লাগে তার। মদের দিকে তাকিয়ে ভাবে এটাই বুঝি পরম সুখ।

এক মাতাল লোক এসে গেটের কাছে বসে আছে। খবর টা প্রথম কানে আসে বেলার কাছে। সে একটু ভাবে পরক্ষণেই অনুভব করে এটা কে হতে পারে। সে জিজ্ঞাসা করে ছেলেটা অতিরিক্ত ফর্সা কি না। এই কথার উত্তর করতে পারে না দারোয়ান। কারন তার মুখ ছিলো বড় বড় চুলের আড়ালে। বেশ চিন্তায় পরে যায় বেলা। অবশেষে বের হয় লুকিয়ে। এসে দেখে তার সন্দেহ ঠিক। দ্রুত গতিতে ইথানের নিকটস্থ হয়। ইথান হাসে।
” পাগল আপনি! এসব কি করছেন। হাতে আবার মদের বোতল। ”

” মদের বোতল বলো না বেলা। এটাই আমার পরম সুখ। আমার প্রাণ। ”

” রাখুন ঐ টা। ”

” না এটা আমার কাছেই থাকবে। ”

” রাখেন বলছি। ”

ধমকে উঠে বেলা। ইথান তাকায় পূর্ণ দৃষ্টি তে। ছেলে টা কে উঠিয়ে আড়ালে নিয়ে আসে। চোখ মুখের অবস্থা দেখে উন্মাদ বনে যায়। তবে সেটা কে প্রকাশ না করে কাঠ গলায় বলে–
” সরেন। চলে যাবো আমি। বহু দূর চলে যাবো। তখন খাবেন এসব। ভালো লাগে না আমার। ”

” তুমি তো আমার কাছেই নেই বেলা। ”

” নেই আর থাকবো ও না। ”

” মেহেদী দিয়েছো হাতে? দেখি দেখি কত টা লাল হয়েছে। ”

বেলার হাত দেখে ইথান। পলকের মাঝেই সেখানে নিজের শুষ্ক ঠোঁট লাগায়। চোখ বন্ধ করে ফেলে বেলা। ইথান নিজের শীতল হাতে বেলার গাল স্পর্শ করে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে ঠোঁটের দিকে।বেলা নিজে ও প্রায় ভুলে যায় সব টা। যখন মনে পরে তখন ধাক্কা দেয় বুক বরাবর। ইথান ছিটকে সরে আসে। হাসে খিটমিট করে।
” চলে যান প্লিজ। ”

” কোথায় যাবো বেলা। এই পৃথিবীর যে স্তরেই যাই না কেন তোমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার কখনোই মিটবে না। ”

” পেয়ে ও আপনি হারিয়ে ফেলেছেন আমায়। আপনি কেন এমন করলেন। ”

” আমার ভাগ্য বিধাতা বড় নিষ্ঠুর বেলা। মদ খেয়েছি, আমি নিশ্চয়ই মাতাল?আর মাতাল লোক কখনো মিথ্যে বলে না। এক বার ভেবে দেখো বেলা, আমি তোমাকে মা’রতে চেয়েছি ঠিক ই তবে মা’রি নি। কেন মা’রি নি একবার ভাবো। আমার কাছে কত সুযোগ ছিলো তবু ও মা’রি নি। বরং বাঁচিয়েছি। আমি প্রথম দিন থেকেই তোমাকে রক্ষা করেছি বেলা। চাইলেই মা’রতে পারতাম আমি। কিন্তু মা’রি নি। এর কারন একটাই তোমাকে ভালোবাসি। ভুল ছিলো তবে ভুলের মাঝে ও ভালো ছিলো। তুমি বুঝলে না আর না বুঝ–”

মাটি তে লুটিয়ে পরে ইথান। বেলা জাপটে ধরে তাকে। আকাশের পানে তাকিয়ে চোখের জল আটকায়। এই ছেলে ওকে পাগল করে দিবে। বেলা নিচু হয়। স্বশব্দে চুমু খায় ইথানের কপালে। ভালোবাসা কে ঘৃনা করা সব থেকে কঠিন কাজের একটি।

চলবে……..?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here