বেলাদোনা (২) #ফাতেমা_তুজ

0
609

#বেলাদোনা (২)
#ফাতেমা_তুজ

ফুলদানির শেষ প্রান্ত থেকে লাল রঙের তরল টপ টপ করে পরছে মেঝেতে। বেলা হতভম্ব হয়ে গেছে নিজের কার্যক্রমে। ক্ষণ কাল পূর্বেই লোক টার মাথায় সর্বশক্তি দিয়ে আ’ঘাত করেছে সে। অথচ এই অদম্য সাহস আগে ছিলো না কখনোই। হয়তো বিপদের সময় এভাবে মানুষ সৃষ্টিকর্তা কর্তৃত্ব অদৃশ্য শক্তি পেয়ে থাকে। কয়েক হাত দূর থেকে ছুটে এলো এলিজা। জাপটে ধরলো বড় বোন বেলা কে। এমন অপ্রীতিকর দৃশ্য আগে কখনো দেখে নি বাচ্চা মেয়েটি।সেই কারনে আরো বেশি ভয় পেয়ে গেছে। বেলা সান্ত্বনা দেওয়া শুরু করলো। তবে এলিজার শরীর থর থর করে কাঁপছে।

লোকটার মাথা থেকে তীর তীর করে র’ক্ত ঝরছে। বেলা কি করবে বুঝতে পারছে না। দিশাহীন পরিস্থিতি তে মাথা এমনি তে ও কাজ করে না। তবে একটি বিষয় অনুধাবন করলো, এলিজার ঘুম প্রয়োজন। প্রচন্ড ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পরেছে বাচ্চা টি। নিশ্চয় হার কাঁপুনি দিয়ে জ্বরের উদয় হবে আজ। সে সব মনে আসতেই এক রাশ খারাপ লাগা অনুভব হলো মানসপটে। বাচ্চা মেয়েটির সারা রাত কষ্টে কাটবে। তবে এখন নিরুপায়। উল্টো বুঝিয়ে এলিজা কে ঘরে নিয়ে এলো বেলা। মেয়েটির মাথায় নরম হাতে হাত বুলাতে লাগলো। তবে অতিরিক্ত ভয়ে ঘুম ও আসছে না। বেলার বাবা জড়িবুটি নিয়ে কাজ করেন। সেই সুবাদেই ঘরের আনাচে কানাচে নানান ধরনের প্রাকৃতিক ঔষধি বিশেষ থাকার কথা। যদি ও এখন উক্ত কাজে বেলা খুব একটা নাক গলায় না।
তবে প্রায় সয় ই হেবার নিদ্রাহীনতা ঘটে। আর তখন বেলা কে দিয়ে জড়িবুটি নিয়ে আসেন। বাবার জড়িবুটির বাক্সে ভালো মতো গবেষনা চালিয়ে ঘুমের ভেষজ খুঁজে পাওয়া গেল। যাক এটা দিয়েই কাজ চলে যাবে। হাতের তালুর সাহায্যে চট জলদি ডলে নিয়ে পানির সাথে ভালো করে মিশিয়ে নিলো ভেষজ। এলিজার ঠোঁট দুটো শীতের হীম শীতলের মতো থরথর করে নড়ছে। মেয়ে টি কে অষ্টাঙ্গে জড়িয়ে নিলো বেলা। এতে বোধহয় কিছু টা আরামপ্রদতা পেল এলিজা। বেলা কৌশলে ভেষজ বাড়িয়ে বলল–
” এটা খেয়ে নাও এলিজা। শরীরের ক্লান্তি মিটবে। ”

যদি ও তেঁতো তবু ও ঢগ ঢগ করে খেয়ে ফেললো এলিজা। ভয়ের কারনে শুকিয়ে কাঠ হয়েছিলো স্বরনালি।

বরাদ্দকৃত স্বকীয় কক্ষে এসে পা মেলে বসলো বেলা। কপালের এক কোন টা ফুলে উঠেছে। লোকটার মাথায় আ’ঘাত করার সময় ধস্তাধস্তি তে নিজ মাথা তে ও কিছু টা আ’ঘাত লেগেছে। সেভলন দিয়ে ললাট এর কোন টা পরিষ্কার করলো ভালো ভাবে। কাঠের জানালা গুলো খুলে দিয়ে এক প্রান্তে এসে তাকিয়ে রইলো নক্ষত্রহীন ঘোলাটে আকাশের পানে।

ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই মারিয়া এসে হাজির। গাঁয়ে থাকা রেইনকোট টা এক হাতে খুলতে খুলতে গলা ছেড়ে ডাকতে লাগলেন —
” বেলা, বেলা, কোথায় তুমি? ঘরের দরজা কেন খোলা রেখেছো। বেলা, আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছো তুমি? ”

মোটা দেহ নিয়ে ছুটতে শুরু করেছেন মারিয়া। ভারী শরীর টা নিয়ে চলাই কষ্টসাধ্য। সেখানে রীতিমতো ছুটছেন তিনি। শুভ্র তুষারের ন্যায় মুখচ্ছটায় ফুটেছে আর্তনাদ। চাঁপা কান্না দেখা যাচ্ছে তাঁতে। বেলার স্বীয় কক্ষে পৌছে শ্বাস ফেললেন তিনি। উত্তর দিকের শেষ জানালায় মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটি। মুখচ্ছবি তে অধিক মায়া থাকা তে বেলা কে একটু বেশিই পছন্দ করেন মারিয়া।

হাত মুখ ধুয়ে খাবারের টেবিলে বসলো এলিজা। রাতের ঘটনা এখনো মনে পরে নি। না হলে হুলস্থল পাকিয়ে যাওয়ার কথা। মারিয়া রসুইঘর থেকে গরম গরম খাবার নিয়ে এলেন। বেলা নিশ্চুপ ভঙ্গি তে খাবার খাচ্ছে। পুনরায় সেই দৃশ্য মনে করতে চায় না সে। তাছাড়া ঘটনা কোনো ভাবে মারিয়ার কানে পৌছালে হেবা কে জানিয়ে দিবেন নিশ্চিত। আর চিন্তা করে শরীর খারাপ করবেন হেবা।
” একি বেলা খাচ্ছো না কেন তুমি? ”

” কোথায়? আমি তো খাচ্ছিই আন্টি। ”

” সেই কারনেই খাবারের প্লেট এখনো ভরপুর! ”

” দুঃখিত। আমি আসলে অল্প করে খেতে পছন্দ করি। তাই ধীরে ধীরে খাবার শেষ করছি। ”

” ভোজনে তোমার অনীহা তৈরি হয়েছে। বিগত দিন গুলো তে এমন টা ছিলো না। হেবা নিশ্চয়ই তোমার শুকিয়ে যাওয়া রুগ্ন দেহ দেখে আমাকে ছেড়ে কথা বলবে না? ”

টুকটাক কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলো মারিয়া। বিগত আট বছর যাবত হালদার বেকারির সাথে যুক্ত সে। হেবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সেই সুবাধে এই পরিবারের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম বিষয় তাঁর নখদর্পণে।

ভাগ্য ভালো থাকায় এলিজার জ্বর আসে নি। ভেষজ টা খুব ভালোই কাজে দিয়েছে তবে।
সেই সাথে অনাকাঙ্খিত ঘটনা টা ও মনে নেই এলিজার। বাচ্চা টি আপনমনে খেলে চলেছে। বরফের ন্যায় সাদা মুখের চামড়া, চিবুক আর নাকের ডগা লাল থাকে প্রায়। অসামান্য সুন্দরী মেয়েটার প্রতি বিরক্তি পোষন করছে শুভ্র রঙের এক বিড়াল। চোখের মনি সামান্য নীল। হেবা না থাকায় পুরো বেকারির দায়িত্ব এখন মারিয়ার ঘাড়ে। আর বেলা কে ও সমান তালে কাজ চালাতে হচ্ছে। রসুই ঘর থেকে কিছু কর্মচারীদের উপর শাসাচ্ছেন মারিয়া। স্বভাব বসত বেলা মুখ টিপে হাসলো। টেবিল গুলো ভালো মতো পরিষ্কার করে জানালায় পর্দা লাগিয়ে দিলো।

বেকারির বাইরে থেকে এলিজার জোড়ালো কন্ঠ ভেসে আসছে। মারিয়া দৌড়ে এলেন। এলিজা তখন বিড়াল টার প্রতি রুক্ষ ব্যবহারে মাতোয়ারা। ইতোমধ্যে বেলা ও উপস্থিত হলো। মারিয়া মুখ বাকিয়ে চলে যেতে যেতে বললেন
” তুমি ওকে সামলাও বেলা। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর পারছি না। ”

” এলিজা কি করছো কি তুমি? একটা বিড়ালের সাথে এমন ব্যবহার কেন! ”

” বিড়াল টা আমাকে খামচি মেরেছে আপুই। দেখো একদম ই লাল করে ফেলেছে। পুরো শ’য়তান এই বদ বিড়াল টা। ”

সত্যিই এলিজার ফর্সা হাতে অনেক গুলো আঁচড়ের দাগ। বিড়াল টি বিরোধ করার ভঙ্গিমায় ম্যাও ম্যাও করলো কয়েক বার। তবে এলিজা যখন ধমক দিলো তখন পালিয়ে গেল। বেকারি তে এন্টিসেপটিক থাকে সব সময়। নানা রকমের কাজে হাত কাঁ’টা ছেঁড়া হয়। তবে আজ নেই। গত কয়েক দিন ধরে শেষ হয়ে গেছে। অগত্যা বাহিরে বের হতে হলো বেলা কে। প্রচন্ড রোদের প্রকোপে মাথায় স্কাফ রাখা মুশকিল হয়ে গেছে। তবু ও হেবার কড়া নির্দেশ রয়েছে কোনো মতেই মাথার স্কাফ খোলা যাবে না।
ফামের্সী থেকে ঔষধ নিয়ে পেছন ঘুরতেই একটি ছেলের তোলপাড় শোনা গেল। পুরো দুনিয়া তছনছ করে দিবে যেন। বুকে জাপটে ধরে আছে কোনো প্রানী। তবে পেছন ঘুরে থাকায় দেখা যাচ্ছে না প্রানী ও তাঁর স্বকীয় মালিক এর মুখ। হাতে তেমন সময় নেই তাই সে দিকে মনোযোগ বাড়ালো না বেলা। প্যাকেট খুলে ঔষধের এক্সপায়ার ডেট দেখতে লাগলো। আজকাল ফার্মেসী গুলো তে নানাবিধ চোরাচালান চলছে। টিভি তে ঘন ঘন হেড লাইন হচ্ছে যাতে করে ফার্মেসী থেকে কেনা যে কোনো ঔষধের এক্সপায়ার ডেট চেইক করা হয়।

বেলা কে রসুইঘরে পাঠিয়ে সবে মাত্র ঠান্ডা হাওয়ার নিচে বসেছিলো মারিয়া। তবে আর বসা হলো না। বিড়াল সমেত এক লম্বা ছেলে হাজির হয়েছে বেকারির দ্বার প্রান্তে। প্রথমে ক্রেতা ভাবলে ও ছেলে টা মূলত নালিশ দিতে এসেছে। মারিয়া বিরক্তি নিয়ে বেলা কে ডাকলো। বেলা কাজ ফেলে রেখে ছুটে এলো রসুই ঘর থেকে। হাত মুছত মুছতে শুধালো–
” কি হয়েছে আন্টি? এভাবে ডাকছেন যে। আমি ওভেন এ কেক বসিয়েছি মাত্র। ”

” দেখো, এই ছেলেটা নালিশ দিতে এসেছে। ”

” নালিশ! কেকের ডেলিভারি তো দুপুরে করার কথা। এখন তো সকাল মাত্র। ”

কথার পথিমধ্যেই দ্বার প্রান্তে চোখ যায়। এক টা ছেলে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অবলীল ধারায়। ভাব ভঙ্গিমা তীব্র আত্মগরিমায় সমেত জানান দিচ্ছে আমি সেই ব্যক্তি যে অভিযোগ হানিয়েছি।
” আমার বিড়াল টার পা মচকে দিয়েছে তোমার বোন। দেখো তো ছোট প্রানী টা ব্যথায় কেমন কষ্ট পাচ্ছে। ”

” এলিজা করেছে? ”

” হু। আমার বিড়াল তো তাই বললো। ”

” বিড়াল কথা বলতে পারে। মশকরা করছেন আপনি? ”

ইথান চুপ হয়ে রইলো। বেলার চোখে মুখে রাগ দৃশ্যমান। ভেতর থেকে এলিজা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বিড়াল টির দিকে কটমট করে তাকাচ্ছে বার বার। ইথান সেটা লক্ষ্য করে নালিশের সুরে বলল–
” দেখো দেখো এখনো আমার লুসি কে শাসাচ্ছে কেমন। এতেই কি প্রমান হয় না সে আ’ঘাত করেছে লুসি কে? ”

” এলিজা তুমি আঘাত করেছো বিড়াল টা কে। ”

” না আপুই। বিড়াল টা মিথ্যে বলছে। ”

” আমার বিড়াল মিথ্যে বলে না এলিজা। তুমি দোষ স্বীকার করছো না। মানে তুমি মিথ্যে বলছো। ”

” আমি করি নি কিছু। আপুই তুমি তো দেখেছো এই বদ বিড়াল টা আমাকে আঁচড়ে দিয়েছে। ”

” আমার লুসি কাউ কে আঁচড় কাটে না। মিথ্যে অপবাদ দিবে না একদম। ”

বাচ্চা এলিজার সাথে ইথানের সামান্য কথা যুদ্ধ চলতে লাগলো। দুজন কর্মচারী হা হয়ে দেখছে এসব। বেলা পরেছে মহা বিপাকে। নিজ মালিক কে জেতাতে লুসি ম্যাও ম্যাও করে প্রতিবাদ জানালো। বেলার চোখ তো তখন চড়কগাছ। সচরাচর এমন বিড়ালের দেখা মিলে না। অবশেষে দেখা গেল এলিজা সত্যই লুসি কে আঘাত করেছে আর লুসি ও এলিজা কে আঁচড় কেটেছে। ইথান তো রেগে আগুন। লুসি এমন টা করে না কখনোই। সে লুসি কে শাসন করবে বলে জানালো। কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে ও এলো। বেলা কে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলো যাতে এলিজা ও কে শাসন করা হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় হা হয়ে রইলো বেলা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here