#বেলাদোনা (৯)
#ফাতেমা_তুজ
স্টিভেন আজ অত্যন্ত খুশি। জীবন আজ স্বার্থক হলো। গত তিন বছর ব্যবসা টা মন্দা যাচ্ছিলো। আজ এমন ভাবে ফিরে এসেছে তা কল্পনা ও ছিলো না। স্ত্রী ড্যানি কে জড়িয়ে ধরেই জিজ্ঞাসা করলেন ছেলের কথা। তিনি জানালেন ছেলে টা আজ বাসায় নেই কয়েক মাস হবে। স্টিভেন প্রথমে রেগে গেলে ও পরে দমে গেলেন। বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য তিনি দায়ী। ইথান কোনো কালেই বাড়ি ছাড়তো না যদি না তিনি বাড়ি ছাড়তেন। ছেলের কথা মনে পরতেই ড্যানি ডুকরে কেঁদে উঠলেন।স্টিভেন সান্ত্বনা দিয়ে বললেন খুব দ্রুত ইথান কে বাড়ি নিয়ে আসবেন।
নিজ বাবা কে ছয় মাস পর দেখলো ইথান। অন্তরে কিছু টা আবেগ কাজ করছে। তবে বাইরে টা আগুনের শিখা তে গড়ে উঠা বস্তুর ন্যায় কঠোর। কফি অফার করতেই স্টিভেন সেটা লুফে নিলেন। ব্যস্ততা দেখিয়ে দ্রুত কথা শেষ করলো ইথান। স্টিভেন ব্যথিত কন্ঠে বলল
” প্লিজ ফিরে এসো ইথান। আমরা তোমায় মিস করি। ”
” যাবো। ”
” সত্যি তুমি ফিরবে? ”
” হ্যাঁ। তবে এখন না এক সপ্তাহ পর। ”
” ঠিক আছে। আমি খুব খুশি হয়েছি মাই সান। ”
ইথান কে জড়িয়ে ধরলো স্টিভেন। প্রথম দিকে তাল না মিলালে ও পরে বাবা কে জড়িয়ে নিলো। মনে মনে বলল আমাকে যে যেতেই হবে ড্যাড।
অপরাহ্ন চলছে। ইথান আসলো লম্বা আকৃতির মোটা ব্যাগ নিয়ে। যেখানে লুসি কে রাখা হয়েছে। বেলার হাতে তুলে দিতেই বেলা ভারিক্কি কন্ঠে বলল–
” লুসির খাবার না হয় দিবো আমি, তবে এর প্রাকৃতিক কাজের কি হবে। ”
হেসে ফেললো ইথান। বেলার মাথায় হালকা করে টোকা মেরে বলল–
” একটা বিশেষ ধরনের মেডিসিন দেওয়া আছে এর ফলে লুসির খিদে লাগবে না আর না প্রাকৃতিক কাজের কোনো চাপ আসবে। ”
” রসিকতা করবেন না একদম। দেখুন এসব ঝামেলা আমি নিতে চাচ্ছিলাম না। আপনি জোড় করে, সে যাই হোক এটা কি সত্যি? ”
” আরে হ্যাঁ সত্যি। তুমি শুধু তোমাদের ঘরের কোনো এক কোনে ওকে ঠাই দিও তাহলেই হবে। আসলে আমি সপ্তাহ খানেক বাড়ি থাকবো না।”
” আপনার মায়ের কাছে রাখলে ও তো হতো তাই না? ”
” উফ বেলা তুমি জানো না মা বিড়াল পছন্দ করে না। আমি শতভাগ নিশ্চিত লুসি কে রেখে গেলে মা তাড়িয়ে দিবে। ”
” বিশ্বাস হচ্ছে না। ”
” কেন? ”
” আপনার মা খুব ই ভালো মানুষ। তাকে দেখলে এমন মনে হয় না। ”
” এক দিনের দেখায় চিনে গেলে? হ্যাঁ তবে এটা সত্য মা সত্যিই খুব ভালো মানুষ। এখন বিড়াল পছন্দ নাই করতে পারেন এটা নিশ্চয়ই ওনার খারাপ হওয়া বহন করে না। ”
” হু সেটাই। ”
বেলার ভারী নিশ্বাস। ইথান কিছু টা চুপ হয়ে রইলো। অনুরোধ করে বলল কিছু সময় অবস্থান করতে। সন্ধ্যার পূর্বে বাসায় ফিরবে না হেবা। সেই কারনেই অবস্থান করলো বেলা। তবে ইথানের থেকে পুরো দু হাত দূরে। এসব দেখে ও না দেখার মতো করে বসে রইলো ইথান। অনেক টা সময় গেলে ইথান বলল–
” এবার যাও। ফিরে এসে দেখা হবে। ”
” হু। সাবধানে যাবেন। ”
” আচ্ছা। নিজের খেয়াল রেখো বেলা। ”
বেলা মাথা ঝাঁকালো। ব্যাগ টা কাঁধে তুলে নিয়ে লম্বা লম্বা কদম ফেলতে লাগলো। মৃদু বাতাসের ছন্দে দুলছে বেলার পিঠ বরাবর স্কাফের কোন। সে দিকে অবিলম্বে তাকিয়ে রইলো ইথান। কেমন যেন কষ্ট অনুভব হচ্ছে। লুসির জন্য নাকি অন্য কারনে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
ফজরের আযানের সময় বেলার উঠার অভ্যাস। তবে আজ উঠতে পারে নি। এর কারন হেবা। দুই মেয়ে কে ঘুমের জড়িবুটি দিয়েছেন। এই ভোর রাত্রী তে ওনার বিশেষ কাজ রয়েছে। তাঁর আগে স্টোর রুমে গেলেন। সেখানে পরিত্যক্ত এক বিশাল ছবি। এই বিশেষ ছবি টা ফ্রান্স এর কোনো বিজ্ঞানীর। বহু বছর পূর্বে নিলামে অল্প দামে ক্রয় করেছিলেন হেবার বাবা। এখন এর মূল্য নেই বললেই চলে। তাই অবস্থান স্টোর রুমে। গ্যাস লাইট নিয়ে হাতে থাকা আলোবর্তিকা জ্বালিয়ে নিলেন। তারপর ঈশ্বর কে স্মরণে নিয়ে বিশাল আকারের ছবি টা সরিয়ে নিলেন। সেখানে দাগ কাঁটা কতো গুলো ফারাসি অক্ষর। সেগুলো তে ভালো করে নজর বুলিয়ে ধাক্কা দিলেন মাঝ বরাবর। সঙ্গে সঙ্গে শব্দ করে একটা সরু পথ তৈরি হলো। হেবার শরীর বেয়ে ঘাম নেমে যাচ্ছে। কিছুদূর গিয়ে তাঁর হাত থেকে আলোকবর্তিকা পরে গেল। চিৎকার করে উঠলেন তিনি। চোখ দুটো ঝাপসা হতে শুরু করলো। আর তারপর কি হলো জানা নেই।
তিন টে দিন বেলার চোখে ঘুম নেই। হেবা কে খুঁজতে খুঁজতে মেয়েটির পাগল প্রায় অবস্থা। মারিয়া নানান ভাবে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছেন। ইতো মধ্যেই নিকটবর্তী পুলিশের কাছে মিসিং ডায়েরি লেখা হয়েছে। তাঁরা খোঁজ চালাচ্ছেন। তবে হেবা কে পাওয়া যাচ্ছে না। বেলার চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে গেছে। এলিজা কে এখনো কিছু জানানো হয় নি। এদিকে বেলার বাবার ফোন নাম্বার টা ও কাজ করছে না। এমনি তেই ভদ্রলোকের ফোনে কল করলে পাওয়া যায় না। সবসময় নেটওয়ার্ক সীমানার বাহিরে থাকেন। একদল কর্মচারী মুখ ভার করে বসে আছে। মারিয়া একা হাতে সামাল দিচ্ছেন সব। এই মধ্যবয়সে শরীর টা আর চলে না। তবু ও নতুন উদ্যেমে কাজ করে যাচ্ছেন। চাইলেই বেকারি বন্ধ করা যাবে না। এই বেকারির পেছনে রয়েছে বিশাল এক ঋন। যা একটু একটু করে পরিশোধ করছেন হেবা। বেশ ভালোই তো যাচ্ছিলো তবে কি এমন হলো?
” বেলা তুমি কি এভাবেই বসে থাকবে? ”
” আমার হাত চলছে না আন্টি। ”
” চিন্তা করো না বেলা। হেবা ভালো আছে। হয়তো দরকারি কাজে গিয়েছে, তবে চলে আসবে দেখো। ”
” কি এমন কাজ মারিয়া আন্টি? যা বলে যাওয়া গেল না। আমার মন বলছে মা বিপদে আছেন। ”
” ঈশ্বর কে স্মরণ করো বেলা। কিচ্ছু হবে না তোমার মায়ের। হেবা কে নিশ্চয়ই রক্ষা করবেন অবিনশ্বর। ”
বেলা উত্তর করলো না। নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। চোখ দুটো জলে ডুবে আছে। মারিয়া ইশারা করতেই নিজেকে পরিপাটি করে গুছিয়ে নিলো। এলিজার সন্দেহ হয় তবে কিছু বলে না। শুধু চুপচাপ হয়ে দেখে যায় সবটা। বেলা মেয়েটার কাছে এসে বুকে চেপে ধরলো। কান্না গুলো গিলে নিয়ে বলল–
” কি হয়েছে বোন তোমার মন খারাপ কেন? ”
” তোমরা আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো আপুই? ”
” না বোন। কেন লুকাবো বলো। সব কিছু তো ঠিক ই আছে। ”
” আচ্ছা আমার খিদে পেয়েছে। আমি ব্রাউন ব্রেড খাবো। ”
” তুমি বসো আমি নিয়ে আসছি। ”
বেলার এমন অবস্থা দেখে মারিয়া আজ সাথেই গেলেন। এলিজা ছোট মানুষ। যদি বেলার কিছু হয় তাহলে মেয়েটা ভয়েই ম’রে যাবে। তাঁর থেকে ভালো বেলার বাসা তেই অবস্থান করা। বেলা কৃতজ্ঞতা জানালো মারিয়া কে। সেটা সবিনয়ে গ্রহণ করলেন মারিয়া। হেবা কে নিয়ে তিনি ও খুব চিন্তায় আছেন। এমন টা আগে কখনো হয় নি।
সন্ধ্যার খাবার খাওয়ার সময় বেলার মনে পরলো লুসির কথা। আলো বাতাস ছাড়া বেচারা লুসির কি অবস্থা সেটা দেখার জন্য গেল পড়ার ঘরে। সচরাচর এ ঘরে কেউ আসে না। সেই কারনেই বেলা লুসি কে এই আবদ্ধ ঘরে রেখেছিলো। ঘর টা তিন দিন ধরে নোংরা হয়ে আছে। পরিষ্কার করার মতো মানসিকতা ছিলো না। তবে আজ কে না করলে দেখা যাবে ঘর থেকে বিশ্রী গন্ধ বের হবে। বেলা নিজ মন কে বুঝ দান করে ঘর টা পরিষ্কার করতে লাগলো। বেশি বড় নয় পড়ার কক্ষ। দুটো ছোট ছোট টেবিল একটা আলমিরা আর কিছু বই রাখার বুক সেলফ। আলমিরার পেছনের দিক টায় সামান্য জায়গা আছে সেখানেই রেখেছিলো ব্যাগ টা। মাত্র ই ব্যাগ টা খুলেছে আর মারিয়ার ডাক। লুসি হালকা আওয়াজ করে ডেকে উঠলো। বেলা দ্রুত গতিতে ব্যাগ টা আটকে ফেললো। লুসির শরীর টা কেমন শীতল হয়ে আছে। স্পর্শ লাগাতে বেলার হাত কেমন শীতল হয়ে উঠলো। বেলা এক পলক তাকিয়ে মারিয়ার ডাকে সাড়া দিলো।
” পড়তে বসেছিলে বেলা? ”
” না আন্টি। এমনি তেই ঘর টা পরিষ্কার করলাম। ”
” ও আচ্ছা। এলিজা ঘুমাতে চাচ্ছে না। ”
” আচ্ছা আমি যাচ্ছি। ”
” হুম যাও। এলিজা কিন্তু রাতের খাবার খাই নি ভালো করে। পারলে খাইয়ে দিও।”
” হু। আন্টি এক কথা ছিলো। ”
” হ্যাঁ বলো না। ”
” কোনো প্রানীর দেহ বরফের মতো হীম শীতল হয়? ”
” হয়তো হয় বেলা। এ পৃথিবীর সব কিছু তো আমাদের জানা নেই তাই না। ”
” ধন্যবাদ। শুভ রাত্রি। ”
” শুভরাত্রি। ”
[ হেবা কোথায় গেল? আর কেন গেল! ]
চলবে