মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা
উম্মে হাবিবা তনু
পার্ট:৪৬
ঢাকা থেকে ৩৫ কিমি উত্তর-পশ্চিমে সাভারে অবস্থিত বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ।
কিছুক্ষণ আগে ওরা এসে পৌঁছেছে জাতীয় স্মৃতিসৌধের সামনে।
হিস্টরিকাল প্লেস গুলো সম্পর্কে ইন্টারনেটে সার্চ করে অনেক কিছু জেনেছে।
এখন খুব মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে আছে মাহা।নিজের চোখে দেখেছে আর বিস্মিত হচ্ছে।
অসমান উচ্চতা ও স্বতন্ত্র ভিত্তির ওপর সাতটি ত্রিভুজাকৃতির প্রাচীর নিয়ে মূল সৌধটি গঠিত। সর্বোচ্চ স্তম্ভটি সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্যের ভিত্তির ওপর, আর সর্বদীর্ঘ ভিত্তির ওপর স্থাপিত স্তম্ভটি সবচেয়ে কম উচ্চতার। প্রাচীরগুলাে মাঝখানে একটি ভাঁজ দ্বারা কোণাকৃতির এবং একটির পর একটি সারিবদ্ধভাবে বসানাে। কাঠামােটির সর্বোচ্চ বিন্দু বা শীর্ষ ১৫০ ফুট উঁচু। কাঠামােটি এমনভাবে বিন্যস্ত যে, ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে একে ভিন্ন ভিন্ন অবকাঠামােয় পরিদৃষ্ট হয়।
ভটির সামনে বেশ কয়েকটি গণকবর ও একটি প্রতিফলন সৃষ্টিকারী জলাশয় নির্মিত হয়েছে।
বাস্তবে যেনো হাজারগুণ সুন্দর।
তারচেয়েও বেশি গর্ব হচ্ছে মাহার।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের মহান শহীদদের অসামান্য ত্যাগ ও শৌর্যের স্মৃতি হিসেবে সৌধটি দাঁড়িয়ে আছে।
আর ঠিক তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে মাহা।ভাবতেই ওর মনটা গর্বে ভরে উঠছে।
নানাভাই ইন্টারনেটে স্ক্রল করে যতটা জেনেছি দেখেছি তার চেয়েও কিন্তু অনেক অনেক সুন্দর আমাদের স্মৃতিসৌধ।
মুবিন হাসান হাসলেন।ভার্চুয়াল জগতের থেকে বাস্তব তো সুন্দর হবেই আপুমনি।
ঠিক বলছো নানাভাই।চলো আমরা আরেকটু এগিয়ে যাই।
মুবিন হাসান ও মমতা হাসান এর সাথে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে মাহা।টুকটাক কথা বলছে।
আমাদের এই স্মৃতিসৌধের নকশা কে করেছেন জানিস??
জানিতো নানা ভাই।স্থপতি মঈনুল হােসেন এর নকশা নির্মাণ করেছিলেন।
একদম ঠিক।
মাহা মুবিন হাসান এর সাথে তাল দিয়ে হাসলো।শাড়ি পরে হাঁটতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু তবুও ওর আজ খুব ভালো লাগছে।
এই পুরো কমপ্লেক্স কতটুকু জমির উপর জানো??
সঠিক মনে পড়ছে না নানাভাই।
কোনো ব্যাপার না আমি বলে দিচ্ছি।এই সমগ্র কমপ্লেক্সটি ৩৪ হেক্টর জমি জুড়ে বিস্তৃত।মানে ৮৪একর জমির উপর এটি দাড়িয়ে আছে।
মাহার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল।এত বড় এরিয়া??
শুধু তাই নয় একে ঘিরে আছে আরও ১০ হেক্টর সবুজ ভূমি।
কি বলো নানাভাই!!!
মাহার চোখে বিস্ময় দেখে মুবিন হাসান বেশ খুশি হলেন।শহীদের ত্যাগ এর কাছে এইটুকু তো কিছুই নয়।
নানাভাই আমরা সৌধে ফুল দিবো না??
হ্যাঁ দিবো তো।চলো ফুল কিনে আনি।
তার আগে মামনি আর পাপাকে ডেকে নেই।
ওদের দিকে একবার তাকিয়ে মুবিন হাসান বলেন ওরা কথা বলছে যখন বলুক আমরা না হয় ফুল কিনে আনি।
ঠিক আছে তাই চলো।
বুঝলে আপুমনি বাংলাদেশের মহান শহীদদের স্মরণে আমরা জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেমন পুষ্পস্তবক অর্পণ করি, তেমনি এর পবিত্রতা রক্ষা করাও কিন্তু আমাদেরই দায়িত্ব।
হ্যাঁ নানাভাই বুঝেছি।
অদূরে দাড়িয়ে কথা বলছে রুদ্র ও সাবিবা।
মুখগুলো থমথম করছে যেনো।খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে কথা বলছে বোধ হয়।কি বিষয়ে তাও মোটামুটি আন্দাজ করতে পারছেন।
তাই তো মুবিন হাসান হাসান নাতনিকে নিয়ে আরেকটু দূরে সরে এলেন যাতে রুদ্র বা সাবিবা বিব্রত না হয়।
এইবার মাহাকে সবটা জানিয়ে দেওয়া উচিৎ আমাদের।
সব সময় তো উচিৎ কাজ ঠিক সময়ে করা যায় না আবার অনেক সময় না করাই ভালো হয়।
কি বলতে চাচ্ছো?নিজের অতীত কি মাহা জানবে না??
ওর কি অতীত আছে যে জানানোর কথা বলছো আপু?
কি অতীত!!!তুমি জানতে চাইছো??রুদ্র তুমি ভুলে যাচ্ছ মেঘলা নিজের বাবা কে তাই জানে না…..
আপু!!
রুদ্র রাগ করো না ভাই।আজ না হয় কাল মাহা ঠিকই জানবে ওর বাবা তুমি নও।
আমরা যদি না বলি তাহলে ও জানবে কি করে???
কয়জন লোকের মুখ বন্ধ করবে??হটাৎ কেউ কিছু বলে বসলে ও কিন্তু আমাদেরকেই ভুল বুঝবে।
আমি ওকে এইখানে বেশিদিন থাকতে দিবো না।আর চার দিন পরই ব্যাক করছি।এর মধ্যে আমি ওকে চোখে চোখে রাখবো।কারো ধরা ছোঁয়ার মধ্যে রাখবো না।আমি কখনোই ওর অতীত সামনে আসতে দিবো না।ওর কোনো অতীত নেই।আমার মেয়ে মাহা।আমি ওর বাবা।এইটাই ওর পরিচয়।
সাবিবা ব্রু কুটি করে দাড়িয়ে আছে।রুদ্র হাইপার হয়ে যাচ্ছে।ওকে স্থির হওয়ার সময়টুকু দিলো।তারপর নিজের মতো করে সব কথা গুছিয়ে নিচ্ছে বলার জন্য।
রুদ্র এতটা অবুঝ কি করে হচ্ছো??পালিয়ে যেতে চাচ্ছো??পালিয়ে যাওয়া কোনো সমাধান??
আপু আমি এইসব নিয়ে ভাবতে পারছি না।
ভাবতে হবে।তোমার তো ভালো করেই জানা মাহা কেমন?একবার যদি অন্য কারো থেকে কিছু শুনে তবে কি পরিমান অভিমান হবে!!রাগ অভিমান এর মাত্রা মাহার ভয়াবহ।আর অন্য কেউ যখন বলবে তখন অবশ্যই সত্যির থেকে মিথ্যাই বেশি বলবে বাড়িয়ে চড়িয়ে।ভুল সেতো তখন আপনাতেই বুঝবেই…..মেঘলার ভালো ভাবতে গিয়ে শেষে কিন্তু তোমাকেই ভুল বুঝলো।শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত ভুলই বুঝে গেলো।
রুদ্র এইবার মিয়ে গেলো।স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো।ঠিকই তো মেঘলা শেষ দিন পর্যন্ত ওকে ভুলই বুঝে গেলো শুধু।
কি ভাবছো??
ভাবছি কি বলবো?কিভাবে বলবো??আমি এইসব বলতে পারবো কি??
কেনো পারবে না?পারতে হবে।
ও যদি ওর বাবার কাছে ফিরে যেতে চায়??
সেটা কি আধেও সম্ভব??সীমান্ত জেলে।শুনেছি আবছা আবছা স্মৃতি ফিরেছে।কিন্তু কতটা সত্যি আমি জানি না।আমি কখনো ওর খোঁজ রাখিনি।
মাহা সব জানার পর যদি খুঁজে বের করে??
করলে করবে।ও দেখুক ওর অতীতটা কি??ওর বাবা কেমন??
আপু আমি মাহাকে হারাতে পারবো না।কোনো কিছুর বিনিময়ে না।
রুদ্র শক্ত হও।এখনই এত ভেঙ্গে পড়লে হবে??
রুদ্র দুহাতে মাথা চেপে ধরে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে।এমন পরিস্থিতি কেন আসছে ওর জীবনে??যা দুহাতে আকড়ে ধরতে চাইছে তাই আঙ্গুল গলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
রুদ্র তুমি আগে নিজেকে সামলাও।আমি যতটা পারি মাহাকে সামলাবো।এইটা ওর অধিকার রুদ্র।
রুদ্রর চোখ ফেটে কান্না আসছে।মেঘলা কিংবা মাহা এদের কারো উপরই ওর অধিকার নেই।কেনো নেই?কেনো?
মাহা কে তুমি ওর মায়ের ডাইরিটা দিবে।ওতে ওর মাই সব গুছিয়ে লিখে গেছে।
রুদ্র করুণ চোখে তাকালো।ওই ডাইরির উপরও কি আমার অধিকার নেই??মেঘলার শেষ চিন্হটুকুও দিয়ে দিতে হবে??
সাবিবার খুব খারাপ লাগছে।কিন্তু ওকে তো কঠিন থাকতে হবে।রুদ্র যতই জানপ্রাণ দিয়ে নিজের ভাবুক আসলে এগুলো তার নয়।নিজেকে কঠিন খোলসে ডুকিয়ে নিল সাবিবা।
দরকার হলে দিয়ে দিতেই হবে তোমার।
রুদ্র হাসলো।যে হাসিতে প্রাণ নেই,নেই কোনো আনন্দ।কোনো রকমে মাথা নাড়িয়ে বুঝলো,দিয়ে দিবে সব দিয়ে দিবে।
অদ্ভুত সুতায় গাঁথা ওর জীবন।জীবনে ওর সব থেকেও কিছু নেই।নেই কিছুই নেই।আছে শুধু শূন্যতা।যে শূন্যতা কখনো উত্তপ্ত মরুভূমির খাখা বালুর মতন দহন করে তো কখন হিম শীতল বরফের মতন জমিয়ে অসাড় করে দেয়।এইতো ওর জীবন।
চলবে……….
গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকবেন।ধন্যবাদ 😇
সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=169467331959466&id=140699218169611