মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা উম্মে হাবিবা তনু পার্ট:৩৩

0
400

মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা
উম্মে হাবিবা তনু
পার্ট:৩৩

অবশেষে রেহানা মাহমুদ ছেলের জেদের কাছে হার মানলেন।নিজের দেশ,স্বামীর ভিটা বাড়ি,নিজের শিকড় সবকিছু ছেড়ে বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমাতে রাজি হয়ে গেছেন।রুদ্রর কথা তিনি আর ফেলতে পারলেন না।
তিনি বারবার বুঝিয়েছেন তিনি তার শিকড় ছেড়ে বিদেশ বিভুয়ে যাবে না।
কিন্তু মুবিন হাসান এর কথায় তিনি তার কথা থেকে সরে এসেছেন।মুবিন হাসান এর কথায় তিনি বুঝেছেন তার ছেলে ভালো নেই।রুদ্রর মানসিক যন্ত্রণা দিনকে দিন তীব্র আকার ধারণ করছে।এইভাবে একা একা থাকলে তাকে একাকিত্ব ঘ্রাস করবে।এমনিতেও সে একাকীত্বে ডুবে আছে।অতীত থেকে এখনো বের হতে পারেনি সে।সময় এগিয়ে গেলেও রুদ্র তার অতীত থেকে বের হয়ে সামনে এগুতে পারেনি।তার পাশে এখন মাকে খুব প্রয়োজন।
তাই তো রেহানা মাহমুদ আর দেরি করলেন না।রুদ্র ওর কাছে যাওয়ার কথা বলতেই বিনা বাক্যে রাজি হয়ে গেলেন।

প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই নিজের চিরচেনা দেশটাকে বড্ড অচেনা মনে হতো লাগলো।যতই প্লেন উপরের দিকে উঠছে ততই চোখের সামনে থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে নিজের প্রিয় শহর,গ্রাম,প্রিয় দেশটা।তার সাথে যেনো অস্থিরতা বেড়েই চলেছে রেহানা মাহমুদ এর মনে।মনে হচ্ছে তিনি যেনো তার সর্বস্ব ফেলে হারিয়ে যাচ্ছেন কোনো এক অজানায়।

আজ অফিস,ইউনিভার্সিটি কোথাও যাওয়া হলো না।নতুন বাসায় শিফট করেছে গতকাল রাতেই।মোটামুটি যতটা সম্ভব গুছিয়ে নিয়েছে।তবে বলেতে গেলে পুরোটাই অগোছালো।কিন্তু এখন তার হাতে সময় খুবই কম।পরেও এইগুলো করা যাবে এখন আগে এয়ারপর্টে যেতে হবে।মা এতদূর থেকে একা আসছে আর এইখানে তো কিছুই চেনে না আগে আগে পৌঁছে যেতে হবে।না হয় মা আবার চিন্তায় পরে যাবে।রুদ্র আর এক মুহুর্ত দেরি না করে বেরিয়ে গেলো এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশ্যে।

কদিন থেকে মেঘলার বেশ কিছু কাজে সাবিবা খুব অবাক হচ্ছে।শুধু অবাক না চিন্তিতও সে।ওর চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ অথচ ইদানিং সে প্রায় সময়ই শুয়ে থাকে।খাওয়া নিয়েও খুব ঝামেলা করে।কিছু খেতে চায় না।জোর করে খাওয়ালেই তার বমি বমি ভাব হয়।কখনো কখনো তো বমি করে একসার করে দেয়।সেজন্য আরও খেতে চায় না।দিন দিন অনেক দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।সারাক্ষণই পারলে সে শুয়ে থাকে।কিন্তু ঘুমায় না।
কিছু বললে বলে হজমে হয়তো সমস্যা হচ্ছে।এই জন্য শরীরও ভালো লাগে না।
কিন্তু এত দিন করো হজমের সমস্যা থাকে নাকি???
না ওর সাথে আরো খোলাখলি কথা বলতে হবে।কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে।আমি যা ভাবছি তা যদি হয় তাহলে??ভয় হচ্ছে খুব।যেখানে নিজেদের অবস্থান নিয়েই সংশয়,মনুষ্য জগতে নাকি ভিন গ্রহের বাসিন্দা তারই কোনো ঠিক নেই সেখানে যদি…….
না না আর এইভাবে চুপচাপ থাকা যাবে না।ভালোভাবে কথা বলতেই হবে।
মেঘলার এমন মুখচোরা ভাব একদমই ভালো লাগছে না দেখতে।

বছর তিনেক পর ছেলেকে পেয়ে রেহানা মাহমুদ যেনো কথার ঝুলি খুলে বসেছেন।ঠিক কথা না অভিযোগ।রুদ্রকে ঘিরে কত শত অভিযোগ।অভিযোগের ধরন কিছুটা এইরকম,
তুই একদম শুকিয়ে গেছিস।
নিশ্চয়ই ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করিস না।
করবি কিভাবে একা একা থাকিস,তুই কি কিছু রান্না করতে পারিস নাকি??
কি রাদিস আর কি খাস কে জানে।
তোর চোখমুখ একদম বসে গেছে।চাপাটা ভেঙ্গে একবারে ভেতরে ঢুকে গেছে।
চুল,দাড়ি এত বড় বড় করে রেখেছিস কেন??
এদেশে কি সেলুন নেই??
কিন্তু তোকে না একদম পূর্ণ বয়স্ক যুবকদের মত লাগছে।অনেকটাই তোর বাবার মতো দেখাচ্ছে তোকে।
রুদ্র হাসলো।তবু তো অভিযোগ থেকে বের হলে।

হঠাৎই রুদ্রকে অনেক বড়বড় মনে হচ্ছে।এই তো সেদিনই রুদ্র এইচ.এস.ছি পাশ করে কানাডাতে পাড়ি জমালো।মাত্র বছর তিনেকের ব্যাবধানে এতটা বড়ো হয়ে গেল!!নাকি অনেকদিন পর দেখায় এমন মনে হচ্ছে??পরম মমতায় রুদ্রর দিকে তাকিয়ে,ভাবছেন রেহানা মাহমুদ।

কিন্তু গাড়ি থেকে নামার পর আর এই ক্যারিং,অভিযোগ সব উড়ে যাবে।এক্ষুনি যাকে পূর্ণ বয়স্ক যুবক বলছে তাকেই বকাবকি শুরু করে দিবে,বলা যায় না দুচার ঘা পিঠে পড়তেও পারে।এইসব ভেবে রুদ্র মনে মনে আরেকবার হাসলো।আজ কতদিন পর মায়ের কাছে বকুনি খাবে।

ফ্ল্যাটের লকটা ওপেন করে মাকে ভিতরে যেতে বলে রুদ্র লাগেজ নামিয়ে আনতে গেল।ড্রাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে লাগেজ টেনে নিয়ে যেই না রুমে ঢুকলো তখনই দেখলো রেহানা মাহমুদ বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।যেনো চোখ দিয়েই ভস্ম করে দিবে।রুদ্র আমতা আমতা করে বলল,
মা..মা..আ..মা..র ক..থা…টা শু…নো…..
রুদ্রকে কিছু বলতে না দিয়েই রেহানা মাহমুদ হুংকার দিয়ে উঠলেন,
কি শুনবো তোর কথা??এইখানে কেউ কি থাকতে পারে???
মা..আ..গে..শু….
আমি কিছু শুনতে চাই না।কি অবস্থা করে রেখেছিস???জামা,কাপড়,জিনিসপত্র যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রেখেছিস।চারপাশে নোংরা যেনো কিলবিল করছে।এই তুই কি আমার ছেলে??এমন নোংরা হলি কি করে??এদেশের মানুষ কি এমন নোংরা??
মা আমি তো গতকালই উঠেছি,গুছানোর সময় পাইনি।
গতকাল এসেছিস তাও এত বাজে হাল??তোকে তো আজ….বলেই রুদ্রর কানটা টেনে ধরলেন।
মা মা আমার লাগছে।
লাগার জন্যই তো দিচ্ছি।
মা আর এমন হবে না কখনো এইবার এর মত ছেড়ে দেও।
রেহানা মাহমুদ ছেড়ে দিলেন।
কি যে করো না মা,আমি কি এখন আর ছোট আছি??আমার লজ্জা করে না বুঝি??
আবার রুদ্রর কান টেনে দিয়ে বললেন,মা বাবার চোখে সন্তান কখনো বড় হয় না।বুঝলি গাধা???

রুদ্র ক্ষানিক তব্দা খেয়ে গেলো।মেঘলাও ওকে গাধা বলতো ওর মাও বলে।

কিরে ওভাবেই দাড়িয়ে থাকবি নাকি লাগেজ গুলো নিয়ে ভিতরে রাখবি??
হ্যাঁ…হ্যাঁ যাচ্ছি।

কে বলবে রেহানা মাহমুদ এত লম্বা জার্নি করে এসেছেন??জার্নির সমস্ত ক্লান্তি উপেক্ষা করে তিনি লেগে পড়েছেন ঘর গুছাতে।
এদিকে রুদ্র বেচারার নাজেহাল অবস্থা হয়ে গেছে আসবাবপত্র টানাটানি করতে করতে।
একবার একদিকে রাখছে তো রেহানা মাহমুদ এর কাছে ভালো লাগছে না।তৎক্ষণাৎ আবার ঘুরিয়ে অন্যদিকে রাখছে।
রুদ্র খুব হাপিয়ে গেছে কিন্তু রেহানা মাহমুদ এর যেনো কোনো ক্লান্তি নেই।

গোটা দিন তো গোছগাছ করেই শেষ।তারউপর মা এতটা লম্বা জার্নি করে এসেছেন এখন আবার রান্নার ঝামেলা না করাই ভালো।তাই রুদ্র খাবার অনলাইনে অর্ডার করলো।

রেহানা মাহমুদ অবশ্য সেটা জানেন না।ধুলো বালি,ক্লান্তি সব ধুয়ে তিনি রান্নায় হাত দিবেন।তাই তিনি গোসল করতে গেলেন।
এর মধ্যেই খাবার চলে আসলো।যা দেখে উনি আবার রেগে গেলেন।এতদিন পর এসেছেন,নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবেন ছেলেকে তা না কিসব হাবিজাবি খাবার নিয়ে এসেছে।

মায়ের ভাবগতিক বুঝে রুদ্র আগেই বললো,
মা কাল থেকে তুমি সব তোমার ইচ্ছে মত করো।আজকে দিনটা এইসব খাবারই খাও।প্লিজ একটু সামলে নেও।
রেহানা মাহমুদ ম্লান হাসলেন।

তিনি এইখানে এসেছে ছেলের জন্য।তার ভালো থাকার জন্য,তাকে সাথ দিতে।যাতে রুদ্র একলা না পড়ে যায়।
তিনি মনে মনে ঠিক করেছেন অনার্স শেষ হতে আর বছর খানিক আছে পড়ে মাস্টার্স টা শেষ হলেই রুদ্রর বিয়ে দিয়ে দিবেন।এমনিতেই ওর মানসিক যন্ত্রণাটা তিনি বেশ বুঝেন।তাই এই ভাবনা।মেঘলা তো ফিরে আসবে না।তাহলে কেনো আমার ছেলেটা কষ্ট পাবে??ওর ভালো থাকার জন্য যা করার আমিই করব।আমি আর কতদিন আছি,বয়সও হচ্ছে।মনে মনে মেয়েও দেখতে শুরু করেছেন।মনের মত কাউকে পেলে পড়াশুনা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করবেন না।সব ভেবেই রেখেছেন রেহানা মাহমুদ।

চলবে……………

(প্রিয় পাঠক পাঠিকা বৃন্দ, আস্সালামুআলাইকুম।একটি গল্প লিখা হয় আপনাদের ভালো লাগার জন্য।সে গল্প পরে যখন আপনাদের সাড়া পাওয়া যায় না তখন লিখার উৎসাহটাই নষ্ট হয়ে যায়।আপনারা যত উৎসাহ দিবেন গল্প লিখায় তত আগ্রহ বাড়বে এবং গল্প তত সুন্দর হবে।তাই গল্প যদি আপনাদের ভাল লাগে এবং পরবর্তী পর্ব পেতে চান তবে অবশ্যই গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকার অনুরোধ রইলো।ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here