মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা উম্মে হাবিবা তনু পার্ট:৫০(শেষ পর্ব)

0
995

মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা
উম্মে হাবিবা তনু
পার্ট:৫০(শেষ পর্ব)

এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছে রুদ্র।
মাহার যাওয়ার কথা ছিল।কিন্তু মেঘলার ডাইরি থেকে মাহা সব জেনে গেছে এবং সবার বারণ সত্বেও নিজের বাবার সাথে দেখা করতে চলে গেছে,সাথে নিজের সুটকেসটাও নিয়ে গেছে।সকলে এইটা বুঝে গেছে মাহা রুদ্রর সাথে যাবে না।
অন্য গাছের ডাল কি আর নিজের গাছে লাগে!!
রুদ্র মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকলেও এখন পর্যন্ত মানতে পারছে না পুরো বিষয়টা।মাহা যে ওর গোটা পৃথিবী।ওর সন্তান।কিন্তু প্রকৃত অর্থে বায়োজিকাল ফাদার না।
রুদ্রর সাথে সাবিবা,মুবিন হাসানও যাচ্ছেন এয়ারপোর্টে।মমতা হাসান যেতে চাচ্ছিলেন না তবুও জোর করেই নিয়ে গেলো সাবিবা।ফাঁকা বাসায় একা রেখে কিছুতেই যাবে না।অগত্যা যেতে হলো।

এসাইলেম এর একটি কক্ষের সামনে দাড়িয়ে আছে মাহা।
সামনে থাকা ব্যক্তিটিকে মাহা চিনে না।উস্কো খুস্কো বড় বড় চুল দাড়িতে তে মুখের গঠন বুঝা দায়।তবে চোখ দুটো খুব চেনা চেনা লাগছে।মনে হচ্ছে বহুবার দেখা এই চোখ।যেনো রোজই দেখা হয়।হ্যাঁ,তো..রোজই দেখা হয় আয়নায়।অবিকল মাহারই চোখ দুটো কেটে বসানো না হয় উনার চোখ দুটো কেটে মাহার চোখে বসানো।
অনেকক্ষণ ধরে শুধু দেখেই চলেছে,কিন্তু কিছু বলার মত খুঁজে পাচ্ছে না।কি বলে সম্বোধন করবে??বাবা!!!
বিপরীত দিকে দাড়ানো ব্যক্তিটিও নিরূত্তাপ।তার নাকি মানসিক ভারসাম্য নেই।তবে কেনো তার মধ্যে অপরাধবোধ দেখা যাচ্ছে??নাকি মাহার চোখের ভ্রম।
জেলার যখন জানিয়েছে তার মেয়ে দেখতে এসেছে তখন থেকেই কাদঁছে।নিজের সন্তানকে প্রথমবার দেখে নাকি তাকে কাছে ডাকতে পারছে না,আদর করতে পারছে না বলে?নাকি তীব্র অপরাধবোধ ঝেকে ধরেছে??
কিছুই বুঝা যাচ্ছে না।শুধুই নিরবে চোখের পানি ফেলছে।কেনো ফেলছে??
মাহা হাজার চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারছে না।এইভাবে কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকবে??মিশ্র এক অনুভূতি হচ্ছে।কখনো ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে বাবা বলে ডাকতে ঠিক তখনই মনে পরে যাচ্ছে মাম্মাম আর মামনির সাথে করা সেই অন্যায়গুলোর কথা।আর তখনই মন বিষিয়ে যাচ্ছে ঘৃণায়।

আপনাকে কি বলে ডাকবো আমি জানি না।আপনার সাথে দেখা করতে আসার পিছনে শুধু একটাই কারণ আমার অস্তিত্বের জানান দেওয়া।
সীমান্ত অশ্রুসিক্ত চোখে মাহার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।অবিকল মেঘলার মত দেখতে।
মাহা বাবা নামক ব্যক্তিটির দৃষ্টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আবার বলতে শুরু করল,আপনি আমার মাম্মাম আর মামনির সাথে যে অন্যায় করেছেন তার কোনো ক্ষমা নেই।আপনার কাছে তো সন্তানের কোনো প্রয়োজনই ছিল না তবুও আমি নাকি আপনার ওরশজাত সন্তান পৃথিবীর বুকে দাড়িয়ে আছি।আপনি দেখতে পাচ্ছেন??
সীমান্ত নিরুত্তর।অপলক দেখে যাচ্ছে তার সন্তানকে।তার সন্তান বেচেঁ আছে এমনকি তার সাথে দেখা করতে এসেছে সবটাই স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
তবে কি বলুন তো আল্লাহ তায়ালা ন্যায় বিচার করেন,উত্তম পরিকল্পনাকারী।আমি আপনার সন্তান কিন্তু আপনার সন্তানের প্রয়োজন নেই তবে আমার তো বাবা চাই।এবং পেয়েছিও।পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা হলো আমার বাবা।
সীমান্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।তার মেয়ে কিনা বলছে তার বাবা শ্রেষ্ঠ বাবা!!
এইভাবে অবাক হবেন না।আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা ঠিকই তবে সে আপনি নন।সে আমার পাপা।যাকে আপনি আমার মাম্মাম এর চোখে খারাপ বানিয়েছিলেন।
এইবার যেনো অবাকের সাথে সাথে সূক্ষ্ম জ্বালাময়ী এক কষ্ট অনুভূত হচ্ছে।এতক্ষণে মুখ খুললো সীমান্ত,অস্পষ্টভাবে বললো,
রুদ্র!!
হ্যাঁ,রুদ্র।রুদ্র মাহমুদ,আমার পাপা।আর আমি তার মেয়ে মাহা মাহমুদ।
তোমার মা কোথায়??সে কি তোমার সাথে এসেছে??
আমি একাই এসেছি।
রুদ্র তোমার পাপা হতে পারে না।
কেনো পারে না??
এ পাপ,ভ্যাবিচার।
আমি মাম্মা নই।আমাকে ভুল বুঝানোর চেষ্টাও করবেন না।
আমি তোমাকে ভুল বুঝাতে চাইছি না।দেখো মা তোমার বয়স কম তুমি বুঝবে না।তবুও বলছি,তোমার মায়ের সাথে আমার ডিভোর্স হয়নি।আমি বেচেঁ থাকতে সে অন্যকারো জীবনে জড়ানোটা পাপই..
অনেক বলে ফেলেছেন।এইবার চুপ করুন।এতবছরেও আপনি বিন্দু মাত্র বদলাননি??সবাইকে আপনার মত কেনো ভাবছেন???আমার আফসোস হয় শেষ দিন পর্যন্ত আমার মাম্মা একটা ভুল মানুষকে ভালোবেসে গেছে।
শেষ দিন!!মেঘলা কোথায়???
আমার জন্মের দিনই আমার মাম্মাম……
মেঘলা আর নেই!!সীমান্তের চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।আর সাবিবা?
আমার মামনিও খুব ভালো আছে।জানেন তো আমি এই মানুষটার কাছে অনেক ঋণী।উনি না থাকলে হয়তো এই পৃথিবীটা আর আমার বসবাসযোগ্য হতো না।
সীমান্ত মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে।নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না।প্রচণ্ড অপরাধবোধ ঝেকে বসেছে।নিজের করা অপকর্মের জন্য আফসোস হচ্ছে।সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে এই অসাধরণ মেয়েটা তাকে বাবা বলে ডাকত।একটা সুন্দর পরিবার হতো।সবই তার পাপের শাস্তি।
আমি আপনার কাছেও কৃতজ্ঞ।
ঝাপসা চোখ মেলে মাহার দিকে তাকালো।
কারণ আপনার নিকৃষ্ট কর্মের জন্যই আমার মাম্মাম চলে এসেছিল বলে আমার পাপার মত পাপা পেয়েছি।আমার খুব গর্ব হয় যখন নিজেকে পরিচয় দেই আমি রুদ্র মাহমুদ এর মেয়ে মাহা মাহমুদ।
সীমান্ত করুন চোখে তাকিয়ে আছে।খুব কষ্ট হচ্ছে।তারই সামনে দাড়িয়ে তারই মেয়ে অন্য একজনকে বাবা বলছে এবং তার জন্য গর্ববোধও করছে।খুব করে একবার বাবা ডাক শুনতে ইচ্ছা করছে।কিন্তু সেকথা বলার মুখ তার নেই।
আমি চলে যাচ্ছি এদেশ ছেড়ে।ভাবলাম একবার দেখে যাই কে সেই ব্যক্তি যার জন্য আমার মাম্মাম ঘর ছেড়েছিল,কার নিকৃষ্ট রক্ত আমার শরীরে বইছে।
একটা কথা রাখবে মা!
আপনার কথা!!এতদূর ভাবনাটা কিভাবে করেন??
সীমান্ত মাথা নিচু করে নিল।সেভাবেই বললো,ভালো থেকো আর তোমার মামনিকে বলো পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিতে।
আমি বলে দিবো।আসি।
মাহা ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো।একবারও পিছন ফিরে তাকালো।
সীমান্ত সেখানেই হাঁটু মুড়ে কাদতে শুরু করলো।প্রথমে নিরব অশ্রু ঝরালে ধীরে ধীরে ভয়াবহ এক করুণ চিৎকার করে কাদতে শুরু করলো।আশের পাশের সবাই সে চিৎকারে ভয় পেয়ে যাচ্ছে।এসাইলাম এর ডক্টররাও ছুটে এলো।তাৎক্ষণিক ইনজেকশন পুশ করে দিলেন।কিছু সময়ের ব্যবধানে সীমান্ত নেতিয়ে পড়ল।

এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়েও যেনো অস্থিরতা কমছে না রুদ্রর।মাহাকে রেখে চলে যাচ্ছে ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু সেতো রেখে যাচ্ছে না মাহা ওর বাবার কাছে ফিরে গেছে।কিন্তু ওর বাবা তো এসাইলামে,তাহলে মাহা কোথায় থাকবে??মাহাকে দেখার জন্য বাংলাদেশে তো ওর নানা নানী মামনি আছে।মিছেই এত কেনো ভাবছি??রুদ্রর অস্থিরতা ক্রমশই বাড়ছে।গাড়ি যখন এয়ারপোর্টের সামনে থামলো তখন যেনো ভিতরে খা খা মরুভূমির উত্তাপ বইতে শুরু করলো।

বাড়ি ফিরে বড় একটা ধাক্কা খেল মাহা।ওকে রেখেই সবাই এয়ারপোর্ট এ চলে গেল??ওর জন্য অপেক্ষাও করলো না!!করবে কিভাবে যেভাবে সুটকেস নিয়ে বেড়িয়েছি…আপন মনেই মাহা হাসলো।আমি একাই যাবো।একদিক দিয়ে ভালই হলো সবাইকে সারপ্রাইজ দিবো।এতক্ষণে হয়তো সবাই ভেবে নিয়েছে অনেককিছু।ইশ পাপা না জানি কত কষ্ট পাচ্ছে!মাহা দৌড়ে বাড়ির পাশে এসে দাঁড়াল।এইখানেই তার মাম্মাম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।প্রথমবারের মতো এইখানে এসে দাঁড়াল মাহা।
মাম্মাম তুমি কি আমার সাথে রাগ করেছ??
আমিও কিন্তু তোমার সাথে রাগ করেছি।আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে সেই যে চলে গেলে একবারও আমাকে দেখলে না,কোলে নিলে না।এমনকি আমাকেও দেখতে দিলে না তোমাকে।তাই আমিও অভিমান করে আসিনি।
জানো সবাই বলে আমি তোমার মত দেখতে হয়েছি।কিন্তু আমার আদর্শ কিন্তু পাপা।তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড।পাপা কিন্তু তোমার কথা রেখেছে,আমাকে তার আদর্শে বড় করেছে।
তবে মাম্মাম তুমি কিন্তু খুব বোকা ছিলে।না হয় কেউ পাপার মত মানুষকে ভুল বুঝে!!
তোমার মনে একটা প্রশ্ন ছিল না মেঘলা আকাশে রুদ্রই কি ভরসা??
হ্যাঁ,মাম্মাম আমি তোমাকে বলছি,মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা।আর সেই জন্যই আমার জীবন এত সুন্দর।সেই জন্যই তোমার সামনে সসম্মানে তোমার মাহা দাড়িয়ে আছে।
আমি চলে যাচ্ছি মাম্মাম।কবে আসব জানি না।তবে তোমার কাছে আমি আবার আসবো।আসি মাম্মমা।

To all passenger of flight no:5508 are requested to pass the emigration the flight ready to to fly Canada.

এনাওউন্স শুনে রুদ্রর অস্থিরতা কয়েকগুণ বেড়ে গেল।পা দুটো আর সামনে এগুতে চাইছে না।মেয়েটার মুখটা শেষবারের মতো দেখে যেতেও পারবে না!!
আঙ্কেল আণ্টি আপু সবার মুখগুলোও থমথম করছিল।সবাই রুদ্রর কষ্ট বুঝতে পারলেও কিছু করতে পারছে না।পিছন ফিরে কতশতবার যে তাকালো।কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি ছাড়া সবাই ছিল।এই শেষবার ও পিছন ফিরবে।তারপরই সব পিছুটান ভুলে ফিরে যাবে।পিছন ফিরতেও ভয় করছে তার।এ পিছুটান সে ছাড়তে চায় না।ঠিক তখনই একটা শব্দ এসে কানে বারি খেলো।
পা..পা….
কারেন্টের গতিতে পিছন ফিরে তাকিয়ে খুব হতাশ হলো।১৫/১৬বছর বয়সী একটা মেয়ে তার পাপাকে ডাকছে।রুদ্র নিরাশ হয়ে যখন ঘুরে যাবে তখনই চোখ আটকে গেলো অদূরে।
ওই তো মাহা…ওর নানাভাইদের কি যেনো বলছে।
এইদিকেই তো ছুটে আসছে।মুরুভূমির বুকে এক পশলা মেঘের আভাস যেনো।
রুদ্র চোখে ভুল দেখছে না তো?সুটকেস হাতে ছুটে আসছে।মেয়েটার কত কষ্ট হচ্ছে।
রুদ্রও ছুটে মাহার কাছে ছুটে গেলো।
পাপাকে সামনে পেয়ে এক ঝুলি অভিযোগ ঢেলে দিচ্ছে।তবুও রুদ্রর মুখে হাসি।
মাহাও খুব খুশি পাপার হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে।
পিছনে পড়ে রইলো সাবিবা,মুবিন হাসান ও মমতা হাসান।উনাদের চোখে অশ্রু।বাবা মেয়ের আনন্দ দেখে তাদের চোখেও আনন্দ অশ্রু ঝরছে।

রুদ্রর বুক পকেটে এক হাত চেপে ধরে আছে যেখানে মেঘলার চিঠিখানা সযত্নে রয়েছে।অন্য হাত মাহার দখলে।অতি সন্তর্পনে ভরসা নিয়ে পাপার হাত আকড়ে ধরে আছে।
ফিসফিস করে মাহা বললো,পাপা বলতো মাহার জীবন এত সুন্দর কেনো??
কেনো??
মাম্মামের করা শেষ প্রশ্নটাই এর উত্তর।
রুদ্র এক চিলতে হেসে বলে উঠলো,মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা।

……….সমাপ্ত……….

আপনাদের মূল্যবান গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকবেন 😊ধন্যবাদ 😌

সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=169467331959466&id=140699218169611

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here