রোদেলা,পর্ব: ৫৮

0
847

#রোদেলা,পর্ব: ৫৮
লেখা: মাহাবুবা মিতু

ঐদিনের পর থেকে সুফিয়ানের নিয়মিত রুটিন হচ্ছে ওর ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ওর গাড়ির কাছে গাড়ি নিয়ে বসে থাকা। এরপর সাত দিনের মধ্যে তিনদিন দেখা পেয়েছে ও রোদেলার। তিনদিনের মধ্যে একদিন মাত্র চোখে চোখ পরে গিয়েছিল দু’জনের। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গাড়িতে উঠে চলে গিয়েছিল ও। সুফিয়ান অবশ্য পিছুপিছু যায় নি….
ঠিক যেন ওকে দেখতে এসেছিলো, আর কিছুই না।
সত্যি বলতে সুফিয়ান দেখতে চেয়েছিল- ওকে দেখে রোদেলার হাব ভাব কি হয় ….

কিন্তু শক্ত ধাতুতে গড়া রোদেলা এত সুন্দর করে উপেক্ষা করছে ওকে যে মাঝে মাঝে সুফিয়ানের সন্দেহ হয়….
এটা সত্যি রোদেলা তো…..!?

কোন বিরক্ত নেই, আতংক নেই, চোখে চোখ পরলেই মাছ ধরার জাল গুটানোর মতো দৃষ্টিটাকে গুটিয়ে নেয় সুনিপুণ ভাবে। কোন আগন্তুকের চোখে চোখ পরলে মানুষ যেমন চোখ ফিরিয়ে নেয় তেমনি ভাবে। আশ্চর্য লাগে সুফিয়ানের। মনে মনে ভাবে –
আমিও দেখবো কত দৃঢ় তোমার উপেক্ষার দেয়াল….!?
আমার ধৈর্যের চেয়েও দৃঢ়….!

বহুলোকের স্বপ্নের দেশ এটি। লন্ডন নাকি জাদুর শহর। কিন্তু ওকে যেন টানে না এসব। যে পবিত্র মায়ায় ও জড়িয়ে গিয়েছে বহুকাল আগে তারপর আর কোন জাদু কাজ করবার কথা না। তাই-ই হয়তো এসবে মন নেই ওর।

পরশ মোটামুটি বিরক্ত সুফিয়ানের উপর। কিন্তু বড় ভাই হওয়ায় কিছু বলতে পারে না মুখের উপর। তবুও একবার কথায় কথায় বলেছিলো- ভাই এই মেয়ে তো অকৃতজ্ঞ। ওর জন্য এতকিছু করলেন, আর ও আপনাকে না চেনার ভান করে যাচ্ছে। এরপরও আপনি এখন যা করছেন “দিস ইজ টু মাচ….” এসব বাদ দিয়ে এদিক সেদিক একটু ঘুরে দেখুন।

সুফিয়ান হেসেছে ওর কথা শুনে। পরশের বিরক্ত যেন আরো বেড়ে যায় ওর হাসি তে। পরে অবশ্য বুঝতে পারে যে ভালোবাসা কত গভীর হলে এমন পরিস্থিতিতেও মানুষ অটল থাকতে পারে…… ভুলটা বুঝতে পেরে শেষে শ্রদ্ধায় মনটা ভারী হয়ে যায় সুফিয়ানের ভালোবাসার জন্য । আর ঘৃণা হতে থাকে ঐ মেয়েটার প্রতি। পরশ ভাবে ও নিজেই দেখা করবে মেয়েটার সাথে… কিন্তু সুফিয়ান তাতে না বলে।

সেই উইকেন্ডের পর সুফিয়ান আবার এলো, সেদিন তাপমাত্রা
0 ডিগ্রি সেলসিয়াস। সুফিয়ানের শরীরও ভালো না। শরীর আবহাওয়ার এই হঠাৎ পরিবর্তনে নিজেকে যেন মানিয়ে নিতে পারছে না। তবুও ওর রুটিনে কোন বদল নেই। একটানা পাঁচদিন দেখা হয় সেই সপ্তাহে। রোদেলার কোন পরিবর্তন নেই। সেই একই ভঙ্গিতে বের হয়ে গাড়িতে উঠে চলে যায়। এমনকি রাস্তা ও বদল করে না, এখানে আসাও বন্ধ করে না। ও ওর স্বাভাবিক জীবন যাপনেই ব্যাস্ত। সুফিয়ানের কিন্তু সেই একই রুটিন, সেই সাইন্স ফ্যাকাল্টির সামনে গাড়িতে বসে থেকে এক পলক দেখবার অপেক্ষা। কোন ইশারা না, কথা বলবার চেষ্টা না পিছুপিছু যাওয়া না, শুধুই চোখে দেখা। আর রোদেলা প্রতিনিয়ত সেই দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে চলে যায়। ইদানীং সে ফোনে ব্যাস্ত থাকার ভঙ্গিতে গাড়িতে উঠে।

এমনি করে এত দীর্ঘ সময় ঠান্ডায় থাকায় সুফিয়ান অসুস্থ হয়ে যায়। ডাক্তার বলে তাকে বাড়িতে থেকে রেস্ট করতে। আবহাওয়া ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত যেন অবশ্যই বাড়িতে থাকে । সামনে সামার আসছে। আস্তে আস্তে তাপমাত্রা বাড়বে। খুব দরকার না থাকলে বাইরে যেন না বের হন।

সুফিয়ানের শরীর অসুস্থ হলেও মনের জোড়েই যেতে চায় বাইরে। কিন্তু পরশ যেতে দেয় না। ও নিজে বাড়িতে থেকে ওর দেখাশোনা করে। প্রায় সপ্তাহ খানিক যাওয়া হয়না রুটিন কাজে…. ঘরবন্দী সাতদিন কেটে যায়।

রোদেলার আচরণে যেন হাল ছেড়ে দেয় সুফিয়ান। এই পর্যন্ত এসে এই অবহেলা ওর আর সহ্য হয় না। নিজের উপর রাগ হতে থাকে। আর ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে হয় আমাকে পথ দেখাও নয়তো মন থেকে মুছে দাও এসবকিছু । আমি আর পারছি না……

এরপর আর যায় না সেখানে। একটু যেন বুঝতে চায় নিজেকে। তাই নিজেকে এই সময় দেয়া।

ওর মায়ের দূরসম্পর্কের মামা থাকেন ওয়েলস এ। তিনি সুফিয়ান ইংল্যান্ড আছে শুনে ফোন নম্বর জোগাড় করে ওকে ফোন করে, তাদের বাড়িতে যেতে বলেছেন। ও প্রথমে যেতে না চাইলেও পরে দেখা করে তাদের সাথে। এতে যদি মন ভালো হয়। কিন্তু এসব ভোলা কি এতই সোজা…. যতটা পথ এসব বয়ে এসেছে ঠিক ততোটা পথ পাড়ি দিলেও হয়তো ভোলা যাবে না এসব। সেখানে গিয়ে তাদের সাথে ও ছিলো বেশ কিছুদিন।

সেখান থেকে মেলিংটনে ফিরে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও। কাল ও যাবে ইউনিভার্সিটি অফ চেস্টরে। এটাই হতো ওদের শেষ দেখা হতে চলছে। সুফিয়ান সে রাতে ঘুমাতে পারে নি। কষ্টে ওর বুক ভারী হয়ে গিয়েছিল। রোদেলার মৃ*ত্যু মেনে নিলেই হয়তো ভালো হতো। কি দরকার ছিল এসবের…?

শেষরাতে চিরকুট লিখে সুফিয়ান। রোদেলার উদ্দেশ্যে।
চার ভাঁজ করে বুকপকেটে সেটা রেখে দেয় ও। শেষরাতে কখন ঘুম এসেছিলো চোখে ও জানে না। ঘুম থেকে উঠে নাশতা না করেই চলে যায় সেই গন্তব্যে, শেষবারের মতো….

সেদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছিলো রোদেলার বের হতে হতে, সুফিয়ান সেদিন দাঁড়িয়ে ছিলো রোদেলার গাড়ির সামনে। ওকে আসতে দেখে গাড়ির দরজা ছেড়ে দাঁড়ায় সুফিয়ান। ওর গাড়ির উপরে একটা পাথর দিয়ে সেই কাগজের টুকরোটা চাপা দিয়ে প্রথম বারের মতো রোদেলার আগেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় ও । ঘটনাটা রোদেলার চোখের সামনেই ঘটে। গাড়ির কাছে এসে পাথর সরিয়ে কাগজটা হাতে নেয় রোদেলা । খুলে দেখে ছোট্ট একটা চিরকুট। মাত্র কয়েক লাইন লেখা তাতে…..

চোখদুটো ভিজে যায় ওর। দ্রুত গাড়িতে বসে পিঁছু নেয় ও, একটু আগে ওকে ক্রস করে যাওয়া গাড়িটাকে। বেশীদূর যায় নি হয়তো গাড়িটা। দ্রুত গতিতে গাড়িটা পৌঁছে যায় বড় সড়কে। গাড়িটাকে দেখা যাচ্ছে দূর থেকে। এতদিন ধরে নিয়মিত দেখা গাড়িটা চিনতে ভুল হয় না ওর।

এটা যদি কোন ছবির দৃশ্য হতো তাহলে এ সময়ে হয়তো দেখা যেতো মেয়েটা তার গাড়ি দ্রুত চালিয়ে ঐ গাড়ির সামনে পথ আটকে দাড়িয়েছে । কিন্তু বাস্তবে এমন হয় না। বাড়তি গতিতে যতটুকু পৌঁছে গিয়েছিল কাছাকাছি, রেলক্রসিং এ আটকে তা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে এখন। তবুও সিগন্যাল ছাড়তেই তুফান গতিতে গাড়ি ছোটায় রোদেলা । এতটুকু ভরসা যে এ রাস্তা একেবারে সোজা গিয়েছে। মাঝপথে থামার কোন সুযোগ নেই। কারন রাস্তার দুইপাশের জায়গাগুলো সংরক্ষিত এলাকা। মিনিট পাঁচেক হাওয়ার গতিতে ছুটার পর গাড়িটা দৃষ্টিতে আসে ওর। আরো কিছুক্ষণ চলবার পর বামে মুভ করে সেটি। এরপর সেটি চলে যায় মেলিংটনের দিকে। একটু ভিতরে যেতেই গ্যাস স্টেশনের পাশের একটা দোতলা বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড়িয়ে।

সাতাশ মিনিট টান টান উত্তেজনায় ড্রাইভিং এর পর সেই গাড়ির পেছনে গাড়ি দাঁড় করায় ও। সামনে দুইতলা একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই কড়া নাড়ে দড়জায়। একটা মেয়ে এসে দড়জা খুলে, স্পষ্ট ইংরেজিতে বলে- তুমি কি রোদেলা……?
উত্তরে মলিন একটা হাসি হাসে ও, মেয়েটা দড়জা ছেড়ে ওকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়ে। দৌড়ে ভিতরে খবর দিতে যায়…

মিনিট সাতেক পর বসার ঘরে আসে সুফিয়ান, ওকে দেখেই উঠে দাঁড়ায় রোদেলা….
সুফিয়ান বলে-
রোদ আমি জানতাম তুমি আসবে….!

একথা শুনেই দুই হাতে মুখ চেপে বসে পরে সে, মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকে ….

সুফিয়ানের ইচ্ছে হয় ওর কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে কাঁদতে নিষেধ করে,কিন্তু ও তা পারে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে……

খানিক বাদে ঠিক ওর বিপরীতের সোফাটায় বসে।
একটু সময় দেয় ওকে….
কাঁদুক মেয়েটা, মন খুলে কাঁদুক……
এতদিন যে মৃ*ত ছিলো, সে আজ জেগেছে, দীর্ঘ মৃ*ত্যু অভিনয় পর জেগে উঠবার উদযাপন একটু না হয় কেঁদেই করুক….

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here