রোদেলা,পর্ব: ৫৯

0
909

#রোদেলা,পর্ব: ৫৯
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু

মিনিট সাতেক পর বসার ঘরে আসে সুফিয়ান, ওকে দেখেই উঠে দাঁড়ায় রোদেলা….
সুফিয়ান বলে-
রোদ আমি জানতাম তুমি আসবে….!

একথা শুনেই দুই হাতে মুখ চেপে বসে পরে সে, মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকে ….

সুফিয়ানের ইচ্ছে হয় ওর কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে কাঁদত নিষেধ করে। কিন্তু ও তা পারে না। ঠিক ওর বিপরীতের সোফাটায় বসে।
একটু সময় দেয় ওকে….
কাঁদুক মেয়েটা, মন খুলে কাঁদুক……
এতদিন যে মৃ*ত ছিলো, সে আজ জেগেছে, দীর্ঘ মৃ*ত্যু অভিনয় পর জেগে উঠবার উদযাপন একটু না হয় কেঁদেই
করুক….

সুফিয়ান অপলক চোখে তাকিয়ে দেখছে রোদেলাকে। কাঁদলেও যে মানুষকে এত সুন্দর লাগে তা এর আগে কখনো খেয়ালই করে নি ও । এটা ওকে ভালো লাগার অংশ নাকি সত্যি তা ও বুঝতে পারছে না। একটু সময় পর পানি ভর্তি একটা গ্লাস এগিয়ে দেয় সেন্ট্রাল টেবিলের ওপাশে বসে থাকা রোদেলার দিকে।

ব্যাগ থেকে ট্যিসু বের করে নাক চোখ মুছে রোদেলা সেই গ্লাসটা হাতে নেয়, একটানে শেষ করে সবটুকু পানি। খালি গ্লাসটা রাখতেই চোখে চোখ পরে সুফিয়ানের। কিছুটা লজ্জায় যেন চোখ ফিরিয়ে নেয় রোদেলা । ব্যাস্ত ভাবে ব্যাগের ভিতরে কি যেন খোঁজে, এটা যে অস্থিরতা লুকানোর চেষ্টা তা ঠিক বোঝে সুফিয়ান….

এরপর সেন্ট্রাল টেবিলে থাকা শূন্য গ্লাসের দিকে চোখ নিবদ্ধ করে প্রথম বারের মতো বলতে শুরু করে রোদেলা….

গত পাঁচ বছর চার মাসে একটু একটু করে আমার ভিতরের একটা দেয়াল তৈরী করেছি আমি, তৈরী করেছি আমার একান্ত নিজস্ব জগৎ, যাতে কোন আত্নীয়, কিংবা প্রিয়জন কিচ্ছু নেই। আছে কাজ, আর নিজের পরিচয় তৈরী করার অদম্য চেষ্টা।

আমি দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলাম তা ভেদ করবার ক্ষমতা আমি কাওকে কখনো দিবো না। এটাকে আপনি আত্ম অহংকার বলতে পারেন। তাতে আমি কিছু মনে করবো না…. কারন যে রোদেলা কৃষ্ণচূড়ায় থাকতো তাকে সবাই মিলে মে*রে ফেলেছে। আর আজকের এই যে আমি……, সে একেবারে ভিন্ন একজন। কাগজপত্রে জটিলতা না থাকলে সত্যি আমি আমাকে গুম করে ফেলতাম পৃথিবী থেকে। কিন্তু আপনার চিরকুটটা আমার আত্ন আহং এ গড়া ভিতরকার ঐ জগৎটাতে একটা ধাক্কা দিলো যেন, প্রথম বারের মতো আমি বুঝলাম যে আমি কত বড় অকৃতজ্ঞ….

বলেই আবারো কেঁদে ফেলে রোদেলা… একটু বিরতি নিয়ে কান্না জড়ানো অস্পষ্ট কন্ঠে বলে-
সত্যি আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমি একটা পরিবার বিলং করি। আমার কিছু আপনজন রয়েছে। তবে বিশ্বাস করেন সবাই মিলে আমাকে এটা ভাবাতে বাধ্য করেছে। সবাই কি সুন্দর মেনে নিয়েছে আমি এক্সজিসটই করি না, আমি ডে*থ….

আচ্ছা তারা আমার কেমন আপনজন….
যাদের মনে একটা বারও নাড়া দিলো না যে ওটা আমি ছিলাম না। শুনেছি ঐ লা*শ*টার উপরের অংশ থেঁ*ত*লে গিয়েছিল, শুধু মাত্র পা দুটো অক্ষত ছিলো… তারপর ও তারা কিভাবে মেনে নিলো যে ওটা আমি ছিলাম।

আমার মা….?
পৃথিবী সুদ্ধ মানুষ বলে মায়ের মতো আপন কেও নাকি নাই…..
এবার বুঝুন আপনি, সেই মা-ও সেদিন বুঝলো না যে সেটা আমি ছিলাম না…..

আমার গোটা জীবনে আমি কখনো আমার জন্য ভালোবাসা তাঁর চোখে দেখি নি, সবাই বলে তার নাকি প্রকাশ ক্ষমতা কম, আচ্ছা সুফিয়ান আপনি বলেন তো- একজন মা যে তার মেয়েকে জন্ম দিয়েছে, বড় করেছে, সেই প্রক্রিয়াটা ঠিক কি রকম হলে সে জানতে পারে না- তার মেয়ে কি খেতে পছন্দ করে, কি রঙ তার মেয়ের প্রিয়, তার মেয়ের বেড়ে ওঠার যত্নে ঠিক কতো অবহেলা মিশালে সে ধরতে পারে না যে সেই লা*শ*টা তার মেয়ের না….
ওটা অন্য কারো শরীরের অংশ….

আবারে কান্না করে রোদেলা….
চোখমুখ মুছে বলে-
আজকের এই যে কঠিন আমি…..
এর জন্য কে দায়ী বলেন….
ঘৃণার কোন সীমায় পৌঁছালে একজন সন্তান দোজখে যেতে রাজি তবুও তার বাবা মায়ের মুখাপেক্ষী হতে রাজী হয় না…..

আমাদের ধর্মে মা বাবার প্রতি একটা কর্তব্য ফিক্সড করে দেয়া আছে…. আমার তো তাহলে জাহান্নাম কনফার্ম হয়ে আছে…. এত খারাপ সময়ের ভিতর দিয়ে গিয়েছে আমার পরিবার আমি তাদের খবরও রাখি নি। তারা আমাকে মৃ*ত মেনে নিয়েছে, আমার জন্য ও তারা মৃ*ত্য। কিন্তু তাদের আমাকে মৃ*ত ভাবাটা যত সহজে তারা বেছে নিয়েছে, আমার জন্য তা কিন্তু এত সোজা ছিলো না…….

কত কত বার যে আমি কল করেছি আমাদের মোবাইলটাতে…. তাদেরকে বলতে চেয়েছি যে আমি মৃ*ত না, আমি এগজিস্ট করি…..
কষ্টে অভিমানে আমি তা পারি নি….

যেই কষ্টে একেকটা দিন পার করেছি আমি ঐদিন গুলোতে, যদি সত্যি মৃ*ত্যু হতো আমার, তাহলে বোধহয় কষ্ট কমই হতো। প্রথম প্রথম অনেক ভাবতাম এসব….

এরপর এই দেশ, এই পরিবেশ, পরিস্থিতি আমাকে কাজ আর পড়াশোনায় এত ব্যাস্ত করে রেখেছে যে একটা সময় আমি ভুলেই গিয়েছি আমি একটা পরিবারের অংশ, আমার একটা কঠিন, জটিল অতীত আছে, আছে নামমাত্র কিছু আপনজন।

তাদেরকে আমি ভুলে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। এখন আমার এসব কোন ফিলিংস্ই কাজ করে না। কিন্তু দিনশেষে আমিও তো মানুষ, সারাদিন যতই ব্যাস্ত থাকি দিনশেষে আমারও একটা মন আছে…..

পরিস্থিতি যখন আমাকে আমার পরিবার থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, তখন যে মানুষটা আমার অবর্তমানে আমার পরিবারকে আগলে রেখেছে, দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে আমি তাকে দেখে কথা বলাটা পর্যন্ত জরুরী মনে করি নি…
আমার এই অকৃতজ্ঞতা আপনি ক্ষমা করুন সুফিয়ান…..

বলে আবার কাঁদতে থাকে রোদেলা….
চোখ, মুখ মোছায় ব্যাস্ত হয়ে পরে রোদেলা….

শেষের এই বাক্যটায় যেন মন্ত্রমুগ্ধ সুফিয়ানের ঘোর কাটে, সোজা হয়ে বসে বলে-
আমি বুঝতে পারছি তোমার উপর দিয়ে কি গিয়েছে….
আমি কিছু মনে করি নি, গো এহেড….

: আর কি বলবো….
: কিছুই তো বললে না এখনো….
: আপনাকে আমার কথা কি প্রিসিলা বলেছে….
: প্রিসিলা…..!!!
তোমার বোনকে যদি কেউ বোমা খাইয়েও দেয় তবুও ওর পেট থেকে কেও কথা বের করতে পারবে না…..
: তাহলে….
: আগে তুমি শেষ করো….
: না আপনি বলুন….

কিছু সময় নিরব থাকে সুফিয়ান। গত পাঁচ-পাঁচটা বছর একটু যেন রিচেক করে নিচ্ছে ও। তারপর নিরবতা ভেঙে বলে-

: নোভেল যখন আমাকে জানালো খবরটা….
যে মগবাজারে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, স্পট ডে*থ
সেটা নাকি তুমি….খবরটা শুনে আমার মনে হচ্ছিল আমার চারপাশ কেমন দুলছে…
কোনমতে গাড়িতে উঠে বজলুকে বললাম ড্রাইভ করতে। জুরাইন থেকে ঢাকা মেডিক্যাল সর্বোচ্চ ১ ঘন্টা লাগার কথা জ্যাম ঠেলে, সেদিন কিসের একটা রাজনৈতিক সম্মেলন ছিলো পল্টনে। জ্যামে রাস্তার অবস্থা খারাপ, আড়াই ঘন্টা লাগলো হসপিটালে পৌঁছাতে। আমি নেমে যে হেঁটে যাবো তাও সাহস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, পরে যাবো।

সেখানে গিয়ে দেখি পুলিশি কাজকর্ম কিছু বাকী আছে। তোমার পরিবারের লোকজন তোমাকে সনাক্ত করছে। আমি সেখানে যাই নি, বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, কেমন একটা ভয় কাজ করছিলো।

তারা সবাই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে ঐ লা*শ*টাকে বের করতে দেখে, তোমার সাইড ব্যাগ, ব্যাগের ভিতরে থাকা ফোন সবকিছু মিলে যাওয়ায় সবার সেই কান্নাকাটি যেন আর্তনাদে পরিনত হয়। তোমার পরিবারের মানুষ তোমার এ খবরে একটা বিশাল ধাক্কা খেয়েছে, তাদের হিতাহিত জ্ঞান তখন হয়তো কাজ করছিলো না, তাই তাদেরকে যা বলা হয়েছিলো তারা তাই মেনে নিয়েছে। তার উপর ব্যাগ, মোবাইল, আইডি কার্ড….

কিন্তু আমার কেমন যেন অস্থির লাগছিলো দেখে, একটা ম*র*দে*হ যার শরীর বলতে কেবল দুটি পা। উপরের অংশ একেবারে থেতলে গিয়েছে। আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম সেখানে, কিছু একটা খুঁজছিলাম যাতে আমি নিজেকে স্বান্তনা দিতে পারি যে ওটা তুমি না….

কিছুই মাথায় আসছিলো না, আমি কেন জানি মানতে পারছিলাম না ঐটা তুমি। আমি দ্রুত সেখান থেকে চলে আসি, সেই লা*শ*টা*কে বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে। বজলুকে বলি একটা ছবি তুলে আনতে…

আমি সেদিন তোমাদের বাড়িতে আর যাই নি, এমনকি জানাযার নামাজেও না। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম ঐ সময়টাতে। আস্তে আস্তে যখন ঘোর থেকে বের হলাম তখন আমি সবার আগে যেটা করলাম সেটা হলো মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করতে লাগলাম। কেন জানি মন থেকে একটা ডাক আসছিলো ঐটা তুমি ছিলে না, তুমি আছো…..!

শুনতে অস্বাভাবিক শুনালেও ঐ লা*শ*টার তোল ছবিটা আমি খেয়াল করছিলাম অনেক দিন ধরে। তোমার পায়ে পাতা মেহেদী দিয়েছিলে তুমি, সেন্টমার্টিনে আমি সেটা খেয়াল করেছিলাম, এমন কি অনিমা জিজ্ঞেস করায় তুমি ওকে বলেছিলে ওটা নেইলপালিশ না পাতা মেহেদী কি একটা প্রসিডিওর ফলো করে দেয়া। যা কারনে ঐটার রঙ এত গাঢ় হয়েছে। আমার মা আগে প্রচুর মেহেদী পরতেন হাতে, সে দিক থেকে আমি জানতাম মেহেদীর রঙ এত দ্রুত উঠে যায় না।

সেই লা*শ*টা*র পায়ের নখ গুলো সাদা ছিলো, তারউপর তোমার পায়ের পাতা ইজিপশিয়ান ধরেনর, সেন্টামার্টিনে গান গাওয়ার সময় তুমি দু’পাতে মুখ রেখে গান গেয়েছিলে…. তখন সেটা আমি খেয়াল করেছিলমা। আর ঐ লা*শে*র পায়ের পাতা গুলো রোমানিয়ান ধরনের। এটা অবশ্য অনেক পরে জেনেছি নেট ঘাটাঘাটি করে। আর স্মৃতি থেকে ধার করে…

যদিও এসব হস্যকর কথাবার্তা মনে হবে যে কারো কাছে, কিন্তু আমি বিশ্বাসী ছিলাম তুমি আছো…..
এই বিশ্বাসই এসব ক্লু আমার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে….

একটু বিরতি দেয় সুফিয়ান……

: এতেই তো প্রমাণ হলো না যে আমি আছি, এবং ইংল্যান্ডে আছি, আমার মতো সামাজিক অবস্থায় থাকা মেয়ের এখানে আসার কথা না…..,
তাই না…..
: সে গল্প অনেক বড় রোদ….
: চমকে তাকায় রোদেলা, রোদ কথাটা কেমন ধাক্কা দেয় ওর মনে….
: চমকানোর কিছু নেই, এত বড় নাম…. আমার আবার নাম ছোট করে বলার স্বভাব… অনিমাকে অনি ডাকি, রেজওয়ানকে ডাকি রেজা বলে…. তুমি কিছু মনে করলে….
: কিছু মনে করছি না, আমার নামটা কি আপনার নামের চেয়েও বড়….!
মুচকি হাসে সুফিয়ান….

রোদেলা তাকিয়ে থাকে ওর দিকে,
মুচকি হাসিতে ভীষণ সুন্দর দেখায় সুফিয়ানকে….

এরমধ্যে চা নিয়ে হাজির হয় পরশের স্ত্রী, হাসিমুখে কথা বলে রোদেলার সাথে, এরপর ওদেরকে কথা বলার স্পেস দিয়ে চলে যায় ভিতরে।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সুফিয়ান বলে….
: নাউ ইউর টার্ন…..

আহত চোখে তাকায় রোদেলা….
কারন সে গল্পটা ওর জীবণের সবচেয়ে কষ্টের, সবচেয়ে দুঃখের…..
শুরু করে ওর সেই কাহিনির পরের পর্ব….

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here