#রোদেলা,পর্বঃ ৫৭
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পাঁচ বছর পর…….
ক্যালেন্ডার হিসেবে এখন উইন্টার চলছে, এখনকার তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেঃ। মৌসুমি জলবায়ুর দেশে বাস করা লোকদের জন্য এটা ভয়ানক একটা ব্যাপার। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বসবাসকারীরা এমন সাথে তেমন পরিচিত না। কিন্তু এখানকার স্থানীয় মানুষেরা এসবে অভ্যস্ত।
এখন বাজে সকাল নয়টা পয়ত্রিশ। কিন্তু চারপাশে দেখলে মনে হবে ভোর সকাল । গত তিনদিন ধরে সূর্যের দেখা নেই। ইউরোপের দেশগুলোর এই এক সমস্যা। এদেশের মানুষেরা নাকি ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট হিসেবে নেয়, সূর্যের আলোর অপর্যাপ্ততা এর কারন। আজ অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠেছে ও। নাশতা করেছে স্যান্ডুইচ, সিদ্ধ ডিম আর কফি দিয়ে। সময় কাটাতে টিভি দেখেছে কিছুক্ষণ। তারপর বেরিয়ে গিয়েছে গাড়িতে করে ।
সুফিয়ান এখন হাঁটছে চেস্টারের নর্থ গেইট এভিনিউ ধরে। যাচ্ছে ইউনিভার্সিটি অফ চেস্টারে। দুই সপ্তাহ হয়েছে এখানে এসেছে। উঠেছে মেলিংটনে এক ছোট ভাইয়ের বাসায়, ওর নাম পরশ। পরশ এখানে ছোটখাটো একটা ব্যাবসা করে। ওর একটা কাজ আছে চেস্টার সিটি সেন্টারে। সুফিয়ানকে আজ তাই এখানেই নামিয়ে দিয়েছে। এখান থেকে চেস্টার ইউনিভার্সিটি হাঁটা পথ। সেখানে পড়াশোনা করে এমন একজনের ফোন নম্বরও জোগাড় করে দিয়েছে পরশ ও আসার পরপরই। এত বড় ইউনিভার্সিটিতে কোথায় কি তা সুফিয়ানের বুঝতে সমস্যা হবে। তাই পরশ সুমনা নামের ঐ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীর নম্বর জোগাড় করে দিয়েছিলো। সুমনা একসময় পরশের শপে পার্টটাইম জব করতো।
কিছু ইনফরমেশন রিভেল করতে ওর এতদূর আসা। প্রকৃত পক্ষে এটাই ওর প্রথম ইউরোপ ভ্রমণ। সুফিয়ানের ট্রাভেল হিস্ট্রি খুবই উইক। বার কয়েক ইন্ডিয়া, একবার থাইল্যান্ড আর একবার মালেশিয়া গিয়েছিল, এ অবস্থায় ইউরোপের ভিসা পাওয়া টাফ। তবুও নিজে নিজে সব কাগজপত্র তৈরী করে একবার পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলো ইংল্যান্ডের ভিসার জন্য। ব্যাংক স্টেটমেন্ট স্ট্রং হওয়া সত্ত্বেও সেবার ও রিজেক্ট হয়। পরে অনেক হ্যাপা পোহাতে হয়েছে ভিসা পেতে। ঢাকার
এক এজেন্সি ধরে বারো লক্ষ টাকার কন্ট্রাকে ছয় মাসের ভিজিট ভিসা নিয়েছে ও। পরিচিত সবাই এটাকে বলেছে পাগলামি। কিন্তু ওই জানে এসব পাগলামি কি না। পাগল তো ও হয়েই আছে, নতুন করে হওয়ার ভয় তাই ওর আর নেই। ছোট ভাই অস্ট্রেলিয়াতে স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেছে বছর তিনেক হলো । ও আর ফিরবেনা দেশে তা নিশ্চিত। ভালো স্টুডেন্ট হওয়ায় ব্রাইট ফিউচার অপেক্ষা করছে ওর জন্য, তা সুফিয়ান জানে। বোনটারও বিয়ে হয়েছে দেড় বছর হলো। মা তো চলেই গেলেন মায়া কাটিয়ে। ওর আর পিছুটান কি। পরশকে এখানে আসার কারন যখন বললো ও পরশ তখন বলেছিলো ভাই ঘুরবার উদ্দেশ্যে যদি আসতেন আমি বলতাম শখের তোলা বারো লক্ষ টাকা। কিন্তু এই এতটুকু কাজে এত দূরে আসা পাগলামিই বটে। সুফিয়ান হেসেছে ওর কথা শুনে, কিছুই বলে নি। নর্থ গেইট এভিনিউ এর চারপাশে দেখতে দেখতে এসব ভাবছিলো সুফিয়ান।
মিনিট পাঁচ পরে পৌঁছে গেছে চেস্টার ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি। এখানে কিছু দূর পরপরই কমিউনিটি গাইড লাইনে ইন্সট্রাকশন দেয়া থাকে। অক্ষর জ্ঞান থাকলে এখানে হারিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এ জিনিসটা খুব পছন্দ হয় ওর। রাস্তাঘাট এত পরিষ্কার যে অবাক না হয়ে পারে না ও।
অবশেষে সেখানে পৌঁছে কল করে সুমনাকে। ও এসে সুফিয়ানকে রিসিভ করে গেইট থেকে। এবার নিয়ে তৃতীয়বারের মতো সাক্ষাৎ সুমনার সাথে, তাই হালকা কুশল বিনিময় করে ওরা। এরপর সুমনা ওকে বরাবরের মতো সাইন্স ফ্যাক্যাল্টির কাছে নিয়ে যায়। সেখানে সুফিয়ানকে রেখে ভিতরে যায় সুমনা। গত সপ্তাহে ও এখানে এসে খবর নিয়ে গিয়েছিল। সুফিয়ানকে নিয়ে এসেছিলো তিন বার। সুফিয়ান যার খোঁজে এসেছে সে এখানকার এলামনেস। কাজ করে এখানকার এক প্রফেসরের রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট হিসেবে। তার আজ মর্নিং শিফটে কাজ চলছে। শেষ হবে একটায়, গত এক সপ্তাহে তিনবার ও এখানে এসেছে তার সাথে দেখা করতে। কিন্তু শিডিউল টাইম ম্যান্টেন করে আসার পরও দেখা হয় নি। প্রত্যেকবার সেখানকার ল্যাব এসিস্ট্যান্ট চোখমুখ শক্ত করে বলেছে কিছুক্ষণ আগেই চলে গিয়েছে। আজ আর তাকে জিজ্ঞেস না করেই সুমনা অপেক্ষা করে। এরমধ্যে একবার ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট বের হওয়ার সময় সুমনাকে দেখে বিরক্ত মুখে না চেনার ভাব করে চলে গেছে। এই এরিয়াটা মোটামুটি সংরক্ষিত। সুমনা এখানকার স্টুডেন্ট হওয়ায় এ অব্দি আসতে পারলেও অপেক্ষা করছে মেইন ফটকের বাইরে। খোঁজ নিয়ে ও সুফিয়ানকে ম্যাসেজ করে জানিয়ে দিয়েছে আজ তিনি আছেন। সুফিয়ানের হার্টবিট থেমে যাওয়ার উপক্রম। কি হতে যাচ্ছে তা ভেবে। গত তিনদিন ফিরে গিয়েছে এত কাছাকাছি এসেও।
সময় যেন এগুচ্ছেই না একটা দিকে। একটু পরপর ম্যাসেজ চেক করছে সুফিয়ান। সুমনাকে ও বলে দিয়েছে কিছু যেন না বলে তাকে। সে বের হলেই একটা ম্যাসেজ করে দেয় যেন।
ঘড়িতে একটা বাজে ছয় মিনিট। সুমনাকে ম্যাসেজ করে সুফিয়ান। সুমনা সিন করে উত্তর দেয় না কোন। একটু পরে ম্যাসেজ করে ওয়েট ব্রো……
ওয়েট…..!
সুফিয়ান সেই ফ্যাকাল্টির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ফোনের দিকে চেয়ে । অবশেষে একটা ম্যাসেজ টোন কানে আসে ওর, লক স্ক্রিন না খুলেই ডিসপ্লেতে ভেসে থাকতে দেখে ম্যাসেজ টি।
মাত্র বের হয়েছে, সিঁড়ি দিয়ে নামতে একমিনিটের মতো লাগবে। সুমনা তাকে দেখলেও, কোন কথা বলে না, তার পিঁছু পিঁছু হেঁটে সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে। আগে থেকে সুমনাকে তার সম্পর্কে হিন্টস দেয়ায় সুমনা সহজেই চিনে ফেলে তাকে।
সুফিয়ানের অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হতে চললো…
ক্লাস পরিয়ড শেষ হওয়ায় অনেকেই বের হচ্ছে একসাথে। অনেকে ভিতরেও যাচ্ছে। মোটামুটি ক্রাউডেড এরিয়া। তবুও সুফিয়ান জানে যাকে ও খুঁজছে তাকে পৃথিবী সুদ্ধ সব মানুষের মধ্যে খুঁজে বের করতে পারবে। রোদ নেই তবুও চোখে সানগ্লাস সুফিয়ানের। নিজেকে আড়াল করতে বোধহয়। সুমনাকে দেখলো সুফিয়ান, কিন্তু…….
অবশেষে সুফিয়ান তাকে দেখলো, দুনিয়াটা যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে, চারপাশের সব কিছু থমকে আছে, শুধু চলছে ও….
কালো টপস পরা পোশাকে ছাই রাঙা ওভারকোট জড়িয়েছে শরীরে, গলায় ঝুলছে বারবেরি প্রিন্টের একটা লম্বা স্কার্ফ,
ব্যাগ হাতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে সে। যেন গাড়ি কিংবা ট্রেন ধরবার তাড়া আছে ওর। যদিও এখনকার সবাই এমনি ব্যাস্ত ভঙ্গিতে হাঁটাচলা করে।
সুফিয়ানের জীবণে সাড়ে পাঁচ বছর কেটে গেছে অথচ তার জীবণ ঘড়ি যেন উল্টো ঘুরেছে। বয়স অনেক কমে গেছে যেন। অনেক হ্যাংলা হয়ে গেছে ও তাই আগের চেয়ে লম্বা লাগছে ওকে, মেদহীন মুখটায় চিবুকের টোল আরো বেশি করে স্পষ্ট লাগছে। গায়ের রং ও খুলেছে ওর। সর্বোপরি একটা সূক্ষ্ণ গাম্ভীর্য জেগেছে ওর মুখশ্রীতে।
হঠাৎ সুফিয়ানের চোখ ভিজে উঠলো কিনা বুঝলো না, মুখ ঘুরিয়ে পকেটের রুমাল বের করে চোখ মুছলো ও। ততক্ষণে সে সুফিয়ানকে অতিক্রম করে তার জন্য অপেক্ষমান গাড়ির দিকে পৌছে গেছে। সুফিয়ান তার সামনে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে-
কেমন আছো রোদেলা…..
তিনি যেন চমকে উঠলেন সুফিয়ানের কথা শুনে। গাড়ির অর্ধ খোলা দরজা আগলে ধরে পেছন ফিরে তাকিয়ে এক মূহুর্ত যেন থমকেও দাঁড়ায় , ওকে দেখে হঠাৎ হকচকিয়ে যায়, যেন দিনের বেলায় ভুত দেখলেন। চেহারায় বিরক্তির ছাপ টেনে এনে স্পষ্ট ইংরেজিতে বললেন-
কে আপনি…
আর কাকে রোদেলা বলছেন….?
সুফিয়ান একটুও না চমকে মৃদু হাসলো শুধু…
বিরক্তির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে, ব্যাস্ত ভঙ্গিতে গাড়ির দড়জা খুলে ড্রাইভিং সিটে বসে দ্রুত সেখান থেকে চলে যায় ও। সুফিয়ানের যেন কোন তাড়া নেই তার পিছুপিছু যাওয়ার৷ তাকিয়ে থেকে ওর গাড়িটার চলে যাওয়া দেখলো শুধু। একটা তৃপ্তির হাসি হাসলো ও । সুমনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেখান থেকে চলে যায় ও….
সুফিয়ান হাঁটতে হাঁটতে আবার পৌঁছে সিসি সেন্টারের কাছে,
মনে মনে ভাবে এমন কেন করলো ও আমাকে দেখে, সুফিয়ান জানতো ও চমকে যাবে কিন্তু না চেনার ভান করবে তা ভাবতে পারে নি। কিছুটা মন খারাপ হয় ওর। ইচ্ছে হয় সব ছেড়েছুড়ে চলে যায় দেশে।
চলবে…..