গল্প:- সি অফ মারমেইড লেখনীতে:- যাবেদ খাঁন আবু বকর সপ্তদশ পর্ব

0
180

গল্প:- সি অফ মারমেইড
লেখনীতে:- যাবেদ খাঁন আবু বকর
সপ্তদশ পর্ব

বায়ান্ন.
রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে এলো। সূর্যি মামা আকাশে তার নজর মেলাতেই আলোক রশ্মি সোজা পতিত হলো সমুদ্র তলদেশে। সুরক্ষা কবচের উপর সূর্যের আলোক রশ্মি এসে উপস্থিত হতেই সমগ্র মারমেইড শহর পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণ আলোয় আলোকিত হয়ে গেল। আলো অলিন্দ দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করতেই আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে সজাগ হয় যুবরাজ রন ইওহার্ড। বুকে তার ভার ভার অনুভব হচ্ছে। ঘুমন্ত চোখে বুকের উপর তাকাতেই বুঝতে পারে কেউ একজন তার বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। কেউ একজন ব্যক্তিটি আর অন্য কেউ নয়। রাজকুমারী ডায়ানা! অসুস্থ শরীর নিয়েও রাতে রাজকুমারী ডায়ানার সাথে খুনসুটিতে মত্ত ছিল যুবরাজ রন ইওহার্ড। কখন যে ঘুমের বাহুডোরে হারিয়ে গেল! সে টের পাওয়া আর হয়ে উঠেনি। কোনোরকম নড়াচড়া না করে প্রথমে জড়িয়ে রাখা ডান হাতটি সরিয়ে দেয়। অতঃপর বুকের উপর থেকে রাজকুমারী ডায়ানার মাথাটা নামিয়ে যত্নের সহিত বালিশে রেখে যুবরাজ। রাজকুমারীর ঘুমে যাতে করে কোনোরকম ব্যাঘাত না ঘটে যার নিমিত্ত নিঃশব্দ করে শয্যা থেকে উঠে যায়। তার দেহে এখন আর তীব্র ব্যথার অনুভব হচ্ছে না। তাছাড়া দেহে থাকা ঘায়ের ক্ষত চিহ্নগুলো প্রায় মিশে গেছে। কেবল আকারে বড় চিহ্নগুলো এখন ফুটে আছে। তবে সেগুলোও প্রায় বিদায়ের পথে। নিঃশব্দ করে দ্রুত বিছানা ত্যাগ করে মেঝেতে দাঁড়িয়ে যায়। কক্ষের পাশে থাকা সাজঘরে প্রবেশ করে নিজেকে পরিপক্ব হিসেবে প্রস্তুত করে নেয়। সাজঘর থেকে বেরিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে যুবরাজ রন ডের। কক্ষের চার পাঁচিলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। কক্ষের একটি পাঁচিলে একটি ঘড়ি ঝুলতে দেখা যায়। ঘড়িতে সময়ের মাত্রা সকাল সাতটা বেজে তেত্রিশ মিনিট। মাঝে-মাঝে খুব হতবাক হয় যুবরাজ রনইওহার্ড। মৎস্য শহরে এতটা উন্নত কী করে সম্ভব! মানুষের তৈরি টেকনোলজি থেকে কোনোদিকেই পিছিয়ে নেই মৎস্য মানবের দল। অবশ্য মৎস্য মানব ও মানবীদের জীবন আর মানুষদের জীবন সমপরিমাণ বলা যায়। সেই একই রকম বিচারবুদ্ধির,রুচি ইত্যাদি। কেবল ভিন্নতা হলো, মৎস্যরা বসবাস করে পানিতে। আর মানুষেরা বসবাস করে স্থলে।

মেঝেতে দাঁড়িয়ে মায়াবী ঘোর লাগা দৃষ্টিতে রাজকুমারী ডায়ানার দিকে তাকায় যুবরাজ রন ইওহার্ড। বাচ্চাদের মতো মায়াভরা চেহারা ফুটিয়ে ঘুমিয়ে আছে রাজকুমারী ডায়ানা। এখনো ছোটো বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। মাথার চুলগুলো গালের মধ্যভাগ ঢেকে আছ প্রায়! নিঃশ্বাসের তালে গোলাপি বর্ণের নেশা ধরিয়ে দেওয়া ঠোঁট দুটো মৃদুভাবে কম্পন হচ্ছে। যা চেহারার মায়া ভাব আরও বৃদ্ধি করে দিচ্ছে তার। ঘোর লাগা নয়নে এক ধ্যানে চেয়ে আছে যুবরাজ তার প্রেয়সীরপানে। মাঝে-মাঝে এ ভেবে যুবরাজ হতভম্ব হয়, রাজা অরগাড এবং রানি নিয়ানো উভয়েই জানেন যুবরাজ রন ইওহার্ড এবং রাজকুমারী ডায়ানার মাঝে কিছু ভালোবাসার আদান-প্রদান আছে। কিন্তু বিষয়টিকে তারা তেমনভাবে দেখনই না ভাব। বিষয়টি নিয়ে এখনো নিজের মনের গহীনে ভাবতে লাগে যুবরাজ। ‘ কোনো বাবা-মা কি এগুলো সহ্য করতে পারে! অবশ্য মানুষদের মাঝে না পারলেও হয়তো মৎস্যদের মাঝে পারে। নয়তো অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে! কিন্তু কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?’ নিজের মনকেই নিজে প্রশ্ন করে যুবরাজ। কিন্তু উত্তর স্বরূপ তেমন কিছুই মিলে না। অযথা চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই তার মাথায় নতুন চিন্তা ঘুরতে লাগে। ঘোর ভেঙে ধীর পায়ে হেঁটে যায় রাজকুমারী ডায়ানার দিকে। রাজকুমারীর দেহের কাছাকাছি অবস্থানে যুবরাজ যেতেই এক নেশাময় ঘ্রাণের উপস্থিতি টের পায়। যা রাজকুমারীর দেহ থেকেই ছড়াচ্ছে। নেশাকে পাত্তা না দিয়ে রাজকুমারী ডায়ানার কপালে পরপর দুটো চুমু খায় যুবরাজ। ব্যগ্রতা দেখিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে কক্ষ ত্যাগের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগে। কক্ষের প্রবেশদ্বারের কাছে এসে দুটো টোকা দিতেই ওপাশ থেকে একজন মৎস্য মানব প্রহরী প্রবেশদ্বারের পাল্লা খুলে দেয়। কক্ষ থেকে বের হবার আগে পেছন দিকে আরেকবার ঘুরে তাকায় যুবরাজ। প্রবেশদ্বার থেকে তার শয়ন কক্ষের ভেতরটা অস্পষ্ট! অগত্যা আহত চেহারা নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটতে লাগে। রাজপ্রাদে তেমন কারওই উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। প্রাসাদের বারান্দা দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে একদম নিচ তলায় চলে আসে। মারমেইড শহরে যতদিন যাবত আছে,ততদিন যাবত সকাল সকাল হাঁটা হয় না তার। স্থলে মানুষের সাথে বসবাস কালে রোজ সকালে বিভিন্ন দেহচর্চা করা হতো। এছাড়া তার আয়ত্ত করা আছে জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় যুদ্ধের কলাকৌশল ক্যারাটে। তাছাড়া রন ইওহার্ডের সবচেয়ে বিশেষ এবং অবাককর বিষয় হচ্ছে, সে যেকোনো পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খুব সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে! উদাহরণ হিসেবে মৎস্য মানবদের সাথে তার বসবাস। কোনো হুলুস্থুল কাণ্ড অথবা বিচলিত কিংবা ভয়ভীতি তথা সংশয়তে দিন না কাটিয়ে তাদের সাথে মিশে গিয়ে নিজের চলাচলের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে নিচ্ছে।

প্রাসাদ থেকে বের হয়ে দৌড়াতে শুরু করে দেয়। প্রভাতের কিরণ কেবল তার ঝলমলে আলো পৃথিবীর বুকে ঢেলে দিচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ প্রান্তরে উপস্থিত হয়। তবে আসার পথে একটি বিষয় লক্ষ্য করে সে। অনুভব করে তার দৌড়ের গতি আগের চেয়ে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বিষয়টা দূরে রেখে মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে নেয়। সকাল সকাল কোনো অনর্থক বিষয় নিয়ে ভেবে সকাল সকাল নিজের মস্তিষ্ক বিগড়ে দিতে সে সম্পূর্ণ নারাজ। প্রান্তরের চিত্রে খানিকটা ভিন্নতা নজরে আসছে তার। যেন বেশ কিছু ভাঙচুর হয়েছে। প্রবেশদ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজন প্রহরী প্রশিক্ষণ প্রান্তরের নড়বড়ে হয়ে থাকা দ্বারটি খুলে দেয়। তা দেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকায়। কিন্তু এগুলোকেও তার অনর্থক ভাবনা মনে হচ্ছে। আর অনর্থক ভাবনা ভাবতে পূর্ব থেকেই নারাজ। তবে কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে প্রহরীর দিকে তাকায়। পূর্বদিনের প্রহরীদের কারওই উপস্থিতি নজরে আসছে না। তবে এটিকে চিন্তা জগতের পুঁজি না করে দ্রুত পায়ে হেঁটে প্রান্তের ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে প্রবেশ করতেই পানির সাথে নিজের গা ভাসিয়ে দেয়। নজরে আসে প্রান্তেরর পানির মধ্যস্থানে কেউ একজন ধ্যান করায় ব্যস্ত। একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে বুঝতে সক্ষম হয় ব্যক্তিটি আর কেউ কেউ নয়, উপদেষ্টা নিওরিয়ান!

পানিতে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত ধ্যান ভেঙে চোখ মেলে তাকান উপদেষ্টা নিওরিয়ান। পেছন ফিরে তাকাতেই আশ্চর্যের সর্বাত্মক সীমায় অতিক্রম করেন। নজরে আসে তার, পেছনে সম্পূর্ণ সুস্থ রূপে দাঁড়িয়ে আছে যুবরাজ রন ইওহার্ড। পূর্ব দিনের মতো আজ আর সে মাটিতে নেমে যায়নি। তার গা ভেসে আছে পানিতে। তার দেহ সে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। পানি দিয়ে দেহ ভাসতে ভাসতে উপদেষ্টা নিওরিয়ানের কাছে উপস্থিত হয়ে যুবরাজ। তাকে এখানে দেখে চমকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি। যেন বিষয়টি বিশ্বাসের অযোগ্য। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠস্বর ভাব ফুটিয়ে প্রশ্ন রাখলেন যুবরাজের কাছে।
‘ যুবরাজ! তুমি এ সময় এখানে! তাছাড়া তুমি তো এখন অসুস্থ! তবে এখানে কেন?’ কম্পিত কণ্ঠে প্রশ্ন রাখেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান।
প্রত্যুত্তরে ঝটপট জবাব দিল যুবরাজ,
‘ আমি মোটেও অসুস্থ নই। কাল দেহের উপর চাপ অধিক পড়ে গিয়েছিল। যার নিমিত্ত চৈতন্যহীন হয়ে যাই। আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। ‘ কিঞ্চিৎ কাঠিন্য ভাব কণ্ঠে ফুটিয়ে কথাটি ব্যক্ত করল।
‘ আচ্ছা বেশ তবে!’ বাকরুদ্ধ হয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলেন উপদেষ্টা নিওরিয়ান।
‘ উপদেষ্টা, আমার পরবর্তী করনীয় কী? তা নির্ধারণ করুন। আমি শিখতে চাই! শত্রুর আক্রমণ মোকাবেলা করতে নিজেকে গড়ে তোলার প্রয়োজনবোধ করছি। আমাকে প্রস্তুত করে দেন উপদেষ্টা। ‘ চমকপ্রদভাবে বাক্য উপস্থাপন করল যুবরাজ।
উপদেষ্টা নিওরিয়ান যুবরাজ রন ইওহার্ডের এরকম অদম্য ইচ্ছেশক্তি দেখে তিনি নিজেই আকুলিত হয়ে যান। কী দিয়ে যুবরাজকে অভ্যর্থনা দেবেন তা ভাবতেই অস্থির।

তেপ্পান্ন.
সন্ধ্যা হবার পূর্বে আচমকাই বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠে রিবন ইওহার্ডের। হঠাৎ এরকমভাবে বুকের অন্তরালে মোচড় দিয়ে ওঠার কারণ বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন না তিনি। কিছু সময় পর কিছুটা বুঝতে সক্ষম হলেন। দ্রুত ব্যক্তিগত অ্যসিস্ট্যান্টকে ডেকে বললেন,
‘ তানভীর, গাড়ি বের করো। দ্রুত।’ হন্তদন্ত হয়ে কথাটি বললেন। কণ্ঠে যন্ত্রণার ছোঁয়ার উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। ব্যক্তিগত অ্যসিস্ট্যান্ট তানভীর প্রথমে কিঞ্চিৎ হতভম্ব হলেও নিজেকে সামলে নেয়। তবে এ নিয়ে আর কোনো কথা বলেনি। আদেশ মান্য করতে দ্রুত চলে যায়। অফিস ইতোমধ্যেই ছুটি হয়ে গেছে। রিবন ইওহার্ড ও তানভীর এবং ম্যানেজার অফিসে আছেন। তাছাড়া যারা ওভারটাইম জব করেন কেবল তারা উপস্থিত রয়েছেন। রিবন ইওহার্ড বসে না থেকে সবাইকে উপেক্ষা বুকে হাত দিয়ে সোজা অফিস থেকে বেরিয়ে যান। পার্কিং প্লেস থেকে গাড়ি আগেই বের করে রেখেছিল তানভীর। রিবন ইওহার্ড অফিস থেকে বের হতেই তার ব্যক্তিগত চারজন দেহরক্ষী তার পিছুপিছু আসতে থাকে। কিন্তু রিবন ইওহার্ডের হাবভাব মোটেও তাদের ভালো ঠেকছে না। তাদেরকে কিছু না বলে অফিসের সামনে রাখা ল্যামবরগিনি গাড়িতে বসে যান। ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে তানভীর। পেছনের সিটে বসে বুকের উপর হাত চেপে রেখে কেবল মৃদুস্বরে বললেন রিবন ইওহার্ড, ‘ হসপিটালে চলো। ‘ কণ্ঠে লেগে আছে তীব্র ব্যথার করুণ সূর!

তানভীর আর কোনো কিছু শোনার প্রয়োজনবোধ করেনি। আপন মনে গাড়ি নিয়ে ছুটতে আরম্ভ করল। রিবন ইওহার্ড চোখ দুটি বন্ধ করে পেছনের সিটে হেলান দিয়ে বসে আছেন। তাদের গাড়ির পেছন পেছন কালো গাড়ি নিয়ে বন্দুক হাতে রেখে চলছেন দেহ রক্ষীগুলো। স্থানীয় বড় হসপিটালের কাছে এসে গাড়ি থামাল তানভীর। রিবন ইওহার্ডের দিকে তাকিয়ে দেখল তিনি চোখ বুজে আছেন। মৃদুস্বরে রিবন ইওহার্ডকে হাঁক দিল তানভীর। ‘ স্যার..! স্যার..! আমরা হসপিটালে চলে এসেছি। ‘ নরম কণ্ঠ কম্পিত গলায় কথাটি বলে। তার বেশ ভয় করছে রিবন ইওহার্ডের এরকম অবস্থা দেখে!
দ্রুত চোখ দুটো মেলে তাকান রিবন ইওহার্ড। গাড়ি থেকে বের হয়ে রিবন ইওহার্ডকে বের হবার জন্য দরজা খুলে দেয় তানভীর। দরজা দিয়ে বের হতেই তাদের কাছে এসে উপস্থিত হয় দেহরক্ষীগুলো। দাঁড়িয়ে থাকতে প্রচুর কষ্ট হচ্ছে রিবন ইওহার্ডের। তানভীর গাড়ির দরজা বন্ধ করে রিবন ইওহার্ডের কাছে এসে দাঁড়ায়। আচমকাই ব্যথার তীব্রতা দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে যেতে নেন তিনি। দ্রুত আকড়ে ধরে তানভীর। দেহ রক্ষীরাও এগিয়ে আসে। তবে তার আগেই পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে নেয় সে। পাজাকোলে তুলে নিয়ে দ্রুত হসপিটালের দিকে দ্রুত হাঁটতে তানভীর। তার পিছুপিছু দৌড়ে আসছে দেহরক্ষীগুলো। তানভীর হাঁটা যেন হাঁটা নয়। প্রায় দৌড়ে এগিয়ে চলছে সামনর দিকে। রিবন ইওহার্ড এখনো চৈতন্যহীন হয়ে যায়নি। তবে দেহের কোনো কিছুই তার নিয়ন্ত্রণে নেই!

রিবন ইওহার্ডকে নিয়ে তানভীর হসপিটালে ঢুকতেই ড. আরভিদ নিয়াল দৌড়ে ছুটে আসেন। ইশারায় তাকে ফলো করতে বলেন। তানভীর তাকে ফলো করে হাঁটতে শুরু করে দেয়। দেহরক্ষীগুলোও তাদের পেছনে দৌড়াতে শুরু করেছে। প্রাইভেট কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয় রিবন ইওহার্ডকে। কেবিনে থাকা বেডে রিবন ইওহার্ডকে দ্রুত শুইয়ে দেয় তানভীর। ড. আরভিদ দ্রুত একটি প্রেসক্রিপশনে কয়েকটি ঔষধের নাম লিখে একজন নার্স ডেকে তার কাছে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত ঔষধগুলো নিয়ে আসার আদেশ দেন। রিবন ইওহার্ডের চোখ দুটো ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। কেবল তার নিঃশ্বাস কার্য চালু রয়েছে। তাছাড়া দেহের কোনো অঙ্গ তার নিয়ন্ত্রণে নেই। কয়েক মিনিটের মাঝে প্রেসক্রিপশন নিয়ে যাওয়া নার্সটি একটা ব্যাগে করে কতগুলো ঔষধগুলো নিয়ে হাজির হয়। ড. আরভিদ নিয়াল একটি ইঞ্জেকশনে হাতে নিয়ে সিরিঞ্জ পূর্ণ করে নেন। এবং দ্রুত ইঞ্জেকশনটি রিবন ইওহার্ডের হাতে পুশ করে দেন। ধীরে ধীরে পুরোপুরি নিস্তব্ধ হয়ে আসে রিবনের দেহ। তা দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়েন ড. আরভিদ নিয়াল।

চুয়ান্ন.
পানির তলদেশে দাঁড়িয়ে আছে রন ইওহার্ড। তার থেলে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে দৈত্যাকার আকৃতির নিচের অর্ধেক মাছের লেজের মতো এবং পেটের উপরের বাকি অর্ধেক মানব আকৃতির। মৎস্য মানবটি হঠাৎ করেই রন ইওহার্ডের দিকে তেড়ে আসতে লাগে আঘাত করার লক্ষ্যে। তীব্র বেগে পানি বুক চিঁড়ে এগিয়ে এসে মৎস্য মানবটি তার লেজ আকৃতির পা দ্বারা রন ইওহার্ডের বুকে আঘাত করে। ‘ ভাইয়া’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে সে। ছিটকে কয়েক মিটার দূরে উড়ে গিয়ে পড়ে। রন ইওহার্ডের মুখে ভাইয়া বলে চিৎকার শোনার সাথে সাথে কেবিনের বেডে শুয়ে থাকা রিবন ইওহার্ডের কান দুটো নড়ে উঠলো। একটি ঝাঁকুনি দিয়ে শোয়া থেকে সাথে সাথে উঠে বসে যান তিনি। তার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক অবস্থা থেকে অনেক বেশি দ্রুত চলছে। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি চলছে। পালস রেট হয়তো ১৫০-এর অধিক হবে।

তাকে এরকমভাবে শোয়া থেকে উঠে বসতে দেখে ছুটে আসে একজন নার্স। গলার স্বর উঁচু করে ড. আরভিদকে ডাকতে থাকে। ড. আরভিদ নিয়াল নার্সের ডাক শুনে হন্তদন্ত হয়ে প্রাইভেট কেবিনের দিকে ছুটে আসেন। তাদের এরকন হন্তদন্ত হতে দেখে দুই হাতের ইশারায় সবাইকে শান্ত থাকতে বলেন রিবন ইওহার্ড। কিছু সময় অতিবাহিত হতে ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাস কার্য স্বাভাবিক পর্যায় নেমে আসে তার। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক করা গর্জনের শব্দ এখন আর শোনা যাচ্ছে না। ড. আরভিদ নিয়াল কিছু বলতে চাইলে হাতের ইশারায় থামিয়ে দেন তিনি। অ্যাসিস্ট্যান্ট তানভীরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘ আমি গাড়িতে আছি। তাদের বিল দিয়ে দ্রুত আসো। ‘ এতটুকু বলে হাতে লাগিয়ে রাখা স্যালাইনের ক্যান্ডেল একটা টান দিয়ে খুলে ফেললেন। পাশে থাকা বক্স থেকে অল্প একটু তুলো নিয়ে স্যালাইন লাগিয়ে রাখা স্থানে চেপে ধরে দ্রুত বেড থেকে নেমে যান। হাতের ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে কেবিনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন। রাত তেমন একটা হয়নি। সবেমাত্র ৯টা বেজে ৩৯ মিনিট। দেহরক্ষীগুলোও রিবন ইওহার্ডের পিছুপিছু হেঁটে আসতে থাকে। হসপিটাল থেকে বাহিরে বেরিয়ে পার্কিং প্লেসে পার্ক করে রাখা গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। একজন দেহরক্ষী তার আগে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। চারদিকে না দেখে সোজা ল্যাম্বরগিনি গাড়ির ভেতরে অনুপ্রবেশ করেন তিনি।

পঞ্চান্ন.
‘ মহাজার, আপনার কি সত্যি মনে হয় এরকম কাণ্ড যুবরাজ রন ইওহার্ডের দ্বারাই সম্ভব? সবে মাত্র একদিন হলো প্রশিক্ষণ প্রান্তরে গিয়েছে। আর তাতেই এত দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম! ব্যাপারটা নড়বড়ে লাগছে না?’ রাজা অরগাডের কাছে সন্দের ভাবনা দৃষ্টিতে প্রশ্ন রাখলেন রানি নিয়ানো।
‘এখানে নড়বড়ের মতো কোনো বিষয়বস্তু আমি খুঁজে পাচ্ছি না। যুবরাজ রন ইওহার্ড কোনো সাধারণ মৎস্য মানবের সন্তান নন। বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করো। ‘ একটু জোর দিয়ে কথাগুলো উপস্থাপন করলেন রাজা অরগাড। তবে রানি নিয়ানোর এরকম কথাবার্তা ভীষণ বিরক্ত তিনি।
‘ হ্যাঁ মানলাম। তাই বলে একদিনে! একদিনে তো পানির নিচে নিশ্বাস নেওয়ার শিখে উঠতে পারে না।’ পুনরায় সন্দেহসূচক দৃষ্টিতে রাজা অরগাডের কাছে বিষয়টি উত্থান করলেন। তার সন্দেহ কোনোভাবেই কমাতে পারছেন না।
‘ একদিনে যুবরাজ রন ইওহার্ড নিশ্বাস নেওয়া নয়। সে বহু আগে থেকেই পানিতে নিশ্বাস নিতে সক্ষম ছিল। আর এখনো সক্ষম। সমুদ্র দেবতার দূত বলা যায় যুবরাজকে। যুবরাজের রক্তে বইছে আদি রাজাদের রাজত্ব। ‘ ধারালো কণ্ঠস্বর ফুটিয়ে কথাগুলো বলে থামলেন। খানিক সময় বাদে পুনরায় বলতে লাগলেন, ‘ এখন এগুলো ভাবা বন্ধ করে বিছানা থেকে উঠো। ভোর হয়ে গেছে। রাজসভায় যাবার প্রস্তুতি নাও। আর দেখে আসো তোমার আদরের কন্যা কোথায়। ‘ জানতে চেয়ে প্রশ্ন রাখলেন রাজা অরগাড। তবে এ প্রশ্নের মাঝে আকুলতার উপদ্রব নেই।
‘ কোথায় আর হবে? রাতে তো যুবরাজের কক্ষেই ছিল। এখনো হয়তো সেখানেই আছে। ‘ কথাটি তেমন আমলে না নিয়ে বললেন রানি নিয়ানো। বিছানা থেকে উঠে সাজঘরে যেতে যেতে বললেন রাজা অরগাড,
‘ আচ্ছা, তবে তুমি প্রস্তুত হয়ে যুবরাজের কক্ষে যাও। আমি প্রস্তুতি নিয়ে রাজসভায় যাচ্ছি। রাজকুমারীকে নিয়ে একেবারে সেখানেই চলে এসো। ‘ এই বলে সাজঘরের ভেতরে প্রবেশ করেন। নিজেকে প্রস্তুত করে বেরিয়ে আসেন। পোশাক পরিধান করে দ্রুত পায়ে হেঁটে কক্ষ থেকে প্রস্থান করলেন। প্রবেশদ্বারের কাছে গিয়ে টোকা দিতেই প্রবেশদ্বারের পাল্লা খুলে দেয় প্রহরী।

রানি নিয়ানো রাজা অরগাডের কথার সম্মতিতে মাথা উপর নিচ করলেন কেবল। এ যাবত সময় বিছানাতেই বসে ছিলেন তিনি। রাজা অরগাড চলে যেতেই শয্যা ত্যাগ করে দ্রুত সাজঘরে ঢুকে নিজেকে রাজসভায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করে নেন। অতঃপর নিজেকে প্রস্তুত করে দ্রুত সাজঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। হাঁটতে হাঁটতে কক্ষের প্রবেশদ্বারের কাছে এসে দাঁড়ান। পূর্বের নিয়ম অনুযায়ী দুটো টোকা দিতেই ওপাশ থেকে প্রবেশদ্বারের পাল্লা খুলে দেয় প্রহরী। দ্রুত পায়ে হেঁটে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান রানি নিয়ানো। প্রাসাদের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যুবরাজ রন ইওহার্ডের কক্ষের কাছে এসে দাঁড়ান। রানি নিয়ানো সেখাননে উপস্থিত হতেই প্রহরীরা দ্রুত প্রবেশদ্বার খুলে দেয়। ধীর পায়ে হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করেন রানি নিয়ানো। কক্ষের ভেতরে একটি ছোট্ট বারান্দা পেরিয়ে যেতেই আরেকটি বড় কক্ষের ভেতরে উপস্থিত হন। কক্ষের ডান দিক থেকে আরেকটি কক্ষ দেখা যাচ্ছে। যদিও কক্ষে প্রবেশদ্বার নেই। এই কক্ষ থেকেই দেখা যাচ্ছে রাজকুমারী ডায়ানা যুবরাজ রন ইওহার্ডের বিছানায় নিষ্পাপ শিশুর মতো ঘুমিয়ে আছে। রানি নিয়ানো দ্রুত কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করেন। কক্ষে প্রবেশ করে বিছানায় শুধু রাজকুমারী ডায়ানাকেই দেখতে পান তিনি। বিছানায় যুবরাজকে না দেখে সাজঘরের দিকে তাকান। সাজঘরের প্রবেশদ্বারও খোলা। তাৎক্ষণিক সময়ে মনের কোনে খটকা লাগে তার। দ্রুত রাজকুমারীকে ঘুম থেকে জাগ্রত করেন। জোর করে ঘুম থেকে তুলে প্রশ্ন করেন, ‘ যুবরাজ কোথায়? তোমার সাথেই না ছিল! তবে এখন কোথায়?’
প্রত্যুত্তরে বিরক্ত হয়ে জবাব দেয় রাজকুমারী, ‘ আমি কী করে জানব? মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম আমি। আর হয়তো এদিকে কোথাও আছে। ‘ ঘুম ঘুম ভাব কণ্ঠে ফুটিয়ে কথাটি বলে উঠল রাজকুমারী ডায়ানা।

রাজকুমারীর প্রত্যুত্তর একদম পছন্দ হয়নি যে তা রানি নিয়ানোর মুখ দেখলেই বুঝা যায়। তিনি আর কিছু না বলে দ্রুত পায়ে হেঁটে কক্ষের প্রবেশদ্বারের কাছে উপস্থিত হন। ডান হাত উঁচু করে পরপর দুটি টোকা দেন। ওপাশ থেকে প্রহরী দ্বার খুলতেই তার কাছে প্রশ্ন রাখেন রানি নিয়ানো, ‘ যুবরাজ রন ইওহার্ড কি কোথাও গেছে? তোমরা দেখেছ?’ কণ্ঠে সন্দেহা ভাব ফুটিয়ে প্রশ্নটি করলেন তিনি।
প্রহরী স্বাভাবিক স্বরে প্রত্যুত্তরে বলে উঠল,
‘ হ্যাঁ, তিনি তো ভোর বেলায়ই কক্ষের প্রবেশদ্বার খুলতে বেরিয়ে গেলেন। এরপর আর এখনো ফিরে আসেননি। ‘ স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রশ্নের জবাব দিলেও রানি নিয়ানোর এরকম প্রশ্ন চোখমুখে কেমন ভিন্নতার ছাপ রয়েছে।
‘ এখনো আসেনি মানে? আর সে কোথায় যাবে? অসুস্থ শরীর। তা নিয়ে কোথাও যাওয়ার কথা নয়। তবে নিশ্চিয়ই সে মারমেইড শহর ছেড়ে পালিয়েছে। দ্রুত রাজসভায় গিয়ে মহারাজকে খবর দাও, যুবরাজ পালিয়েছে। ‘ হন্তদন্ত হয়ে কথাগুলো বললেন রানি নিয়ানো। তবে চেহারায় তার রহস্যময় ভাব ফুটন্ত।

রানি নিয়ানোর এরকম আচরণ দেখে বিছানা ত্যাগ করে উঠে আসে রাজকুমারী ডায়ান। এসে যখন রানির কাছ থেকে শুনে যুবরাজ রন ইওহার্ড পালিয়েছে, তাৎক্ষণিক সময়ে ভড়কে যায়। কী হচ্ছে এসব? প্রহরী সেখানে কোনোরকম অবিলম্ব করে রাজসভার দিকে রওনা হয়। কিছু সময়ের মাঝে রাজসভার প্রবেশদ্বার পার করে ভেতরে উপস্থিত হয়। তার উপস্থিতি দেখে রাজা খানিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। কিন্তু প্রহরীটি সেসব বিষয় পাত্তা না দিয়ে রাজা অরগাডের সামনে উপস্থিত হয়ে কুর্নিশ জানায়। মধ্যম আওয়াজ সৃষ্টি করে বলতে লাগে, ‘ মহারাজ, যুবরাজ পালিয়েছেন। রাজ্যের কোথাও নেই। ‘ কম্পিত গলায় উপস্থাপন করল কথাটি।
যুবরাজ পালিয়েছে শুনতেই রাজসভায় থমথমে পরিবেশ বিরাজমান। নীরবতার রাজ্যে কোলাহল সৃষ্টি করে কঠিন স্বরে বলতে লাগেন রাজা অরগাড,
‘ তোমার জানা আছে তুমি কী বলতেছ? তুমি নিশ্চিত তো?’ রাগী ভাব নিয়ে প্রশ্ন করলেন। তার প্রশ্নের জবাবে ঝটপট প্রত্যুত্তর করল প্রহরী,
‘ জি মহারাজ। রানি নিয়ানো আমাকে আপনার কাছে খবর পাঠানোর জন্য বলেছেন!’ স্বরের ভঙ্গিমা স্বাভাবিক রেখে জবাব প্রদান করে। রানি নিয়ানো পাঠিয়েছে শুনতেই ভরা রাজসভায় গুঞ্জনে ভরে উঠল। একে অপরের সাথে আলাপনে মশগুল। সবার আলোচনার বিষয় বস্তু যুবরাজ রন ইওহার্ড পলাতক। রাজা অরগাডের মাথায় হাত উঠে গেল! তিনি যেন কোনোভাবেই বিশ্বাস কর‍তে পারছেন না!

[– চলবে –]

• রিবন ইওহার্ডের কী হয়েছিল?
• রানি নিয়ানোর এরকম খবর ছড়ানোর কোনো কারণ কি আছে?
• রন ইওহার্ডের পলাতক খবর কি বড় কোনো বিষয় ইঙ্গিত প্রদান করে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here