#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
#Writer_Mousumi_Akter
#পর্ব_১৮
কাকডাকা ভোর।শরীর ঠান্ডায় হিম হয়ে আসছে।জড়সড় হয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করছি।শীতল হাওয়াতে শরীরের প্রতিটা লোমকূপ জেগে উঠছে।হঠাৎ গায়ে আরামদায়ক কিছু অনুভূত হলো।ঘুমে বিভোর থাকা অবস্থায় শরীরে উষ্ণ কিছু অনুভব করলাম।হঠাৎ পাতলা চাদরের আবরণে ঢেকে গেলো সারা শরীর।আরামদায়ক পরিবেশে চাদর টা ভালো ভাবে গায়ে টেনে নিয়ে পাশে থাকা কোলবালিশটা ভালো ভাবে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলাম।ঘুমে অচেতন আমি।কানে ঝুম ঝুম শব্দ ভেসে আসছে।কর্ণকুহরে শ্রুতিমধুর লাগছে।ঠান্ডার প্রবণতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে,সেই সাথে পাল্লা দিয়ে উষ্ণতাও বেড়ে চলেছে। ঘুমন্ত অবস্থায় নিজের ভেতরে কেমন অদ্ভুত এক ভাল লাগা কাজ করছে। মাতাল করা এক অনুভূতি। কিসের অনুভূতি বুঝতে পারছিনা।তবে আমাকে নেশার মত টানছে।নিজের শরীরের অনুভূতির অদ্ভুত এক পরিবর্তন বুঝতে পারছি।পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এক ভাললাগার অনুভূতি। ওষ্টেদ্বয়েও উষ্ণতা অনুভব হচ্ছে।ধীরে ধীরে আমার ইন্দ্রীয় শক্তি জাগ্রত হচ্ছে।সমস্ত ইন্দ্রীয় ঘুমের দেশ থেকে সজাগ হচ্ছে।আমি বুঝতে পারছি,কারোর আড়ষ্ট হাতের বাঁধনে আমি আবদ্ধ,কারো উষ্ণতায় মাতোয়ারা।কারো ঘন, গাড়, উষ্ণ নিঃশ্বাস উপচে পড়ছে আমার মুখের উপরে। কারোর ওষ্ট মিলিত হয়েছে আমার ওষ্টে।আস্তে করে চোখ জোড়া খুললাম।কোলবালিশ ভেবে জড়িয়ে থাকা মানুষটা ওশান স্যার।আমার মত করেই উনিও আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন খুব শক্তকরে।দু’জনের ওষ্টদ্বয় একত্রিত।উনি ঘুমে বিভোর,কিন্তু উনার অনুভূতি জাগ্রত। আমি খেয়াল করছি উনি নেশাক্ত এক অনুভবে আমাকে টানছেন উনার দিকে।উনিও কি আমার মতোই কোলবালিশ ভেবে এমন করছেন!দু’জনের শরীরে একটা কাঁথা।ইশ!কী লজ্জা!ভয়ানক কিছু ঘটে যায়নি তো আবার?।যে অবস্থায় আছি,এর থেকে ভয়ানক কিছু আর হতেই পারেনা।লজ্জায় ভয়ংকর এক অবস্থা আমার। উনার সাথে আর ঝ*গ*ড়া করব কিভাবে?আজ যা ঘটল।উনি আমার কাছে এলেন কখন?উনার শক্তপোক্ত বাঁধন থেকে তো ছোটার ও উপায় নেই।যেনো শক্ত এক শিকলে বাঁধা আমি।কখন মিলিত হয়েছি দু’জন!উনি তো এতটা বেখেয়ালি নন।ঘুমোলে তো একচুল ও নড়েন না।তাহলে আজ কিভাবে আমার কাছাকাছি এলেন!আর আমার ই বা এত ভাল লাগছে কেনো?মনে হচ্ছে ভুল করে কাছে এসে বুঝি জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখ পেলাম।উনার স্পর্শে এত ভাললাগা,এত নেশা,এত তৃষ্ণা। যেনো আমার দীর্ঘদিনের পিপাসিত হৃদয় শীতল হলো।একটা রাগী,গম্ভীর মানুষের শরীরের গন্ধ ও এত দারুণ হয়!এত ভাললাগা, এত অনুভূতির মিশ্রণ থাকে।চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম উনার বুকে।এই ভাললাগাময় মুহুর্তটুকু শেষ না হোক।বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে,বিরতিহীন বৃষ্টি। বৃষ্টির জন্যই বুঝি ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছিল?উনি তো আরামে ঘুমোচ্ছেন। আমি আর কতক্ষণ এভাবে থাকব!জানালার একটা পাল্লা খুলে গিয়েছে,বৃষ্টির ছিটা এসে ভিজে যাচ্ছে ঘর।খয়েরী কালারের পর্দাটা উড়ছে।জানালার সোজা ল্যাপটপ টেবিলে ল্যাপটপ রাখা।বৃষ্টির পানি এসে সেটা ভিজে যাচ্ছে।আজ আবার ফরম ফিল-আপ করতে হবে সেকেন্ড ইয়ারের।নয়টার মধ্য ব্যাংকে পৌছাতে হবে।কলেজে অনেক কাজ আছে।আজ লাস্ট ডেইট ফরম ফিল-আপ এর।ছোঁয়া গতকাল কুমিল্লা থেকে ফিরেছে।ওয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সকাল সাড়ে সাতটা বাজে।ইশ!তরীর একার পক্ষে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে নিশ্চয়ই। উনাকে ঠেলে সরিয়ে ওঠার চেষ্টা করলাম।আমার কিছুক্ষণ নড়াচড়ার পর উনি চোখ মেললেন।এভাবে আমাকে উনার সাথে মিশে থাকতে দেখে চট জলদী উঠে বসে বললেন, ‘উফস! তুমি?’
উনার চোখে মুখে সে কী লজ্জা!লজ্জায় আমি নিজেই মিইয়ে যাচ্ছি।লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে আমি বিছানা ত্যাগ করে ওড়না খোঁজাখুঁজি করে দেখলাম ফ্লোরে পড়ে আছে ওড়না টা।ফ্লোর থেকে ওড়না তুলে গায়ে দিয়ে উনার ল্যাপটপ টা জানালার সাইড থেকে সরিয়ে এনে বললাম,
‘ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো আমার দিকে?আমি ঘুমোলে আপনি তার ফায়দা নেন তাইনা?’
উনি কেমন চিন্তিত সাথে লজ্জিত মনে হচ্ছে।সামনের চুলে হাত দিয়ে চিরুনি করতে করতে বললেন,
আমি কেনো ফায়দা নিতে যাবো?নিশ্চয়ই তুমি এসেছিলে আমার কাছে?
‘আমি একটুও যায়নি,আপনি এসছিলেন।আপনাকে আমি ওড়না খুলতে দেখছিলাম।বাট আমার মনে হলো আমি ওটা স্বপ্ন দেখছিলাম।’
‘ওটা স্বপ্ন নয়, সত্য।গলায় ওড়না পেঁচিয়ে পটল তুলে ফেলতে তাই সরিয়ে দিয়েছিলাম।’
‘এখন এসব অজুহাত দিচ্ছেন!আমার গায়ে কাঁথা আসল কিভাবে?’
‘শীতে হিম হয়ে যাচ্ছিলে।তাই দেখে হেল্প করছিলাম।এটাও আমার দোষ?
‘তাহলে আপনার কাছাকাছি গেলাম কিভাবে?’
‘আমি জানি সেটা।নিজেই এসছো।তুমি কিভাবে ঘুমোও একদিন ভিডিও করি তাহলে বুঝবে।রাতে কতবার এসে আমাকে হামলা করো।বার বার কোল বালিশ ছেড়ে আমাকে এসে ;থাক আর বললাম না।’
‘মোটেও আমি আপনার কাছে যায় না! আমি ঘুমিয়ে গেলে আপনি রেগুলার ওইসব করেন তাহলে।’
‘হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ওইসব?
‘আপনি প্রাপ্তববয়স্ক, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।’
‘তুমিও প্রাপ্তবয়স্ক। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ ওইসব করলে এতদিন বেবির আম্মু হয়ে যেতে।’
‘ছিঃ!কি লজ্জা!আপনার কি একটুও লজ্জা নেই?
‘তুমি কি লজ্জা রাখতে দাও আমার?আর হ্যাঁ! বিয়ে করা বউ আমার।ফায়দা নেওয়ার কী আছে?হক আছে আমার।আর আজ যা সর্বনাশ করলে আমি শেষ।নারী এভাবেই পুরুষের সর্বনাশ করে।’
বলেই উনি শাওয়ারে ঢুকলেন।আল্লাহ রোশান স্যার দিন দিন এমন বেহায়া হয়ে যাচ্ছেন কেনো?মুখে কি কিছু আটকাচ্ছে না উনার!
চুল ঠিক করে বাইরে বের হলাম।তরী চা করে ডায়নিং-এ দিয়েছে।আগুনগরম চা ধোঁয়া উড়ছে।খেয়াল করলাম তরীর মুখটা ভারী হয়ে আছে।ডায়নিং এ বসে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি,ওশান,আর দাদু চা খাচ্ছেন।তরী কোনো কথা বলছে না,কিন্তু কেনো?কী হয়েছে ওর!ওশান কে বেশ পরিপাটি লাগছে দেখতে।জিন্স,গেঞ্জি পরে রেডি;যেনো বাইরে যাবে।আমাকে দেখে শাশুড়ি বললেন, কী ব্যাপার তরী সং এর মত দাঁড়িয়ে আছো কেনো?সারাহ মা কে চা দাও।’
ওশান আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে।আমিও ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে ওশানের দিকে তাকালাম।একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললাম, ‘নাহ! আমি চা খাবো না এখন।তরীর কি মন খারাপ আম্মা?ও এমন চুপচাপ কেনো?’
‘ও তো অলক্ষী।মুখ ওইরকম প্যাঁচার মতো করে রেখে সংসার টাই শেষ করে ফেলল।’
‘মুখ ওরকম রাখে কেনো আম্মা?’
দাদু বললেন, ‘ওর মনে কত সুখ যে তাই হাসবে?’
আম্মা বললেন, ‘আহা!বাবা।আপনি এত প্রশ্রয় দিবেন না।আপনার জন্যই মাথায় চড়েছে ও।’
আমি বুঝতে পারলাম না ব্যাপার টা আসলে কী ঘটেছে।আম্মার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘তরী কী করেছে আম্মা?
‘আরে মা কাল যে তুমি শাড়ি টা গোসল করে খুলে রেখেছিলে ও সেটা ধুয় দেয়নি।আমার শাড়ি ও পড়ে আছে।তোমার বাবার লুঙ্গী,ওশানের লুঙ্গী সব পড়ে আছে।এত ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলে কাপড়ের রং থাকে?ওর নাকি মনে নেই।নবাবজাদির মেয়ের নাকি মনে নেই।পাখনা গজিয়েছে নাকি!খাওয়া টা কোন জায়গা থেকে আসে!বাপের বাড়ি থেকে তো চারআনার সুতো ও আনার ক্ষমতা নেই।ঘুম থেকে উঠে সবার ভেজা কাপড় দেখে আমার মাথা ঠিক নেই।কাল আমার বিছানা ও ঝেড়ে দেয়নি।এ বাড়ি থেকে আর কতবার দূর করব।মাগনা খাওয়া আছে কোথায় আর যাবে!এই আপদ দূর হলে আমার ছেলে ও বাঁচত আমিও বাঁচতাম।’
ওশান বলে উঠল, ‘কত মানুষ গলায় দ* ড়ি দেয়, ও কি দড়ি ও চোখে দেখেনা?আম্মা ও আমার চোখের সামনে আসলেই আমার বিরক্ত লাগে!
ওশানের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তরীর গায়ে হাত তুলেছো তুমি?’
দাদু বললেন, ‘একি নতুন।দেখো তো হাত টা মুচড়ে কেমন ভেঙে ফেলেছে।’
র*ক্তকণিকা জ্বলে উঠল আমার।তরীর হাতের দিকে তাকালাম আমি।হাত টা কেমন ফুলে উঠেছে।কষ্ট পাচ্ছে কিন্তু শেয়ার করার মানুষ নেই।আমার ভেতর টা হুহু করে উঠল যন্ত্রণায়।
শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনাদের সবার কাপড় খুলে রেখেছিলেন কেনো?না ধুয়ে ফেলে রেখেছিলেন কেনো?’ তৎক্ষনাৎ আমার শাশুড়ি বল উঠলেন,
‘বাড়ির পুরুষ মানুষ কি পরনের কাপড় ধুতে পারে ?আর ছেলের বিয়ের পর শাশুড়ি কেনো কাপড় ধুবে?
‘ধুতে পারেনা মানে!তাহলে আপনার বড় ছেলে আমার কাপড় কিভাবে ধুয়ে দিলো?
‘কী বললে!আমার রোশান তোমার কাপড় ধুয়েছে।’
‘হ্যাঁ ধুয়েছে।আপনার কাপড় এখন থেকে আমি ধুয়ে দিবো আম্মা।আর ওশান আমার দেবর, ওর টাও আমি ধুয়ে দিবো।মানে সবার টা ই আমি ধুয়ে দেবো।তরী তো এতদিন ধুয়েছে। ও যেহেতু করতে চায়ছে না আমি করব।’
ওশান চোখ বড় বড় করে তাকাল আমার দিকে।টেবিলের বাকিরাও অবাক হলো।শাশুড়ির ঘোর আপত্তি সে আমাকে এসব করতে দিবেন না।দাদু মুচকি হাসছেন আর বিড়বিড় করে বললেন,
‘ধামাকা হবে বোঝায় যাচ্ছে।’
মৃন্ময় এর নাম্বার থেকে ফোন ক্রমাগত আসছে ।আমি আড়ালে গিয়ে ফোন রিসিভ করে বললাম, কী হয়েছে এত ফোন দিস কেনো?জানিস না জামাই আছে আমার।আগের মত ফ্রি থাকিনা।’
‘সারাহ!সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে।’
‘কী হয়েছে?’
‘তন্ময় সু ই সা ইড করেছে?আমি হসপিটাল আছি।অবস্থা ভালো না।ঘুমের ওষুধ খাইছে অনেক গুলো।’
‘ক্যান?কী হইছে ওর?
‘ছোঁয়ার জন্য।তুই তো জানিস তন্ময় ছোঁয়াকে কত ভালবাসে।’
‘জানি!বাট সু*ই*সা*ই*ড এর কারণ।?
‘কাল ছোঁয়া কুমিল্লা থেকে ফিরলে তন্ময় ছোঁয়ার বাসার নিচে গিয়েছিলো।ছোঁয়ার জন্য এক গুচ্ছ লাল গোলাপ,একটা পান্ডা, একটা থ্রিপিছ নিয়ে গেছিল।তন্ময় টিউশনির টাকা জমিয়ে ওগুলো কিনেছিল।কিন্তু ছোঁয়া তন্ময়কে বকেছে।আর গিফট গুলা তো নেয়নি সাথে অনেক গালি গালাজ করেছে।বলেছে তন্ময় বন্ধু নামের কলঙ্ক।বন্ধু হয়ে কিসের প্রেম ভালবাসা।বন্ধুত্ত্বের মাঝে এসব কী?সে তন্ময় এর সাথে ফ্রেন্ডশীপ ব্রেক করেছে।সাথে বলে দিয়েছে ওশান ছাড়া তার জীবনে কেউ জায়গা পাবেনা।আরো অনেক কথা।তন্ময় সহ্য করতে পারেনি।বিগত চারটা বছর তন্ময় ছোঁয়াকে বোঝাচ্ছে কিন্তু ছোঁয়া লক্ষবার রিজেক্ট করে দিলো।ছোঁয়া বেশী রেগে গিয়েছে তন্ময় বলেছে সে গরীব বলেই ছোঁয়া তাকে চায়না।কাহিনীর শেষ নেই।তুই আয়।এসে বাকিটা শুনিস।’
‘বাঁচবে তো?
‘বলা যাচ্ছেনা।তন্ময় এর মতো ফর্সা,ভালো হাইট,ভাল স্টুডেন্ট রেখে কিভাবে যে ছোঁয়া ওশানের জন্য পা* গ* ল!কত মেয়ে তন্ময় কে প্রপোজ করল অথচ তন্ময় ছোঁয়ার জন্য পা* গ* ল।
আমি দ্রুত চেঞ্জ করে রোশান স্যারকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলাম সিটি হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
চলবে?
🍁পরবর্তী পাট পড়তে পেজটি Follow করুন অবসর সময়ে