গল্প:- সি অফ মারমেইড
লেখনীতে:- যাবেদ খাঁন আবু বকর
অষ্টাদশ পর্ব
ছাপ্পান্ন.
হইহই রইরই গুঞ্জন শুরু হয়ে যায় রাজসভায়। আলোচনা কেবল একটাই, মারমেইড শহর থেকে যুবরাজ রন ইওহার্ডের পলাতকের গুঞ্জনে আচ্ছাদিত। রাজা অরগাড মাথায় হাত দিয়ে সিংহাসনে বসে আছেন। তিনি কী শুনছেন! কোনোভাবেই তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন। তার জানামতে এরকমটা হবার কথা কোনোকালেই ছিল না! গুঞ্জন শেষ হতেই রাজসভায় গুমট পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সবার মনেই একটাই প্রশ্ন, ‘ যুবরাজ রন ইওহার্ড পালিয়ে কোথায় গেছে? এবং কেন পালিয়েছে?’ কিন্তু তাদের এই সকল প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য রন ইওহার্ড অনুপস্থিত। রাজসভায় থমথমে পরিবেশ বিরাজমান। যেন নীরবতা রাজ্যশাসন করছে! কিন্তু এই নীরবতাকে স্থায়িত্ব না দিয়ে তাদের সকল রাজশাসনে ব্যগ্র দিয়ে বিদায় জানালেন রাজা অরগাড।
‘ উপ সেনাপতি হিতাম! দ্রুত যুবরাজ রন ইওহার্ডের খোঁজে বেরিয়ে যাও। রাজ্যের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দাও সৈন্যদের। সাথে রাজ্যের বাহিরে সমুদ্রের মাঝে খোঁজ চালাও। যে কোনো পরিস্থিতিতে তাকে আমার চাই। সৈন্যদের মাঝ থেকে অর্ধেক সৈন্য যুবরাজকে খোঁজার কাজে লাগিয়ে দাও। ‘ এক দমে রাগান্বিত কণ্ঠস্বর ফুটিয়ে কথাগুলো উপস্থাপন করলেন তিনি। রাজা অরগাডের এতটা রাগ দেখে রাজসভার মনে ভয় আঁকড়ে ধরে আছে। তাকে রাজ্যের কেউ এখনো এতটা রাগতে দেখেনি। সভাসদরা ভেবে পায় না, ‘ রন ইওহার্ডের মাঝে এমন কী আছে? যার জন্য রাজা অরগাড এত পাগল!’ কিন্তু কেউ সাহস দেখিয়ে একটু টু শব্দ পর্যন্ত করল না। রাজসভায় পুনরায় নীরবতা বিনা যুদ্ধেই দখল করে নিল। তবে এই দখলদারত্বের সময় বেশি সময়ের স্থায়িত্ব হলো না। বিনা যুদ্ধ করেই নীরবতাকে দখলদারি থেকে ভাগিয়ে দিয়ে বলতে লাগেন উপ সেনাপতি হিতাম।
‘ যথা আজ্ঞা মহারাজ! আমি এক্ষুনি সৈন্যদের কাজে লাগিয়ে দিচ্ছি! ‘ সম্মতি জানিয়ে প্রত্যুত্তরের সাহস করলেন তিনি। রাজা অরগাড যেন রাগে ফেটে পড়বেন। তার শ্বাস-প্রশ্বাস কাজের শব্দ শুনলেই ভয় পেতে বাধ্য। একের পর বড়বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন তিনি এবং সাথে সাথেই তা ত্যাগ করে দিচ্ছেন। চোখ দুটো অস্বাভাবিক লাল হয়ে আছে। যা তার রাগের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। উপ সেনাপতি হিতাম কোনো কথা না বলে দ্রুত পায়ে হেঁটে রাজসভা ত্যাগ করলেন। রাজা অরগাড নিজের রাগ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। কাউকে কিছু না বলেই চেহারায় রাগান্বিত ভাব ফুটিয়ে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ান। দ্রুত পায়ে হেঁটে রাজসভা ত্যাগ করে রাজ কক্ষের দিকে যেতে লাগেন।
রাজা অরগাড রাজসভা ত্যাগ করতে সকল সভাসদগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আর কিছু সময় এভাবে দম আটকে বসে থাকলে হয়তো নির্ঘাত মারা পড়ত। রাজা অরগাড দ্রুত হেঁটে রাজ কক্ষের সামনে উপস্থিত হতে প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীগুলো পাল্লাগুলো দ্রুত খুল দেয়। রাজা অরগাড কোনো বিলম্ব ব্যতীত কক্ষে প্রবেশ করেন তিনি। প্রহর তার এরকম আচরণে হা করে তাকিয়ে থাকে। মাথায় কিছু আসছে না তার। রাজা অরগাড কক্ষে প্রবেশ করেই অনতিবিলম্বে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সরাসরি পড়ে যেতে নেন। তার পড়ে যাওয়া দেখে দৌড়ে এগিয়ে আসেছিলেন রানি নিয়ানো এবং রাজকুমারী ডায়ানা। কিন্তু নিজেকে সামলে নেন রাজা তিনি। দেহের টাল সামলে বিছানায় বসে যান। চিন্তায় তার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। রানি নিয়ানো এবং রাজকুমারী ডায়ানা রাজা অরগাড কক্ষে আসার আগেই এসে উপস্থিত হয়েছেন। রাজা অরগাডের সাথে তাদের আলাপনের অনুষ্ঠান অত্যাধিক পরিমাণ জরুরি।
বিছানায় বসে একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়েন রাজা অরগাড। হতাশাগ্রস্ত হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকেন। বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হতে কক্ষের প্রবেশদ্বারের পাল্লা দুটো খুলে যায়। হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করল দুজন মৎস্য মানব। একজন উপ সেনাপতি হিতাম। অপরজন তার ব্যক্তিগত মৎস্য সৈন্য। কক্ষে নতুন কারও উপস্থিতি টের পেয়ে রাজা অরগাড মাথা তুলে তাদের দিকে তাকান। রাজা অরগাডের তীক্ষ্ণ উপ সেনাপতি হিতাম এবং তার ব্যক্তিগত সৈন্যর দিকে তাকাতে তারা চেহারার ভঙ্গিমা বদল করে নেয়। এরকমভাবে চেহারায় গঠন পরিবর্তন করা মোটেও ভালো দৃষ্টিতে নিয়েলন না তিনি। রাজা অরগাডের কাছে মুখের ভাবার্থ মোটেও সুবিধার ঠেকছে না। সময় ক্ষয় না করে প্রশ্ন করে ফেললেন তিনি,
‘ যুবরাজ রন ইওহার্ডের কোনো খোঁজ পেয়েছ? কোথায় যুবরাজ? ‘ হতাশার ঘোরে নিমজ্জিত হয়ে সাথে খানিকটা ক্রন্দনরত হতবিহ্বল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন। তার এরকম স্বর শুনে হতভম্ব হয়ে যান উপ সেনাপতি হিতাম এবং উপস্থিত কক্ষের বাকি সদস্যগণ! যুবরাজ রন ইওহার্ড পালিয়েছে তা শুনে যতটা হতবাক না হয়েছেন উপ সেনাপতি হিতাম! তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বাকহারা হয়েছেন রাজা অরগাডের ব্যবহার দেখে!
প্রত্যুত্তরে কোনো জবাব দিলেন না উপ সেনাপতি হিতাম এবং তার সঙ্গি।
‘ এদের দুজনকে দেখে মোটেও ভাবসাব সুবিধার ঠেকছে না! কী খবর এনেছে আমার জন্য? ভালো নাকি খারাপ!’ নিজের মাঝেই নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছেন রাজা অরগাড। এই নিয়েই তার চিন্তাভাবনা! তাদের দুজনকে কোনো জবাব দিতে না দেখে পুনরায় প্রশ্ন করেন রাজা অরগাড,
‘ কী হলো? যুবরাজ রন ইওহার্ডের কোনো খোঁজ পাওনি? কোথায় সে? ‘ কিঞ্চিৎ রাগী ভাব ফুটিয়ে প্রশ্ন রাখেন।
এবার আর রাজা অরগাডের প্রশ্নের জবাবে নিশ্চুপ থাকতে পারেননি উপ সেনাপতি হিতাম। উপস্থাপন করতে লাগলেন, ‘ মহারাজ, আমরা সারা রাজ্য তন্নতন্ন করে পর্যটন করেছি। এবং এখনো তন্নতন্ন করে খুঁজে চলেছে সৈন্যরা। কিন্তু কোথাও যুবরাজ রন ইওহার্ডের খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্রজাদের থেকে জিজ্ঞেস করলে জানায় তারা যুবরাজ রন ইওহার্ডকে চিনেই না। কখনো দেখেইনি! এর অর্থ দ্বারা রাজ্যের প্রজাদের মাঝে গিয়ে পালায়নি!এছাড়া সন্দেহের ঝোঁকে আপনার কথামতো চল্লিশজন সৈন্যকে সুরক্ষা কবচের ওপারে সমুদ্রের মাঝে খুঁজতে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু সবার মতো তারাও জানায় সেখানে কাউকে দেখতে পায়নি! যদি সে সমুদ্র দিয়ে পলায়ন কররার চেষ্টা করত তবে তবে নিশ্চয়ই তাদের নজরে আসত! ‘ এক দমে সম্পূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করলেন উপ সেনাপতি হিতাম। উপস্থাপন শেষ করতে বড় একটি টান দিয়ে শ্বাস নেন।
রাজা অরগাড তার করা প্রশ্নের জবাব আশানুরূপ পাননি। এরকম উত্তর শুনে পূর্বের তুলনায় আরও ভেঙে পড়তে লাগলেন। নিজে নিজে বিলাপ করতে লাগেন মাথায় হাত দিয়ে। তার ভেঙে পড়া দেখে উপ সেনাপতি হিতামকে লক্ষ্য করে বলেন রানি নিয়ানো, ‘ তোমরা এখন যাও। মহারাজ আরাম করবেন।’
রানি নিয়ানোর আদেশ অমান্য করার সাধ্য তাদের নেই। তাই মাথা নিচু করে কুর্নিশ জানিয়ে তারা দুজন রাজা অরগাডের সামনে থেকে প্রস্থান করেন। দ্রুত পায়ে হেঁটে প্রবেশদ্বারের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়ে দুটো টোকা দিতে দ্বারের পাল্লা খুলে দেয় ওপাশে থাকা প্রহরী। দ্রুত পায়ে কক্ষ ত্যাগ করেন তারা দুজন।
উপ সেনাপতি হিতাম এবং তার সঙ্গি কক্ষ থেকে বের হতেই প্রবেশদ্বারের পাল্লা দুটো টেনে বন্ধ করে দেয় প্রহরী। রাজকুমারী ডায়ানা নিশ্চুপ হয়ে এক কর্ণারে বসে আছে। কী হচ্ছে! সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে বললেই চলে। রানি নিয়ানো এতসময় যাবত চুপ করে থাকলেও এখন চুপ করে বসে থাকতে তিনি নারাজ। রাগান্বিত হয়ে ক্রোধ ভরা কণ্ঠে বলতে লাগেন,
‘ আমি আপনাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই ছেলে রাজা হবার উপযুক্ত কি না! কিন্তু আপনি আমার কথার কোনো কর্ণপাতই করেননি। কেবল বলে এসেছেন তার মাঝে মৎস্য রাজার রক্ত প্রবাহ হচ্ছে। তা এতই যদি রক্ত প্রবাহ হয়,তবে পালালো কেন? ‘ যুক্তিসহ মন্তব্য উপস্থাপন করলেন তিনি।
কিন্তু রানি নিয়ানোর কথার দিকে একবারও কর্ণপাত করলেন না রাজা অরগাড। সে তার ভাবনায় ব্যস্ত। তা দেখে আরও রেগে গিয়ে তার বক্তব্য উপস্থাপন করতে লাগলেন রানি নিয়ানো।
‘ এমনিতেও আমার কথার কোনো দাম নেই। রাজ্যে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেদিকে খেয়াল আছে আপনার? একটা মানুষের বাচ্চা কী করে গোটা মৎস্য মানবদের রাজা হতে পারে? ‘ পুনরায় কটাক্ষ করে যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন তুললেন তিনি।
এবার আর প্রত্যুত্তর না করে পারলেন না। বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বললেন রাজা অরগাড,
‘ আহ্! তুমি থামবে এবার? কতবার বলব, যুবরাজ মানুষের বাচ্চা হলেও তার দেহের শিরা-উপশিরায় এখনো মৎস্য রাজার বংশের রক্ত প্রবাহ হচ্ছে। তোমার মনে হচ্ছে সে পালিয়েছে! কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সে রাজ্যেই আছে! আর নিশ্চয়ই কোনো কাজে আছে। ‘ শেষ কথাগুলো খানিকটা জোর খাটিয়ে উপস্থাপন করলেন তিনি। তার আত্মবিশ্বাসের মাত্রা ধীরে ধীরে চড়াও হতে লাগে।
‘ হ্যাঁ, আপনার কাছে তো মনে হবেই! সবাই জানে রন ইওহার্ড পালিয়েছে! আর আপনি নতুন খবর বের করেছেন, বলছেন সে রাজ্যেই আছে! এগুলো রাজ্যের লোকেদের কাছে বললে, তারা আপনাকে পাগল ভাববে। ‘ দেহে জ্বালাপোড়া ভাব নিয়ে মনের কথনগুলো ব্যক্ত করলেন রানি নিয়ানো। এতক্ষণ যাবত নীরবে রাজা অরগাড এবং রানি নিয়ানোর ঝগড়া দেখছিলেন রাজকুমারী ডায়ানা। কিন্তু সেগুলোতেও তার ভাবনার ঘোর ভাঙতে সক্ষম হয়নি।
রাজা অরগাড কিছু না বলেই বিছানা ছেড়ে উঠে যান। রানি নিয়ানো তার ব্যবহারে হতবাক। রাজা অরগাডের মাথায় এখন কী ঘুরছে তা ভেবে পাচ্ছেন না তিনি।
রাজা অরগাড দ্রুত পায়ে হেঁটে প্রবেশদ্বারের কাছে উপস্থিত হন। নিয়ম অনুসারে দুটো টোকা দিতে ওপাশ থেকে প্রবেশদ্বার খুলে দেয় প্রহরী। রাজা অরগাডকে দেখামাত্র মাথা নিচু করে প্রহরী কুর্নিশ জানায়। সেদিকে ধ্যান না দিয়ে নিজের মতো হাঁটতে থাকেন রাজা অরগাড। তার পেছনে রক্ষক হিসেবে এসে হাঁটতে লাগে ৮ জন্য সৈন্য। যাদের চারজনের কোমড়ে খাপের আচ্ছাদনে লুকায়িত তলোয়ার। বাকি চারজনের হাতে রয়েছে নীলাভ বর্ণের ভয়ানক তীক্ষ্ণ এবং ধারালো ফলা বা বল্লম। রাজা অরগাড তাদের নিয়ে বারান্দা দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে রাজপ্রাসাদ অতিক্রম করে বাহিরে বেরিয়ে আসতে রাজপ্রাসাদের সম্মুখে মাঠে মৃদু আলোড়িত জনতার সামান্য ভীড় দেখতে পান। উপস্থিত জনতার মাঝে গুঞ্জনের রেশ দেখা যায়। হাতের ইশারায় তাদেরকে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে মাঝখান দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দেওয়ার জন্য বলেন রাজা অরগাড। উপস্থিত মৃদু আলোড়িত জনতাগণ রাজার সম্মানে সাথে সাথে মাঝ থেকে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে রাস্তা তৈরি করে দেয়। রাজা অরগাড কোনোদিকে কর্ণপাত না করে তার সৈন্যদের নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রান্তরের দিকে রওনা দেন। কারাফটক পেরিয়ে বা দিকে মোড় নিয়ে পথ চলতেই দূর থেকে দেখা যাচ্ছে প্রশিক্ষণ প্রান্তেরর নকশা বদল হয়ে গেছে। কিছু কিছু স্থান দিয়ে বেঁকে গেছে। আবার কোনো কোনো স্থানে ভেঙে গেছে।
রাজা অরগাড প্রশিক্ষণ প্রান্তের প্রবেশদ্বারের কাছে উপস্থিত হওয়ামাত্র সেখানে কর্মরত অবস্থায় থাকা প্রহরীটি মাথা নিচু করে কুর্নিশ জানায়। তাকে কিছু না বলতেই প্রহরীটি একটি ধাক্কা দিয়ে প্রবেশদ্বার সম্পূর্ণ খুলে দেয়। রাজা অরগাড এবং তার সাথে আগত সৈন্যদের নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রান্তরে আবদ্ধ জলের ভাণ্ডারে প্রবেশ করেন। সেখানে প্রবেশ করতে চোখ তার কপালে উঠে যাবার উপক্রম। রাজা অরগাডের সাথে আসা সৈন্যগুলোও বাকহীন হয়ে পড়েছে। তাদের বলার ভাষা ফুরিয়ে গেছে বোধহয়। কেবল তাদের মস্তিষ্কে এখন একটি ভাবনা, ‘ এতক্ষণ যাবত কী শুনলাম আমরা! আর এখন কী দেখছি!’ কিন্তু ভাবনাটা মনের অন্তরালেই রয়ে গেল!
আবদ্ধ পানির ভান্ডারের মাঝে উপদেষ্টা নিওরিয়ানের সাথে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন যুবরাজ রন ইওহার্ড। জলরাশিকে নিজের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে সে। হাত মুঠ করে জলরাশিগুলো জমাট করে তলোয়ার এবং ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে উপদেষ্টা নিওরিয়ানের সাথে অনুশীলন করছিল। রাজা অরগাড যুবরাজ রন ইওহার্ডকে এমন অবস্থায় দেখে খুশি হয়ে যান তিনি। বানোয়াট ঘটনার শুরু থেকেই ” যুবরাজ পালিয়ে গেছে ” বচনে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি রাজা অরগাড। তার সন্দেহই ঠিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজা অরগাড যেটা ভেবেছিলেন, ঠিক তেমনটাই হয়েছে।
অনুশীলন করা অবস্থায় আচমকা উপদেষ্টা নিওরিয়ান কারও উপস্থিতি টের পেয়ে বাম দিকে তাকাতে নজরে আসে প্রবেশদ্বার থেকে খানিকটা এগিয়ে জল ভান্ডারের ভেতরে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন রাজা অরগাড। তার পেছনে দাঁড়িয়ে হা হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে রাজা অরগাডের ৮জন দেহরক্ষী। রাজা অরগাড নিজেও কম হতভম্ব হয়নি। চেহারায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব ফুটিয়ে উপদেষ্টা নিওরিয়ান এবং যুবরাজ রন ইওহার্ডের দিকে তাকিয়ে আছেন। রাজা অরগাডকে দেখামাত্রই দ্রুত যুবরাজ রন ইওহার্ডের সাথে অনুশীলন কার্য ছেড়ে তার কাছে এসে উপস্থিত হন উপদেষ্টা নিওরিয়ান। আচমকা রাজা অরগাডের এরকম উপস্থিতি ভালো নজরে নেয় না যুবরাজ রন ইওহার্ড। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাজা অরগাড এবং তার দেহরক্ষীদের দিকে। তবে কিছু সময়ের জন্য হতভম্বের চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করে।
‘ আচমকা রাজা অরগাডের এখানে উপস্থিতি! বিষয়টা মোটেও সুবিধার ঠেকছে না আমার। কোনো না কোনো কারণ তো অবশ্যই আছে! কী সেই কারণ? ‘ নিজ মনের সাথে সকলের আড়ালে আলাপ করতে লাগে যুবরাজ রন ইওহার্ড। কোনোভাবে ভেবে পাচ্ছে না, রাজা অরগাডের উপস্থিতির কারণ কী?
উপদেষ্টা নিওরিয়ান পানির মাঝে দ্রুত পথগামি হয়ে রাজা অরগাডের সামনে উপস্থিত হয়। প্রফুল্ল হয়ে তাৎক্ষণিক সময়ে মাথা নিচু করে কুর্নিশ জানান। কিন্তু তার এরকম সম্মাননায় খুশি হননি রাজা অরগাড। চেহারার ভাব গম্ভীর হয়ে আছে। এক পর্যায়ে আর চুপ করে না থেকে সেদিকে কিছুটা গম্ভীর স্বরের পাশাপাশি রাগী ভাব কণ্ঠে ফুটিয়ে জ্ঞাপন করলেন, ‘ এখানে আসার কী দরকার ছিল? যুবরাজের অনুশীলন কার্য চলছিল সেটাই তো ভালো লাগছিল। ‘ রাজা অরগাডের এরকম হেতুবাদী মন্তব্যর রেশ ধরতে সক্ষম নন উপদেষ্টা নিওরিয়ান। বচনের কোনো হেতু খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইলেন। কিছু কিছু সময় নীরব থাকা ভদ্রতার লক্ষণ! আবার কোথাও নীরব হয়ে থাকা উত্তম। সেই সূত্র অনুসরণ করে তিনি চুপ হয়ে রইলেন। তার চুপ হয়ে যাওয়া দেখে রাজা অরগাড তার দিকে ভ্রু জোড়া কুঁচকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। অতঃপর মায়াবী নয়নে যুবরাজ রন ইওহার্ডের দিকে দৃষ্টিপাত করে তার উদ্দেশ্য করে ব্যক্ত করতে লাগলেন,
‘ বেলা দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবার পথে। আজকের জন্য এখানেই তোমার অনুশীলন কর্ম শেষ করো। আর এখন আমার সাথে চলো। ‘ প্রথমে স্বাভাবিক স্বরে বক্তব্য উপস্থাপন করলেও শেষ বাক্য কঠোর হয়ে উত্থাপন করেন। মাঝে মাঝে রন ইওহার্ডের কাছে রাজা অরগাডকে একজন রহস্যময় ব্যক্তি মনে হয়। কারণ হিসেবে এই মুহূর্তের ঘটনাকেই ধরে নেওয়া যায়। হঠাৎ করে রেগে যাওয়াটা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না তার!
রাজা অরগাড মাত্র কয়েকটি বাক্য প্রকটন করে প্রান্তর ত্যাগের উদ্দেশ্যে পেছন দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। প্রবেশদ্বার এখনো খোলাই আছে। যুবরাজ রন ইওহার্ড কথার অমান্য না করে দ্রুত পানিতে নিজের ভারসাম্য বজায় রেখে রাজা অরগাডের পাশে এসে দাঁড়ায়। তবে প্রান্তর ত্যাগের আগে ইশারায় উপদেষ্টা নিওরিয়ানকে বিদায় জানিয়ে দেয়। রাজা অরগাড যুবরাজ রন ইওহার্ডকে নিয়ে প্রান্তর ত্যাগ করে রাজপ্রাসাদের দিকে রওনা দেন। কিছু সময় বাদে যুবরাজকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হতে প্রাসাদের সম্মুখ মাঠে আগত লোকজনগুলো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। যেন তারা অবিশ্বাস ঘটনা। যুবরাজ রন ইওহার্ড এত লোকের সমাগম দেখে তাৎক্ষণিকভাবে ভড়কে যায়। তার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকার কারণ কী তা এখনো বুঝতে পারছে না সে! তবে সকলের এরকম আচরণ অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার।
উপস্থিত মৎস্য মানবদের সামান্য ভীড়ের মধ্য থেকে একজন বলে ওঠে, ‘ মহারাজ, এই পলাতক যুবরাজকে আপনি কোথায় পেলেন? ‘ কণ্ঠে রাগের পাশাপাশি তাচ্ছিল্যের ছোঁয়া লেগে আছে।
পলাতক যুবরাজ কথাটা শুনতেই উক্ত স্থানেই দাঁড়িয়ে পড়ে রন ইওহার্ড। কথাটা তার উদ্দেশ্য করেই বলা তা সে ভালো করে বুঝতে পেরেছে! কেননা বর্তমানে মারমেইড শহরে একজনই যুবরাজ আছে। আর তা হলো রন ইওহার্ড। কিন্তু তাকে পলাতক কেন বলা হলো! এই প্রশ্নের জবাব রন ইওহার্ডের কাছে জানা নেই।
গলার স্বর উঁচু করে লোকটির জবাবে বললেন রাজা অরগাড,
‘ আপনাদের সকল প্রশ্নের জবাব খুব শীঘ্রই দেওয়া হবে। এখন আপনারা আপনাদের গৃহে অবস্থান করুন। এবং আমাদেরকে এখন যাবার জন্য রাস্তা তৈরি করে দেন! ‘ রাজা অরগাড কথাটি বলামাত্র উপস্থিত সকলে তার কথার সম্মানার্থে দ্রুত মাঝ দিয়ে একটি রাস্তা তৈরি করে দেয়। রাজা অরগাড সেখানে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে যুবরাজ রন ইওহার্ডের হাত ধরে টেনে রাজপ্রাসাদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। পেছনে এগিয়ে আসছে ৮জন দেহরক্ষী। প্রাসাদে প্রবেশ করে সরাসরি যুবরাজ রন ইওহার্ডের কক্ষে নিয়ে যান তিনি। যুবরাজকে পাওয়া গেছে শুনে রাজকুমারী ছুটে এসেছে যুবরাজের কক্ষে। তার সাথে কক্ষে এসে উপস্থিত হন রানি নিয়ানো। যুবরাজ রন ইওহার্ড কক্ষে প্রবেশ করেতেই রাজা অরগাডের কাছে প্রথম প্রশ্ন স্বরূপ উপস্থাপন করে,
‘ মহারাজ, আমাকে পলাতক যুবরাজ কেন বললেন তিনি?’ গম্ভীর ভাব নিয়ে প্রশ্নটি করল রন ইওহার্ড। প্রশ্নের অন্তরালে ক্রোধের উষ্ণতা অনুভব করা সক্ষম।
প্রত্যুত্তরে তৎক্ষণাৎ জবাব দেন রানি নিয়ানো,
‘ পালিয়ে গেলে লোক বলবে না? ‘ তাচ্ছিল্যতার স্বরে কথাটি শেষ করেন তিনি।
রানি নিয়ানোর কথা শেষ হওয়ামাত্র রন ইওহার্ডের চেহারার রঙ পরিবর্তন হতে থাকে। চোয়ালগুলো ফুলে উঠেছে ইতোমধ্যে। চোখ দুটো তার রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।
রাজা অরগাড রানি নিয়ানোকে একটি জোড়ালো স্বরে ধমক দিয়ে বললেন, ‘ তুমি চুপ করো তো। এত সকল সমস্যার মূল তুমি। একটা কথাও আর বলবে না। যুবরাজ, আসলে সকাল সকাল রানি নিয়ানো তোমাকে বিছানায় খুঁজে না পেয়ে সে আসলে ভড়কে যায়। ভাবে, তুমি পালিয়েছ সেনাপতি রিবিয়ানের ভয়ে। এরপর রাজ্যের সাথে যুক্ত সকলের মাঝে খবরটা ছড়িয়ে যায়। এবং তোমাকে খোঁজ করা শুরু হয়। মারমেইড শহর তন্নতন্ন করে খোঁজার পরেও তোমাকে না পেয়ে সমুদ্রে খুঁজতে বের হয় কয়েকজন সৈন্য। কিন্তু তোমাকে না পেয়ে সবাই ভেবে বসেছে তুমি সত্যি সত্যি পানিয়েছে। তাছাড়া গতদিনই প্রশিক্ষণ প্রান্তরে দুর্ঘটনায় বেশ খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেখানে আর কেউ খোঁজ করতে যায়নি। কিন্তু তুমি যে অনুশীলন করছিলে সেটা আমি ব্যতীত আর কারও মাথাতে আসেনি। ‘ একদমে পুরো ঘটনাটা সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যক্ত করেন তিনি। এবং শেষ কথাগুলো কিছুটা নরম স্বরে উপস্থাপন করলেন।
বেঁকে বসে প্রশ্ন করল যুবরাজ রন ইওহার্ড।
‘ কিন্তু আমি রাজ্য ছেড়ে পালাব কেন? আমি চুরি করেছি না ডাকাতি করেছি? যে আমার রাজ্য ছেড়ে পালাতে হবে! বুঝি না আপনাদের কর্মকাণ্ড! যা ভালো মনে হয়, তাই করুন।’ প্রথমে যুক্তির সাথে ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বাক্য বিনিয়োগ করলেও শেষ কথা দুটো বেশ অভিমানী সূর জাগিয়ে বলে ওঠে।
সাতান্ন.
গাড়ি থেকে নেমে কোনো শব্দ অপচয় না করে সোজা বাড়িতে প্রবেশ করেন রিবন ইওহার্ড। আর ব্যক্তিগত এসিস্ট্যান্ট তানভীর পিছুপিছু বাড়িতে প্রবেশ করে। ঢুল খেয়ে পড়ে যেতে নেন রিবন ইওহার্ড। দ্রুত এগিয়ে এসে তানভীর তার দুই হাতে জড়িয়ে ধরে সামলিয়ে নেয়। রিবন ইওহার্ডকে তার রুমে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় তানভীর। তবে পূর্ণ শোয়া নয়। খাটের কার্ণিশের সাথে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছেন তিনি। কৌতূহল ভরা নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রইল তানভীর। কৌতূহলের উত্তেজনায় প্রশ্ন আর পেটের মাঝে চেপে না রেখে পেট থেকে নির্গত করে দেয়,
‘ আপনার কী হয়েছিল? হঠাৎ করেই হসপিটাল গেলেন! আবার হসপিটালের বেড থেকে অজ্ঞান অবস্থায় জাগ্রত হয়ে বসে যান। কারণ কী?’ চোখ দুটোতে মিনতি ভরা ভাব ফুটিয়ে প্রশ্ন উপস্থাপন করে।
তানভীরের মায়াবী মুখপানে তাকিয়ে মানা করতে পারলেন না রিবন ইওহার্ড। ছেলেটার মুখে লেগে আছে জানার প্রচুর আগ্রহের ছোঁয়া।
‘ অফিস করতে করতেই হঠাৎ করে বুকে ব্যথা শুরু হয়। তাই তোমাকে গাড়ি বের করে হসপিটাল যেতে বলি। আর অজ্ঞান অবস্থায় জাগ্রত হওয়ার কারণটা একটু ভিন্ন।’ স্বাভাবিক কণ্ঠে উপস্থাপন করলেও ভূতের গল্পের মতো শেষ বাক্যে রহস্য রেখে দিলেন। এতটুকু বলতেই তানভীর খানিকটা নড়েচড়ে বসল। ‘ একটু ভিন্ন! নিশ্চয়ই এখানে কোনো রহস্য আছে!’ এতটুকু সময়ের মাঝেও প্রশ্ন করতে ভুলেনি সে।
‘ হ্যাঁ, একটু রহস্যময় তো বটেই! আমি স্বপ্নে দেখতে পাই বিশাল এক দৈত্য! উপরের অর্ধেক মানুষের মতো, আর নিচের বাকি অর্ধেক মাছের লেজের অংশ। অর্থাৎ, আমরা যাকে আমরা যাকে মৎস্য মানব বলি। সেই বিশাল দৈত্যাকার মৎস মানবটি আমার রন ইওহার্ডকে আঘাত করে। আঘাতের তীব্রতা দেখে রন ইওহার্ড আমার নাম জপে। যার নিমিত্তে ভয় পেয়ে জেগে যাই!’ রহস্যময় বক্তব্যটি ব্যক্ত করে দিলেন রিবন ইওহার্ড। তানভীর তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। কী বলল তা তার মাথার উপর দিয়ে রকেট যাবার মতো বোলতা ছুটে গেল!
[– চলবে –]
• রানি নিয়ানোর কর্মটি কি বড় কোনো অর্থ বহন করে?
• রাজা অরগাড কার পক্ষ নেবেন? এবং কোন রহস্যের উত্তর উপস্থিত করবেন?
• রিবন ইওহার্ড কী করে রন ইওহার্ডের আঘাতের ব্যথা অনুভব করল?