#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_১৫.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। চারপাশ ভয়ংকর অন্ধকারে গা ঢেকে আছে। গুড়গুড় করে মেঘগর্জন শোনা যাচ্ছে দূর-দূরান্তে। এখনো বজ্রপাতের পৈশাচিক আওয়াজ শুরু হয়নি। বৃষ্টির আগে যেই দমকা হাওয়া ছাড়ে তাতেই পল্লীবিদ্যুৎ উধাও হয়ে গেছে। আকাশ যেভাবে অন্ধকার করেছে, তাতে মনেহচ্ছে তাণ্ডবের মতো বৃষ্টি নামবে। এদিকে মোল্লাবাড়িতে টান-টান উত্তেজনা কাজ করছে। তরুণের কোনো লাতা-পাতা নেই, ঘরের মধ্যে তরুণের ব্যাগটা পযর্ন্ত গায়েব। হুট করে নিরুদ্দেশ ভঙ্গিতে চলে যাওয়ার ঘটনাটা হান্নান শেখ কোনোভাবেই মিলাতে পারছেন না। এদিকে সুরাইয়ার উপরও প্রচণ্ডরূপে ক্ষেপে আছেন তিনি। সুরাইয়া বেহায়ার মতো পাশের গ্রামের নদীপারে গিয়ে নৌকায় ঘুরে এসেছে। সঙ্গে যে একটা ছেলেও ছিলো সেটাও গ্রামের চাষী রবিউল মিয়া কানে দিয়েছে। এসব শুনেই তিনি যারপরনাই বকেছেন সুরাইয়াকে। শেফালী আজ সাফাই দিতে গিয়েও চুপ করে আছে, সুজলা কঠোর চাহনিতে সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে শেষে রান্নাঘরে চলে গেলেন। ঘটনা যখন ইতি টেনে বসলো, সবাই যখন যার-যার কর্মে ব্যস্ত হয়ে পরলো, তখন শান্তচিত্তের মেহনূর ঘরের পর্দা সরিয়ে বাইরে চুপি দিলো। কাউকে তখন দেখতে না পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে চুপিচুপি পুকুরপাড়ের জন্য সিড়ি ধরে নামলো, কিন্তু যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে সুতীক্ষ্ম কন্ঠের জন্য পা থামিয়ে ফেললো মেহনূর। সঙ্কোচ ভঙ্গিতে মাথা ঘুরিয়ে দেখলো মারজা দাড়িয়ে আছেন। তিনি হাতের ইশারা করে ওকে কাছে আসতে বললেন। মেহনূর গুটিগুটি পায়ে উনার কাছে যেয়ে দাড়ালে মারজা ওর হাত ধরে শান্ত গলায় বলেন,
– ওমন চুপিচুপি করে কোথাও যাচ্ছো মেহনূর?
সহজাত নরম কন্ঠ এবং সুলভ আচরণ দেখে মুখ তুলে তাকালো মেহনূর। গাঢ় সবুজ রঙের জামদানী শাড়ি পরে আছে মারজা, মাথায় সুন্দর করে ঘোমটা দেওয়া। চোখেমুখে সৌজন্যের হাসি দেখা যাচ্ছে, শরীরের সর্বত্র যেনো শৌখিনতার ছোঁয়া। মেহনূর শান্ত নয়নে মারজাকে একপলক দেখে নিলো, এরপর চোখ নামিয়ে সরল গলায় বললো,
– পুকুরপাড় যাচ্ছিলাম।
উত্তরটা শুনে মুচকি হাসি দিলেন মারজা। মেয়েটার মধ্যে ছোট ভাবীর সহজ-সরল রূপটা ভালোমতোই প্রকাশ পাচ্ছে। মেয়েটা সম্পূর্ণ ওর মায়ের আচারনিষ্ঠ পেয়েছে। এদিকে মেহনূরের মনে প্রচণ্ড অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে। প্রথমত মারজার সাথে টুকটাক কথা ছাড়া তেমন কোনো কথা হয়নি। শানাজ,সাবা, সুরাইয়া যেখানে ঢের কথাবার্তা সেরে ফেলেছে, সেখানে মেহনূর মারজার কাছ থেকে নিজেকে যথেষ্ট গুটিয়ে রেখেছে। মারজা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে মেহনূরকে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। এ বাড়ির চারটা নাতনীর মধ্যে মেহনূরকেই উনার চমৎকার লাগে। মেয়েটার চেহারায় সুরাইয়ার মতো ভোঁতা ভাব নেই, শানাজের মতো সখ্যতার আলাপন নেই, সাবার মতো হুটহাট মিশুকে স্বভাবটাও দেখা যায়নি। মাহতিমের মুখে দুইবার এই মেয়েটার সম্বন্ধে ‘ গা-ধা ‘ উপাধী শুনেছে, কেনো শুনেছে সেটার বর্ণনা মাহতিম দেয়নি। অথচ মাহদি যেখানে ‘ মেহনূর আপু ‘ বলতেই অজ্ঞান, রাত হলেই ওর রুমে যেয়ে ঘুমানোর জন্য বায়না ধরে বসে, সেখানে মেহনূরকে গা-ধা বলার কোনো কারণ খুজেঁ পেলেন না তিনি। মারজা ওকে বিছানায় বসিয়ে নিজেও ওর পাশে বসলেন। সহাস্য মুখে সান্নিধ্য আচরণে বললেন,
– তুমি পড়াশোনা করছো না? এবার কিসে পড়ছো?
মেহনূর কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে ধীর কন্ঠে বললো,
– দশম।
উত্তরটা শুনে গাঢ় করে হেসে দিলেন মারজা। দুজনের মধ্যে টুকিটাকি বিষয়ে কথা চলতে থাকলে ঠিক ওইসময় ফারিন মারজার রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। আনমনে চলে যেতেই রুমের ভেতরে একপলক ভাবলেশভাবে তাকালো, মুখ ফিরিয়ে আবার যেতে ধরলে হঠাৎ বজ্রাহতের মতো বিপুল বিষ্ময়ে হাঁটা থামিয়ে ফেললো। তাড়াতাড়ি পা পিছিয়ে রুমের বাইরে দাড়িয়ে আড়াল থেকে ভেতরে চুপি দিলো, ওমনেই আশ্চর্য দৃষ্টিতে থম মেরে রইলো ফারিন। সত্যিই মেহনূর কথাবার্তা বলছে? ফারিন অস্ফুট সুরে ‘ সর্বনাশ!’ বলতেই একদৌড়ে সৌভিকের রুমে গিয়ে পৌঁছালো। সৌভিকের রুমে নীতি বাদে বাকি সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। ওই মূহুর্তে ফারিনের আকস্মিক আগমন দেখে ভ্রুঁ কুঁচকালো সবাই। ফারিন হাপাতে-হাপাতে দম ফুরানোর ভঙ্গিতে ছটফট করে বললো,
– তাড়াতাড়ি নিচে যাও, নিচে যাও সবাই! মেহনূর জেঠীমার রুমে কথা বলছে! তাড়াতাড়ি চলো!
ফারিনের কথা শেষ হতে দেরি সবগুলা ধুপধাপ করে খাট নেমে দৌড় লাগালো। মারজা যদি ভুলেও মাহতিমের ব্যাপারে কাছু বলে ফেলে তাহলে সব শেষ! সব মানে সব শেষ! সৌভিক দৌড়ে যেতেই মাথা পিছু ফিরিয়ে ফারিনের উদ্দেশ্যে চটপট গলায় বললো,
– তুই নীতিকে ডাক্! নীতিকে বল নিচে আসতে! আমরা সবগুলা ততক্ষণে সামলে নিচ্ছি! তাড়াতাড়ি কর ফারিন, দৌড়া দৌড়া!!
ফারিনের হাপাঁনি তখনো থামেনি, তবুও সে আর দাড়িয়ে থাকেনি। সৌভিকের আদেশ শুনতেই আবারও পা ছুটিয়ে দৌড়ে লাগালো। এদিকে সিড়ি ধরে সবগুলো নিচে নেমে আসলো। মারজার রুমের দিকে ছুটে যেতেই হঠাৎ সিয়াম পা থামিয়ে সুক্ষ্ম চিৎকার দিয়ে সবাইকে থামতে বললো। সেই চিৎকারের সুর বাড়ির সবার কানে না গেলেও সৌভিকদের কানে পৌঁছেছে। সৌভিক, তৌফ, সামিক, সাবির, প্রীতি তৎক্ষণাৎ মাথা ঘুরিয়ে সিয়ামের দিকে তাকালো। সিয়াম ওদের কাছে গিয়ে নিচু সুরে সর্তক গলায় বললো,
– সবার একসাথে যাওয়া যাবেনা। একসাথে গেলেই ধরা খাবি। শোন এক কাজ কর, প্রীতি? তুই আগে যা। তুই গিয়ে পল্ট্রি মুরগীকে বল, নীতি ওরে পুকুরপাড়ের যেই ঝোঁপের প্লেসটা আছে, ওইখানে ইমিডিয়েটলি যেতে বলছে।
সিয়ামের গুরুত্বপূর্ণ কথার মাঝে তৌফ নিজের কথা ঝুলিয়ে বলে,
– শা-লারপুত তোর কি মাথা নষ্ট হইছে? আর জায়গা পাইলি না? চিপায় হান্দানের কথা বলোস ক্যান? ওই জায়গা কি ভালো?
সিয়াম ওর উগ্রতায় ক্ষেপে গিয়ে ওর গালে কষিয়ে চ-ড় মা-রলো। রাগে চটে গিয়ে দাতঁ কটমট করে বললো,
– মুখ খারাপ করাবি না! ঝোঁপের ভিতরে ঢুকতে বলিনাই, বলছি ওখানে নিয়ে আসতে। আপাতত বাড়ি থিকা দূর থাকলেই ওর মঙ্গল। আন্টি রে তুই চিনোস না? আন্টি যদি সারাবাড়ি খুইজা ওরে আড্ডা মারতে নিয়ে যায়, তাইলে বাবা আর ভাবী পাওনের আউশ করা লাগবো না।
সিয়াম নিজের যুক্তি বুঝিয়ে দ্রুত প্রীতির দিকে দৃষ্টি দিলো। ওর দিকে আদেশসূচকে কঠোর চাহনিতে বললো,
– আরেকটা কথা শোন, আন্টি যদি জিজ্ঞেস করে ‘ নীতি কেন ডাকছে? ‘, তাহলে বলবি নীতি একটু ছবি তুলবো। ছবি তুলার লিগার ডাকতাছে। হিসাব বুঝছোস? এখন জলদি যা।
সিয়ামের আদেশমতো মারজার রুমে ঢুকলো প্রীতি। এদিকে সবার মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছে। মারজা যদি মাহতিমের কাজ সম্বন্ধে বলে ফেলে তাহলে বিরাট কাহিনী হবে। কিছুক্ষণের মধ্যে নীতি এসে হাজির হলে পুরো প্ল্যান ওকে জানানো হয়। নীতি সবটা শুনে সবার জন্য বলে উঠে,
– প্ল্যানের ফার্স্ট ট্রার্ম যেহেতু শুরু হয়ে গেছে, আমাদের উচিত পুকুরপাড়ে গিয়ে বাকি প্ল্যানটা এক্জিকিউট করা। চলো আমরা পুকুরপাড়ে যাই। ওখানে গিয়ে বসে থাকলে আর কোনো প্রবলেম না।
নীতির কথায় সায় জানিয়ে সবাই পুকুরপাড়ে ঝোঁপের কাছে হাজির হলো। ঝোঁপটার ওখানে অনেকগুলো আমগাছ, সেই সঙ্গে জায়গা খুব স্যাতস্যাতে। সেখানে সোনালী রোদের তেজ খুব কম পরে বলে মাটিও বেশ নরম হয়ে থাকে। সবাই ওখানে যেয়ে জড়ো হলে কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রীতির সঙ্গে মেহনূর এসে হাজির হয়। হলুদ রঙের শাড়ি পড়ুয়া মেহনূর খালিপায়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। মাথার চুলটা সুন্দর করে বেণী করে রেখেছে। উজ্জ্বল চামড়ার উপর লাল রঙের ব্লাউজটা বেশ চমৎকার মানিয়েছে। সৌভিক, তৌফ, নীতি একদৃষ্টিতে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে আছে। ওভাবে তাকিয়ে থাকতেই সৌভিক অন্যমনষ্ক কন্রঠে বলে,
– আমাদের ভাবী আম্মাটা সুন্দরী না?
সৌভিকের হেয়ালী কথায় সায় দিয়ে ডানপাশ থেকে তৌফ বলে উঠলো,
– শুধু সুন্দরী না, আগুন সুন্দরী। মাহতিমের সাথে কি যে ডেন্ঞ্জারাস লাগবো! অমার তো এখনই ওইটা ভাইবা এক্সাইটেড লাগতাছে বন্ধু।
তৌফের কথায় মৃদ্যু ভঙ্গিতে হেসে দিলো সৌভিক। সেই হাসির রেশ টেনে সৌভিকের ডানপাশ থেকে নীতি বললো,
– এই পুচকি মেয়ে যে কবে বুঝবে মাহতিম ভাই অলরেডি ঘায়েল হয়ে আছে। এখন শুধু হাত বাড়ালেই ভাইয়ার ডেসপারেট অবস্থাটা দেখতে পারতো।
সৌভিক স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়তে-ছাড়তে বললো,
– সময় আসবে গাইজ। জাস্ট আরেকটু ওয়েট। আমার গাটস বলছে এই দুজনের মধ্যে কিছু তো একটা হবে।
নীতি এই কথার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন করতে পারলো না। ততক্ষণে মেহনূর ওদের সামনে এসে দাড়ালে সৌভিক বলে উঠলো,
– উই আর সো সরি মেহনূর, আসলে আমরা ছবি তুলার জন্যই তোমাকে ডেকেছিলাম, কিন্তু রুম থেকে ডিএসএলআর (DSLR) আনতে ভুলে গেছি। তুমি একটু নীতিদের সাথে থাকো, আমি আর তৌফ চট করে ক্যামেরাটা নিয়ে আসি।
কথাটুকু শেষ করতেই দুজন ক্যামেরার জন্য চলে গেলো। নীতি এসে মেহনূরের হাত ধরে আমগাছের নিচে নিয়ে এলো। সেখানে একটা কাঠের বেন্ঞ্চ করা ছিলো বসার জন্য, সবাই সেই বেন্ঞ্চটাতে বসে পরলো। মেহনূর গাছের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বেন্ঞ্চে বসা ছিলো, তার পরেই ছিলো নীতি, ফারিন, সামিক, সাবির, প্রীতি। সবাই আড্ডা দিচ্ছিলো ঠিকই, কিন্তু সময়ের কাটা বেশি না পেরুতেই হঠাৎ প্রীতি এক চিৎকার দিয়ে বেন্ঞ্চ থেকে উঠে দাড়ালো! ওর আকস্মিকভাবে চিৎকার দেখে সবাই হতভম্ব হয়ে কপাশ কুঁচকে ফেললো। প্রীতি একদমই স্বাভাবিক আচরণ করছেনা, বারবার পিঠের পেছন থেকে ওড়না দিয়ে ঝারা মারার চেষ্টা করছিলো। ঠিক ওই মূহুর্তে বাইরে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলো মাহতিম। কিন্তু প্রীতি হাউমাউ চিৎকার শুনে পুকুরপাড়ের ওদিকে থৌড়ে যেতেই সামিকের চেচাঁনো গলার আওয়াজ শুনলো,
– প্রীতি! প্রীতি! পিঠে ভুলেও হাত দিস না! মেহনূর নীতি, ফারিন তাড়াতাড়ি দৌড়াও! তাড়াতাড়ি পা চালাও! হারি আপ! জায়গাটা ভালো না!
সামিকের চেচাঁমেচি চলতে থাকলে মাহতিম দ্রুত জায়গায়টায় উপস্থিত হয়। সেখানে এসেই দেখে প্রীতির পিঠে যে ছ্যাঙ্গা জাতীয় কিট উঠেছে সেটা ওড়নায় ঝারা মেরে নীতি সরাচ্ছে। সাবির পায়ের তলায় জুতার নিচে ছ্যাঙ্গা পিষার চেষ্টা করছে। কিন্তু সবাই যখন দৌড়ের জন্য পা বাড়ালো তখন মেহনূরের দিকে তাকিয়ে চোখ স্থির হয়ে গেলো সবার। মেহনূর উজবুকের মতো চোখ খিচ মেরে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। ওর শরীরে ছ্যাঙ্গা উঠেছে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। নীতি তখন মেহনূরের দিকে যেতে ধরলে পেছন থেকে মাহতিম কড়া গলায় বলে উঠে,
– নীতি থাম! ওর কাছে যাবি না। তুই এই মূহুর্তে সবাইকে নিয়ে এখান থেকে পালা!
নীতি চকিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো। মাহতিম শক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওকে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো। নীতি ইশারাটা বুঝতেই একটা ঢোক গিলে অসহায় কন্ঠে বললো,
– ভাই ওর আচঁলে —
কথাটুকু শেষ করার সময় দিলো না মাহতিম। তর্জনী উঠিয়ে ওকে বাইরের রাস্তা দেখালো। নীতি একবার মাহতিমের দিকে তাকিয়ে শেষে মেহনূরের দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকালো। মেহনূরের চোখদুটো এখনো খিচুনি দিয়ে আছে, হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করা। নিরুপায় হয়ে নীতি তখন সেখান থেকে চলে গেলো। সবাই যখন হাত-পা চুলকাতে-চুলকাতে চলে গেলো, তখন মাহতিম লম্বা করে একটা নিশ্বাস নিয়ে সেটা ধীরেসুস্থে ছেড়ে দিলো। স্যাতস্যাতে জায়গাটা ভালোভাবে পরোখ করে এগুতে লাগলো মাহতিম। সাবধানে পা ফেলে একেবারে মেহনূরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।মেহনূরের বদ্ধ দুচোখের মাঝে দৃষ্টি ফেলে প্রসন্ন কন্ঠে বললো মাহতিম,
– আমার দিকে তাকাও, কোনো ভয় নেই।
খুবই আস্তে অথচ দৃঢ় কন্ঠের আওয়াজ শুনলো মেহনূর। মানুষটার কন্ঠ ধরতে পেরে সে ধীরে-ধীরে কুঁচকানো চোখের পাতা খুলে ফেললো। চোখের সামনে ধূর্সরবর্ণের টিশার্ট পরে আছে মানুষটা, পড়নে তার কালো প্যান্ট। তার দিকে দৃষ্টি তুলে তাকানোর জন্য প্রচুর সাহস প্রয়োজন। মেহনূর আড়চোখে ডানেবামে দেখে দিলো, আশেপাশে কেউ নেই। একদম নির্জন-শান্ত-কোলাহলমুক্ত হয়ে আছে চারপাশ। ও তীব্ররূপে টের পেলো পিঠের কাছে ব্লাউজের উপর কিলবিল করে কিছু হাটঁছে। সেটা যে ছ্যাঙ্গা জাতীয় চুলকানির পতঙ্গ সেটা বুঝতে পেরেই মেহনূরের শ্বাস টান উঠলো! অকস্মাৎ জোরে-জোরে নিশ্বাস নিতে শুরু করলো মেহনূর, হাত-পাও কাপঁতে লাগলো ওর। মাহতিম সেটা আঁচ করতে পেরে মৃদ্যু সুরে আবার বললো,
– তুমি আমার দিকে তাকাও মেহনূর, তোমাকে শুধু আমার দিকে তাকাতে বলেছি। সময় নষ্ট করো না, আমার দিকে তাকাও।
মেহনূর জীর্ণশীর্ণ রোগীর মতো কাঁপতে লাগলো, কিটটা ধীরে-ধীরে নিচের দিকে কোমরের কাছে নামছিলো। যদি ওটা কাটা জায়গাটার ওখানে যায়, কি করুণ অবস্থা হবে সেটা কি কেউ জানে? এতো বলার পরও যখন মেহনূর মুখ তুললো না, তখন মাহতিম বাধ্য হয়ে ওর থুতনি ধরে মুখ তুললো। সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে উঠলো মাহতিমের স্পর্শ এবং চাহনি দেখে। মাহতিম ওর দিকে কেমন ব্যকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টির মাঝে নিবদ্ধ করে মাহতিম একহাত এগিয়ে ওর কোমরের বাঁপাশ ধরলো, আরেকহাত এগিয়ে ওর পিঠের উপর রাখলো। মাহতিমের চোখের দিকে তাকিয়ে চমকালো না মেহনূর, কেঁপেও উঠলো না একটু। এমনভাবে স্থির হয়ে গেলো যেনো জন্ম-জন্মান্তর থেকে এই লোকটা যেনো এভাবেই ওকে স্পর্শ করে এসেছে। মাহতিম ওর পিঠের উপর হাতের বিচরণ চালাতেই কোমল সুরে বলে উঠে,
– মেহনূর আফরিন, দশম শ্রেনী, রোল নাম্বার তেরো, বিদ্যাশ্বরী স্কুলের সবচেয়ে অনিয়মিত ছাত্রী, চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে থাকো। অন্যদিকে ধ্যান দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
এ কথার উত্তরে একবার শুধু চোখের পলক ফেললো মেহনূর। চোখ খুলে আবারও মাহতিমের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। মাহতিম ওর দুচোখের ভেতর দৃষ্টি জড়িয়ে মেদহীন পিঠটার নিচে হাত নামাতেই হঠাৎ ব্যথার শব্দ তুলে শিউরে উঠলো। কিন্তু মেহনূরকে কিছু বুঝতে না দিয়ে তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে ওর দিকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো। মেহনূর অপ্রতিভ ভঙ্গিতে চমকে উঠলেও মাহতিমের অবস্থা দেখে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ওকে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই ওর দিকে বাঁকা হাসি দিয়ে দু’পা পিছিয়ে গেলো মাহতিম। কোমর থেকে হাত সরিয়ে ফেললো, পিঠ থেকেও সরিয়ে নিলো নিজের অন্যহাতটা। মেহনূরের দিক থেকে পিছিয়ে যেতে-যেতেই ডানহাতটা কেমন লুকানোর ভঙ্গিতে পকেটে গুঁজে ফেললো। অথচ মুখে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রেখে বললো,
– এখানে থাকা সেফ না, বাড়ি যাও। আমি আসছি।
আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করলো না মাহতিম। ডানহাতটা পকেটে গুঁজেই ব্যস্ত পায়ে চলে গেলো। মেহনূরও ওর যাওয়া দেখতে-দেখতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলো। কিন্তু মনের মধ্যে সেই যে সন্দেহ ঢুকেছে সেটা আর কোনোভাবেই বেরুলো না। বিকেলের দিকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো পুরো গ্রাম জুড়ে। গ্রামের আনাচে-কানাচে বৃষ্টির ঝুমঝুম ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে। সবাই বৃষ্টির আমেজ দেখে বিকেলের জন্য গরম লুচি ভাজতে বসেছে। মারজা ছেলের জন্য কফি বানিয়ে রুমে মাহদির হাতে পাঠিয়ে দিলেন। মাহতিমের দরজায় কড়া নেড়ে কফি হাতে ঢুকলো মাহদি। মাহতিম জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাহদির দিকে তাকালো। ডানহাতের জায়গায় ইচ্ছে করে বাঁ হাত এগিয়ে মগ ধরতে চাইলো, কিন্তু মাহদি ব্যাপারটা দেখে ভীষণ কুঁচকে মগ না দিয়ে বললো,
– কোনো জিনিস যে ডানহাতে ধরতে হয়, সেটা জানোনা? ডানহাত বাড়াও ভাইয়া, নাহলে আমি কফির মগ দিবো না।
মাহদির সুক্ষ্ম শাষন দেখে দুই গালে ভাঁজ ফেলে মাহতিম হেসে দিলো। জানালা থেকে সরে এসে মাহদির সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। পকেট থেকে ডানহাতটা বের করলেও সেটা নিচু করে রাখলো। বাঁহাতটা মাহদির কাধে তুলে দিয়ে বললো,
– বেশি বড় সাজা হচ্ছে তাইনা? ডানহাত ব্যথা এজন্য বাঁহাত বাড়িয়েছি। দে মগটা দে, বৃষ্টিটা দেখতে-দেখতে কফিটা এনজয় করি।
মাহদি কোনো কথা শুনলো না, সে ভাবলো মাহতিম হয়তো ব্যথার কথাটা মিথ্যা বলেছে।তাই রাগত সুরেই মাহতিমের উদ্দেশ্যে বললো,
– তুমি আমার সাথে চেকমেট করতে পারবে না ভাইয়া। আমি তোমার চালাকি ধরে ফেলেছি, তুমি যে মিথ্যা বলছো আমি সেটি বুঝেছি।
মাহতিম বাঁকা হেসে বললো,
– তাই? তুই এতো বুঝিস? চ-ড় খেতে-খেতে সব বুঝে গেলি নাকি?
মাহতিমের কথায় এবার সত্যিই রেগে গেলো মাহদি। কাধ থেকে ঝটাং করে ওর হাত সরিয়ে কফির মগটা টেবিলের উপর রেখে আসলো। বুকের কাছে দুহাত ভাঁজ করে এটিটিউট দেখিয়ে বললো,
– আমি এখন ফিডার চোষা বাচ্চা না, আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি। কয়দিন পর তোমার মতোই বন্দুক চালিয়ে সবাইকে ঢিসুম-ঢিসুম করে দিবো।
ওর বাচ্চাসুলভ কথা শুনে হো-হো করে হেসে দিলো মাহতিম। হাসতে-হাসতেই মাহদির কাধটা ধরে কাছে টেনে বললো,
– এই কথা বাইরে ফাঁস করিস না ব্যাটা।কফিটা নিয়ে আয়। আর আপডেট গুলো বল, সকালে তো শুনতে পারিনি। বাকি আপডেট গুলো দে, এখন একটু শুনি।
মাহদি আবারও কাধ ঝারা মেরে মাহতিমের হাতটা সরিয়ে ফেললো। এক পা পিছিয়ে গম্ভীরভাবে বললো,
– মিস্টার মাহতিম আনসারী, সন অফ আব্দুল মেহেদি আনসারী, ব্রাদার অফ মাহদি আনসারী —
কথাটুকু বলতেই মাহদির কথা আটকে গেলো। এরপর আর কার কার পরিচয় ঠেলেঠুলে ঢুকানো যায় সেটা নিয়ে চিন্তায় পরে গেলো ও। মূল কথা ছিটকে যাওয়ার দৃশ্য দেখে ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো মাহতিম। কোনোরকমে হাসি আটকে চিন্তিত মাহদির উদ্দেশ্যে বললো,
– আরো বল, থামলি কেন? পুরো চৌদ্দগোষ্ঠীর নাম আমার নামের পিছনে লাগিয়ে দে, আয়।
মাহদি এবার বিরক্ত হয়ে গজগজ করে বললো,
– ভাইয়া তুমি প্লিজ বলবে, তোমার রাইট হাতে কি হয়েছে? এটা বললেই তো শেষ। আমিতো আর কিছু জানতে চাইনি।
মাহদির মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো মাহতিম। এরপর ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে ডানহাতের দিকে এক নজর তাকালো, তাকিয়েই মাহদির দিকে দৃষ্টি দিয়ে হাসিমুখে বললো,
– কিছুই হয়নি রে পাগল। এমনেই বাঁহাত বাড়িয়েছি। মাঝে-মাঝে একটু গুনাহ করলে তো সমস্যা হবেনা। কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, প্লিজ দিয়ে যা।
মাহদি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সোজা কফি এনে দিলো। ফ্লোর থেকে হাটু তুলে মাহতিম দাঁড়িয়ে পরলো। জানালার দিকে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরতে নিলে সেই সুযোগে ডানহাতটা টান মেরে তৎক্ষণাৎ চোখ বুলালো মাহদি। এমন ঘটনার আকস্মিকতায় ব্যালেন্স হারিয়ে কফিতে চুমুক দেওয়ার বদলে একটুখানি কফি ফ্লোরে ফেলে দিলো মাহতিম। সে মাথা ঘুরিয়ে মাহদির দিকে তাকালে কথা বলার জন্য বাক্য হারিয়ে ফেললো। মাহদি ততক্ষণে ওর হাত দেখে মাহতিমের দিকে ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। ছোট-ছোট হাতদুটো মাহতিমের হাতটা খুবই আলতোভাবে ছেড়ে দিলো। বাকরুদ্ধ হয়ে চুপচাপ বিমর্ষ ভঙ্গিতে চলে যেতে লাগলো। মাহদির উদাস মুখটা দেখে পিছু ডেকে উঠলেও ভাইয়ের ডাকে সাড়া না দিলো না। মাহদি রুম থেকে বেরিয়ে যেতে থাকলে মাহতিম জোর গলায় বলে উঠলো,
– তুই এই ম্যাটারে কাউকে কিছু বললে তোর পিঠের ছাল উঠিয়ে দিবো। কাউকে কিছু বলবি না। কিরে বা-চাল? শুনেছিস?
আর কোনো উত্তর এলো না। বিমর্ষ মুখটা ভার করেই চলে গেলো মাহদি। কফির মগটা নিয়ে কিছুক্ষণ কফির দিকে তাকিয়ে রইলো, ডানহাতটা চোখের সামনে উঠিয়েও দেখলো। কিন্তু এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলো না। কফির মগে ঠোঁট বসিয়ে জানালার কাছে গেলো। বৃষ্টির প্রবলতার জন্য দূরের সব দৃশ্যই এখন অদৃশ্য হয়ে আছে। আকাশটাও সন্ধ্যার মতো কালো করে এসেছে। গাছপালা যেনো বৃষ্টির পানিতে ধূলো ঝেরে পবিত্র হয়ে উঠছে। বৃষ্টির ঠান্ডা পানি ছোঁয়ার জন্য জানালা বাইরে হাত বাড়ালো মাহতিম। ঝর্ণার মতো চাল চুয়ে-চুয়ে পরা পানি ওর হাতের তালুতে পরতে লাগলো। কফির উষ্ণতা উপভোগের সাথে বৃষ্টির শীতলতায় সমস্ত দেহ চনমনিয়ে উঠলো। মনে-মনে সুর ধরলো, মন বাড়িয়ে ছুঁই আমি, হাত বাড়িয়ে নয়। দূরে যাওয়ার চিন্তা করলে কেনো লাগে ভয়?
.
দুপুরের খাবারটা খায়নি মাহতিম। রাতের খাবারটাও খায়নি। দুপুরের খাবারটা হোটেলের নাম বলে কাটিয়ে দিলেও রাতের খাবারের সময় নিচে যায়নি। মারজা খাবারের জন্য তোষামোদ করে গেলেও মাহতিম প্লেট আর নেয়নি। মায়ের হাতে খাওয়াও প্রায় ছয় বছর আগে ছেড়ে দিয়েছে, এমতাবস্থায় আজ যদি খাইয়ে দেওয়ার কথা বলে তাহলে নির্ঘাত মারজার কাছে ধরা খাবে। বিকেলের ঝুম বৃষ্টিটা এখনো থেমে-থেমে হচ্ছে। সন্ধ্যার একটু পরে বৃষ্টি কমলেও খাবারের পর থেকে তুমুল আকারে বেড়ে গিয়েছে। গ্রামে বৃষ্টি হলেই দারুণ ঠাণ্ডাভাব আচ্ছন্ন করে। সবার ঘরেই এক্সট্রা করে মোটা কাথা অথবা কম্বল দেওয়া হয়েছে। মাহতিম কম্বলটা একহাতে খুলে বিছানায় পেড়ে নিলো, গায়ের টিশার্টটা খুলে কম্বলের নিচে ঢুকে পরলো। লাইটটা বহু আগেই নিভিয়েছিলো, তাই স্বল্প আলোর জন্য জানালাটা একটু খুলে দিলো। বৃষ্টির ছাট আসলে আসুক, আজ একটু ভিজলে কোনো সমস্যা হবেনা। বালিশের নিচ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলো মাহতিম। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো আজও শুতে-শুতে যথেষ্ট লেট হয়ে গেছে। দশটা যেহেতু বাজে তার মানে গ্রামের সময় মতে এখন গভীর রাত শুরু হয়েছে। সবাই গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে। মাহতিম ফোনের গুগল ডকে ঢুকলো। প্রতিদিনকার ঘটনা সে গুগল ডকে লিপিবদ্ধ করার দারুণ অভ্যাস করেছে। বামহাতের থাম্বনেলেই চমৎকার স্পিডে টাইপ পারে সে। কির্বোডের উপর বৃদ্ধাঙ্গুল চালাতেই একেকটা শব্দ মিলে বাক্য জুড়ে ঘটনা লিখতে লাগলো,
মাহতিম আনসারী,
ছুটির নবম দিন।
গ্রামটা খুব সুন্দর। কয়েকটা নতুন স্পটেও ঘুরে এলাম। বদ্ধ জীবনে থাকতে-থাকতে ঘুরাঘুরির মানসিকতা আমার তৈরি হয়নি। আজকের দিনটা সাধারণভাবে শুরু হলেও শেষটা সুন্দর একটা স্মৃতি হিসেবে যুক্ত হলো। মেহনূর নামের মেয়েটা আবারও আমার সামনে বেশ অদ্ভুতভাবে পরে গেলো। মেয়েটা কোনোদিন স্বাভাবিক ভাবে থাকেনা। আমাকে দেখলেই মারাত্মক ভয় পায়। এমন একটা ব্যবহার করে যেনো আমি ওকে খেয়েই ফেলবো। মাঝে-মাঝে ওর অবস্থা দেখে চিন্তা করি, আচ্ছা আমি কি গুড লুকিং নই? কেননা, সৌভিকের স্টেটমেন্ট মতে আমার পিছনে যত মেয়ে ঘুরেছে তাদের লিস্ট করতেও নাকি কমপক্ষে একমাস লাগবে। আমি কথাটা মোটেও অহংকার থেকে বলছিনা, আমি এ বিষয়টা নিয়ে কখনো দাম্ভিকতা প্রকাশ করিনা। সবসময় নিজের মধ্যে থাকাটাই আমি ছোট থেকে শিখেছি। বাবা আমাকে যেভাবে গাইড করেছে, যেভাবে বুঝিয়েছে, আমি ছোট থেকে নিজেকে ওভাবেই সাজিয়েছি। কখনো নরম, কখনো শক্ত, কিন্তু পরিবারের জন্য সর্বদা হাসিখুশি থাকাটাই বেষ্ট মনে করি। আমার বন্ধু, আমার ভাইবোন, আমার মা, আমার পরিবার, সবাই আমার দেহের একেকটা অঙ্গের মতো। দেহের একটা অঙ্গে যখন সুঁই ফুটে, তখন কিন্তু সমস্ত দেহ-ই যেন যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। আজ বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে, প্রকৃতির পবিত্রময় পিসফুল বৃষ্টি। আমার আত্মার সাথে এই বৃষ্টির একটা গভীর কানেকশন আছে। মায়ের কাছে শুনেছি, এমনই একটা দিনে আমি হয়েছিলাম, যেদিন বাইরে ঝড়োবৃষ্টি ছিলো, মা ব্যথায় বারবার বাবার হাত খাবলে ধরেছিলো। বাবা নাকি টেনশনে মুখচোখ লাল করে ছটফট করছিলো। এখন এসব ঘটনা চিন্তা করলে হাসি পায়, তবে আজও আমি ডায়েরীর পাতাগুলো পড়ি। কতো সুন্দর একটা সম্পর্ক হলে বাবা সেই দূর থেকে মায়ের জন্য চিঠি পাঠাতো। সেই চিঠির উপরে আদর মাখিয়ে লিখতো ‘ চুম্বন প্রিয়তমা ওই আদুরে মিষ্টি ঠোঁটে ‘। বাবার সব জিনিস আমার দখলে থাকায় তার সব চিঠিগুলো পড়া শেষ। বাবার মধ্যে যে কতখানি ভালোবাসা ছিলো, সেটা মনে হলে গর্বে বুকখানি ভরে আসে। চোখ ছলছল করে আসতে চায়। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে নাকি পাগলের মতো চুমু খেয়েছিলো, এ সব কথা বাবা তার পার্সনাল ডায়েরীতে লিখে রেখেছে। আমার জানামতে, বাবার কাছে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি আদরের শিশু হয়। সেখানে আমি যে ওরকম আদর-স্নেহ পেয়েছি, সেটা ভাবতেও কেমন অদ্ভুত ভালো লাগে। আমার ছুটির দিনগুলি পেরিয়ে যাচ্ছে, জানিনা আবার কবে ফিরে আসবো। আবার কবে সবার সাথে আনন্দে দিন কাটাবো। কোনোকিছুই আমার জন্য জানা নেই। হাতে মাত্র পাঁচ দিন বাকি, এরপর সব গুছিয়ে পূর্বের জায়গায় ফিরে যেতে হবে। পিছুটান কমিয়ে আবার সেখানে থাকার মতো শক্ত মানসিকতা করতে হবে। আর কতো সহ্য? ভালো লাগেনা এখন।
মোল্লাবাড়ি,
বৃষ্টি রাত।
গুগল ডকের অপশনটা বন্ধ করে মোবাইলের মেইলগুলো চেক করছিলো মাহতিম। এক-এক করে সবগুলো মেইল চেক করতেই হঠাৎ খুট করে দরজার কাছে শব্দ হলো। মাহতিম এমন অদ্ভুতকাণ্ডে কখনোই ঘাবড়ায় না। তাই সেও চালাকি করে ফোন রেখে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরলো। দেহের সকল ইন্দ্রীয় সজাগ রেখে শব্দটার দিকে কান খোলা রাখলো। শব্দটা প্রথমে দরজা খোলার মতো হলো, এরপর আস্তে-আস্তে সেটা বন্ধ করার মতোও শব্দ পাওয়া গেলো। কিন্তু মাহতিম চোখ খুলে দেখার চেষ্টা তখনও জারি করলো না। সেও দেখতে চায় ওর রুমে কে এইমূহুর্তে চুপিচুপি ঢুকে পরেছে। পায়ের আওয়াজও বৃষ্টির জন্য ঠিকমতো শোনা যাচ্ছেনা, নাহলে অন্তত এটুকু বুঝতে পারতো কে এসেছে এখন। কিছুক্ষণ পর মনেহলো রুমের মধ্যে হয়তো কেউ নেই, কারণ কোনোকিছুই তখন টের পাওয়া যাচ্ছিলো না। চোখ খুলবে নাকি চিন্তা করতে-করতেই আচমকা মনেহলো কেউ পাশে এসে বিছানায় বসেছে। খুবই সাবধানে সর্তক কায়দায় ওর গা থেকে কম্বল সরাচ্ছে। মাহতিম চোখ বন্ধ করে শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, কম্বল উঠানোর পর কি করে সেটা বুঝার পরপরই দারুণ এ্যাকশন নিবে। সে এটা ভালো করেই জানে, হিউম্যান বডির ঘাড়ের কাছে বিশেষ এক জায়গায় জোরে মারলে একটা মানুষ অকাতরে ম-রে যেতে পারে। কম্বলটা উঠানোর পর মনেহচ্ছে সে ডানহাতটা টেনে নিচ্ছে। ডানহাতটা কেনো টানছে? কে এই ব্যক্তি? অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় জট পাকাতেই চট করে চোখ খুলে ফেললো মাহতিম! সামনে বসা মানুষটিকে দেখে প্রচণ্ড আশ্চর্য হয়ে ‘ তুমি ‘ বলে চেঁচাবে, ওমনেই মুখ চেপে ধরলো মাহতিমের!
#চলবে
#FABIYAH_MOMO