মন_বাড়িয়ে_ছুঁই #পর্বসংখ্যা_০২. #ফাবিয়াহ্_মমো.

0
2405

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
#পর্বসংখ্যা_০২.
#ফাবিয়াহ্_মমো.

বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে রুমে ফিরলো মাহতিম। রাগে-ক্ষোভে-বিরক্তিতে কালো শার্টটা টেনেটুনে যেই খুলবে ওমনেই দরজায় কে যেন টোকা মেরে দৌড়ে পালালো। মাহতিম ওই অবস্থায় দ্রুত শার্টের বোতাম লাগিয়ে তৎক্ষণাৎ দৌড়ে গিয়ে দরজার বাইরে মুখ দিলো। কিন্তু আজব ব্যাপার, বাইরে কেউ নেই! প্রচণ্ড আশ্চর্য হতে গিয়ে ক্ষেপে উঠলো মাহতিম! গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ডাকলো,

– সৌভিক! সিয়াম! তৌফ! এক্ষুনি আমার রুমে আয়! সৌভিক, তুই কি শুনতে পাচ্ছিস?

কথা শেষ হতে দেরি সবকটা রুম থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো কাজিন ও বন্ধুরা। সৌভিক দৌড়ে এসে মাহতিমের রুমে ঢুকলে একে-একে সবাই চলে এলো ওরা। মাহতিম তখন শার্টের বোতাম খুলতে ব্যস্ত। চোখে মুখে বেজায় রাগ ফুটিয়ে ক্রুদ্ধসুরে বললো,

– তোদের মধ্যে কেউ কি আমার সাথে ফাজলামি করছিস? যদি করে থাকিস এক্কেবারে খুন করে ফেলবো বলে দিলাম!এখনো সময় আছে ফটাফট বল, কে করেছিস এই কাজ?

প্রচণ্ড অবাক হয়ে একে-অপরের দিকে বিষ্ময়দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো সবাই। পরক্ষনে সবাই সমস্বরে জবাব দিলো, অসম্ভব! আমরা কি করেছি? মাহতিম সে কথার উত্তর না দিয়ে শার্টটা খুলে বিছানায় ছুঁড়ে ফেললো। খালি গায়ে বিছানায় বসে একে-একে সকলের দিকে ক্ষীপ্র দৃষ্টি ছুঁড়ে কোমর থেকে বেল্ট খুলে হাতে পেঁচাতে লাগলো। পেঁচাতেই গমগম গলায় বললো,

– একটু আগে দরজায় কে নক করেছে? আমি যে রুমে প্রাইভেসি মেনটেইন করি সেটা কি পিটিয়ে স্মরণ করাবো? তাড়াতাড়ি বল কে করছিস!

সবার মুখ নিষ্প্রভ ভঙ্গিতে কাঁচুমাচু করছে। মাহতিম এখানে আসার পর থেকেই ভয়ানক রাগ দেখাচ্ছে। যেখানে ওর মধ্যে তো রাগের কোনো চিহ্ন-ই ছিলো না, সর্বদা হাসিখুশী ও ফাজলামি করাটা যার পছন্দ, সেই ব্যক্তি এমন শক্ত আচরণ করছে এটা মানা খুব কষ্টকর। সৌভিক নিরবতা চ্ছিন্ন করে মাহতিমের পাশে এসে বিছানায় বসে বললো,

– শালা, কি কারনে রাগটা দেখাচ্ছিস বলতো? তুইতো এমন রাগ দেখানোর বান্দা না। এইখানে আসার পরপরই তুই জোয়ালামুখী বারুদ হয়ে বসে আছিস, ব্যাপার কি বলতো?

মাহতিম রাগীদৃষ্টিতে সৌভিকের দিকে তাকালো। ওই দৃষ্টিতেই ক্ষুদ্ধস্বরে দাঁত চিবিয়ে বললো,

– একটা রেসোর্ট বুক করলে কি হতো? মা এমন নষ্টালজিক প্লেসে আনবে কল্পনাও করিনি। আমি বারবার না করেছি ঘুরার জন্য কোনো গ্রামের কথা তুলবেনা। আমার গ্রাম পছন্দ না। সেই জায়গায় আমাকে গ্রামে এনে ছেড়ে দিলো! আমি কালই এখান থেকে চলে যাবো। নো ম্যাটার হোয়াট, আই ওয়ান্ট টু গো!

মাহতিমের তেজালো কথা শুনে সৌভিক নিরুত্তর বসে থাকলো। আগুনে ঘি ঢাললে ভয়ানক কারবার হবে ভেবে চুপ রইলো। এর মধ্যে চাচাতো বোন ফারিন অপ্রসন্ন কন্ঠে বললো,

– মাহতিম ভাই, তুমি কেনো আনইজি ফিল করছো বলবে? দুপুর থেকেই দেখছি তুমি গোমড়া মুখে রাগারাগী করছো। কেনো করছো ভাই? কেউ কি কিছু বলেছে?

এবার ফারিনের প্রশ্নে ফুপাতো বোন নীতিও যুক্ত হলো। অনুযোগের সুরে বললো,

– ভাই তুমি সত্যি কিছু লুকাচ্ছো। এটা আমিও দেখেছি। খাবার টেবিলে বসেও তুমি ঠিকমতো খাওনি। ভাইয়া, কি হয়েছে তোমার? আমাদের কাছে খুলে বলোতো?

মাহতিম দৃষ্টি নত করে ফ্লোরে তাকিয়ে রইলো। উত্তর না পেয়ে চাচাতো ভাই সাবির শান্তসুরে বললো,

– তুমি কি এ বাড়ির মেয়েদের জন্য অড ফিল করছো?

প্রশ্ন ছুড়তেই একজোড়া চোখ সাবিরের দিকে ভয়ংকর ভাবে পরলো। সাবির এতোটা বিব্রত কখনো হয়নি। সে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে কন্ঠ নিচু করে বললো,

– আই এম সরি মাহতিম ভাই। বাট, আমার মনে হচ্ছিলো মেবি তুমি মেয়েদের জন্য সাফোক্যাট ফিল করছো।

সাবিরের ম্লান মুখটা দেখে মেজাজটা শান্ত করলো মাহতিম। শক্ত বাক্য বলার জন্য ঠোঁট খুললে সেটা দ্রুত সামলে নিয়ে ধাতস্থ সুরে বললো,

– এ বাড়ির ছোট মেয়েটা জাস্ট বেহায়া! খাবার টেবিলে বসেও আমি শান্তি পাইনি। একটু পরপর আমার গা ঘেঁষা দিয়ে চলে যায়। এতো ছ্যাঁচড়া একটা মেয়ে হয়? ওই মেয়ে কি জানে আমি ওর কতো বড়? এইভাবে আমার সাথে ঘেঁষাঘেঁষির মানে কি? আমাকে দেখলেই বিনা কারণে হিহি করে হাসতে থাকে। মেজাজটা খারাপ হয়ে আছে ওই বুলশিটের জন্য! আমি এখানে থাকবো না ব্যস।

রাগের সঙ্গে তেজ মিশিয়ে কথাটুকু শেষ করলো মাহতিম। হাতে পেচানো বেল্টটা ঠিকঠাক মতো বিছানায় চাকতির মতো করে রাখলো। তেজালো সুরেই নীতির উদ্দেশ্যে শক্ত কন্ঠে বললো,
– লাগেজ থেকে আমার টিশার্টটা দে নীতি। আর লেফট সাইডে ট্রাউজার পাবি।

নীতি বড় ভাইয়ের আদেশমতো কাজ করতে থাকলে বাকিরা নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাইয়ি করতে থাকে। ইশারায় কিছু কথোপকথন সেরে মাহতিমের দিকে দৃষ্টি দিলো সবাই। তৌফ বুক ফুলিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো,

– দোস্ত বিলিভ মি, তুই একা এইখানে ভিক্টিম না। আমিও ফাঁসছি। ছোট মেয়েটা আস্তা একটা শয়তান! কানের নিচে থাপড়াইতে ইচ্ছা করছে আমার! আব্বুকে ইনফর্ম করতে জানালার কাছে গেছি, ওমনেই পিছন থেকে ঘ্যাটঘ্যাট করে হাসতেছে। মাইরি কি জঘন্য হাসি! আরেকবার সামনে পাইলে রে,দেখিস চুল ছিড়া কি করি!

তৌফের উত্তেজিত অবস্থার মধ্যে প্রীতি কপাল কুচকে প্রচণ্ড আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকালো। ততক্ষণে নীতির দেওয়া সাদা টিশার্ট মাহতিম পরছিলো। প্রীতি নিজের বিষ্ময় উগরে তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,

– তোমরা কি যা-তা বলছো ভাই! ‘ ছোট মেয়ে-ছোট মেয়ে ‘ যে করছো, ওকে কি তোমরা চিনো? ওকে কি দেখেছো? ওকে দেখলে তোমরা স্বপ্নেও এই কথা তুলতে পারতা না। তোমরা যার কথা বলছো সে মেবি মেজোটা। মেজোটা হাড়ে-হাড়ে ফাজিল! ও-ই তোমাদের সাথে ইয়ার্কি করতেছে।

প্রীতির কথায় সায় জানিয়ে শেষে ফারিন-নীতিও যুক্ত হলো। ফারিন বিরক্তির সুরে বললো,

– আমিও প্রীতির কথায় একমত ভাইয়া। এই বাড়িতে চারটা মেয়ে আছে। বড়োটা শানাজ, মেজোটার নাম সুরাইয়া, সেজোটা সম্ভবত সাবা, ছোটটার নাম মেহনূর। তুমি কি মেহনূরকে দেখেছো? আচ্ছা মেহনূর দেখতে কেমন বলোতো?

মাহতিম ফট করে উত্তরের জন্য ঠোঁট খুলে বললো,
– আমি নাম-ধাম জানিনা। লাল শাড়ি পরাছিলো, কপালে খাচ্চরের মতো বড় টিপ দেয়া, আর চোখটা মেবি বড়। গায়ের রঙটা সম্ভবত প্রীতির মতোই, বাট ওই মেয়েরটা আরো চাপা।

ভাইয়ের মুখে এমন উটকো বর্ণনা শুনে ফারিন ও নীতি মৃদ্যু ভঙ্গিতে হেসে ফেললো। প্রীতি তাদের স্বল্প হাসিতে যুক্ত হয়ে সরল কন্ঠে বললো,

– ভাইয়া মেহনূর তোমার চেয়েও ফর্সা।সাহিত্যের ভাষায় ওর ডাগর-ডাগর চোখ। কপালে টিপ তো দূরে থাক, মুখে সামান্য কেমিকেল পযর্ন্ত মাখেনা। ওর পড়নে হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি ছিলো। আর তুমি যার বর্ণনা দিছো ওইটা সুরাইয়া, দ্যা ফাজিলের হাড্ডি! মেহনূর তো কতো শান্ত, একদম লক্ষ্মী একটা মেয়ে। ও তো তোমাদের সামনেই আসবেনা। তুমি জানো মাহদি সারাক্ষন মেহনূরের কাছে থাকে।

শক্ত মুখে কিছুক্ষণ নিরব থেকে সরু চোখ তাকালো মাহতিম। গলাটা শান্ত করে জিজ্ঞেস করলো?

– বয়স কতো ওই মেয়ের? তোর চেয়ে ছোট না?

প্রীতি হো হো করে হেসে দিয়ে বললো,

– ভাইয়া ওই মেয়ে ফারিনের চেয়েও ছোট। আমি যদিও অনার্স কমপ্লিট করে ফেলেছি, কিন্তু মেহনূর সেই তুলনায় একদমই ছোটমানুষ।

প্রীতির কথা টান মেরে এবার ফারিন বলে উঠলো,

– জানো ভাই, এ বাড়ির রুলসগুলো বড় অদ্ভুত। এখানে ছোট-বড় সব মেয়েদের শাড়ি পরা লাগে। মেহনূর যে এতো ছোট সেটা কিন্তু শাড়ির জন্যই বোঝা যায়না। তবে একটা জিনিস সত্যি, মেহনূর মেয়েটা খুব মিষ্টি।

মাহতিম ওদের অযথা বকবক শুনে চাপা বিরক্তিতে মুষড়ে পরছিলো। এসব বেহুদা প্যাচাল আর শুনতে না চেয়ে সোজাসুজি ওদের চলে যেতে বললো। নীতি, প্রীতি, ফারিন-সহ চুপচাপ সবাই রুম থেকে চলে গেলো। দরজায় ছিটকিনি তুলে জানালায় পর্দা টেনে বিছানায় শুলো মাহতিম। মাথার নিচে ডানহাতের তালু ঢুকিয়ে দৃষ্টি সরাসরি ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দিকে স্থির করে ভাবতে লাগলো। এ বাড়িটা হান্নান শেখের। হান্নান শেখ নানাভাইয়ের বন্ধু। নানাভাই এখন আর বেচে নেই, তিনি মারা গিয়েছেন অনেক বছর আগে। হান্নান শেখের কোনো মেয়ে না থাকায় তিনি মারজাকে প্রচুর আদর করতেন। নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন, এজন্যই নিজের বাবাকে ‘ বাবা ‘, আর হান্নান শেখকে ‘ বাবামশাই ‘ বলে ডাকতেন মারজা। কিন্তু বিয়ের পরপরই যোগাযোগ কমে যায় বাবামশাইয়ের সাথে। মাহতিম দুনিয়ায় আসার পর থেকে সাংসারিক চাপে ন্যস্ত হয়ে পরে। যোগাযোগ ক্ষুণ্ণ হয়ে যায় তাঁদের সাথে। মাহতিম ছোট থেকেই গ্রাম অপছন্দ করতো, গ্রামের সৌন্দর্য্য সম্পর্কে রুচি কম ছিলো। কিন্তু মারজা অনেকটা জেদ দেখিয়ে গ্রামে এনেই ছাড়লেন। হায়াত-মউতের কথা চিন্তা করে হান্নান শেখের সাথে সময় কাটাতে এলেন। মায়ের আদেশ অমান্য করার স্পর্ধা দেখাতে পারেনি মাহতিম,চুপ করে নতমুখে সবকিছু মেনে নিয়েছে। কিন্তু এ বাড়ির মেজো মেয়েটার উগ্র আচরণে প্রচণ্ড গা জ্বালাতন করছে। এমনেই মেয়েগুলো বয়সে খুব ছোট, তবুও সুরাইয়ার আচরণ একটু বেশি জঘন্য। কাল যদি উটকো কিছু করার চিন্তায় থাকে, ঠাস করে দুই গাল রাঙিয়ে আঙ্গুলের ছাপ বসিয়ে দিবে মাহতিম। মনেমনে তীব্র সংকল্প করে ঘুমিয়ে পরলো সে। রাতটা পরম শান্তি, পরম ঠান্ডা, পরম আবেশীভূত অবস্থায় কাটলো ওর।

.

ভোর পাচঁটা না বাজতেই ফোনের এলার্মটা বাজতে লাগলো। ঘুমের আড়ম্বর ভেঙ্গে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো মাহতিম। এলার্মটা বন্ধ করে ট্রাউজারের পকেটে সেটা ঢুকিয়ে দরজা খুলে চুপচাপ বাইরে পা দিলো। ওর রুমটা বারান্দার শেষপ্রান্তে ছিলো বলে লম্বা বারান্দা হেঁটে আসতে হলো। আসতে-আসতেই বারান্দার নিচে দৃষ্টি ফেলে দেখলো, বাড়ির মহিলারা জেগে উঠেছে। মাহতিম সিড়ি ধরে নিচে নামলে বড় বৌ সুজলা এগিয়ে আসলেন, ঝলমলে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,

– তুমি দেখি খুব তাড়াতাড়ি উঠো মাহতিম।অথচ তোমার মা এখনো উঠেনি। রাতে তোমার ঘুম হয়েছেতো বাবা? দেখো বাবা, মিথ্যা বলোনা। কষ্ট হলে সব বলবে, কেমন?

মাহতিম সহজ হাসিতে জবাব দিলো,

– জ্বী, আন্টি অবশ্যই বলবো। আমার ভালো ঘুম হয়েছে। তাছাড়া ভোর-সকালে উঠাটা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। এই অভ্যাসটা মা করতে পারেনি। এজন্য ঘুমিয়ে আছেন।

উত্তর শুনে মিষ্টি করে হেসে দিলেন সুজলা। হান্নান শেখের মরহুম বড়ছেলের স্ত্রী উনি। শ্বাশুড়ি মারা যাওয়ার পর থেকেই তিনি দুহাতে নিপুণভাবে সংসার সামলাচ্ছেন। মাহতিমকে হাতমুখ ধোয়ার জন্য কলপাড়ে নিয়ে গেলেন এবং বালতিতে মগ ডুবিয়ে সেটা মাহতিমের দিকে এগিয়ে বললেন,

– মুখ ধোও বাবা, আমি তোমার জন্য তোলা গামছা নিয়ে আসি।

মাহতিম মগটা নিয়ে দ্রুত হাতমুখ ধুয়ে ফেললো। পুরোপুরি ফ্রেশ হলে সুজলার দেওয়া গামছায় হাতমুখ মুছে সেটা ফেরত দিলো। সুজলা ভেজা গামছা নিয়ে চলে গেলে মাহতিম বাড়ির ভেতর ঢুকে ঘুরে-ঘুরে সবকিছু দেখতে লাগলো। বাড়িটা বেশ পুরোনো হলেও বেশ সুন্দর। দোতলা বাড়ির ঠিক মাঝখানে আঙিনা। আঙিনার উভয়প্রান্তে দোতলা থেকে নামার জন্য দুটো সিড়ি আছে। দক্ষিণ দিকের সাইডটায় বাড়ির মেয়েরা থাকে। উত্তর দিকের সাইডটায় থাকছে কুটুম অর্থাৎ অতিথি। মাহতিম নিজের রুমে আসতেই জানালার পর্দা সরিয়ে আলোচিত করে দিলো। পকেটে দুহাত গুঁজিয়ে আকাশে দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইলো। স্নিগ্ধ সকালের ঠান্ডা হাওয়ায় মাহতিমের মন-মাতাল হচ্ছিলো। হঠাৎ কিছুটা দূরে অবস্থিত একটা বাংলাঘরের দিকে দৃষ্টি আটকালে, কপাল কুঁচকে এলো ওর। সেই বাংলাঘরটা টিনের ছিলো এবং জানালাও ছিলো মস্ত বড়। জানালার ডানদিকটায় হেলান দিয়ে গোলাপী শাড়ি পড়ুয়া একটি মেয়ে কি যেনো করছিলো। মাহতিম ওই সামান্যতম দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড কৌতুহলে চনমনিয়ে উঠলো। সে দেখলো মেয়েটার হাতে বই এবং মুখের উপর চুল আছড়ে পরছিলো। ব্লাউজের রঙ রাণী কালারের এবং হাতা একদম কনুই পযর্ন্ত। চুলের বহর এতো দীর্ঘ ছিলো যেটা সম্পূর্ণ চোখ ধাঁধানো। এতো দীর্ঘ কেশের মেয়ে মাহতিম কোনোদিন দেখেনি। চোখ দিয়ে এ্যানালাইসিস করে অনুমান করলো মেয়েটার চুল কমপক্ষে হাঁটু পযর্ন্ত। কিন্তু ফেসটা একদমই দেখা যাচ্ছেনা, বাতাসের জন্য চুলরা যেনো বেহায়ার মতো উড়ছে। ওই বাংলাঘরের জানালার দিকে মাহতিম কতোক্ষন তাকিয়ে ছিলো জানা নেই, পেছন থেকে মাহদির ‘ ভাইয়া ‘ বলে ডাক দিতেই সৎবিৎ ফিরে পেলো মাহতিম। মৃদ্যু ভঙ্গিতে চমকে উঠতেই মাথা পিছনে ঘুরিয়ে দেখলো ছোট ভাই মাহদি থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট ও পলো শার্ট পরে দাড়িয়ে আছে। মাহতিম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,

– রাতে কোথায় ছিলি? কার কাছে ঘুমিয়েছিস?

মাহদি চুপচাপ বিছানায় বসে বললো,

– আপুর কাছে।

মাহতিম জানালায় আরেকবার তাকিয়ে মাহদির দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,

– কোন আপু?

মাহতিম প্রশ্ন করছিলো ঠিকই, কিন্তু দৃষ্টি বারবার জানালার বাইরে ছুটে যাচ্ছিলো। অজানা, অচেনা মেয়েটার মুখ দেখার জন্য মন প্রচণ্ডরূপে আনচান করছিলো। মাহদি ব্যাপারটা লক্ষ করতেই তড়িৎগতিতে দৌড়ে এসে মাহতিমের পাশে এসে দাড়ালো। মাহতিমের দৃষ্টি লক্ষ করে যেই বাইরে তাকালো, ওমনেই মাহদির ঠোঁটে হাসি ছলকে আসলো। খুশিতে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলে উঠলো,

– এটাতো মেহনূর আপু! আপু এখানে? আর আমি আপুকে কতো জায়গায় খুজে আসলাম। আচ্ছা ভাইয়া থাকো, আমি যাই।

বলতে দেরি, ওমনেই অস্থির হয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় মাহদি, কিন্তু পেছন থেকে হাত টান লাগলে থমকে যায় সে। মাথা ঘুরিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে মাহতিম হাত টেনে ধরে আছে। অন্যহাতটা তখনো পকেটে গুঁজানো মাহতিমের, চোখে শক্ত দৃষ্টি দেখা যাচ্ছে। মাহদি ছোট্ট একটা ঢোক গিলে ভীতু চাহনিতে ভাইয়ের দিকে কম্পিত সুরে বললো,

– ভা-ভা-ভাইয়া, তু-তুমি হা-হা-ত ধরলে কেন?

মাহতিম শূন্য উত্তরে কাঠ হয়ে রইলো। সে চোখ রাঙিয়ে তাকালে তের বছর বয়সী মাহদি মারাত্মক ভয় পেয়ে যায়। ভয়ার্ত কন্ঠে বলতে থাকে,

– ভাইয়া মেরো না, আমাকে মেরো না, হাত ছাড়ো ভাইয়া।

মাহদির অবস্থা এমন দেখে ও রাগ কি করবে, উল্টো পেট ফাটা হাসি পাচ্ছিলো মাহতিমের। কোনোরকমে হাসি আটকে কাঠিন্য মুখ করে বললো,

– এই মেয়েটা টিনের ঘরে কি করে?

মাহতিমের ওমন শক্ত কন্ঠ শুনে ঠোঁট ভিজিয়ে ঢোক গিললত মাহদি। চোখ নিচু করে ভীত স্বরে বললো,

– আপু অনেক বই পড়ে ভাইয়া। আপুর কাছে প্রচুর বই আছে।

উত্তর শুনে কপালটা ভাঁজযুক্ত হলো মাহতিমের। সে আবার জানালার বাইরে দৃষ্টি দিয়ে দেখলো মেহনূর একই ভঙ্গিতে বই পড়ছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে মাহদিকে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

– যা, এই মেহনূরকে আমার কাছে নিয়ে আয়।

আদেশ শুনে চকিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো মাহদি,

– কেন ভাইয়া?ভুলেও মেহনূর আপু এখানে আসবেনা। সে ছেলেদের সামনে আসেনা।

– আজব! তোকে কোন্ দিক দিয়ে মেয়ে লাগে?

– মানে?

– তুই কি মেয়ে? ও যে তোর সামনে আসে, রাতে তোকে নিয়ে ঘুমিয়ে পরে, সেগুলোর মানে কি?

মাহদি মুখ ফুলিয়ে বলে,
– আমি ছোট না? আপু আমাকে আদর করে।
– রাতে ঘুমালি কিভাবে? তোর তো শোয়া ভালো না।

মাহতিম ততক্ষণে হাত ছেড়ে দিলে মাহদি চুপচাপ কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বললো,

– আপুর রুমে দুইটা বিছানা ছিলো ভাইয়া। আপু জানালার পাশেরটায় ঘুমিয়েছে, আমি অন্যটায়। ভাইয়া আমি যাই?

মাহতিম ‘ হ্যাঁ ‘ বোধকে মাথা নাড়িয়ে যেতে বোঝায়। ওমনেই ছুট লাগিয়ে মাহদি দৌড়ে পালায়। সকালের সূর্যটা পূর্ণ মায়ায় উদ্দীপ্ত হলে সবাই নাস্তা সেরে যার-যার রুমে চলে যায়। কিন্তু বিছানায় বসা মাত্রই নিচ থেকে এমন চিল্লাচিল্লির আওয়াজ আসে যে, সবাই হকচকিয়ে উঠে। এমন জোরদার টোন শুনে কেউ রুমে থাকতে পারেনি। হৈচৈয়ের আওয়াজটা মাহতিমের মনে হচ্ছে। কিন্তু সে কেনো গলা ফাটিয়ে কথা বলছে? কি হয়েছে নিচে? কাকে এমন ভয়াবহ গলায় বকছে?

মেহনূর আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলো। মাথার মাঝখানে সিঁথি তুলে একটা খেজুর বেণী করার চিন্তায় ছিলো। ঠিক তখনই জেঠাতো বোন শানাজ তীব্র উৎকন্ঠায় অস্থির হয়ে দরজা ধরে উকি দিয়ে বললো,

– সুরাইয়াকে বাশঁ দিচ্ছে মেহনূর! তাড়াতাড়ি নিচে নাম! আমি দাদাভাইকে ডাকার ব্যবস্থা করতে যাই, জলদি নিচের পরিস্থিতি সামলা তুই!

মেহনূর ভ্রুঁ কুঁচকে তৎক্ষণাৎ চিড়ুনি থামিয়ে ফেললো। ড্রেসিং টেবিলে চিড়ুনি রেখে প্রশ্নাত্মক সুরে বললো,
– কি হয়েছে বুবু? বাশঁ দিচ্ছে মানে কি?

শানাজ নিচ থেকে দোতলায় উঠে প্রচুর হাপাচ্ছিলো। নিজেকে শান্ত করার জন্য বড় একটা ঢোক গিললো। বুকভর্তি নিশ্বাস ছেড়ে দ্রুততার সঙ্গে বললো,

– ভয়ংকর অবস্থা হয়ে গেছে মেহনূর! মা, ছোটমা কেউ থামাতে পারছেনা। মারজা আন্টিও হিমশিম খাচ্ছে!

– আল্লাহ, বুবু তাড়াতাড়ি তুমি দাদাভাইকে ডাকতে যাও!

শানাজ জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তাড়াতাড়ি হান্নানকে ডাকার জন্য দৌড়ে যায়। মেহনূর বেনী করার চিন্তা বাদ দিয়ে সেকেন্ডের মধ্যে খোপা বাঁধিয়ে নেয়। কিন্তু চিন্তার বিষয়, নিচে সবার যাবে কি করে? নিশ্চয়ই ওখানে ছেলেগুলো থাকবে। তাছাড়া সুরাইয়াকে বাশঁ দেওয়ার কথা উঠলো কিভাবে?

– ‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO

(#নোটবার্তা : আমার ফোনটা প্রচুর সমস্যা করে, আগেই বলেছি। শাটডাউন মেরে বসেছিলো কিছুদিন। বিলম্বের জন্য দুঃখিত।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here