#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_২১.
#ফাবিয়াহ্_মমো.
গতরাতে মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ার জন্য রেসোর্টের এলাকাটা কর্দমাক্ত অবস্থা হয়ে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় পানি জমে গর্তমতো হয়ে আছে। গাছের নিচগুলা স্যাতস্যাতে হয়ে পিচ্ছিল হয়ে গেছে। সকালের সোনালি আলোয় সবকিছু প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। ফুলের উপর শিশির জমা পানিগুলো সূর্যের আলো পেয়ে ঝলমল করছে। মেহনূর খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে নেয়। শাড়ি বাঁচিয়ে খুব সাবধানে রুমে ফিরে আসে। এলোমেলো চুলগুলো না আঁচড়ে শান্তমনে কটেজ থেকে বেরিয়ে আসে। কটেজ থেকে একটু দূরে ঠিক ডানদিকটায় বসার মতো আরেকটা কটেজ আছে। তবে কটেজ না বলে আড্ডাখানা বললে চলে। সিনেমায় যেমন দেখায় বিলাসী মানুষগুলো সকাল-বিকাল শান্ত সময়টায় চায়ের পসরা নিয়ে আড্ডা দেয়, ঠিক তেমনি একটা আড্ডার জায়গা সেখানে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। বড় বড় দুটো গোল-টেবিল দিয়ে আড্ডাখানার অর্ধেকটা সাজানো হয়েছে, বাকি অর্ধেকটা বাগানের সিন-সিনারি দেখার জন্য ডিভানের মতো সিস্টেম করেছে। মেহনূর হাঁটতে-হাঁটতে সেই কটেজটার দিকে চলে গেলো। দুটো নিচু সিড়ি অতিক্রম করে ভেতরে পা রাখলো। আড্ডাখানার কটেজটা একদম খোলামেলা, চর্তুদিকেই দেয়াল ছাড়া। কিন্তু একটার-পর-একটা বিশাল বড় খাম্বা একটু দূরত্ব রেখে রেখে করা হয়েছে। মেহনূর হাতে করে যেই বইটা এনেছিলো সেটা এমন সুন্দর জায়গায় পড়ার জন্য উত্তম। সোজা ডিভানের সাইডটায় চলে গিয়ে সেখানে বই খুলে বসলো। সামনে তাকাতেই বেশ চমৎকার একটা বাগান, সেখানে রঙ-বেরঙের ফুল ফুটে আছে, ফুলগুলোর মিষ্টি পবিত্র সুভাষে চারপাশটা মৌ মৌ করছে। মেহনূর ডিভানে পিঠ হেলিয়ে পাদুটো বাঁদিকে একত্র রেখে বইয়ের দিকে মন দিলো। কখন যে বইয়ের শব্দমালায় ডুবে গেলো সেই সুক্ষ হুঁশও ওর হলো না। সবাই একে-একে ঘুম থেকে উঠে নিজেদের হাতমুখ ধোয়ার কাজ সেরে ফেললো। সকালের নাস্তার জন্য অপেক্ষা করতেই ম্যানেজার জানালো দূরের কটেজটায় খাবার এসে যাবে। সবাই সেদিকটায় যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে দেখে ডিভানের দিকটায় একাকীভাবে মেহনূর বসে আছে। তৌফ মেহনূরের অবস্থা দেখে সবার দিকে ইশারা করে দিলো, সবাই ওর ইশারা দেখে মেহনূরের উপস্থিতি পেয়ে চুপচাপ গোলটেবিলে চলে গেলো। শানাজ নিজের রুমে চুলসজ্জা করছে, সাবা নিজের শাড়ি ঠিকঠাক করে মুখে হালকা প্রসাধন লাগাচ্ছে। অন্যদিকে সুরাইয়া গো-মর মুখে দুপুরের জন্য শাড়ি সিলেক্ট করছে। মাহতিম সদ্য ব্যায়াম শেষে জগিং করতে-করতে রেসোর্টের গেটটা দিয়ে ঢুকলো। পড়নে কালো রঙের এক্সার্সাইজ ট্রাউজার, গায়ে ‘GUCCI’ ব্র্যান্ডের মেরুন টিশার্ট, পায়ে কালো কালার স্নিকার পরা ওর, যার সোলটা মূলত সাদা এবং জুতার ফিতাগুলো ডোরাকাটা ছিলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে রোদের কিরণে চিকচিক করছে, চুলগুলো ঘামে ভিজে কপালের সাথেই লেপ্টে আছে, পাতলা সুন্দর ঠোঁটদুটো জগিংয়ের জন্য হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ছে। গেটের কাছ থেকে কটেজের জন্য বামদিকে পা চালাবে ওমনেই দূরের সেই কটেজটার দিকে চোখ পরে। মাহতিম কিছু খেয়াল করলেও সেদিকে ঠিক করে তাকায় না, সোজা নিজের কটেজের দিকে চলে যায়। নাস্তার জন্য সবকিছু রেডি হয়ে গেলে মাহদির তাড়নায় সেই কটেজটার টেবিলে এসে পরে। সিয়ামের বাঁপাশে খালি চেয়ার পেয়ে চেয়ারটায় তখন টেনে বসে। পুরো টেবিল জুড়ে নানাপদের ভর্তা সাজানো, একপাশে সালাদের বোল রাখা, খিচুড়ির বিশাল হাড়িটা তখন দুটো ওয়েটার মিলে ধরে আছে। আরেকজন ওয়েটার সবার কাছে গিয়ে প্লেটে-প্লেটে খিচুড়ি বেড়ে দিচ্ছে। গোল-টেবিলের বাঁপাশে ছেলেরা বসেছে, ডানপাশটা নিয়ে মেয়েরা বসেছে। শানাজ এসে চেয়ার টেনে বসতেই মেহনূরের জন্য ডাক পাঠিয়ে টেবিলে আসতে বলে। মেহনূর বইটা বন্ধ করে ওদের টেবিলের দিকে চলে আসে। সবাই যখন খাবারের বিভিন্ন পসরা নিয়ে মেতেছে উঠবে, তখন মেহনূর নীতির পাশে চেয়ার খালি পেয়ে সেটা টেনে চুপচাপ বসে। প্লেটের উপর খিচুড়ির পরিমাণ দেখে মেহনূর ইতস্তত করতে থাকে। ধোয়া উঠা খিচুড়ির উপর আঙ্গুল দিয়ে নাড়তে থাকলে নীতি বিষয়টা লক্ষ করে বলে,
– মেহনূর কোনো সমস্যা? তুমি খাচ্ছো না যে? খিচুড়ি কি বেশি গরম?
নীতির প্রশ্ন শুনে এতোক্ষন পর শানাজ মেহনূরের প্লেটের দিকে নজর দিলো। ওর প্লেটের দিকে তাকাতেই শানাজ নীতির উদ্দেশ্যে হাসি দিয়ে বললো,
– ও তো এতো খিচুড়ি খেতে পারবেনা। ওর প্লেট থেকে কিছু কমাও।
শানাজের হাসিসুলভ কথায় সবাই হাসি না দিয়ে উলটো চোখ বড় করে বিষ্ময়াভূত হলো। মাহতিম একবারের জন্যও মেহনূরের দিকে না তাকালেও, এবার ঠিকই ওর দিকে দৃষ্টি রেখে দেখলো। প্লেটে যেটুকু খিচুড়ি দেওয়া হয়েছে সেটা একদম মাহদির প্লেটের সম-পরিমাণ। যেখানে মাহদি একদম গোগ্রাসে ভর্তা মাখিয়ে খাওয়া শুরু করেছে, সেখানে নাকি মেহনূরের উলটো খিচুড়ি কমাতে হবে। নীতির সাহায্য নিয়ে শানাজ মেহনূরের প্লেটটা থেকে আধা পরিমাণ কমিয়ে ফেললো। বাকি আধা পরিমাণ দিয়ে মেহনূর ধীরেসুস্থে খাওয়া শুরু করলো। মাহতিম ওর সম্পূর্ণ অবস্থা দেখে নিজের খাওয়াটা ঠিকমতো করতে পারছিলোনা। এদিকে কানের কাছে চোরের মতো সিয়াম বলে উঠলো,
– মামা, তোমার মুরগীর তো হেব্বি ফিড দিতে হইবো। তাড়াতাড়ি একটু বুকে টানো। এইভাবে চললে তো তোমারে সামলাইতে পারবো না।
মাহতিম প্লেটের দিকে তাকিয়ে খিচুড়ি মাখানো অবস্থায় ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছাড়লো। এরপর সিয়ামের উদ্দেশ্যে নিচু গলায় শক্ত কন্ঠে বললো,
– খিচুড়ি খাচ্ছিস, সেটার দিকে নজর দে। আশেপাশে কি হচ্ছে সেটার জরিপ এনে আমার কানে ঠুকে দিবিনা।
সিয়াম এই কথা শুনে মুখভর্তি খিচুড়ির লোকমা নিয়ে ফিসফিস নাক দিয়ে শব্দ করে হাসতে লাগলো। সিয়ামের নাকে টাইপ হাসি দেখে চোয়াল নাড়াতে-নাড়াতে ফারিন বলে উঠলো,
– তুমি নাক দিয়ে ভটভটি গাড়ির মতো শব্দ করছো কেন?
ফারিনের ইজ্জত মার্কা কথা শুনে সিয়াম সাথে-সাথে মুখটা কুঁচকে নিলো। তাড়াতাড়ি মুখের খিচুড়ি গিলে ফারিনের জন্য কিছু বলবে, তার আগেই সৌভিক গলা নামিয়ে মাহতিমের জন্য সবার অগোচরে বললো,
– মেহনূরের খাওয়ার অবস্থা দেখ বন্ধু! ও তো কিছুই খায় না। ওর চেয়ে আমাদের মাহদি আলহামদুলিল্লাহ ভালোই খায়। ওর দিকে খেয়াল রাখ মাহতিম। মেয়ে মানুষের এতো কম খাওয়া ঠিক না।
ব্যাপারটা নিয়ে মাহতিম নিজের মনে চিন্তা করছিলো, হঠাৎই সৌভিকের কথায় ভ্রু কুঁচকে কাটকাট সুরে প্রশ্ন করলো,
– আমি খেয়াল রাখবো মানে? ও আমার কে হয় যে খেয়াল রাখতে যাবো?
মাহতিমের ভ্রুঁ কুঁচকানো অবস্থা দেখে সৌভিক একপেশে হাসি দিলো। কোনো উত্তর না দিয়ে খাবারের জন্য তীব্র মনোযোগ দিলে মাহতিম আর কিছুই বললো না। সবাই নিজেদের খাওয়া শেষ করে আজকে কি কি ফূর্তি করা যাবে সেটা নিয়ে শলা-পরামর্শ শুরু করলো। মেহনূর একা-একা আবারও ডিভানে বসে উপন্যাসের বই খুললো। খাওয়ার সময় চুলগুলো খোপা করেছিলো, সে চুলগুলো মেলে দিয়ে পাদুটো আগের মতো উঠিয়ে নিলো। এদিকে কটেজের বাইরে চেয়ার টেনে ছেলেমেয়ে সবাই মিলে বহু বিষয়ে আলোচনা করছে, কালকের ক্লান্তিটা এখধো রয়ে গেছে বিধায় আজও সবাই রেস্ট নিচ্ছে। তবে সবাই মিলে মুভি দেখে আজকের দিনটা রেসোর্টে কাটিয়ে কাল দুপুরে নদীতে নেমে গোসল করবে। বিকেলের দিকে নদীতীরে বসে ছোটখাটো খাবারের আয়োজন করা হবে। নদীতে গোসলের ব্যাপারে সবাই হৈচৈ সমাগম করে প্রফুল্ল হলেও শানাজ প্রথম দফায় দ্বিমত পোষণ করলো। কিন্তু সকলের চাপাচাপি এবং সাবার জুড়াজুড়িতে বহু বছর পর নদীতে নামার জন্য রাজি হলো। মাহতিম সবার কথায় চুপ করে শুনে যাচ্ছে। নিজ থেকে কোনো বাড়তি কথা এখন পযর্ন্ত বলেনি। হাতে কোকাকোলার ক্যান নিয়ে সবার ব্যস্ত আলোচনার মধ্য থেকে চোখদুটো মেহনূরের দিকে রাখলো। সেদিকে দৃষ্টি রেখে ডানহাতের লাল ক্যানটা ঠোঁটের কাছে ছোঁয়ালো। ছোট্ট এক চুমুক দিয়ে ডিভানে বসা মেহনূরের দিকে তাকিয়ে রইলো। কালরাতে এই মেয়েটা কেমন করে রুমে এসে পরলো, সেটাই এখন চিন্তা করছে মাহতিম। শুধুমাত্র চাচাতো বোনের জন্য চিন্তা করে ওর রুমে কথা শোনাতে এসেছিলো, এটা ভাবলেই ওর ভীষণ হাসি পায়। সেই হাসির জন্যই ঠোঁটের কোণে হাসি ঠেলে আবারও ক্যানে চুমুক দিলো মাহতিম। কিন্তু হুট করে কোত্থেকে মাহদির এসে দাড়ালো, সে এসেই মাহতিমের হাত থেকে ক্যান কেড়ে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বললো,
– তোমার ফোন কোথায় ভাইয়া? ফোন দাও। তুমি ইচ্ছে করে ফোন লুকিয়ে রেখেছো। আমি তোমার বালিশের নিচে ফোন পাইনি।
মাহতিম ওর আচরণ দেখে প্রথমেই খুব বিরক্ত হয়ে গেলো। হুট করে মুখের ক্যানটা কেড়ে আবার বড় গলায় মোবাইলের জন্য চাচ্ছে! মাহতিম একদফা তুড়ি বাজিয়ে শক্ত গলায় তর্জনী তাগ করে বললো,
– ক্যান ফেরত দে! আর তুই কিসের মোবাইল চাচ্ছিস? ফোনের ব্যালেন্স দুদিনের মধ্যে কত গিলেছিস ধ্যান আছে? তোর কি বয়স হয়েছে মোবাইল ধরার? একটা চ-ড় মেরে দাঁত ফেলে দিবো ফাজিল!
মাহদি ‘ ডোন্ট কেয়ার ‘ ভাব দেখিয়ে ধীরগতিতে পা পিছিয়ে কটেজের দিকে যেতে লাগলো। মাহতিম বারবার বললো ক্যান ফেরত দিয়ে যেতে, কিন্তু মাহদি সেটা দিলো না। মাহতিমের কথাও একদম শুনলো না। মাহদি সোজা পা ঘুরিয়ে কটেজে ঢুকে মেহনূরের দিকে ছুটে গেলো। মেহনূরের পাশে ধপ করে বসলে মেহনূর চমকে গিয়ে বই বন্ধ করে দিলো। মাহদির দিকে আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকাতেই ফিক করে হেষে দিয়ে ওর টুকটুকে গালদুটো ধরে বললো,
– আজকে তোমার কি কি করার প্ল্যান আছে বলোতো। কিভাবে আজকের দিনটা কাটানোর ইচ্ছা আছে?
মাহদি বেশ ভাব দেখিয়ে ডানহাত দিয়ে চুলের ব্যাকব্রাশ করলো। একদম মাহতিমের মতো স্টাইলটা কপি করে ঢঙ দেখিয়ে বললো,
– ওহে সুন্দরী, চলো আমরা পুকুরপাড়ে গিয়ে বসি। আজ যে সবাই মিলে নদীতে গোসল করবো জানো? জানোনা। চলো চলো আমার হাতটা ধরো, তোমাকে নিয়ে সুন্দর রাজ্যটা ঘুরে-ঘুরে দেখে আসি।
মাহদির এমন ঢকের কথা শুনে মেহনূর খিলখিল করে হেসে দিলো। ঠোঁট চওড়া করে সাদা উজ্জ্বল দাঁতগুলো উকি দিয়ে ওর হাসির জৌলুস যেনো বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। মাহতিম এতোক্ষন আলোচনার দিকে মন দিলেও হঠাৎ বাঁ-কান দিয়ে সুরেলা হাসির শব্দ শুনে খানিকটা চমকে গিয়ে তাকালো। যে দৃশ্যটা চোখের সামনে সে দেখতে পেলো, একটুও প্রস্তুত ছিলোনা সেটা দেখার জন্য। মাহতিম অপলক দৃষ্টিতে মেহনূরের হাসির দিকে তাকিয়ে রইলো, ড্যাবড্যাবে তাকিয়ে রইলো। এদিকে বুকের যন্ত্রটা ওর হাসির শব্দ শুনে ধুপধুপ ধুপধুপ করছিলো। মেহনূর ছোট্ট মাহদির গালদুটো ধরে ওর কপালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দিলো, চুলগুলোতে নরম-চিকন আঙ্গুল দিয়ে এলোমেলো করে হাসি দিয়েই থাকলো। কিন্তু মাহদির সঙ্গে আর পুকুরঘাঁট দেখতে গেলোনা, মাহদি এ নিয়ে মন একটু খারাপ করলেও পরক্ষণে উদাস অবস্থা কাটিয়ে ফেললো। মেহনূরের পাশে সেই লাল ক্যানটা ওভাবেই রেখে মনের ভুলে চলে গেলো। মাহতিম দূর থেকে সব দেখলেও হঠাৎ সাবার ডাকে সাড়া দিতেই মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। এদিকে মেহনূর গলা ভেজানোর ইচ্ছায় যখন বই বন্ধ করে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো, তখনই তার পাশে একটা লাল ক্যান দেখতে পেলো। মাহদি যে ভুলবশত ক্যান রেখে গেছে সেটা ভালোভাবে বুঝতে পারলো। মাহতিম সাবার কথাটা মন দিয়ে শুনে নিজের অভিমত প্রকাশ করে আবারও মেহনূরের দিকে তাকানোর জন্য দৃষ্টি রাখলো। কিন্তু চোখের কোটর স্থির হয়ে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে ধাপে-ধাপে পৌঁছাতে লাগলো যেনো! অজান্তেই ঠোঁট ফাঁক করতে-করতে চোয়াল ঝুলিয়ে তাকিয়ে রইলো। ক্যানের যেই জায়গাটায় মাহতিম ঠোঁট লাগিয়ে চুমুক দিয়েছিলো, সেই জায়গায় ঠোঁট বসিয়ে একটু-একটু করে কোক খাচ্ছে মেহনূর। ডানহাতে ক্যানটা পাঁচ আঙ্গুলে ধরে বামহাতে বইটা নিয়ে নিবিড়ভাবে পড়ছিলো। মেহনূরের অজ্ঞাতসারে দূরের একটা চেয়ারে বসা মাহতিম অদ্ভুত প্রাপ্তিতে হাসছিলো, সেই মনোরম প্রাপ্তিমূলক হাসিটা দেখলে মেহনূর লজ্জায় লাল টুম্পা হয়ে যেতো।
.
দুপুরের সেই কাঙ্ক্ষিত মূহুর্ত, কাঙ্ক্ষিত সময়টা চলে এলো। সবাই নিজেদের পোশাক-আশাক বিছানায় রেডি রেখে মাঠে জড়ো হলো। শানাজ এবার জোর-জবরদস্তি করে সুরাইয়াকে ডেকে আনলো। সুরাইয়া এসেই দেমাক দেখিয়ে বললো,
– আমি তোমাদের সাথে ফান করতে আসিনি। আমাকে দুটো ছবি তুলে দিবে তাতেই হবে। আমি একা-একাই নদীতে গোসল করতে পারবো।
ওর কথার ধরনটা কেউ পছন্দ না করলেও কেউ সেটা মুখের আভাসে একটুও প্রকাশ করলো না। সবাই হাসিমুখে নদীতে গোসল করার আনন্দ উদযাপন করতে সেদিকে দলবেঁধে ছুটলো। তৌফরা একদৌড় মেরে আগেই নদীতীরে চলে গেলো। তারপর চললো শানাজদের দল, শানাজদের পেছনে নীতিদের দল এবং সবশেষে ঢিলামির মতো পেছনে পরে গেলো মেহনূর। মেঠোপথটা ঘাস দ্বারা আবৃত, ডানে সারি-সারি বটগাছ সাজানো। বামপাশে একটা পুকুর শেষ হয়ে আরেকটা পুকুর শুরু হচ্ছে। সূয্যিমামা মাথার উপর দারুণ উত্তাপে ফেটে পরছে। সবাই দ্রুত পা চালিয়ে নদীতীরে চলে গেলেও মেহনূর চারপাশে প্রকৃতি দেখতে-দেখতে ধীরভাবে এগুতে লাগলো। গাছের পাতাগলো কালরাতের বৃষ্টির জন্য সতেজ লাগছে, রাস্তাগুলো মাটির সোঁদাগন্ধে আরো প্রাণচাঞ্চল্যে ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। এদিকে শার্ট পড়ুয়া লম্বাটে মানুষটা পেছন-পেছন হেঁটে আসছে সেদিকে খেয়াল নেই ওর। মেহনূরের থেকে প্রায় সাত-আটহাত দূরে তখন মাহতিম হেঁটে আসছিলো। সাদা শাড়িটা দেহের সাথে মিলেমিশে আছে। সেই শাড়ির গোলাপী মোটা পাড়টা গোলাপের মতো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। চুলগুলো সম্পূর্ণ বাঁদিকে টেনে সামনে এনে রেখেছে। গোলাপী ব্লাউজটা যেনো ফর্সাটে পিঠটা একদম আবৃত করে দিয়েছে। কোমরের দিকটাও জবুথবু করে ঢেকে রেখেছে। মাহতিম হাঁটতে-হাঁটতে পায়ের গতি একটু বাড়িয়ে মেহনূরের ডানপাশে চলে আসলো। মেহনূর হঠাৎ ডানদিকে কারোর উপস্থিতি পেয়ে তৎক্ষণাৎ চোখ তুলে মাহতিমকে দেখতে পেলো। কিন্তু মুখে কিছু না বলে আবার চোখ নামিয়ে মাটির দিকে দৃষ্টি ফেলে হাঁটতে লাগলো। মাহতিম কথা বলার ইচ্ছাটাকে চেপে না রেখে হালকা একটু কেশে নরম গলায় বললো,
– তোমরা কখন থেকে শাড়ি পরা ধরো? আমার মানে হলো, ঠিক কোন বয়সটা থেকে শাড়ির জন্য প্রেশার আসে?
মেহনূর প্রশ্নটা শুনে ঢোক গিলে নিলো, কিন্তু দৃষ্টি তুলে তাকালো না। নতমুখে ঠান্ডা সুরে শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
– বয়স দশ হলেই শাড়ি পরতে হয়। কিন্তু কেউ চাইলে আরো ছোট থেকে অভ্যাস করতে পারে।
মাহতিম এমন উত্তর শুনে মনের ভেতর খচখচ করা প্রশ্নট ছুড়ে দিলো,
– তুমি কবে থেকে অভ্যাস করেছো তাহলে?
মেহনূর এবার নির্দ্বিধায় ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
– নয়ের মাঝামাঝিতে।
উত্তর শুনে কালো প্যান্টের পকেটে দুহাত পুড়ে দিলো মাহতিম। শব্দ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে আরো একটা প্রশ্ন করে বসলো,
– তোমাদের এখানে তাহলে মেয়েদের বিয়ের বয়স কতো? বাল্যবিবাহের প্রথা আছে নাকি?
মেহনূর প্রথম দুটো প্রশ্ন সহজভাবে দিলেও এই প্রশ্ন শুনে মনের ভেতর মারাত্মক একটা কামড় দিলো। একসঙ্গে থেমে-থেমে দুটো ঢোক গিলে হাতদুটো মুচলেকা করতেই বললো,
– আছে।
মাহতিম আবারও তার একপেশে ভঙ্গির তীক্ষ্ম হাসিটা দিলো। এরপর কিছুসময় চুপ থেকে মেহনূরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকালো। মেহনূর যে প্রচণ্ড উৎকন্ঠায় কাঁচুমাচু করচে সে ওর মুখ না দেখেও বলা দেওয়া যাচ্ছে। ওকে আরো বিপাকে ফেলতে মাহতিম ইচ্ছে করেই বললো,
– আমার মা তো ছোট বয়সী বউয়ের জন্য ডেসপারেট হয়ে গেছে। ভাবছে এখান থেকেই বউ বানিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু বুঝছো মেহনূর আফরিন, আমার ছোট বয়সী বউ নিয়ে সংসার করার রুচি নেই। এজন্যই মা পিছিয়ে আছে। নাহলে মা সম্ভবত তোমার বড়জন সাবাকে তুলে নিয়ে যেতো।
মাহতিম কথাটা শেষ করতেই মেহনূরের দিকে তাকালো। কিন্তু মেহনূর সেই যে চোখ-নত করে রেখেছে, সেই চোখ ভুলেও উপরের দিকে উঠলো না। মাহতিম ওর মনের অবস্থা বুঝার জন্য একটুও চেষ্টা করলো না। কালকে যে তিনদিনের শেষদিনটা রাত পোহালেই এসে যাবে, তখন সবকিছু খোলাখুলি ওকে বুঝিয়ে বলবে। আর কালকেই হবে সমস্ত ঘটনার শেষদিন। এরপর হয়তো এখান থেকে প্রস্ফুটিত ফুলটি নিজের বক্ষস্থলে আগলে রেখে আদরে-আদরে সঙ্গে নিয়ে যাবে, নয়তো ক্লেশযুক্ত মনে ভীষণকঠোর হয়ে আজকের এই দিনগুলো হামেশার জন্য মুছে ফেলবে। মাহতিম আনসারী সবই পারবে, শুধু কারোর মনের অধিকার জোরপূর্বক নিজের করে বেধেঁ রাখতে পারবেনা। দুজন হাঁটতে-হাঁটতে নদীতীরে এসে সবার সাথে যুক্ত হলো। মেহনূর শানাজদের সাথে মিলিত হয়ে নদীর অবগাহনে বহু বছর পর গা ভিজালো। ছেলেরা সাঁতারের রেস লাগিয়ে বেশ দূরে চলে গেল। মেয়েরা কোমর পযর্ন্ত পানিতে নেমে আনন্দ করতে লাগলো। কিন্তু মেহনূর নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে বারবার মুঠোভর্তি পানি তুলে সেই পানির দিকে তাকিয়ে রইলো। উদাস হয়ে যাওয়া মনটা আরো নিকষ কালো অন্ধকারের মতো ঘুটঘুটে ঠেকতে লাগলো। সবাই নদীতে গোসল সেরে রেসোর্টমুখী হলে মেহনূর কেনো জানি সবাইকে ফেলে আগে-আগে চলে গেলো। মাহদির বাঁদরামির জন্য মেহনূরের দিকে খেয়াল রাখতে না পারলেও রেসোর্টে পৌঁছে দেখলো মেহনূর ভেজা শরীরে আচঁলটা দিয়ে গা ঢেকে কটেজের সিড়িতে বসে আছে। সাবা-শানাজ-সুরাইয়া ওকে ‘ কি হয়েছে ‘ প্রশ্ন করলে মেহনূর জানায় ‘ বাড়ির কথা মনে পরছে, তাই দ্রুত এখান থেকে চলে যেতে চায়। ‘ শানাজ ওর মাথায় হাত বুঝিয়ে দিলো, সাবা ওকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বললো আর মাত্র কালকে দিনটাই আছে, তারপর সবাই এখান থেকে চলে যাচ্ছে। তিনবোন একসাথে ভেজা কাপড়ে কটেজে ঢুকলে সবাই নিজ-নিজ রুমে চলে যায়। শানাজরা কটেজে ঢুকে গেলেও মেহনূর পা থামিয়ে একপলকের জন্য পিছু ফিরে তাকালো। মাহতিমের আধ ভেজানো দরজার দিকে তাকিয়ে ছোট বন্ধ করে দৃষ্টি নামিয়ে রোমের দিকে চলে গেলো। কাল সবকিছুর শে-ষ-দি-ন।
#চলবে
#FABIYAH_MOMO