#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_২৪.
#ফাবিয়াহ্_মমো.
সৌভিক প্রচণ্ডরূপে ভয় পেয়ে গেলো। অনবরত ঢোক গিলতে-গিলতে পিছু ফিরে তাকালো। ওমনেই ঝড়ের মতো তীব্র বেগে পাচঁ আঙ্গুলে হামলা হলো। দুহাতে শার্টের কলার খাবলে ঘাড় ঝুঁকিয়ে ফেললো। সৌভিক ঘটনার আকস্মিকতার জন্য তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে ফেললো। মিনিট দুয়েক ওভাবেই চোখ বন্ধ করে জোরে-জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। কলারের হাতদুটো এখনো ছাড়েনি বলে ঘাড়টা তখনও ঝুকে ছিলো ওর। হঠাৎ নিরবতার জালে ছিদ্র করে মেয়েলি সুরটা কানে এলো,
– তোমার লজ্জা করেনা? তোমাকে আমি পুকুরঘাঁটে আসতে বলেছি, আর তুমি এখানে এসে আড্ডাবাজি করছো? আমাকে এতোক্ষন অপেক্ষা করানোর মানে কি সৌভিক?
মেয়েলি কন্ঠটা শুনে সৌভিক ধীরে-ধীরে চোখ খুললো। মুখের তটস্থ ভঙ্গিমা পরিবর্তন করে কলার থেকে হাত সরানোর ক্ষীণ চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হলো না একদম। ক্ষীণ চেষ্টাটা বিফলে যেতেই মাহতিমের দরজার দিকে তাকালো সৌভিক। ওই বন্ধ দরজাটা যদি খুলে যায়, তাহলে এখুনি একটা কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। সৌভিক তাড়াতাড়ি সবকিছু চিন্তা করে বেশ জোর দেখিয়ে কলার থেকে হাত সরিয়ে নিলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটার রাগত মুখের দিকে একপলক তাকালো। এরপর আর কোনো শব্দ করলোনা সৌভিক, বেজায় রাগ দেখিয়ে দ্রুতগতিতে কটেজ থেকে বেরিয়ে পরলো সে। রাগে শরীরটা রি রি করে জ্বলছে! মেয়েদের এসব রঙ-ঢঙ দেখলে কষিয়ে চটকাতে ইচ্ছে করে! সৌভিকের রেগে যাওয়া মুখ দেখে মিইয়ে গেলো মেয়েটা। তাড়াতাড়ি ওর পিছু-পিছু ছুটলো সুনশান মাঠটার ভেতর দিয়ে। সৌভিক হনহন করে পা চালিয়ে পুকুরঘাঁটটার দিকে চলে গেলো। তরুণী মেয়ে চটপট তার শাড়ি উঁচু করে সৌভিকের পিছনে পা চালিয়ে ছুটলো। সৌভিক নিজের রাগ কমাতে পুকুরঘাঁটটার কাছে এসে থামলো। পাকা পাটাতনে সজোড়ে লাত্থি মেরে রাগে ফুসতে লাগলো। হাপাতে-হাপাতে তরুণী ওর কাছে এসে থামলে গর্জে উঠলো সৌভিক,
– তোমাকে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করছে শানাজ! চড় মারতে ইচ্ছে করছে! যদি ওই মূহুর্তে মাহতিম দরজা খুলে ফেলতো, তখন কি সর্বনাশ হতো চিন্তা আছে? তোমার কি বিন্দুমাত্র ধ্যান-ধারনা নেই?
সৌভিকের উত্তপ্ত অবস্থার রাগ দেখে দমে গেলো শানাজ। অপেক্ষা করতে-করতে দশমিনিটের জায়গায় যখন চল্লিশ মিনিট পেরিয়ে যায়, তখন সত্যিই আর মাথা ঠিক থাকেনা। শানাজের অবস্থা ঠিক সেরকমই হয়েছিলো, সৌভিকের জন্য অপেক্ষা করতে-করতে রাগে-ক্ষোভে স্থির-জ্ঞান গুলিয়ে ফেলছিলো। নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করলেও সৌভিকের উপর রাগ দেখিয়ে সেও গরম গলায় বললো,
– সর্বনাশ হলে হতো! তোমার জন্য আমি ভয় পাবো কেনো? মাহতিম ভাইয়া নিশ্চয়ই তোমার মতো গণ্ডমূর্খ না! ভাইয়া যদি দেখে ফেলতো, আমি আর সত্য লুকিয়ে দেখা-সাক্ষাৎ করতাম না।
শানাজের কাটকাট কথা শুনে চোখ ছোট করে তাকালো সৌভিক। চোখে-মুখে দাম্ভিকতা ফুটিয়ে দুহাত বুকের উপর ভাঁজ করে দাঁড়ালো। শানাজের দিকে শক্ত ভঙ্গিতে ভাবশূন্য গলায় বললো,
– গণ্ডমূর্খের জন্য অপেক্ষা করার মানে তো আমি দেখিনা। সম্পর্ক যখন ‘ আপনি ‘ থেকে ‘ তুমি ‘-তে টেনেছো, তাহলে তোমার অপেক্ষা করতে সমস্যা কি? শোনো শানাজ, মাহতিম আমার মায়ের পেটের ছেলে না হলেও আমি ওকে আপন ভাইয়ের মতোই দেখি। লাস্ট টাইম বলছি, আমার সামনে তোমার ওই ন্যাকামি বোনের মতো আচরণ দেখালে কষিয়ে চড় মারবো! আমাকে রাগাতে এসো না।
সৌভিকের শক্ত কথাগুলো শুনে একদম চুপ হয়ে যায় শানাজ। নিজের ভুলটা কড়ায়-গণ্ডায় বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে ফেলে ও। শানাজকে চুপ থাকতে দেখে সৌভিক বুকের কাছ থেকে ভাঁজকৃত হাতদুটো খুলে ফেললো। রাতের জোৎস্না আলোতে টলমল করা পুকুরটার দিকে তাকালো তখন। শান বাঁধানো পুকুরটার কাছে কয়েক কদম এগিয়ে পাকা পাটাতনে বসে পরলো সৌভিক। পাদুটো সিড়ির উপর রেখে দিলো, আরাম করে বসলো সিমেন্টের পাটাতনে। শানাজ কিছুক্ষণ কাঁচুমাচু করে শেষমেশ সৌভিকের কাছে যেয়ে বসে পরে। সৌভিকের ডানদিকটায় বসে পরলে পুকুরের দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকালো শানাজ। চাঁদের চন্দ্রকিরণে রূপোর মতো চিকচিক করছে পুকুরঘাঁটের পানি। সেই পানিতে বাতাসের জন্য মৃদ্যু-মৃদ্যু ঢেউ তৈরি হচ্ছে। ঢেউগুলো দুলতে-দুলতে পায়ের কাছে এসে শেষ সিড়িতে মিলিয়ে যাচ্ছে। রাত যে এখন কয়টা বাজে, সে ধারণা নেই আর। ঝিঁঝিপোকার ঝিঁঝি ডাকে মুখরিত হচ্ছে চারপাশ। গাছের ডালপালাগুলো ঠান্ডা বাতাসে দুলছে, মাটির সাথে পানির গন্ধটা মন-প্রাণ উজ্জীবিত করে দিচ্ছে। খানিকটা সময় নিরবে কেটে গেলে শানাজ নিচু স্বরে বলে উঠে,
– আমি অপেক্ষা জিনিসটা ছোট থেকেই সহ্য করতে পারিনা সৌভিক। এটার জন্য আমি আম্মার কাছেও খুব বকা খেয়েছি। কাল তো সবাই চলে যাবো। তাই চেয়েছিলাম আজকের রাতটুকু তোমার সাথে গল্প করে কাটাবো। কিন্তু পরিস্থিতি যে এরকম হয়ে যাবে, আমি ভাবতে পারিনি সৌভিক। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো, রাগ করে থেকো না।
শানাজের কথা শুনে গুমর ভাঙলোনা সৌভিকের। একদৃষ্টিতে পুকুরের দিকে অটলভাবে তাকিয়ে রইলো সে। শানাজ তখন ক্ষান্ত দৃষ্টিতে সৌভিকের দিকে তাকালো, সৌভিকের মুখের ডানদিকটা চাঁদের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে দেখা যাচ্ছিলো। শানাজ সেদিকে তাকিয়ে থাকতেই ওর ডান বাহুটা দুহাতে আঁকড়ে ধরলো। সৌভিকের পাশে আরেকটু এগিয়ে শক্ত কাধে মাথা রেখে দিলো শানাজ। আঁকড়ে ধরা বাহুটা নিজের কোলের উপর টেনে আনলো। সৌভিক কোনো বাধা না দিলে শানাজ ওর আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে দিলো। শক্ত করে ধরলো সৌভিকের হাতটা, চোখ বন্ধ করে আবারও নিচু গলায় বিগলিত সুরে বললো,
– ভুলবশত ভুল করে ফেলেছি, মাফ কি করা যায়না?
শানাজের মলিন সুর শুনে সৌভিক ওর মুখটা দেখার চেষ্টা করলো, কিন্তু সেটা দেখা গেলো না। মনের উপর রাগের খোলস ভেঙ্গে গেলে সৌভিক আর শব্দ করলো না। খামোশ ভঙ্গিতে শানাজের মাথায় ঠোঁট ছুঁয়িয়ে পানির দিকে তাকিয়ে রইলো। শানাজ ও সৌভিকের দৃষ্টি যখন টলমলে পানির দিকে স্থির, তখন হুট করে প্রশ্ন গলায় শানাজ বলে উঠলো,
– তোমরা কি গোপন কিছু করছো?
কথাটা শেষ হতেই বুকটা ধ্বক করে কেপে উঠলো। গোপন কিছু দিয়ে কি বোঝানোর চেষ্টায় আছে সেটাই এখন ধরা বাকি। শানাজের কথায় স্বাভাবিক থেকে শান্ত মুখে বললো সৌভিক,
– তোমার কেনো এমন মনে হচ্ছে বলোতো? ব্যাপারটা আমায় খুলে বলো দেখি।
সৌভিকের কথায় চোখ বন্ধ করলো শানাজ। অনেকক্ষণ পর সৌভিকের মুখে কথা ফুটেছে দেখে মনটা কেমন শান্ত হয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করা অবস্থায় সরল কন্ঠে বললো,
– ওইযে গোল আড্ডা দিতে দেখি খালি।
শানাজের কথায় সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বুঝতে পারলো সৌভিক। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে শানাজ আসলে কিছুই জানেনা সেটা ভেবে চিন্তামুক্ত হলো তখন। শানাজের মাথায় সন্দেহ কাটানোর জন্য শান্ত সুরে বললো সৌভিক,
– ওটা গোপন কিছু না। ওটা জাস্ট নরমাল আলোচনা। সেখানে সবাই ডেইলি রুটিনের মতো ডেইলি ইনজয়মেন্ট নিয়ে ডিসকাস করে, এর চেয়ে বেশি কিছু না।
শানাজ এ কথা শুনে সায় বুঝিয়ে চুপ হলো। চোখ বন্ধ করে সৌভিকের হাতটা ধরে রইলো। পুকুরঘাঁটের পাটাতনে সময় কাটাতে লাগলো দুজন। সৌভিক চুপচাপ তাকিয়ে রইলো পুকুরের দিকে। শানাজ চোখ বন্ধ করে রইলো সৌভিকের কাধে মাথা রেখে। সৌভিক আজ সেদিনের স্মৃতিগুলো স্মরণ করতে থাকলো, যেদিন শানাজের মতো শান্তবুদ্ধির মেয়েটা ওর মন-দিগন্তে সমর্থন জানিয়ে আগমন করেছিলো। সবার অজান্তে সৌভিক সেদিন দেখা-সাক্ষাৎ করেছিলো শানাজের ঘরে। হুট করে ব্যতিব্যস্ত হয়ে শানাজের অনুমতি ছাড়া ওর রুমে ঢুকে পরে। সেদিনই বাধ্য হয় শানাজ নিজের রুমের দরজা আটকে দিতে। যদি সৌভিককে রুমের মধ্যে কেউ দেখে ফেলে, তাই তাড়াতাড়ি দরজা আটকে দ্রুত ওকে বেরিয়ে যেতে বলে। কিন্তু সৌভিকও সেদিন উত্তর জানার জন্য নাছোড়বান্দা হয়ে যায়, শানাজের পেটের কথা বের করার জন্য ইচ্ছে করে বিছানায় সটান মেরে শোয়। এদিকে সৌভিকের অবস্থা দেখে শানাজ চিন্তিত হয়ে উঠে। কি করে সৌভিককে বের করবে, সেটা নিয়ে রুমের ভেতর পায়চারী করতে থাকে। ঠিক তখনই রুমের দরজায় ঠকঠক করে কড়া পরে। দরজায় বাইরে কারোর আগমন শুনে দুজনেই রীতিমতো চমকে যায়। সৌভিক অনেকটা চিন্তিত হলেও শানাজের অবস্থা পুরোপুরি কাহিল প্রায়। নিজেকে বারবার শান্ত করে শানাজ দরজার দিকে এগোয়, দরজার ছিটকিনিতে কাঁপা-কাঁপা হাত রাখতেই মাথা পিছু ফিরিয়ে সৌভিকের দিকে তাকায়। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে শানাজ ওকে খাটের তলায় লুকাতে ইশারা করে। সৌভিক প্রথমে রাজি না হলেও শেষপর্যন্ত বিকট পরিস্থিতি বিবেচনা করে খাটের তলায় লুকায়। শানাজ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে দরজা খুলে দেয়, ওমনেই চোখের সামনে আবিষ্কার করে নীতিকে। নীতির চোখেমুখে তখন রাজ্যের কৌতুহল দেখা যাচ্ছে, কেনো শানাজ দেরি করে দরজা খুললো সেটা নিয়েই সংশয় কাজ করছে। শানাজ যেভাবেই পারলো, সেভাবেই নীতিকে মুখোমুখি করে দ্রুত দরজা আটকে দিলো। নীতির মুখের উপর দরজা আটকালো দেখে নিজের কাছেও বিষয়টা খারাপ ঠেকে গেলো। কিন্তু এদিক দিয়ে শুরু হলো সৌভিকের পীড়াপীড়ি! সেদিনই শানাজের মুখ থেকে শুনে নেয় কাঙ্ক্ষিত বাক্যগুলি। এরপর দুজন প্রথম প্রেম-সাক্ষাৎ সারার জন্য রাতের সময়টা ঠিক করে। ওইসময় বাড়ির সবাই তখন গভীর নিদ্রায় বুঁদ থাকে। সৌভিকের জোড়াজুড়িতে শানাজ তখন রুমের দরজা খুলে বেরোয়। কাউকে বুঝতে না দিয়ে সিড়ি দিয়ে নামে, বাড়ির বাইরে যাওয়ার জন্য খাবার ঘরের জানালা দিয়ে বের হয়। এদিকে সৌভিক আগে থেকেই বাড়ির যেই পুকুরটা ছিলো, সে জায়গায় উপস্থিত থাকে। শানাজ এসে দেখা করতে গেলে হঠাৎ দুমিনিটের মাথায় মাহতিম উদয় হয়। মাহতিমের চোখে কি করে ধূলো দিবে সেটা নিয়েই চিন্তা করতে থাকে। তখন হঠাৎ খেয়াল করলো মাহতিম কিছু একটা খুঁজছে! এই খোঁজাখুঁজির ফাঁকে দ্রুত সৌভিক শানাজকে নিয়ে পালায়! একদৌড়ে বাড়ির পেছন রাস্তা দিয়ে সৌভিক ও শানাজ চলে যায়। সৌভিক কোনোমতে সিড়ির দিকে দৌড়ে গেলেও শানাজ নিজেকে আড়াল করার জন্য মালপত্র রাখার রুমে লুকিয়ে পরে। মাহতিম যখন হন্য হয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে, তখনই সৌভিক গা বাঁচিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। কিন্তু সৌভিক হয়তো জানেনা, সেদিন ও মাহতিমের চোখে ঠিকই ধরা পরেছিলো। মাহতিম ওকে ভালোমতোই দৌড়ের বেগে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখেছিলো। কিন্তু কি কারনে মাহতিম এখনো চুপ করে আছে সেটা সবার জন্যই অজানা।
.
ভোরের অরুণটা আকাশ চিড়ে উদয় হলো। তপ্ত অরুণের কমলাভ রঙটা পুরো আকাশে ছড়িয়ে পরলো। জেগে উঠলো পাখির আস্তানা, সাড়া দিয়ে উঠলো গ্রাম্য-প্রকৃতি। নানা পাখির কিচিরমিচির ডাকে মুখর হলো ভোর। সবাই রেসোর্টের জমজমাট সময় কাটিয়ে রওনার জন্য তৈরী হলো। মাহতিম সবার আগে উঠে গাড়ির প্রতিটা জিনিস চেক করে নিলো। গাড়িতে ঠিকমতো ব্যাগগুলো গুছিয়ে সৌভিককে ডেকে আনলো। সৌভিকের আসার পরপরই চলে এলো সবাই। আজ সবার পড়নে মোটা কাপড় দেখা যাচ্ছে। সৌভিক কালো টিশার্টের উপর কালো হুডি পরে নিয়েছে। তৌফ পরেছে ধূসর শার্টের সাথে মেরুন রঙের নরমাল জ্যাকেট। এমন করে সবার পড়নে যখন মোটা পোশাক পরা, তখন মাহতিমের গায়ে একেবারেই সাদামাটা পোশাক পরিধান ছিলো। নীতি-প্রীতি-ফারিনের সাথে আগমন ঘটলো চারবোনের। সবার আসা শেষ হলে এবার বসার জন্য কথা উঠলো। মাহতিম তখন রেসোর্ট থেকে শেষ দর্শন নিতে গেলো। এদিকে তৌফ পাকনামো করে কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই হড়হড় করে বললো,
– বাবু সোনারা এবার আমার কথা শোনো, প্লিজ এ্যাটেনশন হেয়ার। এইবারের প্ল্যানটা আমাকে করতে দেও। এইবার সৌভিকের জায়গায় সিয়াম ড্রাইভে বসুক, আর সিয়ামের জায়গায় সৌভিক। মেয়েরা সবাই মাইক্রোতে উঠো, আর মাহতিমরে আল্লাহর নামে একলা ছাইড়া দাও। ওয় মনের সুখে জিপ নিয়া মাইক্রোর লেজ ধইরা আসতে থাকুক। আমরা সবাই ‘ টিকাটুলির ‘ গান বাজাইতে বাজাইতে —
তৌফ আর কথা শেষ করতে পারলো না। সশব্দে মাথার পেছনে যেনো ৪০০ভোল্টের কারেন্ট লাগলো। কারেন্টটা যে থাবড়া নামক মশলা ছিলো সেটা মাথায় হাত দিয়ে বুঝতে পারলো। এমন ভয়াবহ থাবড়াটার জন্য তৌফ পিছু ঘুরে দুনিয়ার বীভৎস গালিটা উচ্চারণ করবে, তখনই ঠোঁটের কিনারায় ‘ বা ‘ উচ্চারণ করে মুখটা নিষ্পাপ বাচ্চার মতো চুপ হয়ে গেলো। মাথা থেকে ধীরেসুস্থে হাত সরিয়ে তৎক্ষণাৎ বত্রিশ দাঁতের জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বসলো। এদিকে থাবড়া দেওয়া ব্যক্তি আর কেউ না, সেটা মাহতিম ছিলো। তৌফ মাহতিমের চেহারা দেখে শত চেষ্টা করেও মুখে হাসি আনতে পারছিলো না, কিন্তু নিজের জান-মালের কথা চিন্তা করে তাড়াতাড়ি একটা ভেটকি মেরে দিলো। হিহি মার্কা হাসি দিয়ে মাহতিমের উদ্দেশ্য বললো,
– বা তে বাবু বলতে নিছিলাম। তুইতো বাবুর মতোই সুন্দর, আয় তোর কপালে একটা চুমা দেই।
তৌফের কথায় ফিক করে হেসে উঠলো সৌভিক। সৌভিকের দেখাদেখি হেসে উঠলো সবাই। সেই হাসিটা ফিসফিস থেকে শুরু হয়ে আচমকা তুমুল শব্দে হোহো করে উঠলো। সবাই হাসির রোলে নাস্তানাবুদ হয়ে গেলে মাহতিম তখনও গম্ভীর মুখে দাড়িয়ে ছিলো। সবাই দম ফুরানোর মতো হাসতে-হাসতে একে-অন্যের গায়ে ঢলে পরছিলো। মাহতিম ওমন হাসি দেখে চোখ ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকালো, মেহনূরের দিকে চোখ পরতেই মেহনূর মিচকি-মিচকি হাসি থামিয়ে একদম মলিন মুখ করে ফেললো। মাহতিম এই বিষয়টা আর বাড়তে না দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
– কালকের ঘটনাটা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে? সেই ঘটনা যদি সবার স্মরণে থাকতো তাহলে আজকে এরকম আমোদ করার টপিক উঠতো না। সবাই মাইক্রোতে গিয়ে বসো। আর শানাজ? তোমার সাথে দুটো কথা ছিলো। আশা করবো মোল্লাবাড়ির বড় নাতী হিসেবে আন্সারটা দিবে।
মাহতিমের কঠোর গলা শুনে ভয় করলো শানাজের। সৌভিকও রীতিমতো নিঃশ্বাস আঁটকে আতঙ্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহতিম দু-পা এগিয়ে শানাজের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভয়ে শানাজের গলা শুকিয়ে শুষ্ক কাঠফাটা হয়ে উঠলো। সৌভিক প্যান্টের বাঁ-পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেনসনের প্যাকেটটা দুমড়ে-মুচড়ে মোয়া বানাচ্ছিলো। মাহতিম তখন শানাজের একহাত পেছনে থাকা মেহনূরের দিকে একপলক তাকালো। ওর দিকে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে আবারও সেই হাসিহীন মুখটার চোখ রাখলো। পড়নে কালো রঙের সুতির শাড়ি ছিলো, সেই শাড়ির পাড়টা বেশ মোটা এবং মোটা পাড়টা রাণী গোলাপী রঙ-বিশিষ্ট। গায়ের ব্লাউজটা পাড়ের সাথেই ম্যাচ করা এবং স্লিভদুটো কনুই পযর্ন্ত ঢাকা ছিলো। মাহতিম বুকভর্তি নিশ্বাস টেনে সেটা ধীরগতিতে ছেড়ে দিতেই শানাজের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমি তোমার ভিক্টিম বোনকে স্যাপারেটলি জিপে নিয়ে যেতে চাই। কালকের ইন্সিডেন্টটা যেনো ট্রমাতে না পৌঁছাক সেজন্য ঘুরিয়ে আনতে চাচ্ছি। তুমি এখন আমার উপর বিশ্বাস করবে কিনা সেটা বলো।
মাহতিমের কথা শুনে মনের উপর থেকে ভার সরে গেলো। শানাজ মাটির দিকে তাকিয়ে স্বস্তিজনক নিশ্বাস ছাড়লো। শান্ত দৃষ্টি তুলে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করতে লাগলো। পেছনে থাকা মেহনূরের দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো শানাজ, আর তখনই মেহনূরের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে ওই অবস্থায় বলে উঠলো,
– জ্বী ভাইয়া। নিয়ে যান।
শানাজের উত্তর শুনে বিষণ্ণ মুখের উদাস দৃষ্টিটা তৎক্ষণাৎ শানাজের দিকে পরলো। শানাজ সেই দৃষ্টির বিনিময়ে দুঠোঁটের কিনারায় হাসি ফুটিয়ে হাসলো। মেহনূর একটুও বুঝতে পারলো না হাসিটার কারণ। শানাজ সেই হাসিটা মিলিয়ে দিয়ে সামনে ফিরে তাকালো। মাহতিমের দিকে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়িয়ে আরো একবার সম্মতি জানিয়ে দিলো। মাহতিম সেই উত্তরটা পেয়ে নিজেও একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে ফেললো। সবকিছু ঠিকঠাক করে মেহনূরকে রেখে সবাই মাইক্রোতে চড়ে বসলো। সবার শেষে উঠে বসলো সুরাইয়া। মাহতিম হাসি-হাসি মুখে যখন মাইক্রোর দরজা টেনে দিচ্ছিলো, তখন হুট করে সুরাইয়ার দিকে কয়েক মূহুর্তের জন্য দৃষ্টি থমকে গেলো ওর। দুহাতে দরজা যখন টেনে দিচ্ছে, তখন সুরাইয়া কেমন অদ্ভুত একটা বাঁকা হাসিতে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম মাহতিমের কাছে সুরাইয়ার হাসিটা বোধগম্য হলো না। শুধু মনের মধ্যে শূলের মতো অজস্র খোঁচা অনুভব করলো সে। মাইক্রোটা চোখের সামনে দিয়ে ছেড়ে দিলে মাহতিম এবার মেহনূরের দিকে তাকালো। সাদা টিশার্টের উপর নেভি ব্লু রঙের শার্ট চেপেছে মাহতিম। সেই শার্টের সবগুলো বোতাম খুলে রেখেছে সে, যার কারনে পেশিবহুল বুকটা সাদা টিশার্টের উপর ভেসে উঠেছে। মেহনূর মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলেও আড়চোখে ঠিকই টের পাচ্ছে, মাহতিম এখন ওর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেহনূর লজ্জা-সঙ্কোচ- সংশয় নিয়ে প্রচণ্ড অস্বস্তি অনুভব করছে। কেউ তাকিয়ে থাকলে এমনেই একধরনের অস্বস্তি ঘিরে ধরে, তার উপর ঘায়েল করা চাহনি দিয়ে তাকিয়ে থাকলে সেই অনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করা প্রায় অসম্ভব। মেহনূর আচঁলের শেষপ্রান্ত দিয়ে আঙ্গুলে-আঙ্গুলে খুট পাকাতে থাকলে মাহতিম ওর দিকে এগিয়ে আসতে থাকলো। মেহনূর মিনমিন করে লজ্জামিশ্রিত চাহনি তুলে সামনের দিকে তাকালো। ওমনেই সমস্ত শরীর বিদ্যুতের মতো ঝিমঝিম অনুভূতিতে ছড়িয়ে পরলো ওর। পরিচিত শব্দটা ধুকপুক-ধুকপুক করে শান্ত থেকে অশান্ত বেগের দিকে ছুটতে থাকলো। মেহনূর উজবুকের মতো তাকিয়ে থাকতেই মাহতিম সন্নিকটে এসে দাঁড়ালো। লম্বাটে মানুষটা দাম্ভিকের মতো দাঁড়িয়ে পরলে মেহনূর তার মুখটা নিচু করে ফেললো। ব্যাপারটা একটুও সহ্য হলো না মাহতিমের। মেহনূরের মুখটা দুহাতের তালুতে আবদ্ধ করে উপরের দিকে তুললো সে। সাথে-সাথে মেহনূরের ড্যাবড্যাবে চাহনিটা চোখের সামনে চলে আসলো, মাহতিম পুরো মুখটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ডান গাল থেকে হাত সরিয়ে ফেললো। কি করতে চাচ্ছে মাহতিম তখনো কিছু স্পষ্ট না। মেহনূর কিছু বুঝে উঠার আগেই নরম ঠোঁটদুটোর উপর তীব্র ঘষার চাপ অনুভব করলো। মেহনূর শিউরে উঠে চমকে গিয়ে চোখ কুঁচকে ফেললো। কিন্তু ঘটনা ঘটার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবার চোখ খুলে তাকালো মেহনূর। চোখের ভেতর কৌতুহল ফুটিয়ে মাহতিমের ডান-হাতটার দিকে তাকালো। নেভি শার্টের নেভি ব্লু হাতাটায় মেহনূরের লিপবাম লেগে আছে, সেটা মাহতিম এক ঘষা দিয়ে একটু আগে উঠিয়ে ফেলেছে। এই অপ্রত্যাশিত কাজটা কেনো করলো, সেটা জিজ্ঞেস করার জন্য মেহনূরের মনটা আকুপাকু করছিলো। মাহতিম কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের কাণ্ডকীর্তির পক্ষ থেকে বললো,
– দুটো দিনের জন্য সাদামাটা থাকার চেষ্টা করো। আমার সামনে সামান্যতম সেজে আসলে আমি ঠিক থাকতে পারবো না।
মাহতিমের কথার মর্ম বুঝার জন্য ওভাবেই তাকিয়ে রইলো মেহনূর। খট করে দুটো বাক্য শুনার পর সেটা নিয়ে চিন্তা করতে থাকলো। এদিকে মাহতিম দ্রুতগতিতে শার্টের স্লিভদুটো কনুইয়ে গুটিয়ে নিচ্ছিলো। মেহনূর অল্প চিন্তায় ডুব দিলে হঠাৎ কথাটার মানে ধরতে পারলো। কিন্তু লজ্জার দরুনটা এতো বেশি ছিলো যে, সেটার কারণে মাহতিমের সামনে দাঁড়াতে গা শিরশির করছিলো। মাহতিম স্লিভদুটো গুটিয়ে নিয়ে পকেট থেকে ঘড়ি বের করে পরলো। বাঁ কবজিতে বাদামী ঘড়িটার হুক বেধেঁ নিলো। মেহনূর লজ্জায় দৃষ্টি নুইয়ে রাখলে মাহতিম ওর দিকে আবার বলে উঠলো,
– ওটা মুছিয়ে না দিলে আমি ঠিকমতো ড্রাইভ করতে পারতাম না। তোমাকে বিয়ে না করে হাসপাতালে যাওয়ার ইচ্ছে নেই মোটেই।
মেহনূরের মনেহচ্ছে মাইক্রোতে না উঠাটাই ওর মস্ত বড় ভুল ছিলো। এখন মাহতিমের সামনে থেকে লজ্জা পাওয়ার চাইতে মাইক্রোতে চাপাচাপি করে বসলেও শান্তি হতো। মাহতিম কালকের পর থেকে যেরূপে রূপান্তর হয়ে গেছে, সেটার সাথে আগের রূপগুলো মেলানো এখন মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। মেহনূর নিজের মনে এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করলে মাহতিম ওইমূহুর্তে ওকে শূন্যে তুলে নেয়। আচমকা কাণ্ডের জন্য আগের মতো একটুও বিচলিত হলোনা মেহনূর। এবার মাহতিমের কোলে চড়ে ওর দিকেই তাকিয়ে রইলো। মাহতিম একটা চওড়া হাসি দিয়ে জিপের দিকে যেতে লাগলো। মেহনূরের ছোট্ট শরীরটা মাহতিম শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরেছে, মাহতিমের বুকটার কাছে মেহনূরের মুখটা ঠেকে আছে। ওভাবে শক্ত করে ধরার জন্য মেহনূর নিজের চাপা খাওয়া হাতদুটোতে ব্যথা পাচ্ছে। ব্যথাটা অসহন মাত্রায় চলে গেলে মেহনূর হাতদুটো বের করে একটা মাহতিমের ঘাড় জড়িয়ে ধরলো, অন্য হাতটা এগিয়ে শার্টের কলার আঁকড়ে ধরলো। মাহতিম ওর অবস্থা দেখে হাসি-হাসি মুখেই হাতদুটো আরো কঠোর করলো। ওমনেই মেহনূর কিন্ঞ্চিত পরিমাণ কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে তারপর খুললো। মাহতিম ওকে জিপের কাছে এনে সিটে বসিয়ে দিলো। গতবার যেই হাতটা অগ্রাহ্য করে মায়ের সাহায্য নিয়ে জিপে উঠেছিলো, আজ সেই অগ্রাহ্য হাতের মালিক তাকে কোলে নিয়ে জিপে বসালো। মেহনূর জিপে বসতেই পাদুটো ঠিকঠাক মতো রেখে দিলো, মাহতিম সিটবেল্ট টেনে শান্তমুখে সেটা বেধেঁ দিলো। মাহতিম চোখ তুলে সেই মায়াবী চোখদুটোর দিকে নিবদ্ধ করে তাকালো। ভোরের প্রথম সোনালী আলোটা মেহনূরের মুখের উপর পরেছে, সেই আলোর জন্য উজ্জ্বল মুখটা রাঙা আভার মতো ফুটে আছে। উজ্জ্বল ফর্সার গালটায় ডানহাত রাখলো মাহতিম। নরম গালটায় যতোবার হাত রেখেছে, মনে হয়েছে, নিজের শক্ত হাতের জন্য ওর নরম গালটা ডেবে যায়। আঙ্গুলের চাপ খেয়ে নরম গালটা ভেতরে ঢুকে যায়। মাহতিম জানতে চায়, ওই নরম গালটায় যখন পরমাহ্লাদে ওষ্ঠযুগলের চাপ দিবে, তখন গালটা কতখানি তুলার মতো আচরণ করবে? কতখানি ডেবে যাবে ওষ্ঠযুগলের চাপ পেয়ে? মাহতিম নিজেকে সহ্য এবং ধৈর্য্যের মধ্যে আঁটকে রেখে শান্ত গলায় বললো,
– তোমাকে প্রথম চুমুটা কোলে তুলেই দিবো মেহনূর।
-‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO
( #নোটবার্তা : অসংখ্য ভুল থাকতে পারে। বানানে প্রচুর সমস্যা থাকতে পারে। আমি এর জন্য সত্যিই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ভালোবাসা অবশ্যই সবার জন্য 🖤)