#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_২৮.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
মাহতিমের কথায় প্রচণ্ড লজ্জা পেলো মেহনূর। এই লজ্জায় নত হয়ে চোখটা পযর্ন্ত তুলতে পারলো না। মাহতিমের কথায় কি উত্তর দিবে, মেহনূর যেনো বুঝতে পারলো না। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। সেই বৃষ্টির পৈশাচিক আওয়াজে গা কেমন ছমছম করে উঠছে। কালো কুচকুচে আকাশটা এমনভাবে ফেটে যাচ্ছে, যেনো দিনের আলোতে পুন্ঞ্জীভূত হচ্ছে বারবার। খোলা জানালার জন্য বাইরের ভয়াবহতা রুমের ভেতরে চলে আসছে এখন। আলোহীন রুমটার ভেতর থেমে-থেমে আসছে বিদ্যুৎপৃষ্ঠের আলো। মাহতিম কিছুসময় চুপ থেকে সাদা পান্ঞ্জাবীর বোতামে হাত দিলো। মেহনূরের নতমুখটার দিকে দৃষ্টি রেখে প্রথম দুটো বোতাম খুলে ফেললো। মেহনূর আড়চোখে এমন অবস্থা দেখে কচ্ছপের শক্ত খোলসের মতো ভেতরে গুটিয়ে যাচ্ছিলো। মাহতিম স্লিভদুটো ঠিক করার জন্য হাতাদুটো কবজি পর্যন্ত নামালো, এরপর ঠিকঠাক মতো গুটানোর জন্য আবার ভালোভাবে ফোল্ড করতে লাগলো। কনুইয়ের কাছে মোটা করে গুটাতেই মেহনূরের দিকে এগিয়ে গেলো মাহতিম। মেহনূরকে পালটা প্রতিক্রিয়ার সুযোগ না দিয়ে ওর দু’কাধ শক্ত করে ধরলো, মেহনূর তখন কাধের কাছে ভার অনুভব করতেই মাহতিমকে দেখার জন্য মুখ তুলে তাকালো, ঠিক তখনই আকাশের আলো নিভে গিয়ে চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেলো। মেহনূর কিচ্ছু দেখতে পেলো না তখন, অদৃষ্ট অবস্থায় তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ দুম করে ধাক্কা খেলো। নিজের সাথে কি হলো সেটা বুঝে উঠার আগেই মাথার নিচে নরম বালিশের অস্তিত্ব বুঝতে পারলো। কাধের কাছে এখনো সেই শক্ত হাতের ভার লাগছে, মাহতিম নিজের শক্ত হাতদুটো দিয়ে মেহনূরের কাধ খাবলে রেখেছে। মেহনূর বড় করে ঢোক গিলতেই চোখের পাতা খুলে তাকালো। উজবুকের মতো তাকিয়ে থাকতেই মাহতিম ওর মুখের দিকে একটুখানি নুইয়ে এলো, কাছে আসার এমন আকস্মিক মূহুর্ত দেখে বুকের যন্ত্রটা যেভাবে ধপাস-ধপাস করে লাফাচ্ছে, ধুকপুকনি যেভাবে অস্বাভাবিক হারে ছুটে চলছে, তাতে মেহনূরের ঠোঁট থেকে গলার স্বর পযর্ন্ত গুলিয়ে গেছে। খরার মতো শুকিয়ে গেছে গলদেশের অবস্থা। বারবার ঢোক গিলেও শুষ্ক গলা সিক্ত করা যাচ্ছেনা। নাকের কাছে মাহতিমের নেশালো পারফিউমের ঘ্রাণ এসে আচ্ছন্ন করে দিলো ওকে। মনের অগোচরে চোখ বন্ধ করে ফেললে পুরোপুরি বশীভুত করে ফেললো মেহনূরকে। গায়ের উপর বিশাল দেহের মানুষটা বেশ দূরত্ব রেখে মুখের উপর ঝুঁকে আছে, তার বলযুক্ত হাতদুটো বেশ কোমলভাবে কাধে স্থান নিয়েছে, উত্তেজিত নিশ্বাসগুলো মুখের উপর অনুভব হচ্ছে ওর। মেহনূরের ছোট্ট মনটা প্রবল ঝড়ের মতো বিক্ষোভ সৃষ্টি করছিলো। সেই ঝড়টা আকস্মিকভাবে আরো তোলপাড় শুরু করলে সমস্ত ইন্দ্রিয় অশান্ত হয়ে উঠলো। মেহনূরের চিকন নাকটার হাড্ডির উপর থুতনি বসিয়ে দিলো মাহতিম। একেকটা প্রখর নিশ্বাস মেহনূরের চোখের উপর ফেলতে থাকলো সে। মেহনূরের কপালের দিকটায় পুরোপুরি এগিয়ে যেতেই চোখ বন্ধ করলো দুজনই। টানটান কপালের লাবন্যময় চামড়ায় ওষ্ঠযুগলের গাঢ় পরশ অনুভব করলো মেহনূর, ওমনেই জড়তার আবেশে ডুবে গিয়ে তীব্রভাবে মিইয়ে গেলো সে। চোয়াল শক্ত করে চোখদুটো ভেতরের দিকে খিঁচে ফেললো মেহনূর। মাহতিম ওর কাধ থেকে বাঁহাত সরিয়ে ধীরে-ধীরে কানের পেছনটায় চারটা আঙ্গুল রেখে দিলো, অবশিষ্ট বৃদ্ধাঙ্গুলটা গালের দিকে রাখতেই আঙ্গুলের ডগা দিয়ে মেহনূরের গাল বুলিয়ে যাচ্ছিলো। তীব্র উৎকন্ঠার নিশ্বাসগুলো বেশ জোরেসোরে চোখ বন্ধ অবস্থায় ছাড়ছিলো মাহতিম। কপালে ওষ্ঠ-চুম্বনের কার্যসিদ্ধি সম্পন্ন করে তৎক্ষণাৎ তপ্তস্পর্শ সরিয়ে ফেললো। চোখ মেলে মেহনূরের খিঁচুনি দেওয়া চোখের দিকে শান্তভাবে তাকালো। ওই খিঁচুনি দেওয়া চোখদুটোতে তাকিয়ে থেকে সেখানেও ছাপিয়ে দিলো ওষ্ঠযুগলের ছোঁয়া। মেহনূর দারুণ কুন্ঞ্চিতবোধে ক্লিষ্ট হয়ে দাঁত শক্ত করে ঠোঁট কুঁচকে ফেললো। মেহনূরের জড়সড়-করুণ অবস্থা দেখে মাহতিম না পারতে হেসে দিলো। সেই সৌন্দর্য্যমণ্ডিত হাসিটা ঠোঁটে সর্বোপরি যুক্ত রেখে মেহনূরের উদ্দেশ্যে বললো,
– তোমার এই লজ্জা কাতর মুখটা লোভনীয় লাগছে মেহনূর। লোভনীয় জিনিসটা বুকটার মধ্যে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু —
কথার প্রসঙ্গ মাঝপথে থেমে গেলে আর কোনো শব্দ শোনা গেলো না। বৃষ্টির তোড়জোড় আওয়াজ এবং বজ্রপাতের ক্ষীণ শব্দ ছাড়া কোনো কথা যেনো আসছে না। মাহতিমের এমন চুপটি দেখে মেহনূর খুব সংশয় নিয়ে চোখ খুলে তাকালো। অন্ধকারে সবকিছু অদৃষ্ট হলেও আচমকা আকাশ ফেটে বিদ্যুৎপৃষ্ঠের আলো এসে ঢুকলো। সেই আলোতে মাহতিমের মুখটা দেখতে পেয়ে আবার সেটা অন্ধকারে তলিয়ে গেলো। মাহতিম ওর কানের পেছন থেকে হাত সরিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে দিলো, বামপাশে থাকা মেহনূরের হাতটা ভাঁজে-ভাঁজে ধরতে লাগলো। মেহনূর নিজের হাতের উপর ধীরস্থিরে কার্যাদি টের পেয়ে মাথাটা সেদিকে ঘুরিয়ে একপলক তাকালো। মাহতিম যে খুব কায়দামতো আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে নিচ্ছে সেটা বিদ্যুপৃষ্ঠের আলোতে একঝলক দেখতে পেলো। মেহনূর সেদিকে উদ্বেগপূর্ণ চাহনিতে তাকিয়ে থাকলে মাহতিম ওর মুখের দিকে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– এইমূর্হতে তোমার কাছ থেকে চুমুর অধিকারটা চাইতাম না মেহনূর। নিশ্চয়ই তুমি আমার কথা শুনে আমাকে চরম অসভ্য ভেবে ফেলেছো। ভাবছো লোকটার চরিত্র আসলেই খুব খারাপ, বিয়ে করতে দেরি, অধিকার খাটাতে দেরি করলো না। মেহনূর, এই সময় আমাকে খারাপ ভাবে নিও না। আমার হাতে সময় কম, তোমাকে তিনটা দিনের বেশি সময় দিতে পারবো না। একটু আগে ফিল্ড থেকে খবর এসেছে। ভেবেছিলাম তোমাকে আরো কিছুদিন সময় দিতে পারবো, কিন্তু আমি ব্যর্থ। ওরা আমার এ্যাপ্লিকেশন ফিরিয়ে দিয়েছে, আমি এখানে কিছুই করতে পারবো না। তোমার মনে এখনো আমার জন্য শক্ত অনুভূতি হয়নি, যেটুকু আছে সেটুকু হালকার-উপর-ঝাপসা হয়ে আছে। কাজেই আমি যদি এখন চলে যাই, তুমি যে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়বে সেটা আমি জানি। খারাপ লাগছে একটা ব্যাপারে, তুমি আমার জন্য পাকাপোক্ত ভাবে কিছুই ফিল করো না। আমি যে চলে যাচ্ছি, এ ব্যাপারে তোমার খারাপও লাগবেনা।
মাহতিমের কথা কিছুই ধরতে পারলো না মেহনূর। শুধু এটুকু সে বুঝতে পারলো, মাহতিম খুব শীঘ্রই নিজের কর্মজীবনে ফিরে যাচ্ছে। মাহতিম কর্মজীবনের কোন্ স্তরে কাজ করছে সে সম্বন্ধে এখনো কিছু জানেনা মেহনূর। আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে হাতটা শক্ত করে ধরলো মাহতিম। মূহুর্ত্তের ভেতর হাতটা কাছে টেনে আনলো সে, মেহনূরের উপর থেকে সরে গিয়ে কোমরের কাছটায় গেলো। মেহনূরের কোমরটার দিকে ডানহাত বাড়িয়ে সেদিনের মতো কিছুটা অংশ উন্মুক্ত করে নিলো। ব্লাউজটা একটু উপরে তুলে শাড়িটাও কিন্ঞ্চিত নিচে নামিয়ে ফেললো, ঠিক সাথে-সাথেই কাটাস্থানটা চোখের সামনে দেখতে পেলো মাহতিম। ওমন সুন্দর চামড়ার উপর লম্বাটে কাটাদাগটা বুঝা যাচ্ছে, মাহতিম একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ডানহাতের তর্জনী দিয়ে কাটাদাগটা স্পর্শ করতে থাকে। সেখান থেকে তর্জনী সরিয়ে আলতোভাবে বৃদ্ধাঙ্গুল চেপে ধরে। মেহনূরের দিকে মুখ তুলে ব্যথিত দৃষ্টিতে বলে,
– এখনো ব্যাথা করে?
মেহনূর সরল চাহনিতে তাকিয়ে থেকে মাথাটা ‘ না ‘ ভঙ্গিতে নেড়ে উঠে। মাহতিম তার উত্তরটুকু পেয়ে আবার জায়গাটার দিকে তাকায়, বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে দু-একবার ছুঁয়ে মাথাটা নিচের দিকে ঝুঁকায়। মুঠোয় থাকা মেহনূরের হাতটা আলতোভাবে ধরে, চোখদুটো বন্ধ করে কাটাদাগটার উপর নমনীয় ঠোঁটদুটোর চাপ দেয়। কোমরের উপর মৃদ্যু চাপের অনুভূতিতে সংকোচ-উৎকন্ঠায় মেহনূর সংকুচিত হয়ে যায়। মাহতিমের বলপূর্ণ হাতটাকে নিজের সরু-সরু আঙ্গুল দিয়ে লতার মতো আঁকড়ে ধরে মেহনূর, ভেতরের দহনক্রিয়ায় উদ্বেলিত হয়ে পরে তখন। মেহনূরের কোমল চামড়া থেকে স্পর্শ সরিয়ে মেহনূরের হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। মেহনূর চোখ খুলে তাকালে ততক্ষণে মাহতিম স্বাভাবিক রূপে বিছানায় শুয়ে পরে। পায়ের নিচ থেকে কাথাটা টেনে বুক পর্যন্ত ঢেকে ফেলে। ব্যস্ত সুরে মেহনূরের দিকে বলে,
– ঘুমাও, আমি আর বিরক্ত করবো না। কাথাটা অর্ধেক ছেড়ে দিচ্ছি, দরকার পরলে টেনে নিও।
মাহতিম কথাটুকু শেষ করে মেহনূরের দিকে পিঠ দিয়ে ঘুমালো। মেহনূর সেই পিঠটার দিকে অপলক ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে নিজেও শেষমেশ অন্যপাশ ফিরে শুলো। মাঝখানে সামান্য দূরত্ব রেখে দুজন দুদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মাহতিম সারাদিনের ধকল শেষে বিছানায় শুতেই ঘুমানোর জন্য দেরি করলো না। শরীরের সব ক্লান্তি শেষে একটু বিশ্রামের জন্য ঘুমে তলিয়ে গেলো তৎক্ষণাৎ। এদিকে মেহনূর শত চেষ্টা করেও চোখে ঘুম আনতে সক্ষম হলো না। যখনই চোখদুটো ঘুমে ঢুলে আসে, তখনই বজ্রপাতের ঠাস-ঠাস আওয়াজে গা কাঁপিয়ে শিউরে উঠে। এতোক্ষন বজ্রপাতের শব্দ কম হচ্ছিলো, কিন্তু এখন তীব্রভাবে শব্দ হওয়াতে বিছানা সুদ্ধো কেঁপে-কেঁপে উঠছে। ছোট থেকে বজ্রপাতের ভীতি আছে ওর, কান ফাটিয়ে বিকট শব্দ হলে অপ্রতিভ অবস্থায় পরে যায় মেহনূর। কানে দুহাতের তালু চেপে আছে, শব্দ না শোনার বৃথা চেষ্টা হিসেবে চোখ কুঁচকে আছে। এদিকে বাজের শব্দ যেনো প্রতিযোগিতার মতো হচ্ছে। কার চেয়েকে বেশি শব্দ করবে, সেটা নিয়ে যু’দ্ধ চলছে। ভয়ের চোটে চোখও বুজতে পারছেনা মেহনূর। ভয়ে-ভয়ে চোখদুটো খুললে আকাশ চিড়ে দিনের আলো ফুটে উঠলো। ওমনেই মেহনূর প্রচণ্ড আতঙ্কে ব্যতিব্যস্ত হয়ে মাহতিমের পিঠের দিকে ধেয়ে আসলো। কাথার ভেতরে গা লুকিয়ে পিঠের সাথে গুটিশুটি মেরে থাকলো। মাহতিম তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘুমে মত্ত ছিলো, কিন্তু পিঠের কাছে বিড়াল ছানার মতো নড়াচড়া টের পেলে চট করে চোখ খুলে তাকালো। ভ্রুঁদুটো সামান্য কুঁচকে ঘাপলা বোঝার চেষ্টা করলো। মেহনূর কেনো নড়াচড়া করছে, সেটা প্রথমে স্পষ্ট না হলেও শেষে বজ্রপাতের বিষয়টা ধরতে পারলো। কয়েক মিনিট চুপ থেকে মাহতিম ওই অবস্থায় শান্ত সুরে বললো,
– ওদিকে মুখ ঘুরাও।
আদেশসূচক কথা শুনে মেহনূর দৃষ্টি উপরে তুললো, মাহতিম ওকে দূরে ঠেলতে চাইছে দেখে ওর মনটা ভীষণ ক্ষুদ্ধ হলো। মেহনূর নির্বাক হয়ে ভাবশূন্য হয়ে গেলে মাহতিম ওকে আবার বলে উঠলো,
– তোমাকে কিছু বলেছি মেহনূর আফরিন। তখন যেভাবে শুয়েছিলে, ওভাবে মুখ ঘুরিয়ে শোও।
মেহনূর হতভম্ব চাহনিতে তাকিয়ে থেকে ধীরে-ধীরে পিছনের দিকে সরে গেলো। একপর্যায়ে অন্যপাশে মুখ ঘুরাতেই আগের মতো চুপচাপ ভঙ্গিতে শুয়ে পরলো। ভয়ের কারণে কুণ্ঠিত মনটা ভাঙ্গা কাঁচের মতো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো ওর। মাহতিম কি ওর কাছে অব্যক্ত কিছু চেয়েছিলো? যেটার জন্য সে রাগ পুষিয়ে অভিমান দেখিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো? মেহনূর ভারী একটা নিশ্বাস ছেড়ে চোখ বুজে নিলো ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণে চরমভাবে আশ্চর্য হয়ে গেলো সে। মাহতিম ওকে পেছন থেকে স্বল্প দূরত্ব রেখে আগলে ধরেছে, একটা হাত মেহনূরের গলার নিচে সাবধানে রেখে দিচ্ছে। কাথাটা দিয়ে গলা পযর্ন্ত ঢেকে দিয়ে কানের কাছে মুখ এনে বলে,
– ভয় নেই, আমি আছি। বেশি ভয় লাগলে আমার হাতটা ধরতে পারো।
মেহনূর কন্ঠের শিহরণে চমকে উঠলে দ্রুত চক্ষুজোড়া বন্ধ করে ফেললো। তৎক্ষণাৎ একটা বাজের শব্দ হলে জীর্ণশীর্ণ মনে গলার নিচে পেশিবহুল হাতটা দুহাতে খাবলে ধরলো। মাহতিম খানিকটা হেসে দিয়ে বালিশে মাথা রেখে দিলো। মেহনূরের ভয়ার্ত অবস্থা দূর করার জন্য পেশিবহুল হাতটা দিয়ে শক্ত করে ধরে থাকলো। অন্যহাতটা দিয়ে মেহনূরের খোঁপাটা খুলে চুলগুলো আঙ্গুলে পেঁচাতে লাগলো, আঙ্গুলের ডগা দিয়ে মাথার চামড়ায় স্পর্শ করতেই আলতো সুরে বললো,
– তখন আমার হাতে চুমু কিভাবে দিলে? একটুও লজ্জা করলো না?
মেহনূর গলা ভিজিয়ে ঢোক গিলে শান্ত ভাবে উত্তর দিলো,
– আম্মা বলেছিলো।
মাহতিম উত্তর শুনে আহাম্মকের মতো তাকালো। চুলের চামড়ায় স্পর্শ করা বাদ দিয়ে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
– তোমার মা তো দেখি সাংঘাতিক মহিলা। সে কি করে জানলো তোমার চুমু পেলে আমি খুশী হবো?
কথার খোলাখুলি অবস্থা দেখে খুক করে কেশে উঠলো মেহনূর। গলাটা একটু খাকারি দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বললো,
– স্বামীকে সম্মানিত ব্যক্তি বুঝাতে এই নিয়ম পালন করতে হয়।
মাহতিমও ওকে জেরা করার জন্য প্রশ্ন করে বললো,
– তুমি কি তাহলে সম্মান করো?
কোনো উত্তর এলো না মেহনূরের কাছ থেকে। মাহতিম ব্যকুলরূপে অপেক্ষা করলো, কিন্তু আর শোনা হলো না উত্তরটা। মেহনূর গভীর নিদ্রায় ডুবে গিয়ে শরীর ছেড়ে দিলো। ধীরগতিতে শরীরের ভারটা মাহতিমের বুকের সাথে মিশে যেতে থাকলো। গলার কাছ থেকে খাবলে ধরা হাতদুটো ঢিলা হয়ে খসে পরলো। মাহতিম ওর ঘুমের উপস্থিতি বুঝতে পেরে নিজের বুকটার সাথে মেহনূরের পিঠটা পুরোপুরি মিলিয়ে দিলো। মাথা থেকে হাত সরিয়ে চুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে দিলো, কেশবহুল মাথায় চোখ বন্ধ করে নাক ঘষতে লাগলো কিছুক্ষণ। কেশের মোহে রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে তলিয়ে যাচ্ছিলো মাহতিম। ছোট-ছোট উষ্ণ-স্পর্শ করছিলো মেহনূরের কেশের মধ্যে। কেশের রাজ্য থেকে মুখ সরিয়ে বালিশ থেকে মাথা উঠালো। মেহনূরের ঘুমন্ত মুখটার দিকে দৃষ্টি রেখে মনে-মনে বললো,
– কাছে আছি বলে গুরুত্ব বুঝতে পারছো না। দূরে চলে গেলে কি করবে?
তীব্র আক্ষেপে নত হয়ে মাহতিম ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছাড়ে। গলার কাছ থেকে হাত সরিয়ে এলোমেলো চুলগুলো গলা থেকে সরাতে থাকে। ওমনেই কালো বিন্দু-তুল্য তিলটার দিকে চোখ আটকে যায় ওর। মেহনূরের ঘুমন্ত মুখটা আরেকবার দেখে নিতেই আনমনে হেসে ফেললো। মাহতিম গলার দিকে ঝুঁকে গেলে মেহনূর সাথে-সাথে ঘুমের ঘোরে চাপা আর্তে ‘ আম্মা ‘ বলে উঠলো। দেহের ক্লান্তি আর ঘুমের জোর এতোটাই বেশি ছিলো মেহনূর আবার বেঘোরে ঘুমের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে গেলো। কিছুই টের পেলো না তখন।
.
ভোরের আকাশটা নির্মল এখন। পাখির কিচিরমিচির ডাকে চারপাশ মুখরিত। গতরাতের বৃষ্টিতে সব ধূলো-ময়লা ধুয়ে গেছে। গাছের পাতাগুলো সবুজ রঙে সজীব হয়ে উঠেছে। প্রাণবন্ত হয়ে গেছে আশেপাশের পরিবেশ। গ্রামের মানুষগুলো ঘুম শেষে জাগ্রত হচ্ছে এখন। কর্মকাণ্ডে যোগদানের জন্য কলপাড়ে প্রাতঃকাজ সম্পণ্ণ করছে তারা। গৃহিনী মহিলারা ঝাড়ু হাতে কোমর নুইয়ে উঠোন সাফ করছে, পুরুষরা তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে দাঁত পরিস্কারের কাজ সারছে। পরিশ্রান্ত প্রকৃতি সকালের প্রথম রোদে ঝলমলিয়ে উঠেছে। হান্নান মোল্লা গতরাতে ঘুমাতে পারেননি, মেজো বউয়ের কাজকর্ম দেখে একমূর্হতের জন্য স্বস্তি পাননি। সুজলা সবসময়ের মতো আগে উঠে ঘর-দুয়ার দেখতে থাকলো। মাহমুদা সকালের নাস্তা তৈরিতে আটা নিয়ে বসে পরলো। বাকিরা খুবই আরাম-আয়েশে ঘুমে ডুবে থাকলো, বিশেষ করে শেফালী আরো দেরি করে ঘুম থেকে উঠলো। মেহনূর ঘুমে ঢুলু চোখদুটো শান্তভাবে খুললো, বড় একটা হাই তুলে হাতের তালুতে হাই ঢেকে নিলো। চোখদুটো কচলে হঠাৎ মাহতিমের কথা মনে পরলো। সাথে-সাথে ধপ করে বিছানা থেকে উঠে আশেপাশে তাকাতে লাগলো, কিন্তু মাহতিম রুমের কোথাও নেই। মেহনূর এলোমেলো চুলগুলো খোপা পাকাতেই গা থেকে কাথা সরিয়ে নিলো। বিছানা থেকে নেমেই টেবিলের দিকে বন্ধ জানালাটা খুলে দিলো। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো সে। আকাশের উদাসী ভাব আজ আর নেই, মেঘাচ্ছন্ন রূপ এখন সাদা-সাদৃশ্যে ছেয়ে আছে। দূরের তেপান্তরে সোনালী রোদের ঝিকিমিকি চলছে। মেহনূর সেখান থেকে সরে এসে গোসল করে আসে। গায়ে সাদা শাড়ির সাথে গোলাপী রঙের ব্লাউজ পরে। ভেজা চুলগুলো গামছায় পেঁচিয়ে সোজা রুমে এসে ঢুকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো মুছতে থাকে। মেহনূর একমনে চুল মুছতে থাকলে পেছন থেকে শেফালী নিঃশব্দে রুমে ঢুকে পরে। কোনোযূপ অনুমতি ছাড়া রুমে ঢুকাটা ওর নিত্যদিনের বাজে স্ব’ভাব। মেহনূরকে ভয়াবহ ভাবে চমকে দিয়ে শেফালী চড়া গলায় তাচ্ছিল্যের হাসিতে বললো,
– তোর কপালে বিয়া জুটলো তাহিলে?
মেহনূর থতমত দৃষ্টিতে আয়না থেকে মুখ ঘুরিয়ে শেফালীর দিকে তাকালো।শেফালীর দিকে চোখ উঠানোর সাহস করেও চোখ উঠাতে পারলো না মেহনূর। চুল থেকে গামছা সরিয়ে দ্রুত হাতটা নিচে নামিয়ে ফেললো। শেফালী এক কদম এগিয়ে এসে নতুন শাড়িটার ফেব্রিক দেখতে লাগলো। তিন আঙ্গুলে চেক দিয়ে হাসতে-হাসতে বললো,
– কম দামী কাফুর।
এরপর যা হলো সেটার জন্য ঢপ খেলো দুজনই। শেফালী খুব চালাকি করে মেহনূরের হাতটা মুচড়ে ধরার চিন্তায় ছিলো, যেটা সে সুযোগ মতো সবসময় করতে আসে। কিন্তু সে চিন্তায় পানি ঢেলে মাহতিম ব্যস্তভঙ্গিতে রুমে ঢুকে। শেফালীর চালাকি এক লহমায় বুঝতে না পারলেও ভালো কিছু যে করতে আসেনি, সেটা ভালোভাবে বুঝেছে। শেফালীও মাহতিমের হূটহাট আগমন দেখে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাহতিম রুমে হাসিমুখে ঢুকেছিলো, কিন্তু শেফালীর উপস্থিতি দেখে মেজাজটা চরমভাবে বিগড়ে গেলো। শেফালীকে ইচ্ছামতো অপমান করে তাড়াতে পারলে শান্তি লাগতো। মাহতিম নিজেকে ধাতস্থ করে সহজাত কন্ঠে বললো,
– আপনার আগমন যে ভালো লাগলো না মামী। আপনি এখানে কি করতে এসেছেন? এখানে কি প্রয়োজন? সেটা বললে একটু হেল্প করতে পারতাম।
শেফালী এমন কথার প্যাঁচ দেখে কি উত্তর দিবে খুঁজে পাচ্ছিলো না। অহেতুক কারণে শুধু হিহি করে হেসে দিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে কেটে পরলো। শেফালী চলে গেলে মেহনূর নিজের কাজে পুনরায় মনোযোগ দিলো। আয়নায় চুল মুছতেই আড়চোখে মাহতিমকে দেখতে পেলো। একদম হালকা নীল রঙের পাণ্ঞ্জাবী পরেছে মাহতিম, যার গলার কলারটা গাঢ় নীল। মেহনূরের কিছুটা পেছনে দাড়িয়ে সেও আয়নায় তাকিয়ে চুলের ব্যাকব্রাশ করছে। মেহনূর আড়চোখে তাকানো বন্ধ করে গামছায় কানটা মুছে নিচ্ছে, কিন্তু গলার দিকে নজর পরতেই তৎক্ষণাৎ ভ্রুঁদুটো কুঁচকে গেলো। গলার কাছে কালো তিলটার উপর লাল হয়ে আছে। গোল করে রক্ত জমে জায়গাটা কেমন হয়ে গিয়েছে। মেহনূর কপাল কুঁচকে জায়গাটার উপর আঙ্গুলে বুলাচ্ছিলো। কৌতুহল মনে বারবার জায়গাটার উপর জোরে চাপ দিচ্ছিলো, কিন্তু আয়নার দিকে নজর যেতেই প্রচণ্ড আশ্চর্য হয়ে গেলো। মাহতিম আয়নায় তাকিয়ে দাম্ভিকতার সাথে পাণ্ঞ্জাবীর বোতামগুলো লাগাচ্ছিলো, কিন্তু মেহনূরের চাহনি দেখে সাথে-সাথে বাঁকা ঠোঁটে হেসে দিলো মাহতিম। মাহতিমের কপটাচারী হাসি দেখে কপালের ভাঁজগুলো স্বাভাবিক হয়ে গেলো মেহনূরের। আকাশচুম্বী বিষ্ময় নিয়ে হা হয়ে গেলো সে।
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO
( #নোটবার্তা : সামনে আমার বোর্ড পরীক্ষা, এটা সকলেই জানেন। প্রচুর চাপে আছি আমি, আশা করছি সবাই আমার ব্যক্তিগত হালটা বুঝতে পারবেন। অবশ্যই আপনাদের ভালোবাসা দেখে কৃতজ্ঞ আমি। শ্রদ্ধা রইলো সবার জন্য।)
#আপডেট_বার্তা : কিছু ভুলক্রুটি সংশোধন করেছি, যেগুলো পূর্বে করার সময় পাইনি। 💜