মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤ #পর্বসংখ্যা_৪৯. #ফাবিয়াহ্_মমো . অংশ সংখ্যা – শেষ .

0
1849

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৯.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

অংশ সংখ্যা – শেষ .

মাহতিম ওই মূহুর্তে কিচ্ছু চিন্তা করতে পারছিলো না! মাথাটা একদমই কাজ করছেনা! মেহনূর উন্মাদের মতো সমুদ্রের দিকে ঝাঁপ দিতে আসছে! অপরদিকে স্রোতের তুমুল উত্থালে দূরে চলে যাচ্ছে মাহদি। দুদিক থেকে বিরাট সমস্যার মোকাবিলা আগেও করেছে মাহতিম, কিন্তু এবারেরটা পুরোই ভিন্ন। আবেগের ঘনঘটা তাকে গোগ্রাসে গিলে ধরেছে, মেহনূর যতোই সাঁতারে পটু হোক, সমুদ্রের কাছে সে পারবে না। সৌভিকরা মাহদির জন্য ঝাঁপিয়ে পরলেও সাঁতরে বেশিদূর যেতে পারেনি, তারা পিছিয়ে যাচ্ছে স্রোতের ধাক্কা খেয়ে। মাহতিম লম্বা-লম্বা নিশ্বাস ছাড়তেই চোখ বন্ধ করলো, তার মাথাটা ঠিকভাবে কাজ করা প্রয়োজন। তার সচল মস্তিষ্কটা বারবার নেতিয়ে পরছে, ঠোঁট কাঁপছে প্রচুর, কেনো এমন হচ্ছে? হওয়ার কারণটা কি? আগে তো এমন অবস্থা হয়নি? শত্রুর হাতে ধরা খেয়েও মৃত্যুর ভয়ে বুক কাঁপেনি, আজ কেনো ভেতরটা ভেঙেচুড়ে শেষ হয়ে আসছে? তার ক্যালকুলেশন মতে কেউ কি শেষ হতে যাচ্ছে? মেহনূর কি সমুদ্রের পানিতে ঝাঁপ দিয়ে দম হারাবে নাকি, মাহদি … ক্যালকুলেশন বারবার গুলিয়ে যাচ্ছে, সূত্র বসাতে ভুল করছে, কেনো এমন হচ্ছে? তার ট্রেনিংয়ের সিক্যুয়েন্সগুলো এভাবে বেখাপ্পা হয়ে যাচ্ছে? কোনো কঠিন সত্যের জন্যই কি ভেতরটা ধসে-ধসে ভাঙছে? মাথা কাজ করছেনা, সমুদ্রের অতল গহ্বরের কাছে মস্তিষ্কের গভীরতা কাজ করছেনা।

নাক দিয়ে, মুখ দিয়ে নোনাপানি ঢুকছে। অবাধে ছোট্ট দেহটার ফুসফুস থলির ভেতর অক্সিজেন শূন্য হচ্ছে। মস্তিষ্কের ক্রিয়া আস্তে-আস্তে সুইচ টেপা বাতির মতো নিভে আসছে। মনে হচ্ছে, কেউ যেনো মাথার ভেতর ঢুকে সব বাতিগুলো টপটপ বন্ধ করে দিচ্ছে, বন্ধ করতেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে মাথার যন্ত্রটা নিস্তেজ হয়ে আসছে। শরীরের উপর কয়েক শো টনের ভার অনুভূত হচ্ছে, নিশ্বাস ফুরিয়ে শূন্য স্কেলের দাগে পৌঁছেছে। জীবনের মায়াটা হাতছানি দিয়ে তাকে বিদায় জানাচ্ছে, যেনো বলছে ওপারে ভালো থেকো মাহদি। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা, কোনোকিছু স্বচ্ছ না। পানির তলে বহুক্ষণ যাবৎ যুদ্ধ করেও কারোর নাগাল ছুঁতে পারেনি। কান্নার অশ্রুগুলো সমুদ্রের নোনাপানিতে মিশে গেছে, আলাদা করে যাবে না তার অশ্রুগুলো। উঁচিয়ে রাখা হাতদুটো আস্তে-আস্তে পানির উপর ধপাস-ধপাস করে পরলো, হাতে আর শক্তি নেই, শক্তি শেষ। পানির নিচে পাদুটো পাগলের মতো দানাদাপি করে মুখটা শেষবারের মতো উপরে তুলতে পারলো, গলা অবধি শরীরটা পানির নিচে কাতরাচ্ছে। মুখ হা করে শেষ নিশ্বাসগুলো টানার সময় স্তব্ধ কানে ‘ ভো ভো ‘ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কেউ ‘ মাহদি, মাহদি ‘ বলে জান-প্রাণ দিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। সুরসুর করে আরো একদফা পানি নাক দিয়ে ঢুকলো মাহদির, সোজা মাথার ভেতর ছ্যাৎ করে আঘাত হানতেই নিশ্বাসে দারুণভাবে টান খেলো। যন্ত্রনায় কাতরাতে গিয়ে দুই হাত সমানতালে ঝাপটাতে লাগলো, পানির উপর ঝপাস-ঝপাস আওয়াজ হলো আবার। গলাকাটা মুরগির মতো কিছুক্ষণ দাপাতে লাগলো, এরপরই নিস্তেজ মুরগির মতো শান্ত হয়ে গেলো মাহদি। দুচোখের পাতা এক হয়ে রঙিন দুনিয়াটা ঢেকে গেলো, শরীর হালকা হতে-হতে পানির তলে নেমে গেলো। আরো তলে, আরো গভীরে, আরো অতলস্পর্শী জায়গার ভেতর যেতে-যেতে দিনের আলোটা ফিকে হয়ে আসতে লাগলো। জীবনের শেষ সন্ধিটুকুতে ফ্যাকাশে ঠোঁটে ক্ষীণভাবে হাসলো মাহদি, মানসপটে শৈশবের সেই দৃশ্য থেকে জীবনের সমস্ত মধুর দৃশ্যগুলো স্মৃতির দেয়ালে চলে আসলো। মনে পরলো, অবুঝ বয়সে তার ভাই কত রাত ঘুমায়নি। অসুস্থ হলে বুকে টেনে ঘুম পাড়িয়ে দিতো, কখনো-কখনো মায়ের পরিবর্তে সে-ই গোসল করিয়ে দিতো। বাবাহীন জীবনে সকল বায়নাক্কা তার ভাই-ই পূরণ করেছে। জন্মদিনে ভাইয়ের কাছে কম্পিউটারের বায়না করেছিলো, দামটাও ছিলো ঢের। তাও নিজের বেতন দিয়ে সেই শখ পূরণ করেছিলো মাহতিম, সাইকেলটাও এনেছিলো বিদেশী ব্র‍্যান্ডের। তার ভাই তো তাকে ভালোবাসেই, কে বলেছে আদর করেনা? যদি আদর না করতো তাহলে কি সমুদ্রের মধ্যে বাঁচাতে আসতো? কই, সৌভিক ভাইয়ারা দেখি পিছিয়ে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। কিন্তু ভাইয়া তো ভাইয়াই, সে যে এখনো বাঁচাতে ছুটে আসছে। বাবার আদর, মায়ের আদর, স্বজনের আদর সবার আদর ভাইয়া একাই দিয়েছে। কখনো বাবার মতো ছায়া হয়ে থাকতো, কখনো ভাইয়ের মতো ঢাল হয়ে দাঁড়াতো। জীবনে এইটুকু বয়সে কখনো একা-একা লাগেনি, তার ভাইয়া ছুটি থেকে ফিরলে তাকে একা রেখে কোথাও ঘুরেনি। পকেটের ফোনটাও তো ভাইয়ার দেওয়া, তাহলে সে কেনো ভাইয়াকে আজ কষ্ট দিলো? খাবার টেবিলে ওসব কথা বলে কষ্ট দেওয়া হলো না? কেনো বললো ওসব? মেহনূরকে আর বিয়ে করা হলো না, ভাইয়া বুড়ো হয়ে গেলে মেহনূর একা থেকে যাবে। তার তো কেউ নেই। ভাইয়া কি মেহনূরকে দেখে রাখবে? মেহনূর সবার চেয়ে আলাদা, কেউ ওর মতো নয়। সবাই স্বার্থপর, সবাই খারাপ, শুধু মেহনূর তাকে খুব চোখে-চোখে রাখতো। রজনী মামী কি মেহনূরকে খুব মা’রবে? হঠাৎ নিশ্বাসের শেষ টান খেয়ে কাশতে লাগলো মাহদি, তার শরীরটা শেষের দিকে এসে পরেছে। মুখের ভেতর সমুদ্রের নোনাযুক্ত বিদঘুটে স্বাদ, পেটটাও এমন ভরে গেছে যেকোনো সময় বোমার মতো ফেটে যাবে। শরীরটা ছেড়ে দিয়েছে সে, ভরহীন শরীরটা তলিয়ে যাচ্ছে, নিচ থেকে কেউ যেনো সাদরে টেনে নিচ্ছে তাকে। সমুদ্রের অতল অন্ধকারে চেতনার শেষ সময়টুকু চলছে, চোখের সামনে সব শূন্য হতে শুরু করেছে। দেহ-মন-মস্তিষ্ক সবকিছু কোথাও মিলিয়ে যেতেই চূড়ান্ত নিশ্বাস ছেড়ে দিলো, অন্ধকূপের দৃষ্টিতে ছেপে উঠলো একটি মুখ, একটি হাসি-হাসি চেহারা, একটি সুদর্শন আদলের যুবক। তার দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসি দিয়ে কপালে গাঢ় চুমু খেলো। যুবকের চোখদুটোয় কি আনন্দ, আনন্দে চোখের ভেতর পানি চিকচিক করছিলো। সদ্য নবজাতকের ফুটফুটে দুটো গালে চুমু খেয়ে আদরে-স্নেহে গালে-গাল জড়িয়ে রাখলো। ফিসফিস করে নবজাতকের কানে বললো, ‘ তোর নাম দিলাম মাহদি। আমার মাহদি আনসারী। আমার কলিজার ভাই প্লিজ দ্রুত বড় হ।’

.

বাংলাদেশের স্বনামধন্য কক্সবাজার সমুদ্র-সৈকতটা এখন রেড এলার্টে সিল করা হয়েছে। দলে-দলে সমুদ্রের উপর ডুবুরিদের হামলা হচ্ছে, দূর থেকে উৎসুক পর্যটকদের ভীড় বড় হচ্ছে। বালুর উপর অনেকগুলো মানুষ এসেছে, কারো-কারো পড়নে আর্মিদের মতো পোশাক, কারো পড়নে সাদা রঙের অদ্ভুত ইউনিফর্ম। ট্যূরিস্ট পুলিশ, স্থানীয় পুলিশ, টহল দল, ডুবুরিদের বিশাল ফোর্স, জেলা প্রশাসন থেকে কিছু গুণী ব্যক্তিবর্গদের গাড়ি যেনো হৈচৈ অবস্থা করে ফেলেছে। কৌতুহল পর্যটকরা এতোক্ষণে বুঝে ফেলেছে, এখানে কোনো বিশেষ ব্যক্তি তার পরিবার নিয়ে এসেছে। সবার সাথেই সাধারণ মানুষদের মতো চলাফেরা করেছে তারা। যার দরুন তারা কেউই বুঝতে পারেনি সেই বিশেষ ব্যক্তিটা এতো ক্ষমতাসীন ছিলো। একটু আগে আবাসিক হোটেলের সামনে সাইরেন বাজাতে-বাজাতে দুটো এ্যাম্বুলেন্স এসে থেমেছে, এটা তাদের কাছে বেশ বিরল চিত্রের মতোই লাগছে। কখন-কিভাবে-কি হলো তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেনা। একটা এ্যাম্বুলেন্স হোটেলের দোরগোড়ায় থামলো, হুড়মুড় করে হোটেলের ভেতরে ডাক্তারদের একটা টিম ঢুকে গেলো। একটু আগে সবাই দেখেছে শাড়ি পড়ুয়া একটা মেয়েকে অচেতন অবস্থায় হোটেলের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে একদল শিক্ষার্থী কক্সবাজার ট্যূরের জন্য এসেছে, তাদের পুরো দলটাই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সমুদ্র-তীরের দৃশ্য দেখে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও স্মার্ট মেয়েটা ন্যাকান্যাকা সুরে বললো,

– আমার কিন্তু অসহ্য লাগছে। প্লিজ এখান থেকে চলতো। অন্যের ম্যালোড্রামা দেখার টাইম আছে? আমরা সেফে আছি, সেটা নিয়ে চিল করা উচিত না?

মেয়েটার দিকে পুরো ছেলেদলটা গরম চোখে তাকালো। তাদের ভেতর থেকে চশমা পরা বিজ্ঞ-বিজ্ঞ চেহারার তূর্য বললো,

– তোর কাছে মানুষের মৃ’ত্যুটা ড্রামা লাগে? চোখের সামনে নিজেই তো দেখলি ছোট্ট একটা ছেলে পানিতে ডুবে নিখোঁজ হলো। এখনো ছেলেটার লাশ পাওয়া যাচ্ছে না। যেই অফিসারের রিলেটিভ ম’রেছে উলটো তার দিকেই তুই ত্যাড়া চোখে তাকাচ্ছিস। তোর মতলব কি বুঝিনি ভেবেছিস? আমরা কি এতোই মূর্খ?

ছেলেটার কাটকাট কথা শুনে মেয়েটাও চড়া গলায় বললো,

– তোর যদি এতোই মায়া লাগে তাহলে নিজেই লা’শ খোঁজ না! এখানে এসে লেকচার কেনো দিচ্ছিস? এতোই যখন আমার মতলব বুঝেছিস তাহলে যেয়ে লেগে পর। তোর মতো জনদরদী হওয়ার ইচ্ছে তো আমার নেই।

তূর্য দৃষ্টিচ্যূত হলো। ফোর্সের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সোজাসুজি ইতির পানে তাকালো। ইতির মেয়ে সঙ্গীরা বুঝে গেছে এখন দুজনের তুমুল তর্কযুদ্ধ বাঁধবে। তাড়াতাড়ি মধ্যকার যুদ্ধটা স্থগিত করার উদ্দিশ্যে ইতিকে টানতে-টানতে অন্যদিকে নিয়ে গেলো তারা। পরাস্ত ইতি চোখ পাঁকিয়ে রাগে গজগজ করে বললো,

– তোরা আমাকে আনলি কেন? দিতাম দুটো গালি শুনিয়ে। ফাজিল কোথাকারটা যখন-তখন আমার উপর তেড়ে আসে। অসহ্য কাজকর্ম! আমি থাকবো না এদিকে, বাসায় চলে যাব।

ইতিকে ঠান্ডা করার জন্য মিলি নামের মেয়েটা নিজের কোকের বোতল ধরিয়ে দিলো, খাওয়ার জন্য ইশারা করতেই শান্ত কন্ঠে বললো,

– চেতিস না। তূর্যকে শুধুশুধু আমরা গ’বেট বলি? ও তো আস্তো একটা গ’বেট! আচ্ছা সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুঁজে থাকলেই কেউ নিউটন হয়? উহু, ভেতরে চিয়ার্স ভাইবটা থাকা লাগে।

মিলির ভুল বক্তব্য শুনে ভ্রুঁ কুঁচকালো আফরা। পড়াশোনায় ভুল তথ্য শুনলে তার মাথায় ঢিংঢিং ঘন্টা বাজতে থাকে, এখনও তাই হচ্ছে। মিলিকে খপ করে নিজের যুক্তির ভেতর ধরলো সে,

– তুই নিজে গ’বেট হয়ে তূর্যকে গ’বেট বলিস? নিউটন কবে চিয়ার্স ভাইব রেখেছে রে ছা’গল? আইজ্যাক নিউটন যদি একটু হলেও চিয়ার্স ভাইব রাখতো, তাহলে আজ তার কপালে বিয়ের তকমা থাকতো বুঝলি? ওই ব্যাটার একটা গার্লফ্রেন্ডও ছিলো। বাট, আফসোস ব্যাটার অন্যমনা স্বভাবের জন্য গার্লফ্রেন্ড তাকে ছেড়ে যায়।

মিলি, ইতিসহ সব মেয়েরা মুখরোচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আইজ্যাক নিউটনের ঘটনা শুনতে গিয়ে হঠাৎ ইতি অন্যমনষ্ক গলায় মিহি করে বললো,

– ওই লোকটা খুব মারাত্মক দোস্ত। সে জাস্ট একবার দিকে তাকিয়েছিলো। মুখটা ক্লিন, নো দাড়ি। একদম আর্মি-আর্মি কাটের মতো চুল। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা কি জানিস? পানিতে ভিজে লোকটার মাশল-ফাশল বডিটা দেখার মতো। হি হ্যাজ এ্যা এ্যাক্ট্রেক্টিভ লুক, ফিগার এ্যান্ড ড্যাশিং পার্সোনালিটি।

.
সামুদ্রিক অভিযান এখনো চলছে। লাপাত্তা মাহদিকে খোঁজার জন্য পুরো ফোর্স ডেকে ফেলেছে। মাহতিমের খিটখিটে মেজাজ দেখে তার জুনিয়রদের অবস্থা শোচনীয়। বিশেষ করে, নোমান ইকবাল ঢোক গিলে একটু পরপর ভয় কাটিয়ে চলছে। মাহদির কিছু হলে মাহতিম তাদের একটাকেও ছাড়বে না, সবগুলোকে ইচ্ছে মতো ঝাড়বে। তার চেয়েওবড় কথা, মাহতিমের রাগের চেয়ে তার নিরবতাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। পুরো ডিপার্টমেন্ট জানে মাহতিমের নিরবতা কতটা ভয়াবহ। মাহতিম এখন সেই রূপেই নিরব বনে আছে। মুখে নূন্যতম শব্দ নেই। গায়ের শার্টটা ভেজা, প্যান্ট ভেজা, পুরো শরীরটাই ভিজে শেষ। বুকের কাছে দুহাত ভাঁজ করা। মুখে তালা এঁটে স্ট্যাট-কাট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার ডানে-বামে দুজন সিনিয়র পুলিশ ওয়াকি-টকিতে কথা বলে যাচ্ছে। আশেপাশের কিছু পর্যটক অবাক চোখে দেখে যাচ্ছে, কারো-কারো দৃষ্টিতে মাহতিম আঁটকে গেছে। আপাদমস্তক তার দিকে চোখ বুলিয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছে কেউ। হঠাৎ নোমানের লেফট পকেট থেকে ফোন বিপ করলো, পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করলো নোমান। কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে নিউজ শুনে বিষ্ময়ে চেয়ে রইলো। কলটা কেটে দিয়ে নিশ্বাস ছাড়লো নোমান, নিচের ঠোঁটে জিহবা বুলিয়ে সামনে তাকালো। কয়েক কদম সামনে থাকা মাহতিমের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সে, বাঁদিকের পুলিশটাকে ক্রস করে মাহতিমের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভুড়ি পেটওয়ালা পুলিশটা নোমানকে দেখে কিছু একটা বুঝে দূরে সরে গেলো। একই ভঙ্গিতে মাহতিমের ডানদিকের পুলিশটা দূরে সরলে সন্নিকটে এলো নোমান, স্বর নামিয়ে একটু আগের নিউজটা বসের উদ্দেশ্যে বললো,

– স্যার, আপনাকে হোটেলে যেতে বলেছে। ম্যামের অবস্থা একটু খারাপ।

বিশেষ প্রতিক্রিয়া নেই। যেমন ছিলো, তেমনই আছে মাহতিম। দৃষ্টি অটল, ভাব অটুট, দেহভঙ্গি শক্ত। নোমান আবার সঙ্কোচের সাথে বাকি কথাটা পাড়লো,

– ম্যামের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে স্যার। আপনার ছোট বোন ফারিন আপনাকে যেতে বলছে।

কথাটার বলার প্রায় মিনিট খানেক পেরিয়ে গেলো, মাহতিম একটুও ভ্রুক্ষেপ দেখায়নি। সে স্থির দৃষ্টিতে সমুদ্রের ফেনিল রাশিতে তাকিয়ে আছে। আশাহত নোমান যেই চলে যেতে নিবে, ওই সময় তেজালো গলায় ছোট্ট জবাব চলে এলো,

– ডাক্তারকে হ্যান্ডেল করতে বলো।

নোমান বেকুবের মতো অস্ফুট সুরে বলে উঠলো,

– জ্বী.. মানে তারা —

কথা শেষ করার আগেই দাঁত চিবিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো মাহতিম,

– ডাক্তারকে হ্যান্ডেল করতে বলেছি নোমান! গেট লস্ট!

ঝাঁজালো কন্ঠের গলা শুনে একমূহুর্তের জন্য সব চুপ! সবার দৃষ্টি কেবল মাহতিমের দিকে। ওয়াকিটকিতে কথা বলা পুলিশও কথা থামিয়ে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে আছে। নোমান আড়চোখে বিব্রতকর অবস্থা দেখে ছোট্ট করে বললো,

– সরি স্যার।

ওপাশ নির‍্যুত্তর। মুখ তুলে স্যারের শক্ত মুখের দিকে তাকালো নোমান। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হতাশার সাথে নিশ্বাস ছেড়ে চলে গেলো। সময়ের পালা এখন চারটায় এসে ঠেকেছে। মাথার উপর সাক্ষী থাকা সূর্যটা এখন পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু আগে হেড অফিস থেকে কল এসেছিলো, মাহতিম সেই কলে রিসপন্স করতে পারেনি। মাহতিম জানে, তারা আজকের ভেতর ফিল্ডে ফেরার জন্য তাগাদা দিবে। একমাত্র এটার জন্যই এইমূহুর্তে কল এসেছে, নাহলে আসতো না। নিজেকে একটু স্থির করে হেড অফিসের জন্য কল করলো মাহতিম, কয়েক টোন বাজতেই রিসিভ হলো কলটা,

– হ্যালো,

হেড অফিসের বিশেষ ব্যক্তির উত্তরে মাহতিম বললো,

– আনসারী বলছি।

মাহতিমের কন্ঠ পেয়ে ধাতস্থ হলো বিশেষ ব্যক্তি। সমবেদনার মতো বিমর্ষ সুরে বললো,

– তোমাকে আজই ফিরতে হবে মাহতিম। আই এ্যাম সো সরি। তুমি তো রুলস রেগুলেশান জানোই। আমি এর চেয়ে বেশি কিছুই করতে পারবোনা, আমি রুলস মানতে বাধ্য।

আক্ষেপে চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। কানে ফোন ধরা অবস্থায় জোরে নিশ্বাস ছাড়লো সে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চোখ খুলে হালকা কেশে বললো,

– সমস্যা নেই। আমি নিজেও ডিপার্টমেন্টকে এক্সকিউজ দিতাম না। কিন্তু, স্যার, যদি ডিউরেশনটা একটু বাড়ানো যেতো…

মাহতিমের অসম্পূর্ণ কথাটা ওপাশের ব্যক্তি চট করে বুঝলো,

– আজ মানে আজই মাহতিম। আমি এ বিষয়ে কিছুই করতে পারবো না। তোমাকে আজই ফিরতে হবে, আমি রুলসের এ্যাগেনেস্ট যেতে পারবো না। প্লিজ ট্রায় টু আন্ডারস্টেন্ড ম্যান।

কথা বাড়ালো না মাহতিম। তাদের বলে অবশ্য লাভ নেই। একরোখা কর্মজীবনে সবকিছুই একমুখী হয়ে গেছে। ‘ ইমোশন ‘ শব্দটাই বড্ড ভেজাল শব্দ, ভেজালের জন্যই বোধহয় পাষাণ হবার জঘন্য ট্রেনিং দেওয়া হয়। আজ থেকে নাহয় আসল রূপটাই দেখানো যাক। অদ্ভুত ক্ষোভের সাথে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম, খুবই অদ্ভুত।

বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ ডুবুরির তৎপরতায় অভিযান সমাপ্ত হলো। যেই কাঙ্ক্ষিত মূহুর্তের জন্য দিনকাল স্থির করে পুরোটা দুপুর, পুরোটা বিকেল অপেক্ষা করছিলো সেটা উদ্ধার করতে পেরেছে। জালের ভেতর আঁটকা পরেছে নিথর একটি দেহ, দেহে কোনো প্রাণ নেই। পুরো শরীর বরফের মতো জমে গেছে, মুখটা পাণ্ডুর। ডুবুরির দলটা জলযানে করে তীরের দিকে ফিরলো, ছোট্ট দেহটা পাজকোলে করে মাহতিমের সামনে আনলো তারা। বালির উপর রাখা প্লাস্টিকের শীটের উপর আস্তে করে ডেডবডিটা নামিয়ে দিলো। মাহতিম চোখ কুঁচকে আছে, তার হাতের মুঠোদুটো মুষ্টিবদ্ধ। ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে আছে, এখুনি চোখ খুললে ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে আসবে। বাঁকাধে হাতের স্পর্শ পেয়ে মাথা তুললো মাহতিম, একটু ভরসার মতো সুরাহা পেয়ে সেদিকে চোখ খুলে তাকালো। নোমানের চোখ দিয়ে দরদর করে পানি নামছে, ছেলেটা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। লাশকে ঘিরে গোল হয়ে আছে সবাই, অন-ডিউটিতে থাকা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরা মাথার টুপি নামিয়ে মাথানত করে আছে। মাহতিম একপলক সবার দিকে চেয়ে থেকে শেষমেশ নিচের দিকে তাকালো, শূন্যদৃষ্টির মতো নিষ্পলক হয়ে গেলো সে। ধপ থেকে হাঁটু গেড়ে বালিতে বসে পরলো, একদৃষ্টিতে সামনে থাকা নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখে কোনো অশ্রু নেই মাহতিমের, ভেতরের কোনো উত্তাপও বাইরে প্রকাশ পেলো না। নিরব চাহনিতে বহু সময় ধরে তাকিয়ে রইলো। গায়ে লেমন টিশার্ট, গতবছর ঈদে কেনা দেওয়া কালো ট্রাউজার পরনে। পেটটা অনেক ফুলে উঠেছে, এখুনি দুহাতে চাপ দিলে গড়গড় করে পানি বেরিয়ে আসবে। মুখে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, নেই কোনো দুঃখের ছাপ। যেনো গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে নিষ্পাপ মাহদি, দুনিয়াবি সকল কারসাজি থেকে বিদায় নিয়ে ঘুম দিয়ে ফেলেছে। এই নিদ্রা, এই তন্দ্রা আর কোনোদিন ভাঙবে না। এই নিদ্রামগ্ন মুখটা আগেও দেখেছে মাহতিম, কিন্তু তখন ইচ্ছে করেই জাগাতো না। ভাবতো, ঘুমাচ্ছে যেহেতু, একটু নাহয় ঘুমোক। অথচ, কঠিনভাবে ইচ্ছে করছে দুহাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে-ঝাঁকিয়ে উঠাতে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ঘুমাস নারে ভাই, এবার উঠ্। আর ঘুমিয়ে থাকিস না। আর ঘুমিয়ে থাকিস না ভাই। আর ঘুমিয়ে থাকিস না।

ডাক্তারের পুরো টিম এখনো রোগীর দিকে ঝুঁকে পরেছে। একটু পরপর পালস রেট দেখছে, অক্সিজেন লেভেল নিরীক্ষা করছে, শরীরের অবস্থা কোন পর্যায়ে খারাপ বা ভালো, সেটা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। রুমে স্বজনদের মধ্যে কেবল দুজনকে এলাউ করেছে, তাও সেই দুজন কোনো প্রকার আওয়াজ করতে পারবে না। মেহনূরের অবস্থা ভালো না। পানিতে দীর্ঘক্ষণ থাকার কারণে রক্তে অক্সিজেন কমে গেছে, ঠান্ডায় অবস্থা আরো জঘন্য। সদ্য জ্বর থেকে উঠার জন্য বডিতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো লক্ষণ দেখাচ্ছে না। ঘড়িতে এখন ছয়টা চল্লিশ বাজছে, ঘন্টা খানেক আগে দাফনের জন্য চলে গেছে সবাই। ছেলেরা কেউ হোটেলে নেই, মারজা থেমে-থেমে হাউমাউ করে কাঁদছেন। রজনী পাশে নেই, অনামিকার অজুহাত দেখিয়ে অনামিকার রুমে দরজা বন্ধ করে উইষ্কির ফূর্তি করছে। নীতি ও ফারিন ফোলা-ফোলা চোখ নিয়ে মেহনূরের রুমে বসে আছে। চোখ ভিজে-ভিজে আসছে দুজনের, তবুও নিজেদের শক্ত করে নিরবে চোখ মুছে যাচ্ছে তারা। ডাক্তাররাও ব্যথিত, এরকম একটি শোকের ভেতর আরেকটি শোক যেনো ভর না করুক নিজেরাই মন থেকে প্রার্থনা করে যাচ্ছে। নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই এখন পেশেন্টের দিকে। দরজার নব মোচড়ানোর আওয়াজ হতেই নীতি ও ফারিন চোখ মুছে তাকালো, কেউ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দুজন দাঁড়িয়ে পরলো। মাহতিম এসেছে। মাহতিমের চোখ-মুখের অবস্থা একদম স্বাভাবিক, কান্নার সামান্য চিহ্নটুকুও নেই। গায়ের পোশাকটা পালটে ফেলেছে, এখন গায়ে ফর্মাল ক্যাটাগরির ড্রেসআপ। নীতি পুরোপুরো বুঝে ফেলেছে মাহতিম বিদায় নিতে এসেছে, তাই বিদায়ের সময়টুকুতে নিজেরাই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মাহতিম নিশব্দে হেঁটে আসতে-আসতে ডাক্তারের দিকে নিম্ন স্বরে বললো,

– কিছুক্ষণের জন্য কি কথা বলতে পারি? আসলে আমি চলে যাচ্ছি তো, এজন্য ওয়াইফের সাথে একটু প্রাইভেট-টক সারতে চাই।

থুতনীতে মাষ্ক নামানো ডাক্তার মেহনূরের দিকে তাকালেন, এরপর দৃষ্টি তুলে মাহতিমের দিকে বললেন,

– জ্বী স্যার, পারবেন। কিন্তু, ম্যাম এখনো খুব উইক। একটু খেয়াল রাখবেন, কথায় যেনো প্রেশারাইজ না থাকে।

মাহতিম স্বাভাবিক গলায় বললো,

– জ্বী, শিওর।

রুম থেকে একে-একে সবাই বেরিয়ে গেলো। শেষ নার্সটা চলে যেতেই দরজা থেকে চোখ সরালো, সামনে তাকিয়ে বিছানার দিকে দৃষ্টি রাখলো মাহতিম। গায়ের শাড়িটা খুলে ফেলা হয়েছে, তার পরিবর্তে আগের মতোই ঢিলেঢালা সাদা কামিজ দেখা যাচ্ছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো, চোখদুটো এখনো বন্ধ। সম্ভবত নিম্ন স্বরে কথা বলার জন্য মেহনূর এখনো টের পায়নি। বিছানার ঠিক ডানদিকটায় টুল টেনে বসলো মাহতিম। স্যালাইন লাগানো হাতটা ছুঁতে গিয়েও ধরলো না। একটু এগিয়ে এসে মেহনূরের কপালে হাত রাখলো। সুপরিচিত স্পর্শ পেয়ে চোখ খুললো মেহনূর, মাষ্কের আড়ালে থাকা ঠোঁটদুটো একটুখানি ফাঁক করলো। প্রথম-প্রথম অস্বচ্ছ দেখতে পেলেলেও আস্তে-আস্তে পরিষ্কার দেখতে পেলো। মাহতিম কাছে এসে বসে আছে, একটা হাত কপালে রেখে চুপ করে তাকিয়ে আছে। গায়ে এখন সাদা শার্ট, কালো প্যান্টের সাথে ইন করে শার্ট পরেছে। পুরো বেশভূষা ঠিকমতো আঁচ করতেই মেহনূর বুঝে যায় মাহতিম চলে যাবে। মেহনূরের দিকে অপলক চাহনিতে তাকিয়ে থাকতেই ঠান্ডা সুরে বললো মাহতিম,

– ঠিক আছো?

মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো মেহনূর। মোটা অশ্রুটা চোখ গড়িয়ে টপ করে পরলো। ঠোঁট নাড়িয়ে ফিসফিস করে বললো,

– ঠিক আছি।

অসুস্থ মুখটার কাছে গেলো মাহতিম, একহাতে গাল ধরে কপালে গভীর চুমু খেলো। নিভু-নিভু চোখদুটোর দিকে আবারও চুপ করে তাকিয়ে রইলো। নির্বাক মাহতিমের দৃষ্টিজোড়ায় দৃষ্টি মিলিয়ে তাকালো মেহনূর। মুখের অক্সিজেন মাস্কটা টেনে সরাতে ইচ্ছে করছে। যদি মাষ্কটা মুখে না থাকতো, তাহলে মাহতিম কি চুমু খেতো না? মাহতিম নড়েচড়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো, মুখের উপর থেকে মুখ সরিয়ে দূর্বল মেহনূরের কন্ঠায় ছোট্ট চুমু খেলো। চোখ বন্ধ করে মেহনূরের থুতনির নিচে মুখ গুঁজে দিলো মাহতিম, মেহনূরের দেহের উপর নিজের অস্তিত্বকে ছেড়ে দিলো সে। স্যালাইনের নল ঢুকানো হাতটা ধীরগতিতে উপরে তুললো মেহনূর, মাহতিমের শক্ত শরীরটায় হাত উঠিয়ে দূর্বল ভাবে বুলিয়ে দিতে লাগলো। অন্যহাতটা নাড়াতে পারছেনা মেহনূর, ওই হাতটা অবশ হয়ে পরে আছে। অসহ্যকর মাষ্কটার জন্য একটুও আদর করতে পারছেনা। হঠাৎ মাহতিম আস্তে-আস্তে বলে ফেললো,

– সব চলে গেলো, আর কেউ নেই।

ভেতরটা যন্ত্রনায় গুমরে উঠলো, চোখ বন্ধ করে ফেললো মেহনূর। নিজের বুকটার ভেতর মাহতিমকে লুকিয়ে রেখে চিৎকার করে বলতে মন চাচ্ছে তার, খুব মন চাচ্ছে বলতে,
‘ আমি আছি, আমি কক্ষনো আপনাকে ছেড়ে যাবো না। ‘ মেহনূর দূর্বলতার কাছে হার মেনে কিছুই বলতে পারলো না , শুধু স্পর্শ হিসেবে মাহতিমকে নিজের সাথে জোর খাটিয়ে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকতেই স্বাভাবিক কন্ঠে বললো মাহতিম,

– তুমি তোমার বাড়ি ফিরে যাও মেহনূর।

কথাটায় সম্বিত ফিরে পেয়ে চোখ খুললো মেহনূর, পিঠের উপর হাত সরাতেই মাহতিম মুখ তুলে তাকালো। মেহনূরকে ছেড়ে দিয়ে চোখে-চোখ রেখে তাকাতেই মেহনূর আশ্চর্য হয়ে তাকালো। মিনিটের ভেতর কি হয়ে গেলো? ফিসফিসিয়ে কোনোরকমে বললো,

– কেনো যাবো?

মেহনূরের দিক থেকে চোখ সরালো মাহতিম। মেহনূরের স্যালাইন লাগানো হাতটা নিজের গা থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। পুনরায় মেহনূরের দিকে দৃষ্টি ফেলে কাঠিন্য স্বরে বললো,

– কারণ, এখানে কারো দরকার নেই। তুমি তোমার গ্রামে ফিরে যাও। আমি সৌভিককে বলে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমি যাওয়ার পরপরই নিজ দায়িত্বে গ্রামে ফিরে যাবে।

একটা পাষাণের মতো লাগলো মাহতিমকে, একটা আস্তো পাষাণতুল্য মানুষ! হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকতে-থাকতে স্থির হয়ে গেলো মেহনূর। ‘ কারো দরকার নেই মানে কি? ‘

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

নোটবার্তা : এবার আপনাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাই। শুনতে ইচ্ছুক। ❤

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৪৯.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

অংশ সংখ্যা – শেষ .

মাহতিম ওই মূহুর্তে কিচ্ছু চিন্তা করতে পারছিলো না! মাথাটা একদমই কাজ করছেনা! মেহনূর উন্মাদের মতো সমুদ্রের দিকে ঝাঁপ দিতে আসছে! অপরদিকে স্রোতের তুমুল উত্থালে দূরে চলে যাচ্ছে মাহদি। দুদিক থেকে বিরাট সমস্যার মোকাবিলা আগেও করেছে মাহতিম, কিন্তু এবারেরটা পুরোই ভিন্ন। আবেগের ঘনঘটা তাকে গোগ্রাসে গিলে ধরেছে, মেহনূর যতোই সাঁতারে পটু হোক, সমুদ্রের কাছে সে পারবে না। সৌভিকরা মাহদির জন্য ঝাঁপিয়ে পরলেও সাঁতরে বেশিদূর যেতে পারেনি, তারা পিছিয়ে যাচ্ছে স্রোতের ধাক্কা খেয়ে। মাহতিম লম্বা-লম্বা নিশ্বাস ছাড়তেই চোখ বন্ধ করলো, তার মাথাটা ঠিকভাবে কাজ করা প্রয়োজন। তার সচল মস্তিষ্কটা বারবার নেতিয়ে পরছে, ঠোঁট কাঁপছে প্রচুর, কেনো এমন হচ্ছে? হওয়ার কারণটা কি? আগে তো এমন অবস্থা হয়নি? শত্রুর হাতে ধরা খেয়েও মৃত্যুর ভয়ে বুক কাঁপেনি, আজ কেনো ভেতরটা ভেঙেচুড়ে শেষ হয়ে আসছে? তার ক্যালকুলেশন মতে কেউ কি শেষ হতে যাচ্ছে? মেহনূর কি সমুদ্রের পানিতে ঝাঁপ দিয়ে দম হারাবে নাকি, মাহদি … ক্যালকুলেশন বারবার গুলিয়ে যাচ্ছে, সূত্র বসাতে ভুল করছে, কেনো এমন হচ্ছে? তার ট্রেনিংয়ের সিক্যুয়েন্সগুলো এভাবে বেখাপ্পা হয়ে যাচ্ছে? কোনো কঠিন সত্যের জন্যই কি ভেতরটা ধসে-ধসে ভাঙছে? মাথা কাজ করছেনা, সমুদ্রের অতল গহ্বরের কাছে মস্তিষ্কের গভীরতা কাজ করছেনা।

নাক দিয়ে, মুখ দিয়ে নোনাপানি ঢুকছে। অবাধে ছোট্ট দেহটার ফুসফুস থলির ভেতর অক্সিজেন শূন্য হচ্ছে। মস্তিষ্কের ক্রিয়া আস্তে-আস্তে সুইচ টেপা বাতির মতো নিভে আসছে। মনে হচ্ছে, কেউ যেনো মাথার ভেতর ঢুকে সব বাতিগুলো টপটপ বন্ধ করে দিচ্ছে, বন্ধ করতেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে মাথার যন্ত্রটা নিস্তেজ হয়ে আসছে। শরীরের উপর কয়েক শো টনের ভার অনুভূত হচ্ছে, নিশ্বাস ফুরিয়ে শূন্য স্কেলের দাগে পৌঁছেছে। জীবনের মায়াটা হাতছানি দিয়ে তাকে বিদায় জানাচ্ছে, যেনো বলছে ওপারে ভালো থেকো মাহদি। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা, কোনোকিছু স্বচ্ছ না। পানির তলে বহুক্ষণ যাবৎ যুদ্ধ করেও কারোর নাগাল ছুঁতে পারেনি। কান্নার অশ্রুগুলো সমুদ্রের নোনাপানিতে মিশে গেছে, আলাদা করে যাবে না তার অশ্রুগুলো। উঁচিয়ে রাখা হাতদুটো আস্তে-আস্তে পানির উপর ধপাস-ধপাস করে পরলো, হাতে আর শক্তি নেই, শক্তি শেষ। পানির নিচে পাদুটো পাগলের মতো দানাদাপি করে মুখটা শেষবারের মতো উপরে তুলতে পারলো, গলা অবধি শরীরটা পানির নিচে কাতরাচ্ছে। মুখ হা করে শেষ নিশ্বাসগুলো টানার সময় স্তব্ধ কানে ‘ ভো ভো ‘ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কেউ ‘ মাহদি, মাহদি ‘ বলে জান-প্রাণ দিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। সুরসুর করে আরো একদফা পানি নাক দিয়ে ঢুকলো মাহদির, সোজা মাথার ভেতর ছ্যাৎ করে আঘাত হানতেই নিশ্বাসে দারুণভাবে টান খেলো। যন্ত্রনায় কাতরাতে গিয়ে দুই হাত সমানতালে ঝাপটাতে লাগলো, পানির উপর ঝপাস-ঝপাস আওয়াজ হলো আবার। গলাকাটা মুরগির মতো কিছুক্ষণ দাপাতে লাগলো, এরপরই নিস্তেজ মুরগির মতো শান্ত হয়ে গেলো মাহদি। দুচোখের পাতা এক হয়ে রঙিন দুনিয়াটা ঢেকে গেলো, শরীর হালকা হতে-হতে পানির তলে নেমে গেলো। আরো তলে, আরো গভীরে, আরো অতলস্পর্শী জায়গার ভেতর যেতে-যেতে দিনের আলোটা ফিকে হয়ে আসতে লাগলো। জীবনের শেষ সন্ধিটুকুতে ফ্যাকাশে ঠোঁটে ক্ষীণভাবে হাসলো মাহদি, মানসপটে শৈশবের সেই দৃশ্য থেকে জীবনের সমস্ত মধুর দৃশ্যগুলো স্মৃতির দেয়ালে চলে আসলো। মনে পরলো, অবুঝ বয়সে তার ভাই কত রাত ঘুমায়নি। অসুস্থ হলে বুকে টেনে ঘুম পাড়িয়ে দিতো, কখনো-কখনো মায়ের পরিবর্তে সে-ই গোসল করিয়ে দিতো। বাবাহীন জীবনে সকল বায়নাক্কা তার ভাই-ই পূরণ করেছে। জন্মদিনে ভাইয়ের কাছে কম্পিউটারের বায়না করেছিলো, দামটাও ছিলো ঢের। তাও নিজের বেতন দিয়ে সেই শখ পূরণ করেছিলো মাহতিম, সাইকেলটাও এনেছিলো বিদেশী ব্র‍্যান্ডের। তার ভাই তো তাকে ভালোবাসেই, কে বলেছে আদর করেনা? যদি আদর না করতো তাহলে কি সমুদ্রের মধ্যে বাঁচাতে আসতো? কই, সৌভিক ভাইয়ারা দেখি পিছিয়ে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। কিন্তু ভাইয়া তো ভাইয়াই, সে যে এখনো বাঁচাতে ছুটে আসছে। বাবার আদর, মায়ের আদর, স্বজনের আদর সবার আদর ভাইয়া একাই দিয়েছে। কখনো বাবার মতো ছায়া হয়ে থাকতো, কখনো ভাইয়ের মতো ঢাল হয়ে দাঁড়াতো। জীবনে এইটুকু বয়সে কখনো একা-একা লাগেনি, তার ভাইয়া ছুটি থেকে ফিরলে তাকে একা রেখে কোথাও ঘুরেনি। পকেটের ফোনটাও তো ভাইয়ার দেওয়া, তাহলে সে কেনো ভাইয়াকে আজ কষ্ট দিলো? খাবার টেবিলে ওসব কথা বলে কষ্ট দেওয়া হলো না? কেনো বললো ওসব? মেহনূরকে আর বিয়ে করা হলো না, ভাইয়া বুড়ো হয়ে গেলে মেহনূর একা থেকে যাবে। তার তো কেউ নেই। ভাইয়া কি মেহনূরকে দেখে রাখবে? মেহনূর সবার চেয়ে আলাদা, কেউ ওর মতো নয়। সবাই স্বার্থপর, সবাই খারাপ, শুধু মেহনূর তাকে খুব চোখে-চোখে রাখতো। রজনী মামী কি মেহনূরকে খুব মা’রবে? হঠাৎ নিশ্বাসের শেষ টান খেয়ে কাশতে লাগলো মাহদি, তার শরীরটা শেষের দিকে এসে পরেছে। মুখের ভেতর সমুদ্রের নোনাযুক্ত বিদঘুটে স্বাদ, পেটটাও এমন ভরে গেছে যেকোনো সময় বোমার মতো ফেটে যাবে। শরীরটা ছেড়ে দিয়েছে সে, ভরহীন শরীরটা তলিয়ে যাচ্ছে, নিচ থেকে কেউ যেনো সাদরে টেনে নিচ্ছে তাকে। সমুদ্রের অতল অন্ধকারে চেতনার শেষ সময়টুকু চলছে, চোখের সামনে সব শূন্য হতে শুরু করেছে। দেহ-মন-মস্তিষ্ক সবকিছু কোথাও মিলিয়ে যেতেই চূড়ান্ত নিশ্বাস ছেড়ে দিলো, অন্ধকূপের দৃষ্টিতে ছেপে উঠলো একটি মুখ, একটি হাসি-হাসি চেহারা, একটি সুদর্শন আদলের যুবক। তার দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসি দিয়ে কপালে গাঢ় চুমু খেলো। যুবকের চোখদুটোয় কি আনন্দ, আনন্দে চোখের ভেতর পানি চিকচিক করছিলো। সদ্য নবজাতকের ফুটফুটে দুটো গালে চুমু খেয়ে আদরে-স্নেহে গালে-গাল জড়িয়ে রাখলো। ফিসফিস করে নবজাতকের কানে বললো, ‘ তোর নাম দিলাম মাহদি। আমার মাহদি আনসারী। আমার কলিজার ভাই প্লিজ দ্রুত বড় হ।’

.

বাংলাদেশের স্বনামধন্য কক্সবাজার সমুদ্র-সৈকতটা এখন রেড এলার্টে সিল করা হয়েছে। দলে-দলে সমুদ্রের উপর ডুবুরিদের হামলা হচ্ছে, দূর থেকে উৎসুক পর্যটকদের ভীড় বড় হচ্ছে। বালুর উপর অনেকগুলো মানুষ এসেছে, কারো-কারো পড়নে আর্মিদের মতো পোশাক, কারো পড়নে সাদা রঙের অদ্ভুত ইউনিফর্ম। ট্যূরিস্ট পুলিশ, স্থানীয় পুলিশ, টহল দল, ডুবুরিদের বিশাল ফোর্স, জেলা প্রশাসন থেকে কিছু গুণী ব্যক্তিবর্গদের গাড়ি যেনো হৈচৈ অবস্থা করে ফেলেছে। কৌতুহল পর্যটকরা এতোক্ষণে বুঝে ফেলেছে, এখানে কোনো বিশেষ ব্যক্তি তার পরিবার নিয়ে এসেছে। সবার সাথেই সাধারণ মানুষদের মতো চলাফেরা করেছে তারা। যার দরুন তারা কেউই বুঝতে পারেনি সেই বিশেষ ব্যক্তিটা এতো ক্ষমতাসীন ছিলো। একটু আগে আবাসিক হোটেলের সামনে সাইরেন বাজাতে-বাজাতে দুটো এ্যাম্বুলেন্স এসে থেমেছে, এটা তাদের কাছে বেশ বিরল চিত্রের মতোই লাগছে। কখন-কিভাবে-কি হলো তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেনা। একটা এ্যাম্বুলেন্স হোটেলের দোরগোড়ায় থামলো, হুড়মুড় করে হোটেলের ভেতরে ডাক্তারদের একটা টিম ঢুকে গেলো। একটু আগে সবাই দেখেছে শাড়ি পড়ুয়া একটা মেয়েকে অচেতন অবস্থায় হোটেলের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে একদল শিক্ষার্থী কক্সবাজার ট্যূরের জন্য এসেছে, তাদের পুরো দলটাই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সমুদ্র-তীরের দৃশ্য দেখে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও স্মার্ট মেয়েটা ন্যাকান্যাকা সুরে বললো,

– আমার কিন্তু অসহ্য লাগছে। প্লিজ এখান থেকে চলতো। অন্যের ম্যালোড্রামা দেখার টাইম আছে? আমরা সেফে আছি, সেটা নিয়ে চিল করা উচিত না?

মেয়েটার দিকে পুরো ছেলেদলটা গরম চোখে তাকালো। তাদের ভেতর থেকে চশমা পরা বিজ্ঞ-বিজ্ঞ চেহারার তূর্য বললো,

– তোর কাছে মানুষের মৃ’ত্যুটা ড্রামা লাগে? চোখের সামনে নিজেই তো দেখলি ছোট্ট একটা ছেলে পানিতে ডুবে নিখোঁজ হলো। এখনো ছেলেটার লাশ পাওয়া যাচ্ছে না। যেই অফিসারের রিলেটিভ ম’রেছে উলটো তার দিকেই তুই ত্যাড়া চোখে তাকাচ্ছিস। তোর মতলব কি বুঝিনি ভেবেছিস? আমরা কি এতোই মূর্খ?

ছেলেটার কাটকাট কথা শুনে মেয়েটাও চড়া গলায় বললো,

– তোর যদি এতোই মায়া লাগে তাহলে নিজেই লা’শ খোঁজ না! এখানে এসে লেকচার কেনো দিচ্ছিস? এতোই যখন আমার মতলব বুঝেছিস তাহলে যেয়ে লেগে পর। তোর মতো জনদরদী হওয়ার ইচ্ছে তো আমার নেই।

তূর্য দৃষ্টিচ্যূত হলো। ফোর্সের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সোজাসুজি ইতির পানে তাকালো। ইতির মেয়ে সঙ্গীরা বুঝে গেছে এখন দুজনের তুমুল তর্কযুদ্ধ বাঁধবে। তাড়াতাড়ি মধ্যকার যুদ্ধটা স্থগিত করার উদ্দিশ্যে ইতিকে টানতে-টানতে অন্যদিকে নিয়ে গেলো তারা। পরাস্ত ইতি চোখ পাঁকিয়ে রাগে গজগজ করে বললো,

– তোরা আমাকে আনলি কেন? দিতাম দুটো গালি শুনিয়ে। ফাজিল কোথাকারটা যখন-তখন আমার উপর তেড়ে আসে। অসহ্য কাজকর্ম! আমি থাকবো না এদিকে, বাসায় চলে যাব।

ইতিকে ঠান্ডা করার জন্য মিলি নামের মেয়েটা নিজের কোকের বোতল ধরিয়ে দিলো, খাওয়ার জন্য ইশারা করতেই শান্ত কন্ঠে বললো,

– চেতিস না। তূর্যকে শুধুশুধু আমরা গ’বেট বলি? ও তো আস্তো একটা গ’বেট! আচ্ছা সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুঁজে থাকলেই কেউ নিউটন হয়? উহু, ভেতরে চিয়ার্স ভাইবটা থাকা লাগে।

মিলির ভুল বক্তব্য শুনে ভ্রুঁ কুঁচকালো আফরা। পড়াশোনায় ভুল তথ্য শুনলে তার মাথায় ঢিংঢিং ঘন্টা বাজতে থাকে, এখনও তাই হচ্ছে। মিলিকে খপ করে নিজের যুক্তির ভেতর ধরলো সে,

– তুই নিজে গ’বেট হয়ে তূর্যকে গ’বেট বলিস? নিউটন কবে চিয়ার্স ভাইব রেখেছে রে ছা’গল? আইজ্যাক নিউটন যদি একটু হলেও চিয়ার্স ভাইব রাখতো, তাহলে আজ তার কপালে বিয়ের তকমা থাকতো বুঝলি? ওই ব্যাটার একটা গার্লফ্রেন্ডও ছিলো। বাট, আফসোস ব্যাটার অন্যমনা স্বভাবের জন্য গার্লফ্রেন্ড তাকে ছেড়ে যায়।

মিলি, ইতিসহ সব মেয়েরা মুখরোচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আইজ্যাক নিউটনের ঘটনা শুনতে গিয়ে হঠাৎ ইতি অন্যমনষ্ক গলায় মিহি করে বললো,

– ওই লোকটা খুব মারাত্মক দোস্ত। সে জাস্ট একবার দিকে তাকিয়েছিলো। মুখটা ক্লিন, নো দাড়ি। একদম আর্মি-আর্মি কাটের মতো চুল। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা কি জানিস? পানিতে ভিজে লোকটার মাশল-ফাশল বডিটা দেখার মতো। হি হ্যাজ এ্যা এ্যাক্ট্রেক্টিভ লুক, ফিগার এ্যান্ড ড্যাশিং পার্সোনালিটি।

.
সামুদ্রিক অভিযান এখনো চলছে। লাপাত্তা মাহদিকে খোঁজার জন্য পুরো ফোর্স ডেকে ফেলেছে। মাহতিমের খিটখিটে মেজাজ দেখে তার জুনিয়রদের অবস্থা শোচনীয়। বিশেষ করে, নোমান ইকবাল ঢোক গিলে একটু পরপর ভয় কাটিয়ে চলছে। মাহদির কিছু হলে মাহতিম তাদের একটাকেও ছাড়বে না, সবগুলোকে ইচ্ছে মতো ঝাড়বে। তার চেয়েওবড় কথা, মাহতিমের রাগের চেয়ে তার নিরবতাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। পুরো ডিপার্টমেন্ট জানে মাহতিমের নিরবতা কতটা ভয়াবহ। মাহতিম এখন সেই রূপেই নিরব বনে আছে। মুখে নূন্যতম শব্দ নেই। গায়ের শার্টটা ভেজা, প্যান্ট ভেজা, পুরো শরীরটাই ভিজে শেষ। বুকের কাছে দুহাত ভাঁজ করা। মুখে তালা এঁটে স্ট্যাট-কাট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার ডানে-বামে দুজন সিনিয়র পুলিশ ওয়াকি-টকিতে কথা বলে যাচ্ছে। আশেপাশের কিছু পর্যটক অবাক চোখে দেখে যাচ্ছে, কারো-কারো দৃষ্টিতে মাহতিম আঁটকে গেছে। আপাদমস্তক তার দিকে চোখ বুলিয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছে কেউ। হঠাৎ নোমানের লেফট পকেট থেকে ফোন বিপ করলো, পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করলো নোমান। কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে নিউজ শুনে বিষ্ময়ে চেয়ে রইলো। কলটা কেটে দিয়ে নিশ্বাস ছাড়লো নোমান, নিচের ঠোঁটে জিহবা বুলিয়ে সামনে তাকালো। কয়েক কদম সামনে থাকা মাহতিমের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সে, বাঁদিকের পুলিশটাকে ক্রস করে মাহতিমের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভুড়ি পেটওয়ালা পুলিশটা নোমানকে দেখে কিছু একটা বুঝে দূরে সরে গেলো। একই ভঙ্গিতে মাহতিমের ডানদিকের পুলিশটা দূরে সরলে সন্নিকটে এলো নোমান, স্বর নামিয়ে একটু আগের নিউজটা বসের উদ্দেশ্যে বললো,

– স্যার, আপনাকে হোটেলে যেতে বলেছে। ম্যামের অবস্থা একটু খারাপ।

বিশেষ প্রতিক্রিয়া নেই। যেমন ছিলো, তেমনই আছে মাহতিম। দৃষ্টি অটল, ভাব অটুট, দেহভঙ্গি শক্ত। নোমান আবার সঙ্কোচের সাথে বাকি কথাটা পাড়লো,

– ম্যামের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে স্যার। আপনার ছোট বোন ফারিন আপনাকে যেতে বলছে।

কথাটার বলার প্রায় মিনিট খানেক পেরিয়ে গেলো, মাহতিম একটুও ভ্রুক্ষেপ দেখায়নি। সে স্থির দৃষ্টিতে সমুদ্রের ফেনিল রাশিতে তাকিয়ে আছে। আশাহত নোমান যেই চলে যেতে নিবে, ওই সময় তেজালো গলায় ছোট্ট জবাব চলে এলো,

– ডাক্তারকে হ্যান্ডেল করতে বলো।

নোমান বেকুবের মতো অস্ফুট সুরে বলে উঠলো,

– জ্বী.. মানে তারা —

কথা শেষ করার আগেই দাঁত চিবিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো মাহতিম,

– ডাক্তারকে হ্যান্ডেল করতে বলেছি নোমান! গেট লস্ট!

ঝাঁজালো কন্ঠের গলা শুনে একমূহুর্তের জন্য সব চুপ! সবার দৃষ্টি কেবল মাহতিমের দিকে। ওয়াকিটকিতে কথা বলা পুলিশও কথা থামিয়ে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে আছে। নোমান আড়চোখে বিব্রতকর অবস্থা দেখে ছোট্ট করে বললো,

– সরি স্যার।

ওপাশ নির‍্যুত্তর। মুখ তুলে স্যারের শক্ত মুখের দিকে তাকালো নোমান। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হতাশার সাথে নিশ্বাস ছেড়ে চলে গেলো। সময়ের পালা এখন চারটায় এসে ঠেকেছে। মাথার উপর সাক্ষী থাকা সূর্যটা এখন পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু আগে হেড অফিস থেকে কল এসেছিলো, মাহতিম সেই কলে রিসপন্স করতে পারেনি। মাহতিম জানে, তারা আজকের ভেতর ফিল্ডে ফেরার জন্য তাগাদা দিবে। একমাত্র এটার জন্যই এইমূহুর্তে কল এসেছে, নাহলে আসতো না। নিজেকে একটু স্থির করে হেড অফিসের জন্য কল করলো মাহতিম, কয়েক টোন বাজতেই রিসিভ হলো কলটা,

– হ্যালো,

হেড অফিসের বিশেষ ব্যক্তির উত্তরে মাহতিম বললো,

– আনসারী বলছি।

মাহতিমের কন্ঠ পেয়ে ধাতস্থ হলো বিশেষ ব্যক্তি। সমবেদনার মতো বিমর্ষ সুরে বললো,

– তোমাকে আজই ফিরতে হবে মাহতিম। আই এ্যাম সো সরি। তুমি তো রুলস রেগুলেশান জানোই। আমি এর চেয়ে বেশি কিছুই করতে পারবোনা, আমি রুলস মানতে বাধ্য।

আক্ষেপে চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। কানে ফোন ধরা অবস্থায় জোরে নিশ্বাস ছাড়লো সে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চোখ খুলে হালকা কেশে বললো,

– সমস্যা নেই। আমি নিজেও ডিপার্টমেন্টকে এক্সকিউজ দিতাম না। কিন্তু, স্যার, যদি ডিউরেশনটা একটু বাড়ানো যেতো…

মাহতিমের অসম্পূর্ণ কথাটা ওপাশের ব্যক্তি চট করে বুঝলো,

– আজ মানে আজই মাহতিম। আমি এ বিষয়ে কিছুই করতে পারবো না। তোমাকে আজই ফিরতে হবে, আমি রুলসের এ্যাগেনেস্ট যেতে পারবো না। প্লিজ ট্রায় টু আন্ডারস্টেন্ড ম্যান।

কথা বাড়ালো না মাহতিম। তাদের বলে অবশ্য লাভ নেই। একরোখা কর্মজীবনে সবকিছুই একমুখী হয়ে গেছে। ‘ ইমোশন ‘ শব্দটাই বড্ড ভেজাল শব্দ, ভেজালের জন্যই বোধহয় পাষাণ হবার জঘন্য ট্রেনিং দেওয়া হয়। আজ থেকে নাহয় আসল রূপটাই দেখানো যাক। অদ্ভুত ক্ষোভের সাথে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম, খুবই অদ্ভুত।

বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ ডুবুরির তৎপরতায় অভিযান সমাপ্ত হলো। যেই কাঙ্ক্ষিত মূহুর্তের জন্য দিনকাল স্থির করে পুরোটা দুপুর, পুরোটা বিকেল অপেক্ষা করছিলো সেটা উদ্ধার করতে পেরেছে। জালের ভেতর আঁটকা পরেছে নিথর একটি দেহ, দেহে কোনো প্রাণ নেই। পুরো শরীর বরফের মতো জমে গেছে, মুখটা পাণ্ডুর। ডুবুরির দলটা জলযানে করে তীরের দিকে ফিরলো, ছোট্ট দেহটা পাজকোলে করে মাহতিমের সামনে আনলো তারা। বালির উপর রাখা প্লাস্টিকের শীটের উপর আস্তে করে ডেডবডিটা নামিয়ে দিলো। মাহতিম চোখ কুঁচকে আছে, তার হাতের মুঠোদুটো মুষ্টিবদ্ধ। ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে আছে, এখুনি চোখ খুললে ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে আসবে। বাঁকাধে হাতের স্পর্শ পেয়ে মাথা তুললো মাহতিম, একটু ভরসার মতো সুরাহা পেয়ে সেদিকে চোখ খুলে তাকালো। নোমানের চোখ দিয়ে দরদর করে পানি নামছে, ছেলেটা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। লাশকে ঘিরে গোল হয়ে আছে সবাই, অন-ডিউটিতে থাকা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরা মাথার টুপি নামিয়ে মাথানত করে আছে। মাহতিম একপলক সবার দিকে চেয়ে থেকে শেষমেশ নিচের দিকে তাকালো, শূন্যদৃষ্টির মতো নিষ্পলক হয়ে গেলো সে। ধপ থেকে হাঁটু গেড়ে বালিতে বসে পরলো, একদৃষ্টিতে সামনে থাকা নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখে কোনো অশ্রু নেই মাহতিমের, ভেতরের কোনো উত্তাপও বাইরে প্রকাশ পেলো না। নিরব চাহনিতে বহু সময় ধরে তাকিয়ে রইলো। গায়ে লেমন টিশার্ট, গতবছর ঈদে কেনা দেওয়া কালো ট্রাউজার পরনে। পেটটা অনেক ফুলে উঠেছে, এখুনি দুহাতে চাপ দিলে গড়গড় করে পানি বেরিয়ে আসবে। মুখে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, নেই কোনো দুঃখের ছাপ। যেনো গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে নিষ্পাপ মাহদি, দুনিয়াবি সকল কারসাজি থেকে বিদায় নিয়ে ঘুম দিয়ে ফেলেছে। এই নিদ্রা, এই তন্দ্রা আর কোনোদিন ভাঙবে না। এই নিদ্রামগ্ন মুখটা আগেও দেখেছে মাহতিম, কিন্তু তখন ইচ্ছে করেই জাগাতো না। ভাবতো, ঘুমাচ্ছে যেহেতু, একটু নাহয় ঘুমোক। অথচ, কঠিনভাবে ইচ্ছে করছে দুহাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে-ঝাঁকিয়ে উঠাতে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ঘুমাস নারে ভাই, এবার উঠ্। আর ঘুমিয়ে থাকিস না। আর ঘুমিয়ে থাকিস না ভাই। আর ঘুমিয়ে থাকিস না।

ডাক্তারের পুরো টিম এখনো রোগীর দিকে ঝুঁকে পরেছে। একটু পরপর পালস রেট দেখছে, অক্সিজেন লেভেল নিরীক্ষা করছে, শরীরের অবস্থা কোন পর্যায়ে খারাপ বা ভালো, সেটা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। রুমে স্বজনদের মধ্যে কেবল দুজনকে এলাউ করেছে, তাও সেই দুজন কোনো প্রকার আওয়াজ করতে পারবে না। মেহনূরের অবস্থা ভালো না। পানিতে দীর্ঘক্ষণ থাকার কারণে রক্তে অক্সিজেন কমে গেছে, ঠান্ডায় অবস্থা আরো জঘন্য। সদ্য জ্বর থেকে উঠার জন্য বডিতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো লক্ষণ দেখাচ্ছে না। ঘড়িতে এখন ছয়টা চল্লিশ বাজছে, ঘন্টা খানেক আগে দাফনের জন্য চলে গেছে সবাই। ছেলেরা কেউ হোটেলে নেই, মারজা থেমে-থেমে হাউমাউ করে কাঁদছেন। রজনী পাশে নেই, অনামিকার অজুহাত দেখিয়ে অনামিকার রুমে দরজা বন্ধ করে উইষ্কির ফূর্তি করছে। নীতি ও ফারিন ফোলা-ফোলা চোখ নিয়ে মেহনূরের রুমে বসে আছে। চোখ ভিজে-ভিজে আসছে দুজনের, তবুও নিজেদের শক্ত করে নিরবে চোখ মুছে যাচ্ছে তারা। ডাক্তাররাও ব্যথিত, এরকম একটি শোকের ভেতর আরেকটি শোক যেনো ভর না করুক নিজেরাই মন থেকে প্রার্থনা করে যাচ্ছে। নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই এখন পেশেন্টের দিকে। দরজার নব মোচড়ানোর আওয়াজ হতেই নীতি ও ফারিন চোখ মুছে তাকালো, কেউ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দুজন দাঁড়িয়ে পরলো। মাহতিম এসেছে। মাহতিমের চোখ-মুখের অবস্থা একদম স্বাভাবিক, কান্নার সামান্য চিহ্নটুকুও নেই। গায়ের পোশাকটা পালটে ফেলেছে, এখন গায়ে ফর্মাল ক্যাটাগরির ড্রেসআপ। নীতি পুরোপুরো বুঝে ফেলেছে মাহতিম বিদায় নিতে এসেছে, তাই বিদায়ের সময়টুকুতে নিজেরাই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মাহতিম নিশব্দে হেঁটে আসতে-আসতে ডাক্তারের দিকে নিম্ন স্বরে বললো,

– কিছুক্ষণের জন্য কি কথা বলতে পারি? আসলে আমি চলে যাচ্ছি তো, এজন্য ওয়াইফের সাথে একটু প্রাইভেট-টক সারতে চাই।

থুতনীতে মাষ্ক নামানো ডাক্তার মেহনূরের দিকে তাকালেন, এরপর দৃষ্টি তুলে মাহতিমের দিকে বললেন,

– জ্বী স্যার, পারবেন। কিন্তু, ম্যাম এখনো খুব উইক। একটু খেয়াল রাখবেন, কথায় যেনো প্রেশারাইজ না থাকে।

মাহতিম স্বাভাবিক গলায় বললো,

– জ্বী, শিওর।

রুম থেকে একে-একে সবাই বেরিয়ে গেলো। শেষ নার্সটা চলে যেতেই দরজা থেকে চোখ সরালো, সামনে তাকিয়ে বিছানার দিকে দৃষ্টি রাখলো মাহতিম। গায়ের শাড়িটা খুলে ফেলা হয়েছে, তার পরিবর্তে আগের মতোই ঢিলেঢালা সাদা কামিজ দেখা যাচ্ছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো, চোখদুটো এখনো বন্ধ। সম্ভবত নিম্ন স্বরে কথা বলার জন্য মেহনূর এখনো টের পায়নি। বিছানার ঠিক ডানদিকটায় টুল টেনে বসলো মাহতিম। স্যালাইন লাগানো হাতটা ছুঁতে গিয়েও ধরলো না। একটু এগিয়ে এসে মেহনূরের কপালে হাত রাখলো। সুপরিচিত স্পর্শ পেয়ে চোখ খুললো মেহনূর, মাষ্কের আড়ালে থাকা ঠোঁটদুটো একটুখানি ফাঁক করলো। প্রথম-প্রথম অস্বচ্ছ দেখতে পেলেলেও আস্তে-আস্তে পরিষ্কার দেখতে পেলো। মাহতিম কাছে এসে বসে আছে, একটা হাত কপালে রেখে চুপ করে তাকিয়ে আছে। গায়ে এখন সাদা শার্ট, কালো প্যান্টের সাথে ইন করে শার্ট পরেছে। পুরো বেশভূষা ঠিকমতো আঁচ করতেই মেহনূর বুঝে যায় মাহতিম চলে যাবে। মেহনূরের দিকে অপলক চাহনিতে তাকিয়ে থাকতেই ঠান্ডা সুরে বললো মাহতিম,

– ঠিক আছো?

মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো মেহনূর। মোটা অশ্রুটা চোখ গড়িয়ে টপ করে পরলো। ঠোঁট নাড়িয়ে ফিসফিস করে বললো,

– ঠিক আছি।

অসুস্থ মুখটার কাছে গেলো মাহতিম, একহাতে গাল ধরে কপালে গভীর চুমু খেলো। নিভু-নিভু চোখদুটোর দিকে আবারও চুপ করে তাকিয়ে রইলো। নির্বাক মাহতিমের দৃষ্টিজোড়ায় দৃষ্টি মিলিয়ে তাকালো মেহনূর। মুখের অক্সিজেন মাস্কটা টেনে সরাতে ইচ্ছে করছে। যদি মাষ্কটা মুখে না থাকতো, তাহলে মাহতিম কি চুমু খেতো না? মাহতিম নড়েচড়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো, মুখের উপর থেকে মুখ সরিয়ে দূর্বল মেহনূরের কন্ঠায় ছোট্ট চুমু খেলো। চোখ বন্ধ করে মেহনূরের থুতনির নিচে মুখ গুঁজে দিলো মাহতিম, মেহনূরের দেহের উপর নিজের অস্তিত্বকে ছেড়ে দিলো সে। স্যালাইনের নল ঢুকানো হাতটা ধীরগতিতে উপরে তুললো মেহনূর, মাহতিমের শক্ত শরীরটায় হাত উঠিয়ে দূর্বল ভাবে বুলিয়ে দিতে লাগলো। অন্যহাতটা নাড়াতে পারছেনা মেহনূর, ওই হাতটা অবশ হয়ে পরে আছে। অসহ্যকর মাষ্কটার জন্য একটুও আদর করতে পারছেনা। হঠাৎ মাহতিম আস্তে-আস্তে বলে ফেললো,

– সব চলে গেলো, আর কেউ নেই।

ভেতরটা যন্ত্রনায় গুমরে উঠলো, চোখ বন্ধ করে ফেললো মেহনূর। নিজের বুকটার ভেতর মাহতিমকে লুকিয়ে রেখে চিৎকার করে বলতে মন চাচ্ছে তার, খুব মন চাচ্ছে বলতে,
‘ আমি আছি, আমি কক্ষনো আপনাকে ছেড়ে যাবো না। ‘ মেহনূর দূর্বলতার কাছে হার মেনে কিছুই বলতে পারলো না , শুধু স্পর্শ হিসেবে মাহতিমকে নিজের সাথে জোর খাটিয়ে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকতেই স্বাভাবিক কন্ঠে বললো মাহতিম,

– তুমি তোমার বাড়ি ফিরে যাও মেহনূর।

কথাটায় সম্বিত ফিরে পেয়ে চোখ খুললো মেহনূর, পিঠের উপর হাত সরাতেই মাহতিম মুখ তুলে তাকালো। মেহনূরকে ছেড়ে দিয়ে চোখে-চোখ রেখে তাকাতেই মেহনূর আশ্চর্য হয়ে তাকালো। মিনিটের ভেতর কি হয়ে গেলো? ফিসফিসিয়ে কোনোরকমে বললো,

– কেনো যাবো?

মেহনূরের দিক থেকে চোখ সরালো মাহতিম। মেহনূরের স্যালাইন লাগানো হাতটা নিজের গা থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। পুনরায় মেহনূরের দিকে দৃষ্টি ফেলে কাঠিন্য স্বরে বললো,

– কারণ, এখানে কারো দরকার নেই। তুমি তোমার গ্রামে ফিরে যাও। আমি সৌভিককে বলে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমি যাওয়ার পরপরই নিজ দায়িত্বে গ্রামে ফিরে যাবে।

একটা পাষাণের মতো লাগলো মাহতিমকে, একটা আস্তো পাষাণতুল্য মানুষ! হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকতে-থাকতে স্থির হয়ে গেলো মেহনূর। ‘ কারো দরকার নেই মানে কি? ‘

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

নোটবার্তা : এবার আপনাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাই। শুনতে ইচ্ছুক। ❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here