মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤ #পর্বসংখ্যা_৬৫. #ফাবিয়াহ্_মমো . অংশ ০১ .

0
1518

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৬৫.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

অংশ ০১ .

ফ্লোরের উপর আছাড় দেওয়া ফোনটা পরে আছে! প্রচণ্ড রাগে মুখের চামড়া লাল দেখাচ্ছে। কপালের ক্ষত জায়গার কাছে নীল রগগুলো ফুলে উঠেছে। রাগের এমন ভয়াবহ আক্রোশ আগে দেখেনি কেউ। শান্তভাবে বিছানায় বসে থাকলেও মুখটা কাঠ-কাঠ ভাবে গম্ভীর। দরজার সরু ফাঁক দিয়ে দৃশ্যটুকু দেখতেই অজান্তে ঢোক গিললো ফারিন। অবাকে চোখদুটো বড়-বড় করে পাশে থাকা তৌফের দিকে তাকালো। তৌফও দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফারিনের দিকে তাকালে ফিসফিস করে বললো ফারিন,

– এটা রেড সাইরেন তৌফ ভাই! আমার ভয় লাগছে! আমি শিওর খারাপ কিছু হয়েছে। ভাইয়ার এমন চুপ মানেই বিপদ। সবাইকে ডাকো, প্লিজ সবাইকে ডাকো।

তৌফ ভেতরে-ভেতর ভয় পেলেও বাইরে প্রকাশ করলো না। বাড়িতে বিয়ের আমেজটা পণ্ড হোক, এমন মূর্খতা করা যাবে না। দ্রুত কিছু বুদ্ধি এঁটে গলা নামিয়ে বললো,

– তুই এখুনি নিচে যাবি। যেয়ে চুপচাপ সিয়ামকে ডেকে আনবি। আগেভাগে কিচ্ছু বলতে যাবি না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে নীতির রুমে দেখা কর। তাড়াতাড়ি যা! দৌঁড় দে!

দেরি করলো না ফারিন। দু’হাতে লেহেঙ্গা ধরে একদৌঁড়ে সিয়ামের উদ্দেশ্যে ছুটলো। তৌফ সেখান থেকে দ্রুততার সাথে নীতির রুমে ঢুকে পরলো। আয়নার সামনে রঙিন বুরুশে ব্লাশার দিচ্ছিলো নীতি, তৌফকে চিন্তাগ্রস্থ অবস্থায় ঢুকতে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। আয়নায় দৃষ্টি রেখে বললো,

– ব্যাপারটা কি? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?তৌফ ভাই, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো না?

চিন্তায় বিভোর তৌফ হঠাৎ সৎবিৎ ফিরে পেলো। চোখ তুলে আয়নার দিকে তাকাতেই নীতির উদ্দেশ্যে বললো,

– মেবি ঝামেলা হইছে। মাহতিমের এক্সপ্রেশান নরমাল ছিলো না। তুই ভাবতে পারোস, ও নিজের ফোন আছাড় দিছে! আমি সিয়ামরে ডাকার জন্য ফারিনরে নিচে পাঠাইছি। গণ্ডগোল হইছে নীতি, পিঠ-পিছে বিরাট গণ্ডগোল হইছে!

বুকটা ধ্বক করে উঠলো নীতির। ঝট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরলো সে, হাতের বুরুশটা ফসকে ফেস প্যালেটের উপর শব্দ করে পরলো। নীতি চাপা মুখে ঠান্ডা কন্ঠে বললো,

– তুমি খুব ভয় দেখাচ্ছো তৌফ ভাই। এমন ভয় দেখিও না।

তৌফ হঠাৎ তেঁতে উঠলো। মারমুখি আচরণের মতো চিৎকার দিয়ে বললো,

– তোর কি আমার কন্ঠ রিল্যাক্স মনে হইতাছে? টেনশনে শা:লা শেষ হইয়া যাইতাছি, এইদিকে তুই মশকারি লাগাইছোস!

নীতি অপ্রতিভ অবস্থায় নিভলো। কথা বাড়িয়ে কুরুক্ষেত্র ডাকার দরকার নেই। ততক্ষণে সিয়ামকে নিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকলো ফারিন। দরজাটা লাগিয়ে চার মাথা একত্র হলো। গোল করে বিছানায় বসতেই সিয়াম প্রথম বললো,

– ঘটনা কি? ফারিন তো কুত্তার মতো আমারে টানতে-টানতে আনলো। কাহিনী জিগাই, কিছুই বললো না।

সিয়ামকে থামিয়ে দিয়ে তৌফ বলে উঠলো,

– সৌভিকরা আসছে?

সিয়াম যেই উত্তর দিবে, তখনই পাশ থেকে ফারিন বলে উঠলো,

– না, রাস্তায়। জ্যামে আঁটকে গেছে।

বুকভরা নিশ্বাস নিলো তৌফ। একে-একে সবার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললো,

– মাহতিম একটু আগে মোবাইল আছাড় দিছে। কি কারণে দিছে জানি না।

সিয়াম উজবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

– কি বলোস? হুর, বিশ্বাস হয়না! সকালেই ভাবীর সাথে বান্দরামি করতে দেখছি। সেকেন্ডের মধ্যে আরেক চেহারা দেখাইবো ক্যান?

তৌফের ইচ্ছে করলো কষে একটা চড় লাগাতে! এমন বোকার মতো কথা শুনে প্রচণ্ড খ্যাঁকিয়ে উঠলো তৌফ,

– ওরে আবা:ল! মানুষ কি সেকেন্ডে-সেকেন্ডে চেন্ঞ্জ হয় না? এমন হাবলার মতো কথা বলতাছোস ক্যান? তুই নিজেও জানোস মাহতিম হুদাই রাগ দেখাইতে যাইবো না। আমার তো মনে হইতাছে —

কথার মাঝখানে দাঁড়ি বসিয়ে চমক কাটলো নীতি,

– অনামিকার জন্য?

বিরক্তি নিয়ে নীতির দিকে তাকালো তৌফ। ডানহাত উঠিয়ে নীতির মাথায় জোরে এক ঘা মারলো। ব্যথায় নীতি আর্তনাদ করে উঠলে চিবিয়ে-চিবিয়ে বললো তৌফ,

– গালে মাখ্খন লাগাইছোস দেইখা থাপ্পড়টা দিলাম না। আমার পুরা কথা শেষ হইতে দিস। ওই জাউরার কথা স্মরণ না কইরা আমার কথা চুপচাপ শোন্!

তৌফের দিকে গরম চোখে তাকালো নীতি। তন্মধ্যে নীতির পক্ষে সাড়া দিয়ে ঝাড়ি মারলো ফারিন,

– তুমি আপুকে শুধু শুধু মারলে কেনো? তোমার হাতটা অযথা কারণে কেনো উঠাও? কারোর মাথায় যে হিট করা নিষেধ এই কমনসেন্স নেই?

সিয়াম পরিস্থিতিটা সামাল দিলো। আড়ালে তৌফের দিকে কনুই গুঁতা দিয়ে ঠান্ডা থাকার ইশারা করলো, ফারিনের উদ্দেশ্য স্বাভাবিক ভাবে বললো,

– প্লিজ, নিজেদের মধ্যে এরকম করিস না। সিচুয়েশনটা কোন্ ফেজে আছে ওইটা বুঝতে দে। তৌফ তুই শুরু কর্।

তৌফ ক্রুদ্ধ ভারি নিশ্বাস ছেড়ে হালকা হয়ে বললো,

– আমি শিওর মাহতিম ফোনে কথা বলছে। ফোনে এমন কিছু শুনছে যেটার জন্য রাগ সামলাইতে পারেনাই। ভোরে ওর নামে কুরিয়ার আসছে। পাক্কা একটা ছোটখাট বক্সের মতোন প্যাকেট। ওই প্যাকেটে কি আসছে আমি জগিংয়ের সময় জিগাইছিলাম। মাহতিম এদিকেও লজিক্যালি টপিকটা স্কিপ করছে। বলছে ভাবীর জন্য নাকি সারপ্রাইজ অর্ডার দিছিলো, ওটা কুরিয়ারে আসছে। অথচ তোরা বিশ্বাস করবি কিনা জানিনা, আমি কিচেনে যখন হুদাই ভাবীরে মশকারির জন্য জিগাইলাম, ভাবী বললো মাহতিম নাকি রুমে কোনো পার্সেলই আনে নাই। এখন প্রশ্ন হইলো, মাহতিম আসলে কি লুকাইতেছে?

সবাই মন দিয়ে পুরো কথাটা শুনলো। তৌফের কথায় গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য আছে। কিন্তু সামান্য একটু খটকা লাগলে প্রশ্ন করলো সিয়াম,

– কিন্তু দোস্ত এদিকে আরেকটা ব্যাপার আছে। যদি ওই পার্সেলটা ভাবীর জন্যই হয়, তাহলে তো চিন্তার কিছু নাই। হয়তো ভাবীরে অন্য বাবে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য মাহতিম ওটা রুমে আনেনি।

সিয়ামের কথা যুক্তি পেয়ে সম্মতি দিলো নীতি,

– কথাটা ভুল বলোনি সিয়াম ভাই। ভাবীকে ইউনিক স্টাইলে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য অন্য কিছুও প্ল্যান থাকতে পারে। কি পারে না?

তৌফ দুজনের কথাকেই সমর্থন করলো। কিন্তু সুক্ষ্ম ফাঁকটা সবার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে, সেটাই তৌফ ভালোভাবে বুঝিয়ে বললো,

– তোদের দুজনের কথাই ঠিক। দুইটার কথাই আমি মানলাম। কিন্তু একটা জিনিস চিন্তা কর্, যেই মানুষটা সকালেও ঠিক ছিলো, দুপুরেও ঠিক ছিলো, ওই মানুষ সন্ধ্যার টাইমে রাগের চোটে চুপ হইবো ক্যান? কোনো উত্তর আছে? জানি আমার কথা শুইনা আগা-মাথা কিছু বুঝতাছোস না। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাছি। আমি জানি ওই পার্সেলটা নিয়ে গণ্ডগোল বাঁধছে। সবকিছুর পিছে ওই পার্সেলটাই আছে, সময়মতো আমার কথাটা মিলায়া নিস।

দুটো মিনিট পুরো নিঃশব্দ অবস্থা চললো। কারো মুখে শব্দ নেই। চারজনের নজর বিছানার ফ্লোরাল ডিজাইনে আঁটকে আছে। একটা সময় ছিলো, যখন নয় মাথা একত্র হয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ করতো। যেকোনো মুশকিল মূহুর্তে উপায় খুঁজে ফেলতো। আজ সেই সংখ্যাটা কমে এসে চারে দাঁড়িয়েছে। দলের সবচেয়ে চন্ঞ্চল সদস্যটা পাকা-পাকা বুদ্ধি মিলানোর জন্য আর নেই। সবার বুকের ভেতরটা যেনো একইসঙ্গে হাহাকার করে উঠলো। একসাথে ভারি নিশ্বাসটা চারটা বুক থেকে বেরুলো। অনেকক্ষণ পর নিচে থেকে হৈচৈ শুরু হলো। ওরা চারজন বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই সৌভিকরা এসেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দুপক্ষের আংটি বদল হবে। ঠিক পন্ঞ্চম দিনে ঢাক-ঢোলের সাথে সৌভিকের বিয়ে হচ্ছে। নিরবতার রুদ্ধ অবস্থা ছিঁড়ে ফারিন কথা বললো,

– আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। মাহতিম ভাইয়া যদি নিজে থেকে যেচে বলে, তাহলে হয়তো সম্পূর্ণ ব্যাপারটা জানা সম্ভব। কিন্তু আমরা যদি পাকনামি করে জানার আগ্রহ দেখাই, তাহলে বিয়েতে নেগেটিভ ভাইব পরবে।

তিনজনই চোখ তুলে ফারিনের দিকে তাকালো। মুখে কিছু না বললেও ফারিনের কথাকে সবাঈ মেনে নিয়েছে। অপেক্ষা নামক শব্দের কাছে স্থির থেকে রুম ত্যাগ করলো সবাই। কেউ যেন সন্দেহ না করুক, তাই নিচে নামার আগে দলভঙ্গ করে আলাদা হলো প্রথমে নীতি ও ফারিন একসাথে নামলে শেষে বাকি দুজন নামলো।

সাদা সিল্কের শাড়ি পরেছে মেহনূর। মোটা পাড়টা রক্তজবার মতো লাল। গায়ের ব্লাউজটা লাল পরলেও স্লিভটা কনুই সমান। আজ মারজার জোর-জবরদস্তিতে বেশ সেজেছে মেহনূর। বাড়ির বড় বউ বলে কথা। মারজার কথা মতোন ফিটফাট হলেও মেহনূরের কাছে ভালো লাগছে না। পার্লারের মেয়েগুলো রাক্ষু:সের মতো মারজা কথাই শুনেছে। তার লম্বা চুলগুলো খোঁপা পাকিয়ে ঘাড়ের কাছে সেঁটে দিয়েছে। মাথার মধ্যভাগে সিঁথি তুলে খোঁপার গোল স্তুবকটা গাজরা দিয়ে পেঁচিয়েছে। আচ্ছা ঠোঁটের মেরুন লিপস্টিকটা খরার মতো শুকালো কেনো? এটাকেই তাহলে নীতি আপু ‘ ম্যাট ‘ বলে পরিচয় দেয়? মেহনূর একবুক অস্বস্তি নিয়ে মেহমান দেখাশোনা করছে। চোখদুটো চুম্বকের মতো সিঁড়ির কাছে চলে যাচ্ছে। ফাঁকা সিঁড়িটা দিয়ে কখন মাহতিম নিচে নামবে, কখন সবার আড়ালে ডেকে মেহনূরের দিকে তাকাবে, আজকের সম্পূর্ণ সাজটা একজনের জন্যই উৎসর্গ। অন্তত সেই মানুষটা একটাবার দেখুক, হাসি-হাসি ঠোঁটে অবাক চাহনিতে আপাদমস্তক দেখতে থাকুক। ওই মূহুর্তে কিযে লজ্জার পরিস্থিতি হবে, সেটা ভেবেই আনমনে মিচকি-মিচকি হাসছে মেহনূর।

– একা-একা বেকুবের হাসছিস কেন?

পাশ থেকে কন্ঠ শুনতেই চমকে উঠলো মেহনূর। কল্পনার চিন্তাটা কেটে যেতেই বাম দিকে তাকালো। গোলাপী রঙের জামদানী শাড়িতে সাবা দাঁড়িয়ে আছে। চোখের ভেতর প্রশ্ন নিয়ে মেহনূরের কাণ্ডকারখানা দেখছে। সাবার দিকে জোরপূর্বক হাসি দিলো মেহনূর, অপ্রস্তুত গলায় আমতা-আমতা করে বললো,

– এই যা, হাসবো কেনো? হাসির তো কিছুই নেই। ভুল দেখেছো বুবু।

সাবা চোখদুটো ছোট-ছোট করে গোয়েন্দার মতো তাকালো। ভ্রঁ-টা বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো উঁচু করে ভাবুক কন্ঠে বললো,

– আমি দশ মাইল দূর থেকে তোর তামাশা দেখছি। কাঁটাচামচ দিয়ে মিষ্টি গুঁতিয়ে কি করলি হ্যাঁ?

সাবার কথামতো পিরিচে তাকালো মেহনূর। সাথে-সাথে জিহবায় কামড় দিয়ে চোখ খিচুঁনি দিলো। কি সর্বনাশ! মহাজনের কথা ভাবতে-ভাবতে মিষ্টি খুঁচিয়ে শেষ! মেহনূরকে হা-হুতাশ করতে দেখে হো-হো করে হেসে উঠলো সাবা। টিটকারিটা জায়গামতো ছুঁড়ে বললো,

– যার ধ্যানে এতোক্ষন ডুবেছিলি, ওই ব্যক্তি একটু আগে বাইরে চলে গেছে। এখন এদিক-সেদিক না তাকিয়ে অপেক্ষা কর।

সাবার অকপটে কথায় আজ লজ্জা পেলো না মেহনূর। উলটো একরাশ মনক্ষুণ্ণতা ভর করলো তাকে। মাহতিম না বলে বাইরে গিয়েছে? দুপুরের পর থেকে বড্ড অদ্ভুত আচরণ করছে। খুবই অদ্ভুত! প্রায় দশ মিনিটের মধ্যে নিচে নামলো শানাজ। সোনালী রঙের তাঁতের শাড়িতে উজ্জ্বল দেখাচ্ছিলো তাকে। মেহনূর দূর থেকে শানাজের মুখটা দেখে তৃপ্তির হাসি দিলো। কতগুলো দিন শেষে শানাজের মুখটা হাসিখুশি দেখাচ্ছে। শানাজকে এনে সোফায় বসালো সুজলা। দু’পক্ষের আংটি বদলটা প্রায় শুরু হলো। সৌভিক যখন হাতে আংটি নিলো, তখনই কিছু একটা মনে পরায় আশেপাশে কাউকে খুঁজতে লাগলো। সৌভিকের হন্য হয়ে খুঁজাটা দৃষ্টি এড়ালো না প্রীতির। সৌভিকের কাধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো সে,

– কাকে খুঁজো ভাইয়া?

সৌভিক উৎসুক গলায় বললো,

– মাহতিম কোথায়? ওকে ডেকে আন্। ও ছাড়া আংটি বদল করবো, এটা হয় না।

সৌভিকের কথায় চেতন ফিরলো সবার। ঠিকই তো, মাহতিম কোথায়? ও কি বাইরে থেকে ফিরেনি? সবাই একযোগে খুঁজতে লাগলো মাহতিমকে। নীতি নিজ দায়িত্বে রুমে গিয়ে ফেরত আসলো। মাহতিমের ফোন কল দিয়ে কেউই তাকে পেলো না। ফোনের ওপাশ থেকে মেয়েলি সুরে বলতে লাগলো,

– যে নাম্বারটিতে কল করেছেন, তা এই মূহুর্তে বন্ধ আছে। অনুগ্রহ করে আবার চেষ্টা করুন, ধন্যবাদ।

মাহতিম তো ফোনটা আছাড় মেরেছিলো, তাহলে কি ফোনটা ওভাবেই আছে? কথাটা মনে-মনে আওড়ালো সিয়াম। ভাবনাটা মাথায় খেলতেই দ্রুত তৌফকে আড়ালে নিয়ে বললো। তৌফ আর দেরি না করে সৌভিককে মিথ্যা বুঝ দিয়ে শুভ কাজ সারতে বললো। সৌভিক প্রথম-প্রথম অমত করলেও শেষে সবার জোড়াজুড়িতে আংটি বদল করলো। মাহতিমের উদ্ভট আচরণ দেখে ভীষণ খটকায় আছে মেহনূর। না, এবার শান্ত হচ্ছে না। কাউকে না বললেও অন্তত মেহনূরকে জানিয়ে যায়। যেখানেই কাজ থাকুক, মেহনূরকে আশ্বস্ত করে বাসা থেকে বেরোয়। অপেক্ষা করতে লাগলো মেহনূর। যে পযর্ন্ত না আসবে, ওই পযর্ন্ত একটা খাবারও টাচ করবে না সে।

বাড়ির ভেতরটা কোলাহলে ভরপুর। সৌভিকদের পরিবারের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে বড়রা। মারজার তোষামোদে সৌভিকের কাকা-কাকিমা রাতটুকু এখানেই কাটাবে। বিয়ের পরিবেশটা জমানোর জন্য আজ ভালোই আয়োজন হয়েছে। অন্যদিকে নীতিরা ছাদে আঁড়ি গেঁথেছে। খোলা আকাশের নিচে চেয়ার-টেবিল ছড়িয়ে এলাহি কারবার। সবাই নিজেদের ব্যক্তি জীবনের নানা গাল-গল্প নিয়ে হাসাহাসি করছে। তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে মেহনূর। রাগে ভেতরটা দাউদাউ করছে মাহতিমের জন্য। অসভ্য লোকটা এখনো দোরগোড়ায় হাজির হয়নি। গেছে কই? কোন্ চুলায় আগুন ধরাতে গিয়েছে? মেহনূরকে অন্য চিন্তায় বিভোর দেখে জোরে কাশলো সৌভিক। কাশির ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যাপারটা কানে যেতেই স্বাভাবিক হলো মেহনূর। সৌভিক একগাল হাসি দিয়ে ফাজলামির সুরে বললো,

– আপনার অভদ্র লোকটা কাজে গেছে ভাবী-শ্যালিকা। চিন্তা ঝেড়ে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হোন।

সৌভিকের মুখে ডাবল সম্বোধন শুনে হো-হো হাসছে সবাই। সামিক হাসতে-হাসতে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,

– ভাই জানলে টুট টুট খাবা ব্রো। ভাবীই ডাকো।

সামিকের ইঙ্গিত শুনে কপট রাগ দেখালো সৌভিক। পিঠে জোরে চাপড় মেরে হাসি দিয়ে বললো,

– আমার কাছে বোনই ভালো। এর ঊর্ধ্বে কিছু ভাবা লাগবে না।

কোকাকোলার গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলো ফারিন। হঠাৎ গ্লাসটা ঝটকা মেরে ছিনিয়ে নিলো তৌফ। সুন্দর করে চুমুক দিলে হা হয়ে গেলো ফারিন। একবার গ্লাসের দিকে তাকালো, আরেকবার তৌফের দিকে দৃষ্টি ঘুরালো সে। রাগে গজগজ করে চেঁচিয়ে বললো,

– অসহ্য তৌফ ভাই! অসহ্য! তোমার জ্বালায় কি শান্তি মতো কোকও খেতে পারবো না? তুমি কি আমাকে বিরক্ত করা অফ করবে?

তৌফ নির্বিকার ভঙ্গিতে পুরো গ্লাস খালি করে করলো। বড় একটা ঢেঁকুর তুলে বললো,

– ওই সিয়াম, শোনতো ব্যাটা, ফটাফট একটা রুম স্প্রের ব্যবস্থা কর। নাইলে একটু পরে যেই কেলেঙ্কারিটা হইবো, ওইটার জ্বালায় টিকতে পারবি না।

ফারিন বাদে সবাই তখন অবুঝের চোখে তাকালো। সিয়াম নিজেই ব্যাপারটা বুঝার জন্য বললো,

– তোর দেখি ভালোই কারেন্ট। রুম স্প্রে চাস ক্যান? কোন্ জায়গায় লাগাবি?

তৌফ রাগী মুখে তাকালো। নিচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে থাবড়া মা:রার ভঙ্গি ধরে বললো,

– দূর ব্যাটা! আলগা কথা কস ক্যান? পরিবেশে মাইয়া মানুষ আছে দেখোস না? ফারিন পারদ মারবো বুঝছোস? এজন্য আনতে বলতেছি।

সিয়াম আবার জিজ্ঞেস করলো,

– আরে ব্যাটা পারদ মানে কি?

তৌফ বিরক্ত ভরে বললো,

– মূর্খ! অশিক্ষিত! আই-কিউ দিয়াও বুঝোস না? পারদ মানে বুঝোস না? মাঝখানের শব্দ আউট কর, এরপর দ্যাখ কি দাঁড়ায়।

একমিনিট পুরো পরিবেশটা ঠান্ডা হয়ে থাকলো। সবাই একে-অন্যের দিকে চাওয়া-চাইয়ি করলো। যেই সবগুলো চোখ ফারিনের দিকে আঁটকে গেলো, তখনই দুম করে তীব্র হাসির ঝড় উঠলো। পুরো ছাদটা তখন হাসির শব্দে গমগম করে উঠলো। ফারিন লজ্জায় নত হয়ে গেলেও শেষে সবার হাসিতে যুক্ত হলো। ছাদের শুকনো কাপড় তুলতে অন্যপ্রান্তে ছিলো মেহনূর। সেখানে আলো জ্বালায়নি বলে জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাতাসে উড়তে থাকা কাপড়গুলো তুলতেই হঠাৎ গা ছমছম করলো মেহনূরের। ক্লিপের উপর হাত রেখে স্থির হলো সে। শোঁ শোঁ বাতাস, থেমে-থেমে হাসির শব্দ, ঝিঁঝিপোকার ছন্দপূর্ণ ডাকটা স্পষ্ট কানে শুনতে পাচ্ছে। বুকের স্পন্দনটা একটু-একটু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওটা কিসের আলো? মেহনূর ধীরপায়ে রেলিংয়ের কাছটায় এগিয়ে গেলো। বাড়ির সদর দরজার বাইরে ‘ হাইজ ‘ গাড়ি থামানো। আরেকটু মনোযোগ দিয়ে তাকাতেই লম্বা গড়নটা দেখতে পেলো মেহনূর। গেটের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সাদা পান্ঞ্জাবিটা দেখতে পাচ্ছে। তাকে তিনজন ব্যক্তি কি কথা যেনো বললো। ওমনেই মাহতিম রণমূর্তি ধারণ করে তাদের শাষাতে লাগলো। এটুকুতেই ক্ষান্ত হলো না মাহতিম, সোজা তর্জনী তুলে রাগের তেজ ছেড়ে দিলো। ধুক-ধুক তালটা যেনো কানের পর্দায় আঘাত দিচ্ছে। শরীরটা ঠান্ডা মৌসুমের মতো ভয়ে শিউরে উঠছে। মাহতিম এখন পযর্ন্ত কোনোকিছু লুকায়নি! যা জানতে চেয়েছে, যখন জানতে চেয়েছে, সব নির্দ্বিধায় মেহনূরকে বলার জন্য প্রস্তুত থাকতো। হঠাৎ চোখের পলকে প্রথম লোকটার কলার চেপে ধরলো মাহতিম, দু’হাতে কলার খামচে জোরে-জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। দৃশ্যটা দেখার সাথেই মুখে হাত চাপা দিলো মেহনূর। মাথাটা এলোমেলো লাগছে! কি হচ্ছে বাইরে? মাহতিম কেনো ঝগড়া করছে? লোকগুলো কারা? মাহতিমের কবল হতে কোনোভাবেই কলার ছাড়াতে পারছেনা। দুজন লোক অবিরামভাবে কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু ব্যর্থ! মাহতিমকে ওরকম অবস্থায় দেখতে পেয়ে বাড়ির দারোয়ান গিয়ে তাড়াতাড়ি আঁটকালো। দারোয়ান-সহ তিনজন মিলে ওই কলার ছাড়িয়ে দিলো। মাহতিম তবুও ওদের শাষাতে থাকলে দারোয়ান লোকটা ভেতর টেনে আনলো। মাহতিমকে শান্ত থাকার কথাটা দূর থেকে বুঝলো মেহনূর, দৃশ্যটা দেখতে-দেখতে আরো একবার ঢোক গিললো। হাতভর্তি কাপড় ফেলে দৌঁড় লাগালো মেহনূর। মেহনূরের দৌঁড় দেখে সবাই একটু প্রশ্নসূচকে তাকালেও মাহতিমকে দেখে হয়তো ছুটে গিয়েছে। মেহনূর কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা বাড়ির বাইরে গেলো, হাঁপাতে-হাঁপাতে ডান-থেকে-বামে তাকালে লন এরিয়ায় দৃষ্টি পরলো। পাকা ছাউনি দেওয়া বসার জায়গাটায় বসে আছে মাহতিম। আবার দৌড় লাগিয়ে একেবারে সামনে থামলো মেহনূর। মুখ হা করে নিশ্বাস নিতেই মাহতিমের কাছে গেলো। বসার পাকা জায়গায় মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে সে। নিচু করা মাথাটায় হাত রাখলো মেহনূর। চুলগুলো আঙ্গুলে নাড়াতেই মাথা তুললো মাহতিম, সামনে আগত মানুষটার দিকে থমথমে দৃষ্টিতে তাকালো। মুষ্টিবদ্ধ করা হাতদুটো আলগা করে একটা হাত উপরে তুললো, মাথা থেকে কোমল হাতটা পাঁচ আঙ্গুলে খামচে ধরলো সে। প্রচন্ড রাগে-ক্ষোভে-আক্রোশে ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে দিলো। সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো মেহনূরের, তুমুল আশ্চর্যে চূর্ণ হলো সে। অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে একবুক ভয় নিয়ে প্রশ্ন করলো মাহতিমকে,

– বাইরের লোকগুলো কারা?

কোনো জবাব দিলো না মাহতিম। নির্বাকভাবে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহনূর একটু ঢোক গিলে আবার জিজ্ঞেস করলো,

– ওই তিনটে লোক কারা ছিলো? আপনি ওদের সাথে ঝগড়া করছিলেন। একজনের কলারও চেপে ধরেছেন, ওরা কারা ছিলো?

বুকটা ধড়ফড়-ধড়ফড় করছে। মাহতিম কোনো কথাই বলছে না। বেচইন মেহনূর এবার কাট-কাট ভঙ্গিতে সংযত সুরে বললো,

– আপনি আমার কাছে কোনো কথাই লুকান না আনসারী সাহেব। আজ যদি কথাটা গোপন করেন, তাহলে আপনার ওয়াদাটা ঠিকই ভেঙ্গে যাবে।

চট করে দুই চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। জোরে এক নিশ্বাস নিয়ে চোখ খুলে তাকালো। অদ্ভুত কঠোরতায়, ভিন্ন শঠতায়, আলাদা গাম্ভীর্য স্বরে বলে উঠলো সে,

– তোমাকে বিয়ে করাই হয়তো আমার জীবনের মস্ত বড় ভুল! নয়তো এই মাহতিমকে পাওয়াটা তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশা:প!

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here