#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_৩০ .
#যবনিকা_পর্ব . ০১ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
দেখার জন্য তর সইছে না। অপেক্ষা মানছে না। ধৈর্য্য কুলাচ্ছে না। মাহতিমকে দেখার জন্য আকুলিবিকুল করছে মেহনূর। কখন একটুখানি দেখা মিলবে, কখন দু’চোখের তৃষ্ণা মিটাবে, কখন হাতে হাত রেখে মুঠোয় চেপে চুমু খাবে। মুখটার মধ্যে কতটুকু আঘাত লেগেছে, কোথায় ক্ষত লেগেছে, কতখানি কেটেছে উনার। যদি ঠোঁটের আশেপাশে আঘাত লাগে, অসংখ্য চুমু খাবে মেহনূর। যদি মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা হয়, তবে বুকে চেপে আদর করবে ও। প্রতিটা মূহুর্ত্তে-মূহুর্তে তাকে সেবার হাত বাড়িয়ে আবদ্ধ করবে। যখন নার্স এসে বলবে, ‘ আপনি ভেতরে যান, স্যার ডাকছেন ‘, তখন কেমন অনুভূতিতে গা ছমছম করবে? কেমন শিহরণে মৃদ্যু-মৃদ্যু কেঁপে উঠবে? কেমনটা লাগবে ওর? শরীরের মধ্যে দমকা হাওয়ার মতো শিরশির ভাব হবে। এই অপেক্ষায় থাকাটা একপ্রকার আনন্দ। এক না-বলা সুখের মতো। অপেক্ষার পর দু’চোখ ভরে যখন দেখার সুযোগ মিলবে, তখন আত্মায়-প্রাণে-অন্তরে চান্ঞ্চকল্যকর অনুভূতি জাগ্রত হবে। মাহতিমকে আবারও, আরো আকণ্ঠরূপে পাওয়ার-বোঝার ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষায় বশীভুত হবে। মনে-মনে এসব ভাবতে-ভাবতে চোখদুটো খুলল সে। দেখতে পেল, বেসিনের আয়নায় শুকনো-মলিন মুখটা। এই ক’দিনের টেনশনে খুব ম্লান হয়ে গেছে। চোখের সাদা অংশটা খুব লাল। গতরাতে ঘুম হয়নি। রাত জেগে-জেগে বইয়ের পাতায় বুঁদ থেকেছে। যদি এ অবস্থায় উনি দেখেন, তাহলে কি ভীষণ চlটে যাবেন? মুখ ঘুরিয়ে রাlগ দেখাবেন? মুখ ভার করে গম্ভীর সুরে বলবেন, ‘ তোমার কাছ থেকে এমনটা আশা করিনি। কি করেছ নিজের? এই জন্য তোমাকে একা ছাড়ি? ‘ আজ আই.সি.ইউর পন্ঞ্চম দিন চলছে। পুরো পাঁচটা দিন দেখতে-দেখতে চলে গেছে। প্রতিদিন ভোর সকালে উঠা, গোসল করা, হালকা নাস্তা খাওয়া, হাসপাতালের দিকে যাওয়া, সেখানে পৌঁছে অপেক্ষায় থাকা; পরিশেষে রিক্ত মুখে রাত নয়টায় কোয়ার্টারে ফেরা। মানুষটার দেখা আর মিলে না। বিগত তিন ধরে শরীরের উপর ঝlড় বয়ে গেছে। রাত জেগে পড়াটা খুব কষ্টের, তবুও জক্কি পোহাতে হয়েছে। মেহনূর আয়নায় তাকিয়ে নির্লিপ্ত সুরে বলল,
– পাঁচ দিন কেটে গেছে মেহনূর। সময়টা কেটে গেছে তোর। নিজেকে নিয়ে খুব হেলা করেছিস, খুব কষ্ট দিয়েছিস। আর দিস না। চোখদুটো মুছে নিজেকে প্রস্তুত কর। তোর এই অবস্থা দেখলে উনি খুব রাlগ করবে। তুইতো জানিস, পরিস্থিতিটা কেমন ছিল। আল্লাহ্ যেন এমন অবস্থায় কাউকে না ফেলে। যতটুকু পারিস ততটুকুই পরীক্ষায় খাতা তুলে দিবি। মনটা খারাপ করিস না। তুই আগের মতো দুর্বল নেই। আজ তো উনার সাথে দেখা করবি, তাই না? পুরো পাঁচ দিন পর দেখতে পাবি। মনে ভরসা রাখ মেহনূর। আশ্বাসের প্রদীপটা জ্বালিয়ে দে।
মুঠোভর্তি পানি নিয়ে মুখ ভেজাল সে। ট্যাপটা বন্ধ করে আয়নায় তাকালো মেহনূর। মুচকি হাসি দিয়ে আপন সুরে বলল,
‘ সময়টা বদলে গেছে আমার। বদলে গেছে আমার চিন্তাও। একদিন আমি দূর্বল হয়ে চললেও আজ আমি যথেষ্ট কঠোর। শুকরিয়া করছি তাদের, যারা আমাকে ঠকিয়ে গেছে। ধন্যবাদ দিচ্ছি তাদের, যারা আমাকে অপlদস্থ করেছে। মুচকি হাসছি তাঁকে পেয়ে, যে আমার জীবনটা ধন্য করেছে।
ফাইল হাতে মেহনূর বেরিয়ে গেল। পড়নে ছিল আকাশী রঙের শাড়ি। সাদা ব্লাউজটার স্লিভ কনুই অবধি। চুলের গোছা সুন্দর করে আঁচড়ে মাথার ডানদিকে সিঁথি গেঁথেছে। বাঁদিক বরাবর লম্বা বেণী করে বুকের বাঁ-পাশটায় ঝুলিয়ে রেখেছে। সাদামাটা ভূষণে আধঘন্টার ভেতর পরীক্ষার কেন্দ্রে পৌঁছে গেল। ভীড় জমাট গেটটার কাছে স্থির হল মেহনূর। ডানহাতে ফাইল, বাঁহাতের মুঠোতে আঁচল ধরা। চোখের চাহনিটা গেটটার দিকে নিবদ্ধ। আজ যদি উনি সুস্থ থাকত, তবে এই গেটটার কাছে সেই-ই ছেড়ে যেত। হাসিমুখে ভরসার হাতটা কাধে রাখত। কানে-কানে নিচু সুরে বলত, ‘ কোনো ভয় নেই। আমি আছি। আমি জানি তুমি কনফিডেন্সের সাথে পারবে ‘। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আজ তিনি পাশে নেই। চোখের পাতা বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়ল মেহনূর, আঁচলটা ছেড়ে গেটের দিকে এগুতেই পেছন থেকে সামিক চ্যাঁচিয়ে উঠল,
– অল দ্যা বেস্ট ভাবী। একদম নার্ভাস হওয়া যাবে না। সবকিছু ঠান্ডা মাথায় লিখতে হবে। আমি বাইরেই আছি। তুমি ভালভাবে দিও ওকে? পরীক্ষার খাতায় কুlপাকুlপ লিখে দিবে। বেস্ট অফ লাক।
সামিক মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে মেহনূরকে উৎসাহ দিল। দূর থেকে বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে শুভকামনা জানাল। মেহনূর হাতছানি দিয়ে বিদায় বুঝিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। অসংখ্য পরীক্ষার্থীর মাঝে মিশে গেল মেহনূর। আকাশী রঙের শাড়িটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।
.
বহুদিন পর শহরের মাটিতে পা রাখলেন। কান জ্বালা করা হর্ণ শুনতে পেলেন। চোখের সামনে ব্যস্ত সড়কে গাড়ির প্রlতিযোlগিতা দেখলেন। এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে বিশাল বড় হাসপাতালটা দেখতে পেলেন। বয়সটা যেমন বেড়েছে, তেমনি অনেককিছু বদলে গেছে। কেন জানি শহরে আসলে দম বlন্ধ লাগে। ভীড়ের মাঝে মন মানে না। মানুষ দেখলে মনে হয় পাlথর। সুজলা মাথায় ঘোমটা টেনে নিলেন। হাতে থাকা ছোট্ট বাটন ফোনটা টিপে কানে চাপলেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই কারো উদ্দেশ্যে তিনি বললেন,
– হ্যাঁ বাবা, এসে গেছি। কি বললে? চার তলা? আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। রাখি তাহলে, আমি আসছি।
কলটা কেটে তিনি গাড়ির দিকে ফিরলেন। সাবা, সুরাইয়া ও শেফালি কথাগুলো শুনে নেমে পরল। মহিমপুর থেকে লম্বা জার্নি করে পৌঁছেছে সবাই। শানাজের অবস্থা, মাহতিমের কথা, মেহনূরের খবর শুনে কেউ একমূহুর্ত থাকতে পারেনি। গাড়ি একটা ভাড়া করে চলে এসেছে তারা। সুজলা ওদের সঙ্গে নিয়ে চতুর্থ তলায় পৌঁছল। আই.সি.ইউ রুমটার কাছটায় দলবদ্ধ সবাইকে দেখে বিনয়ী হাসি দিলেন সুজলা। যেই উনার দৃষ্টিটা চেয়ারে বসা মারজার দিকে পরল, ওমনেই হাসিটা শূন্যে মিলিয়ে পাণ্ডুর হয়ে গেল। কোনো এক জাদুবলেই সুজলা অশ্রুসিক্ত হয়ে মারজার কাছে ছুটে গেলেন। মারজা স্থির রইলেন না। সুজলাকে দেখতে পেয়ে দুহাতে জড়িয়ে নিঃশব্দে ভেঙে পরলেন। সুজলার কাধে কপাল ঠেকিয়ে হুঁ হুঁ করে কাঁদতে লাগলেন। এ যন্ত্রণা শুধু মায়েরা বুঝবে। এ মর্মবেদনা শুধু মায়ের বুকেই বিদ্যমান। মারজার পিঠে সান্ত্বনার হাত বুলিয়ে সুজলা নরম হলেন, আশ্বাস বাণী ছেড়ে বললেন,
– আপা, আপা শান্ত হোন। আর কান্না করবেন না। এই দ্যাখেন, দ্যাখেন না আপা, দ্যাখেন আমরা সবাই এসে গেছি। কেউ বাদ নেই। আল্লাহ্ যেমন বিপদ দিয়েছে, সহি-সলামত উদ্ধার করেছে আপা। শান্ত হোন আপা, চুপ করুন।
মারজা নাক টেনে কিছুক্ষণ পর সুজলাকে ছেড়ে দিলেন। চোখের উপর ওড়না চেপে দু’চোখ মুছে নিলেন। সুজলার দিকে সরল হাসিতে কুশল সেরে স্বাভাবিক হলেন তিনি। সাবা ও সুরাইয়া যেয়ে নীতিদের সাথে কথা জমিয়ে ফেলল। হাসপাতালের নির্জীব অবস্থা ধীরে-ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগল। শানাজের অবস্থা আগের চেয়ে সুস্থ বলে আজ তার সেlলাই খোlলার কথা। সুরাইয়া সাবার দিকে টিlপ্পlনী কেlটে বলল,
– দেখলে বুবু, দেখলে? মেহনূর যে আlকাlইlম্মার ঢেঁlকি, গাlধাlর গাlধা, তা দেখতে পেলে? এবার কিন্তু হাতে-নাতে প্রমাণ পেলে। যে জায়গায় ওর বাবুটা নিয়ে আমরা হৈচৈ করতাম, সেখানে শানাজ বুবুর টোনা এসে হাlগু-মুlতু করছে। কবে এই গাlধাটার সুবুlদ্ধি হবে বুবু?
সাবা ভ্রুঁদুটো কুঁচকে সুরাইয়ার মাlথায় কlষিয়ে এক চাlট্টি মাlরল। বেশি বকবক করা স্বভাবটা সুরাইয়ার এখনো যায়নি। অথচ, ক’দিন পর ওর নাকি বিয়ে; তাও আবার এলাকার গনমান্য হুজুরের সাথে। সাবা কণ্ঠস্বর নিচু করে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল,
– ওর বাবু, ওর চিন্তা, তোর এত জ্বlলছে কেন? বাড়ি থেকে মlরিচ ডlলে এসেছিস? খুব পোlড়াlচ্ছে? পোlড়া জায়গায় মlলlম লাগাবি?
সুরাইয়া মাথায় হাত বুলাতে-বুলাতে মুখটা ব্যlথাতুর ভঙ্গিতে বলল,
– আমার মাlথা নিয়ে কি পেয়েছ বুবু? কি শুরু করলে? যখন-তখন শlয়তাlনের মতো থাlবlড়া দেও। আমি কিন্তু বড়মার কাছে কlঠিন বিlচাlর লাগাব! তোমাকে নিয়ে আর পারছি না। এসব কিন্তু অসহ্য লাগে বুবু!
সুরাইয়ার কথা শুনে ভ্রুঁ-টা উঁচু করল সাবা। মুখের ভঙ্গি এমন করল, যেন ওর নাlলিশ শুনলে কি-না-কি হয়ে যাবে। সাবার মুখভঙ্গিমা দেখে ঢোক গিলল সুরাইয়া। সে বোকা-বোকা চাহনিতে বলল,
– কি হয়েছে? আমি কি মিlথ্যে বলছি নাকি? আমি সত্যি-সত্যিই বড়মার কাছে বিচার দেব। তুমি আমাকে হুজুরের ভয় দেখাবে না। আমি কিন্তু —
এবার সাবা বুকের কাছে হাত ভাঁজ করল। বাঁ ভ্রুঁটা উঁচু করে ছোট-ছোট চোখে বলল,
– তোর হুজুর দিয়ে আমার কি? আমি কি তোকে একাই শাlয়েস্তা করতে পারব না? কি ভেবেছিস আমাকে? শানাজ বুবুর অবস্থা দেখছিস? দেখেছিস পেlটটা ফেঁlড়ে বেচারির অবস্থা কি করে ছেড়েছে? শহরের নিlর্দlয় ডাlক্তাlরগুলো কি রকম ফাlজিlল হলে সিlজাlর করতে পারে, ভেবেছিস একবার? মেহনূর যদি এই অবস্থায় —
হাতটা খপ করে ধরল সুরাইয়া। সাবাকে থামিয়ে আরেকটু কাছ ঘেঁষে বলল,
– রান্নাঘরের ঘটনাটা মনে আছে বুবু? দুজন চুলার ধারে ছিল, এরপর ভাইয়া রাlজার মতো কোলে নিল, ওকে কোলে নিয়ে দরজায় খিল দিল। মনে আছে তোমার?
সাবা এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিল। ওর বেহুদা গল্প শুনে-শুনে মাথাটা ধরে যাচ্ছে। এমনেই পুরো রাস্তা জুড়ে বকবক করে এসেছে। তার উপর এখন যদি — না, এটা হতে দেওয়া যায় না। সাবা গলা নামিয়ে এমন সুরে বলল যেন কথাটা শুধু সুরাইয়াই শুনুক।
– হ্যাঁ, মনে আছে। আমার এটাও মনে আছে তোর ছ্যা:বলা:মির জন্য আমি তোকে ক:ষিয়ে চ:টির বা:রি লাগিlয়েlছিলাম। এখনো পায়ে সেই চ:টি জুlতাটা আছে। খাবি নাকি? লাlগাlব দুটা? আসার সময় নোংরা-পlচাঁ পাlরা দিয়ে এসেছি। সুরাইয়া, সময় থাকতে শুlধlরে যা। মুখটা যদি বন্ধ না-করিস এখন আচ্ছামত প্যাঁlদাlব।
সাবার শক্ত মুখটা দেখে সুরাইয়া নিমিষের ভেতর চুপসে গেল। ঢোক গিলে ঠোঁটের উপর এমন ভঙ্গি করল, যেন দু’আঙুলে অদৃশ্য কোনো জিপার টেনে মুখ বন্ধ করে ফেলল। সাবা মুখ বন্ধ করার দৃশ্যটা দেখে ফারিনের কাছে চলে গেল। একটু পরেই খবর এল, মাহতিমকে আই.সি.ইউ থেকে শিফট করে নরমাল কেবিনে পাঠান হচ্ছে। অবস্থা এখন উন্নতির দিকে এবং শারীরিক দুর্বলতা বেশ খানিকটা সেরে উঠেছে। ঠিক আধঘন্টার ভেতর বিশাল বড় কেবিনে মাহতিমকে পাঠান হল। সেখানেও নিlরাপlত্তার জন্য দরজার বাইরে দুজন অlস্ত্রধাlরী গাlর্ড লাগিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর পরিবারের সাথে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হল। সবার আগে মারজা ছেলেকে ওই অবস্থায় দেখে চিৎকার দিতে যেয়ে মুখে কাপড় চাপা দিলেন। ভেতরে ডলা পাকানো চিৎকারটা আঁটকে ছেলের পাশে বসলেন। চোখ খিঁচে তরতর করে পানি ঝরিয়ে যাচ্ছে, মুখে কোনো শব্দ করতে পারছেন না। ছেলের বুকে পরম মমতায় হাত রাখলেন মারজা। আর্দ্র কণ্ঠে বললেন,
– তোর উপর জুlলুlম করব না মাহতিম। তুই যা চাস, যেভাবে চাস, ওভাবেই কর। তোর কোনোকিছুতে আমি অমত করব না। শুধু নিজের বিiপদ ডেকে আমার কlলিlজায় ছুlড়ি বসাস না বাবা। তোর এই অবস্থা দেখলে আমার কlলিlজাটা বেরিয়ে যায়। আমাকে মাফ কর বাপ। আর সহ্য করতে পারতে পারব না।
মায়ের অবস্থা দেখে মিচকি হাসে মাহতিম। কোনো জবাব দেয় না সে। মা-কে বোঝানোর মতো ভাষা এই মূহুর্তে নেই। একে-একে কেবিনের ভেতর সবাইকে দেখতে পায় সে। সুজলার ভেজা চোখের চাহনি দেখে কয়েক মূহুর্ত নির্বিকার চেয়ে থাকে। পুরো বেড ঘিরে সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরপরই ডান-বামে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নির্দিষ্ট একজনকে খুঁজতে থাকে। মায়ের দিকে চিন্তার ফেলে দৃষ্টি দুর্বল কণ্ঠে শুধায়,
– ও কোথায়?
মারজা কথার মানেটা বুঝে। বুঝার পরও অবুঝের মতো অভিনয় করে বলেন,
– কে কোথায়? সবাই তো এখানে।
মারজার উত্তর শুনে বে-আক্কেলের মতো মাহতিম তাকায়। অন্যদিকে বাকিরা চেপে-চুপে হেসে যাচ্ছে। কোনোমতে হাসি আঁটকে শান্ত-স্বাভাবিক দেখিয়ে যাচ্ছে। মাহতিম একদম ভণিতা না করে জিজ্ঞেস করল,
– আমার বউ কোথায়?
এবার অকপটে বলা দেখে সবাই হো-হো করে হেসে ফেলল। পুরো কেবিন জুড়ে হাসির ফোয়ারা দিগ্বিদিক ছাপিয়ে যাচ্ছে। কেউ-কেউ হাসি থামাতে গিয়ে আবার হেসে ফেলছে। কেউ আর মাহতিমের উত্তর দিচ্ছে না। মাহতিম চোখ খাটো করে গরম চোখে তাকাল। সবার এই অমূলক হাসির চেয়ে মেহনূরকে নিয়ে ভাবনা হচ্ছে। ও কি রাগ করল? ওর কথা রাখেনি বলে অভিমান করে চলে গেছে? পেট ফাটা হাসি শেষে ফারিন ভাইয়ের পাশে বসল। হাসি থামিয়ে শান্তভাবে বলল,
– টেনশন কোরো না ভাইয়া। ভাবী এক্সাম দিতে গিয়েছে। আজ থেকে ভাবীর বোর্ড এক্সাম শুরু। তাই সে সেন্টারে আছে। দু’ঘন্টা পরেই এসে যাবে। ততক্ষণ একটু অপেক্ষা করো, আমরা যাই।
.
মেহনূর ফাইলটা নিয়ে হাসlপাlতালে ঢুকল। চতুর্থ ফ্লোরে এসে শুনল, মাহতিম এখানে নেই। চোখদুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। বলে কি! নেই মানে? এরপরই জানতে পারে, মাহতিম এখন তৃতীয় ফ্লোরে, নরমাল কেবিনে। সবাই সেখানে গিয়ে দেখা করে ফেলেছে। তবে কিছুক্ষণ আগে ভিlজিlটিং আওয়ার শেষ। তাই আর ঢুকতে দেওয়া হবে না। মেহনূর কথাগুলো শুনতে-শুনতে সিঁড়ি বেয়েই নিচে নামল, লিফট ধরে নামল না। সে দেখা করবে, যে করেই হোক দেখা করবে! সবাই যেখানে দেখা করেছে, সেখানে ওর বেলায় হবে ‘শেষ’ কেন? তৃতীয় তলায় এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে কেবিনটার কাছে আসল। সবাই সেখানে হাসিমুখে বসে আছে। ওয়ান টাইম কাপে করে চা খাচ্ছে। মেহনূরকে অপ্রতিভ অবস্থায় দেখে সবাই চা খাওয়া থামিয়ে দিল। মেহনূরকে কিছু বলবে, তার আগেই মেহনূর অস্থিরভাবে বলল,
– আমি ভেতরে যাব। ভেতরে কে আছে? সৌভিক ভাই, ভেতরে কে আছে? নার্স? ডাক্তার? কেউ কি আছে? ডেকে বলুন আমি দেখা করতে চাই।
সৌভিক কেবল মাত্র চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। মেহনূরের পাগলপ্রায় অবস্থা দেখে উদ্বেগের সুরে বলল,
– ভাবী কাম ডাউন। একটু বসুন, একটু জিরিয়ে নিন, আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলছি।
মেহনূর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। সে এখনই দেখা করতে চায়। ওর কপাল-মুখ-গলা ঘেমে একাকার, মুখটা রlক্তিlম হয়ে গেছে। মেহনূরকে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় দেখে সৌভিক বাক্য ব্যয় করল না। ওকে আশ্বস্ত করে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেল। সুজলা ওকে ঠান্ডা হতে বললেন। নিজের আঁচল দিয়ে সমস্ত ঘাম মুছিয়ে দিলেন। শেফালি পানির বোতল এগিয়ে পানি খাইয়ে দিল। মেহনূরকে শান্ত করে, স্থির করে, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলল। একটু পরেই ভেতর থেকে একজন ইনটার্ন ডাক্তার এসে জানাল,
– আসুন। সমস্যা নেই। স্যার এখনো ঘুমাননি। আপনি ভেতরে যেতে পারেন।
দুরুদুরু পায়ে কেবিনটার কাছে গেল মেহনূর। ডাlক্তাlরটা প্রাইভেসির জন্য বাইরে রয়ে গেল।ডানহাতে দরজার হ্যান্ডেলটা ধরে এক মোচড় মাlরল মেহনূর, ক্যাচ করে প্রশস্ত দরজাটা খুলল। বুকের ভেতরটা ধুকপুক গতিতে চলছে। শরীরটা ঠান্ডা হয়ে আসছে। চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার টাইলসে রেখে ভেতরে পা বাড়াল সে, রুমটায় ঢুকে যেতেই হ্যান্ডেলটা ছেড়ে দিল। ভারী দরজাটা আপনা-আপনি বন্ধ হতেই নিস্তেজ পরিবেশে আবদ্ধ হল। মেহনূর তখনও নতচোখে তাকিয়ে আছে, চোখ তুলে বেডের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। সুস্থ একটা মানুষকে বিদায় দিয়েছিল। তাঁর করুণ অবস্থা কিভাবে সহ্য করবে?
‘ – ও মেহনূর, ‘
আকুল ভরা কণ্ঠে ডেকে উঠল মাহতিম। অপেক্ষা-প্রতীক্ষা-আশায় থাকা অভিব্যক্তিগুলো তার দুর্বল কণ্ঠে ফুটে উঠল। আদরমাখা কাতরমিশ্রিত ডাকটা শুনে মেহনূর রুখে থাকতে পারল না। ফ্লোর থেকে ঝাপসা দৃষ্টি তুলে বেডের পানে চাইল। চোখে-চোখ পরতেই ঠোঁট উলটে ফাইলটা ছেড়ে দিল মেহনূর। দুহাতে মুখ ঢেকে ফ্লোরে বসে পরল। যেটুকু মনোবল নিয়ে চোখ তুলার সাহস দেখিয়েছিল, সব শেষ, সব নিঃস্ব। পুরো পাঁচ দিনের যন্ত্রণাকে মুক্ত করল মেহনূর। সকলের কাছে নীরব থেকে-থেকে যেই যন্ত্রণা কাউকে বুঝতে দেয়নি, যেই দlগ্ধ-ভগ্ধ হৃদয়ের একেকটি চিৎকার নিজের ভেতরে সংগোপনে রেখেছিল, সেই গোপন কুঠির প্রতিটি মর্মবেদনা আজ খুলে দিল মেহনূর। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চার দেয়ালের মাঝে ওর অজস্র নিরবতা চারধারকে বিদীর্ণ করে দিল। হাউমাউ করে কাঁদতেই আর্দ্র সুরে বলল,
– আপনি আমার কথা রাখলেন না। কোন কথাই শুনলেন না। আমি কি করব? কোথায় যাব? আপনাকে সুlস্থভাবে ছেড়েছিলাম, কি হাল করে আমার সামনে আসলেন। কি হাল করেছেন? মাথায় সেlলাlই লাগিয়ে শুয়ে আছেন, হাতে স্যাlলাইন — আমি এসব কিভাবে দেখব? ইয়া আল্লাহ্! এই দৃশ্য আমি আম্মার বেলায় দেখিনি, আপনার বেলায় কিভাবে সহ্য করব?
নির্যুত্তর মুখে মাহতিম তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে, এক্ষুণি মেহনূরকে তুলে বুকে আবদ্ধ করতে। ওর গালে-ঠোঁটে গভীর চুমু খেয়ে খুব করে বলতে, ‘ তুমি শান্ত হও মেহনূর। কেঁদো না। দ্যাখো, আমি সুস্থ। দ্যাখো, তোমাকে কতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছি। এতখানি শক্তি কোথায় পেলাম? আমার কিচ্ছু হয়নি মেহনূর। কিচ্ছু হয়নি দ্যাখো। এইতো সামান্য একটু ইন্ঞ্জুlরি হয়েছে, এটা কিছুদিনের ভেতর সেরে যাবে ‘। কথাগুলো ঠোঁটের কাছে এসেও বেরুলো না, মাহতিম কিছুই বলতে পারল না। দুর্বলতার কাছে জোর খাটিয়ে আকুল সুরে ডাকল,
– আসো না লক্ষ্মী। আমিতো উঠতে পারছি না।
কথাটা বলতে গিয়েই চোখ খিঁচুনি দিল মাহতিম। সেলাইয়ের জায়গায় চিলিক দিয়ে উঠেছে। ব্যথাটা প্রশমনের জন্য খুব ধীরগতিতে নিশ্বাস নিতেই কানে সুক্ষ্ম শব্দ পেল। চোখ মেলার পূর্বেই ডান গালটায় তপ্ত আঙুলের ছোঁয়া অনুভব করল। খুব মোলায়েম স্পর্শে গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে। মাহতিম কোমল হাতটাকে ঠোঁটে ছোঁয়ার জন্য বদ্ধ চোখে মুখটা ডানে ফেরাল। হাতের গরম-নরম তালুতে দু’ঠোঁট প্রগাঢ়ভাবে চেপে দিল। কিছু সময় ওভাবেই কাটাল মাহতিম। একটুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখল, মেহনূর পাশে বসে রক্তিম চক্ষু মেলে চুপ হয়ে আছে। ফোলা-ফোলা চোখের কোটরে এক স্তুপ নোনাজল। সামান্য টোকাতে পরার জন্য প্রস্তুত। মাহতিম ব্যাlন্ডেজ মোড়ানো ডানহাতটা কম্পনরত অবস্থায় উপরে তুলল। মেহনূরের গালটা ধরে মুখটা নামিয়ে ওর কপাল স্পর্শ করল, নিচু সুরে বলল,
– জ্বর বাঁধিয়েছ, তাই না?
মেহনূর কিয়ৎকাল তাকিয়ে থেকে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়ল। আস্তে করে বলল,
– সেদিনের মত সারিয়ে দিবেন?
মাহতিম ওর আবদার শুনে হাসল। মাথার যন্ত্রণা ভুলে দুষ্টু ঠোঁটে বলল,
– এখনই কমাই আসেন। আমার চাদরটার নিচে ঢুকে পরেন।
মেহনূর এভাবে অকপটে বলা দেখে লজ্জামিশ্রিত চোখে ঈষৎ হেসে ফেলল। চোখ নিচু করে বলল,
– মাথায় সেlলাlই লাগিয়ে, পা একটা ভেlঙে এখনো অসlভ্যতা করছেন?
মাহতিম দু’ঠোঁট প্রসার করে ঝলমলে হাসি দিল। ওর হাতটা টেনে উন্মুক্ত বুকে চেপে ধরল। চোখ বন্ধ করে নিচু সুরে বলল,
– তোমাকে আমি যেতে দেব না। তুমি আমার কাছেই থাকছ। আমার এই সিঙ্গেল বেডে তুমি শোবে, আমার পাশে তুমি ঘুমাচ্ছ। জুতা খুলে উঠ। দুটো ঘন্টা তোমার বুকে ঘুমোতে চাই। একটু শান্তি চাচ্ছি মেহনূর। দরজাটা লক করে এসো।
চলমান .
#FABIYAH_MOMO .
#নোটবার্তা : বিশাল বড় পর্ব। ❤