#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০৫
“কে মেরেছিল আপনাকে?”
তপার প্রশ্ন শুনে পলক মৃদু হাসল। তপা বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে আবারও বলল,
“আশ্চর্য আমি হাসার মত কি বললাম? শুধু তো জানতে চেয়েছি কে মেরেছে? এতে এত হাসির কি আছে বুঝলাম না।”
” তোমার মনে হচ্ছে না তুমি আজ একটু বেশিই কথা বলে ফেলছো?” সামনে তাকিয়ে গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে বলল পলক।
তপা ঈষৎ অবাক হলো। সত্যিই সে আজ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কথা বলছে। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করছে কে মেরেছে লোকটাকে। কিন্তু ইনি তো সোজা কথা বলার মানুষ নয়। তাই মনের ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছেটা মনে মনেই কবর দিয়ে দিল।
গেইট পর্যন্ত এসে পলক মসৃণ কণ্ঠে বলল,
“এখন যেতে পারবে তো?”
তপা যেন আকাশ থেকে পড়ল।
“আমি কখন বললাম আমি যেতে পারবো না? আমি একবারও বলেছি আপনাকে পৌঁছে দিতে?”
পলক মুচকি হেসে বলল,
” বারণও তো করো নি? আসলে তুমি আমার সঙ্গ চেয়েছো তাই জন্যই বারণ করো নি তাই না?”
তপা উত্তর না দিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেল চোখের আড়ালে। পেছনে ফেলে গেল একজোড়া হাস্যজ্বল চোখ।
কেটে গেল বেশকিছুদিন। পরীক্ষা শেষে আবার পুরো দমে শুরু হয়েছে ক্লাস। সামনেই সেমিস্টার ফাইনাল। তপা দিকবিদিক ভুলে কেবল লেখাপড়ায় মনোযোগ দিল। ক্লাস বাসা আর মাঝেমধ্যে ব্যবসার জন্য কিছু গ্রোসারি কিনে আনার জন্য বের হওয়া। তপা বা পৃথা কেউ এখন কেক ডেলিভারি করতে যায় না। একজন ডেলিভারি ম্যান ঠিক করে নিয়েছে। নয়তো সবটা তপা সামলাতে পারে না।
সব ঠিকঠাক ভাবে চললেও তপার মনটা অশান্ত হয়ে আছে। বেশ কয়েকদিন থেকে মনে হচ্ছে কেউ তাকে ফলো করছে। সবসময় তাকে নজরে নজরে রাখছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু খুঁজে পায় না।
সেদিন লাইব্রেরীর ঘটনার পর তপা আর পলকের মুখোমুখি হয় নি। হ্যা সামনাসামনি পরে গেছে অনেকবার। কিন্তু নিজেই পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। অস্বস্তির থেকে নিজের সম্মানটাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছে তপা। পলকের সাথে কেউ ওকে জড়িয়ে কিছু রটিয়ে দিক তা ও কষ্মিণকালেও চায় না। এতদিনে এটা বুঝতে পেরেছে লোকটা ঠোঁট কাটা হলেও মনটা স্বচ্ছ। নয়তো শুধুমাত্র একটা মেয়েকে টিজ করা নিয়ে ঝামেলা করে কেউ নিজের মাথা ফাটিয়ে বসে থাকে না।
সেদিন ক্যাম্পাসে একজন ছাত্রীকে কিছু বখাটে উত্ত্যক্ত করছিল। এক পর্যায়ে ওড়নায় হাত রাখে। টেনে নেওয়ার আগেই সেখানে উপস্থিত হয় পলক। শুরু হয়ে যায় হাতাহাতি। সেখানেই মাথা ফাটিয়ে লাইব্রেরীতে ঘাপটি মেরে ছিল।
হন্তদন্ত হয়ে তপা ছুটলো লিফটের দিকে। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে বোধহয়। কিন্তু ও লিফটে পা রাখতেই বড় বড় পা ফেলে পলক ভেতরে ঢুকে পড়ল। তপা বাইরে বের হতে চেয়েও ভেতরে প্রবেশ করল। লোকটা তো আর তাকে খেয়ে নিচ্ছে না। এত ভয় পাওয়ার কি আছে আশ্চর্য। কিন্তু এই গা ছাড়া ভাবটাই তাকে ফাঁসিয়ে দিল। তপার ক্লাস দশ তলা ভবনের ছয় নাম্বার ফ্লোরে। তপা বাটন প্রেস করার আগেই পলক দশ তলায় যাওয়ার বাটন প্রেস করে দিল। তপা অবাক হলো। এরচেয়ে তো সিঁড়িই ভালো ছিল। মুখটাকে হাঁড়ি করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সে। পলক সেদিকে খেয়াল করে মুচকি হাসল।
হঠাৎ কারেন্ট চলে যাওয়ায় লিফট জুড়ে নেমে এলো অন্ধকার। তপা ভয়ে সিটিয়ে গেল। লিফট সবে তিন চার তলার মাঝামাঝি। তপা ভয়ে পলকের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে হাত খামচে ধরে ফুপিয়ে উঠল। পলক অবাক হয়ে অন্ধকারেই তপার মুখটা দেখার চেষ্টা করছে। তপা ফুপিয়েই চলেছে। পলক তপার হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল,
“ভয় পেও না। আমি আছি তো কিছু হবে না। শান্ত হও।”
তপা ঈষৎ কেঁপে উঠল। পলক ভাবল হয়তো সে হাত ধরেছে বলে কেঁপে উঠেছে। কিন্তু পলককে ভুল প্রমাণ করে তপা থেকে থেকেই কেঁপে উঠল। পলক অবাক হয়ে ভাবল, এইটুকুতে এত ভয় পাওয়ার কি আছে। আশ্চর্য।
উপায় না পেয়ে দু’হাতে বুকের সাথে আগলে নিল। । মিনিট দুয়েক যেতেই তপা আবারও কেঁপে উঠল। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। অনবরত কেঁপে উঠতে দেখে দেখে পলক ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সে ভেবেই নিয়েছে এ মেয়ে এখন নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যাবে।
তপা নিজেকে পলকের বাহুডোরে আবদ্ধ বুঝতে পারে। কিন্তু তার নিজের শরীরে এক ফোটাও শক্তি পাচ্ছে না।নিজেকে ক্রমশই হারিয়ে ফেলছে কালের গহবরে। হঠাৎ জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করল তপা। পলক পড়েছে মহা বিপদে। কাঠখোট্টা, ঠোঁটকাটা পলক তাজওয়ার কখনো এরকম পরিস্থিতিতে পড়ে নি আগে। কি করবে ভাবতে ভাবতেই তপা নিজের সবটুকু ভার পলকের উপর ছেড়ে দিল। নিশ্বাসের গতিও কমে আসছে। নিশ্বাসের গতি কমলেও এখনো হা করেই শ্বাস ফেলছে সে। তবে সেটাও ক্রমশ কমছে। নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। তবে কি মেয়েটা সত্যি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে?
পলক দিকবিদিকশুন্য হয়ে অন্ধকারেই আলতো করে হাত রাখল তপার গালে। শত দ্বিধা মিশ্রিত নয়নে একবার তপার অবয়ব দেখে মুখ এগিয়ে নিল তপার মুখের একদম কাছে। ঠোঁটে স্পর্শ লাগার আগেই চোখ বন্ধ করে ফেলল পলক। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের স্পর্শ। হোক না সেটা অনুভূতিহীন। দু আঙুলে তপার নাক চেপে ধরে অধরে অধর মিশ্রিত করে অনবরত শ্বাস প্রধান করল সে। কয়েক মূহুর্ত পর তপা স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিতে শুরু করল। কিন্তু শরীরটা তখনও নিস্তেজ। পলক তপার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে মিহি কণ্ঠে বলল,
“আই’ম সরি তিয়াশা । তোমার অনুমতি বিহীন তোমাকে ছোঁয়ার জন্য। মুখে বার বার চুমু খেতে চাওয়ার কথা বললেও আমি চাইনি তোমার অবচেতনে তোমাকে স্পর্শ করতে। কিন্তু কি করব বলো? আমি নিরুপায়।”
তপা ঈষদুষ্ণ চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল পৃথার দিকে। পৃথা মুচকি হেসে কাপটা নিয়ে বলল,
” তপা মা তোকে যেতে বলেছে আমার সঙ্গে।”
তপা কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে বলল,
“আমি তো যেতেই চাই। কিন্তু আজ নয় প্লিজ। আমি ওই মানুষগুলোর সামনে যেতে পারবো না রে। ওদের সামনে গেলে আমার ঘেন্না ধরে যায় নিজের জীবনের উপর।”
“কিন্তু ওরা তো কেউ আসবে না। শুধু তুই আর ভাইয়ার দুই একজন বন্ধু। এছাড়া কেউ নয়। মা ওদের আসতে বলে নি তো। মা তোকে খুব করে চায় তপা। তুই জানিস না মা তোকে কতটা ভালবাসে।”
তপা মলিন হাসল।
“আমি জানি রে। তোদের ভালবাসার জন্যই তো এখনো বেঁচে আছি আমি। কিন্তু এটা বল ভাইয়ার বন্ধু আসবে। ভাইয়াই তো নেই। বন্ধু এসে কি করবে?”
পৃথা একগাল হেসে বলল,
” ভাইয়া এসেছে দুইদিন আগে।”
তপার চোখ খুশিতে চকচক করে উঠল।
“সত্যি বলছিস তো? নাকি আমাকে নেওয়ার জন্য মিথ্যে বাহানা বানাচ্ছিস?”
“তোকে নিতে আবার বাহানার প্রয়োজন আছে? মা দুটো ইমোশনাল ডায়লগ দিলেই তো তুই শুরশুর করে চলে যাবি।”
তপা মৃদু হেসে বলল,
“তা ঠিকই বলেছিস। আন্টির কথা ফেলতে পারি না যে। এই পৃথিবীতে আমার মায়ের পরে আন্টিই একমাত্র মহিলা যাকে আমি এতটা ভালবাসি।”
পৃথাও একটুখানি হাসল। মেয়েটা একটু ভালবাসা পেলেই একবারে গলে যায়। অথচ কপাল দেখ, সেই একটুখানি ভালবাসাও জুটে না সেখানে। পৃথিবীটা বড্ড স্বার্থপর। আরও বেশি স্বার্থপর পৃথিবীর মানুষগুলো। কেউ কি নেই যে এই মেয়েটির ছোট্ট জীবনটা ভালবাসায় ভরিয়ে রাখবে। সুখে মুড়িয়ে রাখবে। ঠিক যেভাবে রাখে কনকনে শীতের রাতে ছোট্ট শিশুকে তুলোয় মুড়িয়ে।
তপা পৃথার বাড়িতে পৌঁছতেই পৃথার মা আয়েশাকে জড়িয়ে ধরল। আয়েশা তপার কপালে চুমু একে দিয়ে নিজেও জড়িয়ে নিলেন। খানিকক্ষণ পর মৃদু অভিমান করে বললেন,
“এত দেরি কেন করলি তুই? জানিস কতক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছি আমি? প্রান্তও তোর উপর রেগে আছে।”
তপা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ওহ ভালোই তো। তোমার ছেলে দুদিন আগে এসে আমার কথা মনে করতে পারে নি। আর আমি একটু দেরি করায় রেগে আছে। কোথায় তোমার ছেলে? ডাকো দেখি। ”
আয়েশা ডাকার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো দুজন সুদর্শন যুবক। অন্যজনের দিকে না তাকিয়ে প্রান্তর দিকে তাকিয়ে অভিযোগ করে বলল,
“দুদিন আগে এসে একবার আমার সাথে দেখা করতে পারলে না তুমি? তা করবে কেন? আমি কি নিজের বোন নাকি? নিজের হলে ঠিকই দেখতে যেতে।”
প্রান্ত কিছু বলার আগেই আয়েশা এগিয়ে এসে বললেন,
“এত এত অভিমান, অভিযোগ যেন না করতে পারিস সেজন্য আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
তপা মৃদু হেসে বলল,
“কি সিদ্ধান্ত আন্টি?”
“এই যে বলছিস এসেই দেখা করতে গেল না কেন? তাই আমি ভাবছি এসে যেন তোর মুখটাই সবার আগে দেখে সেই ব্যবস্থা করবো। বিয়ে দেব তোদের দুজনের।”
তপা, প্রান্ত যেন আকাশ থেকে পড়ল। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে মাত্র কি বললেন আয়েশা। বোধগম্য হতেই দুজনে একসাথে বলল,
“মা!”
“আন্টি!”
কিন্তু এতকিছুর মাঝে কেউ একবারও খেয়াল করল না পেছনে দাঁড়ানো ব্যক্তির শক্ত মুঠোবন্দি হাতটা। যেখানে জীর্ণ শীর্ণ অবস্থায় বন্দি একটি মুঠোফোন। যার দামী গ্লাসটায় চুরচুর করে ভাঙনের শব্দ হচ্ছে। ঠিক যেমনটা হচ্ছে তার হৃদমাঝারে।
চলবে….