#শবনম(পর্ব ৯)
সায়লা সুলতানা লাকী
“আল্লাহর গজব নামবো তোগো উপরে। জাহান্নামের আগুনে জ্বলবি তোরা। এমন গাছেমাছে ডাহা মিত্যা কতা যদি আর একবার কস জয়নবি! মরনের ডরভয় নাই তোগো? আল্লাহ হাজির নাজির, দুলাল আমার ছোট ভাই। ওরে লইয়া যদি আর একটা কতা কস তাইলে দেখবি তোগো উপরে আল্লার গজব পড়ব। বুঝি, আমি সবই বুঝি। আমারে যে দুলাল মায়া করে হের লেইগ্যা তোগো অন্তর পুড়ে। এক বাপের জন্মের অইয়াও দুলালের বইন অইতে পারলি না কপালপুড়িগুলি। অইছোসতো এক একটা শত্রু। হের দুঃখে আমার লগে তোগো এত হিংসা। ”
“হ, আমহো কত দুঃখরে! হাছা কতা কইলে মাওই বেজার। দেওরের বিয়ার আগে রাইতে রাইতে রানদা দিতেতো আর আমরা দেহি নাই? মশলা পিষ্যা দিতেতো আর আমরা দেহি নাই? দেওরে শার্ট লুঙ্গি আর কেডা কেডা ধুইয়া দিছে? কার মনে এত্তো পিরিত আছিল? আমরাতো সব অন্ধ, চক্ষে দেহি না। আল্লার গজবের ডরভয় দেহাইলেই হাছা মিছা হইয়া যায় না?”
“জয়নবি তুই কইলাম এইবার বেশি কইতাছোস? বানুর লগে তোর এত কীয়ের শত্রুতামীরে? এমন গাছেমাছে দিনেরে রাইত করতাছোস ক্যা? মতলবডা কী তোর?”
“চাচিআম্মা, আপনে আবার এর মইধ্যে আহেন ক্যা? আমার মায় কী এইহানে কতা কইছেনি? আপনে কোনো কতা কইয়েন না, উত্তর দিলে পরে কইবেন জয়নবি বেদ্দব।”
“তুই আমার পোলার বৌরে যা মুখে আহে তাই কবি আর আমি বুঝি চুপ থাকুম? সাবধান করলাম, তোগো হিস্যায় গিয়া গলাবাজি করগা কোন আপত্তি নাই। আমগো এইহানে এগুলি করিস না।”
“হ, পোলার কোন নাম নাই৷ ঘরে পোলার বৌ পালে। আবার হেই বৌ দিয়া ঘাটে ঘাটে লাং খাডায় খায়। তাইতো কই চোরের মার আবার বড় গলা। ওই জয়নবি আয় ঘরে আয়। এগো লগে কোন কতা কইস না। পারবি না।”
“জমিরার মা তুমি এইডা কী কইলা? যত বড় মুখ না তত বড় কতা! তোমার আইজকা পরমান দিতে অইব তুমি যেই কতা কইছো নাইলে জেল ফাঁস অইব আইজ এই বাড়িতে।”
“হ,হ, আমরা জেল ফাঁসেরে ডড়াই না। আমগো জমিরই উকিল অইতাছে। আইও পরে আমগো দোরে। দেহুমনে কত জোর তোমগো? বাড়ির সবগুলিরে জেলে ভরুম কইয়া দিলাম। আমি কেডা তহন চিনাই দিমু।”
“হ,হ ভরিস। এতিমের সম্পদ কুড়ি গোষ্ঠী মিইল্যা গিল্লা খাইতাছোস তগো আবার ঈমান? কেইস করলে আগে তোরাই জেলে ঢুকবি। পাকিস্তানের আইন কানুন সবতো তোরা কিন্যা লইছোস, বেইমানের দল।”
“আল্লাহগো আল্লাহ! কী কতা, কই থেইক্যা কই গেছেগা। আপনেরা এইবার ক্ষান্ত দেন, থামেন।জয়নব বু, বানু ভাবিরে লিবিস্টিক আর নোক পালিশ আমি দিছি। ছোট খালায় আমারে নিয়া নিউমার্কেট গেছিলো ওইহান থেইক্যা কিন্যা আনছি। বানু ভাবিরে হুদা এত আকতা কুকতা কইয়া নিজের মুখ ঈমান নষ্ট করেন ক্যা? কেমন বইন আপনে, নিজের ভাইয়ের স্বভাব চরিত্র জানেন না?”
“ওই শবনমি তুই আবার আইছোস ক্যা এই গ্যাঞ্জামে? ঘর থেইক্যা বাইর অইছোস ক্যা? এগুলিরে চিনোস না, এগুলি এক একটা—”
বানুর কথা শেষ না হতেই জয়নব ব্যঙ্গ স্বরে বলে উঠল
“আহ্হা কী পিরিতরে! দিনে দিনে কত্ত কী যে দেহুম। আইছে ভালা মাইনষের ঝিয়ে, আমারে বুঝাইতে। দেহুমনে এ পিরিত কত্তদিন থাকে?”
জয়নব আর দাঁড়াল না নিজেদের ঘরে ঢুকে গেল।
রাতে দুলাল ঘরে ফিরলে পরে শবনম ওর কাছে ঝগড়ার বিস্তারিত কথাগুলো বলল। সবটা শোনার পর দুলালের চোখমুখ ক্রোধ স্পষ্ট ফুটে উঠল। অবস্থাটা এমন যে এখনই বের হয়ে সৎবোনকে দুইচারটা কথা শুনিয়ে দিয়ে আসে। কিন্তু তার কিছুই করতে পারল না। শবনম ওকে কিছুই করতে দিল না। একটা সময় অসহায়ের মতো বলে উঠল
“বৌ তুমি যে আমারে বিশ্বাস করছো তাই আমার সাত কপালের ভাগ্য। ওরা আসলে চাইছিল তোমার ভিতরে সন্দেহ ঢুকাইয়া আমার অশান্তি করতে। দেখছে আমি একটু শান্তিতে আছি, তাই ওগো সহ্য হইতাছে না।”
“আরে থুনতো এইসব কতা, আগে কন হেই কতা-”
“কী কতা বৌ?”
“বানু ভাবিতো কইল আপনেরে হেয় ছোট ভাই মনে করে কিন্তু আপনে তারে কী মনে করেন?”
“ও আল্লাহ এইডা তুমি কী কইলা? আমি অইলাম ভালোবাসার কাঙ্গাল, যেই আমারে একটু ভালোবাসা দিছে তারেই আমার আত্মার আত্মীয় বইল্যা মনে করছি। ভাবিও আমার তেমন একজন। আমারে বড়ই স্নেহ করেন। আমিও তারে বইনের মতই জানি।”
“হুদাই মুখে জানেন কিন্তু অন্তরে না।”
“হায় আল্লাহ বৌ তুমি এমন অপবাদ দিও না।”
“হুমম, হাছাই কই? অন্তর দিয়া মনে করলে হের লগে হওন সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন। শাহ আলম ভাইরে জিগাইতেন হেয় কেন এমন অন্যায় করে বানুভাবির লগে?”
“ও আল্লাহ, বৌ এইডাতো কোনদিন ভাইব্যা দেহি নাই। তয় ভাইয়েররও কোনদিন সাবাশিও দেই নাই। হের লগে কতা অইলে সবসময়ই কইছি তুমি কামডা ভালা করো নাই ভাই।”
“হেই কওন আর বইনের ভাই হইয়া জিগান দুইডা কী এক হইল? আমার খুব খারাপ লাগে ভাবির কষ্ট দেইখ্যা।”
“বৌরে তোমার অইল মায়ার শরীর, তাই সবার লেইগ্যাই তোমার এত মায়া। আইচ্ছা এহন এইসব কতা বাদ। তোমার কতা কও, ঔষধগুলি ঠিকমতো খাইতাছোনি?”
“খাই, তয় কেনজানি এগুলি আমার ঠিকমতো খাইতে ইচ্ছা করে না।”
“হায় হায় কও কী বৌ? তুমি ডাক্তারের কতা মন দিয়া শুনো নাই? খালাওতো সুন্দর মতো বুঝায় কইল, তুমি বুঝো নাই?”
“বুঝছি তয় হেগো কারো কতাই আমার মনে লয় নাই। আমার খালি মনে অইছে হেরা আমার আর আপনের আনন্দ, খুশিডাই বুঝে নাই। আমগো শান্তিডাই দেহে নাই।”
“বৌ এইডা কী কইলা? তোমার মনে এইগুলা আইল কেমনে?”
“আমি যহন অইছি তহন আমার মায়ের বয়স আমার মতোই আছিল, আমি কী বাঁইচ্যা আছি না?”
“বৌরে বিপদ কী সবারডাই একরকম কইরা আহে?”
“হেইডাইতো! বিপদতো যে কারোর বেলাই অইতে পারে। এইহানে বয়সের আবার কী?”
“তোমার মনে যহন এত প্রশ্ন তহন তুমি তাগো জিগাইতা? ডাক্তার, খালা কেউ না কেউ তোমারে বুঝায় কইত। তুমি এত কতা ভেতরে চাপায় রাখছো ক্যা? আমিতো এসবের উত্তর জানি না, বুঝিও না।”
“আমি সব কতা সবাইরে কইতে পারি না। যহন বুঝি হেরা ঠিক আমার মত কইরা আমার ভালো চায় না আমি তহন হেগো কাছে সব চাইপ্যা যাইগা।”
“বৌরে এই কামডা তোমার ঠিক অইল না। মনের মধ্যে চাইপ্যা রাখাডা ঠিক কাম না। অনেক সময় তোমার আমার ভালাডা আমরা সামনে বইয়া ঠিক মতো বুঝি না। কিন্তু বাইরের কেউ বিষয়ডা ভালো বুঝতে পারে। আমগো দোষত্রুটিগুলি ধরতে পারে। তাই সবসময় সবার লগে জোগজিজ্ঞাসা কইরা সিদ্ধান্ত নিতে অয়। নিজের ভুলডা নিজের চোখে সবসময় ধরা পড়ে না। কিন্তু অন্যের চোখটারে আর এড়ায় যাইতে পারে না ভুল ব্যাডায়, বুঝছোনি বৌ!
“হ বুঝছি আপনে ফাস্ট অইছেন, এক্কেবারে রেলগাড়ীর মতন লম্বা একটা লেকচার দিছেন।” বলেই শবনম খিলখিল করে হেসে উঠল।
জীবনে প্রথম সিনেমা দেখে এখন সেই সিনেমার সব ডায়লগ গরগর করে বলে বেড়ায় শবনম। যেকোন কথার মধ্যে সেই সিনেমার এক একটা ডায়লগ লাগিয়ে হিহি হা হা করে হেসে উঠে। কেনজানি এই বিষয়টাকে দুলাল নিজেও খুব উপভোগ করে। মাঝে মাঝে শবনমের সাথে নিজে সুর মেলায়। ওর সাথে হা হা হা করে হেসে ফেলে। আজও তাই করল খান জয়নুলের ডায়লগটা মনে করে দুজনই খুব হাসল।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ গুলো নিয়ম না মেনে খেয়েতো শেষ করেছে, সাথে নিজেও বেশ সুস্থতা বোধ করছে। এতেই যেন সব চিন্তা শেষ এমনই যখন ভাবছে ঠিক তখনই শবনম টের পেল ও আবার পোয়াতি হয়েছে। এবার নিজের ভুলকে ঢাকতে বিষয়টা ভেতর ভেতর চেপে গেল। খুব সাবধানে চলা ফেরা করতে শুরু করল। দুলালের পাশাপাশি বাড়ির কাউকেই বিষয়টা বুঝতে দিল না। এতে অবশ্য সাপে বর হল বানু গিয়েছে ওর বাপের বাড়ি। ওখানে ওর মা অসুস্থ তাই থাকবে বেশ অনেক দিন। বানু ছাড়া আর কেউতো হুটহাট ওর ঘরে এসে বসে থাকে না। তাই ওর চেপে যেতে আরও সুবিধা হল।
দুলাল যখন টের পেল তখন পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। তখন আর রাগ করতে পারল না শবনমের ভুলের কথা ভেবে উলটো ভয় বাসা বাঁধল মনের মধ্যে। বাচ্চার সুস্থতার সাথে মায়ের শারীরিক সুস্থতাও যে এখন প্রশ্নের সম্মুখীন ডাক্তারের কথা মতো।
এবার আর কোন রিস্ক নিল না। শবনমের মায়ের কাছে খবরটা নিজে গিয়ে দিল এবং এবার যেন কোন ভুল না হয় সে বিষয়ে জোর দিল তাদের ।
শবনমের মায়েরও তেমনই কথা, ভুলটা যখন হয়েই গিয়েছে তখন শবনম ও ওর বাচ্চা দুটোর জন্যই সাবধান হতে হবে। শবনমের মা দুলালকে আশ্বস্ত করল ব্যবস্থা একটা করে জানাবেন তিনি।
দুলাল বাড়ি ফিরে এল কিন্তু মনে শান্তি পেল না। শবনমকে দেখে রাখার জন্য বানুও এবার বাড়ি নাই। তাই প্রতিটা মুহুর্তেই ও চিন্তায় থাকে।
এদিকে শবনমে পেট দেখে দেরিতে হলেও এবার বাড়ির সবাই জানতে পারল ওর পোয়াতি হওয়ার খবর। কেউ কেউ একটু রাগও করল, বলল কেন ডাক্তারের কথা মানল না। ওর সৎ শাশুড়ি হেসে হেসে একদিন অনেক বাজে কথা শুনালো এইবারের পোয়াতি হওয়া নিয়ে। সম্পত্তির লোভে নাকি এসব করেছে শবনম, এমনটাও শোনাতে ভুলল না। এই বাচ্চাও বাঁচাতে পারবে না এমন কথায় শবনমের মন কেঁপে উঠল।
শবনম কারো কোন কথার জবাব দেয় না, দিনরাত জায়নামাজে পড়ে শুধু আল্লাহর দরবারে রহমত চায়। ও শুধু বুঝে এই সন্তানটা পৃথিবীতে এলে তা দুলালের মনের সব কষ্ট দূর করে দিবে নিমিষেই।
এক রাতে শবনমের মা আর বাবা এসে হাজির শবনমের বাড়িতে পালকি নিয়ে । বাড়ির সবাই কারনটা বুঝে উঠার আগেই পরের দিন ভোর বেলা ওরা বেড়িয়ে পড়ল ঢাকার উদ্দেশ্যে। যাবার বেলায় শবনম তেমন কাউকে কিছুই বলে যেতে পারল না।
ঢাকায় গিয়ে উঠল শবনমের ছোট চাচার বাসায়। টিনসেডের একতলা বাড়ির একটা ঘরে আপাতত শবনমের ঠিকানা হল। দুলাল সব সময় থাকতে পারবে না এমনটাই প্রথম বলেছিল কিন্তু শবনমকে একা রেখে বাড়িতেও আসতে মন সায় দিল না। বাচ্চা আর শবনমকে হারানোর ভয়টা যে ওর মনেই বেশি তাই দায় ঠেকা ঠেকে ও নিজেও কয়েকদিনের জন্য থেকে গেল।
শবনমের বাবা একমাসের বাজার-সদাই করে দিয়ে এল ভাইয়ের ঘরে। যাতে মেয়ের কোনরকম কষ্ট না হয়। শবনমের মা চলে এল নিজের গেরস্থ দেখাশোনার তাগিদে কিন্তু মনটা পড়ে রইল শবনমের কাছে। এখানে শবনমের ঘরের পাশের ঘরে ভাড়া থাকেন দুইজন মেয়ে। ওদের পরামর্শেই ওর চাচা ওকে এখানে এনেছেন। মেয়ে দুইটা হাসপাতালের নার্সের ট্রেনিং নিচ্ছে। ট্রেনিং পিরিয়ড চলা কালেও ওরা টুকাটাক ক্লিনিকে কাজ করে।
পরদিন আবার ওকে হাসপালে নিয়ে ডাক্তার দেখানো হল। ডাক্তার ভালোমতো দেখেশুনে বেশ কিছু ঔষধ দিয়ে বাসায় পাঠায় দিলেন আর বললেন “এখন বকা দিয়েতো আর কোন লাভ নেই তবে খুব সাবধানে থাকবেন যাতে কোন অঘটন না ঘটে। আর সাথে কীভাবে চলতে হবে তাও বলে দিলেন।
দুলালের ব্যবসাপাতি পড়ে রইল গ্রামে আর ও এই ঢাকা শহরে। কিন্তু শবনমকে ছেড়েও যেতে মন সায় দিল না একদিনের জন্যও। কিন্তু শ্বশুরের টাকায় এইভাবে বসে বসে খেতেও বিবেকে লাগে এদিকে নিজের ব্যবসা বন্ধ থাকায় হাতেও তেমন কোন টাকা নাই। তাই একদিন বেড়িয়ে পড়ল কাজের সন্ধানে।
রাতে বাসায় ফিরতেই পড়ল ছোট চাচার সামনে।
বেশকিছু ক্ষন তার সাথে কথাবার্তা বলে পরে ঢুকল শবনমের ঘরে।
“সারাদিন কই ছিলেন? কাকায় অনেক চিন্তা করছে আপনেরে লইয়া। শহরের বাও বাতাস না কি বলে ভালো না। কিয়ের বলে আন্দোলন অইতাছে খুব। পুলিশ বলে সাধারণ মানুষ ধইরা ধইরা জেলে ভরতাছে, এমন কতা শুনলে আমার ভিতরডায় কেমন করে তা আপনে বুঝেন?”
শবনমের ক্ষোভ এখন উপচে চোখ বেয়ে পড়তে শুরু করল।
“আহা বৌ কাইন্দো না। গেছিলাম কাম খুঁজতে, আলহামদুলিল্লাহ ভালো কামই পাইছি। যা পামু তাতে খারাপ অইব না। বুঝছো বৌ ঢাকা শহরের বাতাসে খালি টেকা উড়ে। শুধু ধরতে জানলেই অয়। আমগো যেই সন্তান
আইব দুইন্যায় হেয় বড় কপালের অইব। কেমনে হের রিজিক গুছায় লইল, বুঝছো কিছু?”
“ও আল্লাহ, এইসব কী কন? আপনে ঢাকা শহরে কীয়ের কাম লইছেন? কে দিলো আপনেরে কাম?”
“হা হা হা, তুমি এত ডড়ায় গেলাগা ক্যা? নিজের হিম্মতের জোড়ে চলইন্যা পুরুষ আমি বুঝছো? সুবিধা মতো কাম পাইছি দেইখ্যাই লইছি। তোমার চাচায় চিনে যার অইহানে কাম পাইছি। একটু আগে চাচার লগে কতা কইয়াই আইছি। ডরাইও না। ঢাকা শহরে কেউ না খাইয়া থাকে না। এইহানে অইল টেকার খনি। শুধু কামাই কইরা লইতে অয়। যার যেমন ধান্দা তেমনেই কামায়। আমার যেমন ধান্দা ভালো তাই ভালো পথেই টেকা কামানের পথ ধরছি।” কথাটা শেষ করে দুলাল ওর সহজসরল হাসিটাই হাসল।
শবনম ওর হাসির দিকে তাকাল না। ওর ধ্যান অন্য জায়গায়। দুলাল এইবার শুধু সন্তান সন্তান করে একবারও মা, আম্মা এসব বলে না। ওর ভেতরে প্রথম বারের মতো সেই আনন্দ, উত্তাপ ও আর দেখে না।
পরেরদিন দুলাল সকালেই কাজে চলে গেল। শবনমের চাচা খুব করে দুলালের প্রশংসা করলেন, এমন কর্মঠ ছেলেকে ভাতিজির জামাই করে পেয়ে তিনি নাকি ধন্য। এমন কথা শুনেতো শবনমের মন আনন্দে নাচতে চাইল। দুলালে যে তার মন মজেছে তা বহু আগেই ওর দাদি ওকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে অবশ্য শবনমের কোন লজ্জা নেই। বরং দাদির রঙ্গরসের কথায় নিজেও হেসেছিল
এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুদিন। একদিন বিকেলে নার্সরা শবনমের মুখে ব্যথার কথা শুনে আর ওর চোখমুখ দেখেই চাচিকে সহ ওকে নিয়ে হাসপাতালে চলে এল। ডাক্তার ওকে ভর্তি করিয়ে নিল সাথে সাথে ঠিকই কিন্তু ব্যথাটা রাত বাড়তেই কমে গেল। সারারাত দুলাল হাসপাতালের বারান্দায় বসে ছিল। এটা জানার পর শবনম যেহেতু ওর ব্যথা নাই তাই বাসায় ফিরতে চাইল। কিন্তু দুলাল রাজি হল না। বলল চুপচাপ এখানেই থাকতে আর অপেক্ষা করতে।
ওর কথায় শবনমের চাচাও সম্মতি জানালেন।
দুইদিন হাসপাতালে থাকার পর তিনদিনের দিন ঠিকই একটা ফুটফুটে বাচ্চার জন্ম দিল শবনম।
মেয়েকে যখন দুলালের কোলে দিল তখন দুলালের হাত কাঁপছিল ভয়ে। সিস্টারের আশ্বাসে মেয়েকে কোলে নিল। বুকে নিয়ে আজান দেওয়ার আগেই ও হুহু করে কেঁদে ফেলল।
নাতিন হওয়ার খুশিতে শবনমের মা বাবা আবার শহরে এলেন ছোট ভাইয়ের বাসায়। নাতিন আর মেয়ে সুস্থ আছে দেখেই শবনমের মায়ের শান্তি মিলল মনে। মেয়ের কাছে বেশ কিছু দিন থাকলেন তিনি। সেই সময়তে দুলাল বাড়ি ফিরল। মেয়ে হওয়ার খুশিতে গঞ্জে আর বাড়িতে সবাইকে মিষ্টিমুখ করাল। জমির গ্রামে মোটামুটি এমন খবর ছড়িয়েছে যে দুলাল আর গ্রামে ফিরবে না। শহরে আস্তানা গাড়বে পাকাপোক্ত ভাবে। আর তাই ওর ব্যবসা সব এখন থেকে জব্বার আর জহিরেরই হবে। এমন গুজব শুনে ওর মেজাজ গেল চড়ে৷ ও সবাইকে জানিয়ে দিল, ওর ব্যবসা ওরই থাকবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বৌ আর মেয়ে সহ গ্রামে ফিরবে।
চলবে