#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১৬
আয়েশা হাজেরা বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় বললেন,
” তুই মেয়েটার সাথে এত জঘন্য একটা কাজ করলি কি করে? কেন করলি বল তো? ওর গায়ের রঙ কালো। ওর বিয়েতে তোকে মোটা টাকা গুনতে হবে যৌতুক হিসেবে সেজন্য? তুই যে বাড়িতে এত দাপট দেখাচ্ছিস সেই বাড়ির অর্ধেকটার মালিক যে তপা সেটা ভুলে গেছিস? তোর শ্বশুর মানে তপার নানা যে তপার মায়ের নামে এই বাড়ির অর্ধেক অংশ লিখে দিয়েছে সেটা জানিস না তুই? নাহ না জানার তো কথা নয়। তপার জন্মের আগে যখন তপার বাবা মায়ের মধ্যে ঝামেলা হচ্ছিল তখন তো তুই এবাড়িতেই ছিলি।তখন তোর শ্বশুর যে বাড়ি লিখে দিল তখন সেটা ভালো করে মগজে গেঁথে নিতে পারিস নি? নিজের টাকায় তপার খরচ নাই-বা চালালি। অন্তত ওর মায়ের অংশ থেকে কিছুটা বিক্রি করে নাহয় ওর খাওয়া পড়ার খরচ চালাতি। বাকিটা বিয়ের জন্য রেখে দিতি। কিন্তু তা না করে তুই মেয়েটার চরিত্রে কলঙ্ক লাগিয়ে দিলি? তোর কলিজা একবারও কাঁপল না? এই তুই মায়ের জাত?”
হাজেরা বেগম চেঁচিয়ে বললেন,
“তোর চোখে শুধু আমার অবহেলা ধরা পড়ল। আমার দোষ ধরা পড়ল। নিজের ছেলের অন্যায় দেখলি না? ওই কালনাগিনী যে তোর ছেলের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে সেটাও দেখলি না। তোর ছেলেরও চরিত্রের দোষ আছে। যেই সুযোগ পেয়েছে হামলে পড়েছে। ”
“আমার ছেলে মেয়ের চরিত্র সম্পর্কে আমার যথেষ্ট ধারণা আছে। তোর কাছে আমি সার্টিফিকেট চাইতে আসি নি।”
তপার সামনে গিয়ে বললেন,
“চল মা। এই নরকে আর তোর থাকতে হবে না। আমার সাথে আমার বাড়ি চল। বাবা ছাড়া যখন নিজের দুটো সন্তান মানুষ করতে পারছি তোকেও পারব।”
তপা শেষবারের মত সিজানের সামনে গিয়ে মলিন গলায় বলল,
“তুই কিভাবে বিশ্বাস করলি এই জঘন্য কথাটা?”
সিজান শক্ত গলায় বলল,
“আমি নিজের চোখে দেখেছি।”
“কি দেখিছিস?”
“তোরা দুজন জড়িয়ে ধরে ছিলি।”
তপা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“জড়িয়ে তো আমি তোকেও ধরি ভাই। তবে কি তোর সাথেও আমার নোংরা সম্পর্ক?
সিজান অসহায় চোখে তাকাল তপার মুখশ্রীতে। কি বলবে সে?
হাজেরা বেগম এসে তপার চুল ধরে টেনে সরিয়ে নিল সিজানের সামনে থেকে। কঠিন গলায় বলল,
” আমার ছেলের সামনে গিয়ে ন্যাকা কান্না করছিস তুই? নাটক করে আবার আমার ছেলের মন গলাতে চাইছিস। লাজ লজ্জা কি আল্লাহ একটুও দেয় নি?”
আয়েশা তপা কে সরিয়ে নিল। হাজেরার উদ্দেশ্যে বিক্ষিপ্ত গলায় বললেন,
“আজ এই ব্যবহার করছিস তো তুই। আজ বুঝলি না বুঝবি সেই দিন। যেদিন তোর মাথায় বারি পড়বে। দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষছিস তুই। তোর অবলা কালসাপ যেদিন তোর দিকে ফণা তুলবে সেদিন লুকোনোরও জায়গা পাবি না। আল্লাহ না করুন তোর না তপার পায়ে পরতে হয়। কিন্তু সেদিন দেখবি তপা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে তুই হাজার চেষ্টা করে ওর পাটাও ছুঁতে পারবি না।”
এবার সিজানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন আয়েশা।
“তুই তো মেয়েটা কে ভালবাসতি বাপ। কি এমন হলো যে তুই ও মায়ের কথায় তাল দিচ্ছিস? সত্যি কি ভালবাসতি নাকি ভালবাসার নামে ভান করেছিস।”
সিজান অসহায় চোখে তাকিয়ে মৃদু আওয়াজে বলল,
“ওকে তুমি নিয়ে যাও খালা মনি। এই নরকে আর আসতে দিও না ওকে। আমি জানি তোমার কাছে ও ভাল থাকবে।”
আয়েশা কিছু বলার আগেই সিজান গলার জোর বাড়িয়ে আবারও বলল,
” আমি নিজের চোখে দেখেছি ওদের দুজন কে একসাথে। নিজের চোখ কে কি করে অবিশ্বাস করব?”
“সিজান নাহয় মিথ্যে বলছে।কিন্তু মামুন? ও কি মিথ্যে বলবে? ওতো অবলা, অসহায় মানুষ। একহাতে জোর নেই। পায়েরও খারাপ অবস্থা। ভালো করে হাঁটতে পর্যন্ত পারে না। সে কিসের স্বার্থে মিথ্যে বলবে? আমরা বাড়িতে না থাকলেও মামুন তো বাড়িতেই ছিল। ও নিজের চোখে দেখেছে ওদের নোংরামো। আমরা বাড়ি পৌঁছানোর আগেই ও ছুটে গিয়ে রাস্তায় বলেছে ওদের কথা। তারপর তো সিজানও এসে দেখেছে দুজনকে ঘরে। আমরাও এসে তোর ছেলেকে ওই ঘর থেকে বের হতে দেখেছি। তপার তখন এলোমেলো অবস্থা। এরপরেও বলবি মিথ্যে কথা?”
তপা হাজেরা বেগমের কথা শুনে দু’হাতে কান চেপে ধরে বসে পড়ল মাটিতে। আয়েশা এসে তপাকে টেনে তুলে বাইরের দিকে পা বাড়ালো।
প্রান্ত যেতে যেতে হাজেরা বেগমের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“এই দিন দিন নয় আরও দিন আছে, এই দিন নিয়ে যাবে সেই দিনের কাছে।”
সেদিন চলে আসার পর এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত কেটেছে পৃথার সাথে একঘরে থেকে। সেদিনের পর আর তপা কোনো সম্পর্ক রাখে নি তো ওই পরিবারের সাথে। কেবল তার মামা বাদে। প্রান্ত ক’দিনের মধ্যেই চলে যায় ভার্সিটির হলে। তপা এসএসসির পর কলেজে ভর্তি হয়ে হোস্টেলে চলে যায়। পৃথার কলেজের জন্য শহরে চলে যায় আয়েশাও। তপা ইচ্ছে করেই ভর্তি হয় অন্য শহরে, অন্য কলেজে। নয়তো আয়েশা তার সাথে থাকতেই বাধ্য করবে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? নিজের চেষ্টায় জীবন গড়তে শুরু করে তপা। দু-তিনটে টিউশনি আর মামার পাঠানো সামান্য কিছু টাকা দিয়েই চলে যেতে থাকে তার দিনগুলো। দিনগুলো চলে গেলেও রাতের আধারে নেমে আসে বিপর্যয়। ছোট বেলা থেকে শুরু করে কিছুদিন আগের ঘটনা নামক দূর্ঘটনা গুলো দুমড়ে মুচড়ে দিতে থাকে তার জীবনটা। রাতগুলো চলে যায় নির্ঘুম ভাবে। যদিওবা একটুখানি দুচোখের পাতা এক করতো তখনই হানা দিতো ভয়ঙ্কর স্বপ্নগুলো। তমসায় ডুবিয়ে দিত তাকে।
বেশ কয়েকমাস পর কাকতালীয় ভাবে দেখা হয় সিজান পৃথার। শৈশবের খুনসুটি কৈশোরে গিয়ে রূপ নেয় প্রণয়ে।চাতক যেমন আশায় থাকে বৃষ্টির ঠিক তেমন দুজনে আশায় থাকতো একটুখানি সাক্ষাতের। যাকে দেখলে ওষ্ঠযুগল প্রসারিত হতো লজ্জালু হাসির দাপটে। সেই তাকে দেখেই পৃথার ভ্রুযুগলের মাঝের জায়গাটায় দুতিনটে ভাজ পড়েছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাতে সিজান কিছু বলার চেষ্টা করলেও লাভের লাভ কিচ্ছু হয় নি। উল্টো শুনতে হয়েছে কটুকথা। মেনে নিতে হয়েছে অপমান। ভালবাসার প্রত্যাখান।
সেদিনের পর আর সিজান পৃথার সামনে আসে নি। কিছু বলার চেষ্টাও করে নি। পৃথার কথা মনে হতেই কর্ণকুহরে কেবল একটা কথাই প্রতিধ্বনিত হতো বারংবার।
“যে নিজের বোনের সম্মান নিলামে তুলতে পারে, সে তো কাল পুরো আমাকেই নিলামে তুলে দিবে।”
নিজের ভাই, প্রাণপ্রিয় বোনরূপী বান্ধবীর উপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া কলঙ্ক পৃথা মেনে নিতে পারে নি। কি হতো সেদিন একটুখানি তপার হয়ে কথা বললে? কি হতো সেই দানব টাকে সবার সামনে নিয়ে আসলে?
আয়েশা বোনের বাড়ির দিকে ফিরে না তাকালেও হাজেরা বেগম সব ভুলে ঘেঁষতে থাকেন বোনের গা। মনে রাগ থাকলেও তা অপ্রকাশিতই রেখে দেন আয়েশা। শত হোক একই মায়ের সন্তান তারা। দুবোন একসাথে জায়গা ভাগ করে থেকেছে মায়ের পেটে। প্রান্ত প্রথম দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতো হাজেরা বেগম আসলে। পরে মুখ ফিরিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঘরবন্দী হয়ে থাকতো। শুধু দেখা হতো না পৃথা, প্রান্ত, তপা আর সিজানের। একটা ঘটনা পুরো জীবনের মোড়টাই ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
পলক হাতের ফোনটা সিজানের দিকে বাড়িয়ে দিল। সিজান ভ্রু কুঁচকে তাকালে পলক ইশারায় কথা বলতে বলল।
” এক বোনের রাগ ভাঙালে হবে না। আমার আরও একটা বোন আছে। সেও এক আকাশ সমান অভিমান নিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিচ্ছে।”
সিজান অবাক হয়ে বলল,
“ভাইয়া!”
“এত খুশি হয়ে লাভ নেই। আগে আমার বোনদের রাগ ভাঙা। আমি সবটাই শুনেছি। পলকের ফোনের সাথে কানেক্টেড ছিলাম।”
সিজান মলিন কণ্ঠে বলল,
“তাহলে মাফ করবে তো?”
প্রান্ত থমথমে গলায় বলল,
“আমি আমার বোনদের জন্য হাসিমুখে প্রাণও দিয়ে দিতে পারি।”
সিজান মন খারাপ করে ফেলল। সে তো পারে নি। ছোট বয়সের একটা ভুল জীবনটা ঝাঁঝড়া করে দিচ্ছে। কিন্তু তারই বা কি করার ছিল। পরিস্থিতি তো তার অনূকূলে ছিল না। অনেক আগেই হাতের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। সে তো শুধু হ্যা তে হ্যা মিলিয়েছে। আর কিছু না। তার বিশ্বাস অবিশ্বাসে কি আদৌ কিছু যেতো আসতো?
খাওয়ার সময় সিজান বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবা তুমি একা ফিরতে পারবে?”
মোর্শেদুল হক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“কেন তোর জন্মের আগে কি আমি বাড়ি থেকে বের হই নি? নাকি বাড়ি ফিরি নি?”
সিজান কণ্ঠ খাদে নামিয়ে নরম গলায় বলল,
“তা না বাবা। এখন তো বয়স হচ্ছে তোমার।”
“আমাকে দেখে বুড়ো মনে হয় তোর?”
সিজান এক হাতে কান ছুঁয়ে বলল,
“আমার ভুল হয়ে গেছে। মাফ করো। এখন বলো আমি যদি পরে যাই কোনো সমস্যা হবে?”
মোর্শেদুল হক খানিক সময় ভেবে বললেন,
“সমস্যা তো হবে না। কিন্তু তুই ফিরবি কখন? বিকেল তো হয়েই এলো। পরে গাড়ি পাওয়া যাবে না তো।”
” মামা ও আজ এখানেই থাক। কাল নাহয় সকাল সকাল চলে যাবে।”
পলকের কথা শুনে মোর্শেদুল হক কিঞ্চিৎ ভেবে বললেন,
“কিন্তু এখানে তো তপা, পৃথা দুটো মেয়ে থাকে। ও এখানে থাকবে কি করে?”
পলক মৃদু হেসে বলল,
“দ্বিতীয় তলায় আমার ফ্ল্যাটের দুটো রুম প্রায় খালিই পড়ে থাকে মামা।”
পলকের কথা শুনে তপা মৃদু স্বরে বলল,
“আপনি মামা বলছেন কেন? আংকেল বলুন।”
পলকও তপার মত ফিসফিস করে বলল,
“তোমার মামা তো আমার মামাই হবে না?”
তপা কিছু না বলে নিজের মত বিরবির করতে শুরু করল। পলক স্পষ্ট কিছু শুনতে না পারলেও বুঝতে পারল বিরবির করে তপা তারই পিন্ডি চটকাতে ব্যস্ত।
মাগরিবের নামাযের পর ছাদের এক কোণে রাখা দোলনায় চুপচাপ বসে আছে পৃথা। পাশে বসে পশ্চিম আকাশের রক্তিম আভা মিশে যাওয়ার দৃশ্য দুচোখ ভরে দেখছে তপা। গোধূলি আকাশের আগুন রঙা আলোর ছটা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দূর দেশে। কিয়ৎক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ধরণী ছেয়ে গেল আধো আলো আধো অন্ধকারে। মৃদু আলোয় সাদা গোলাপ গুলোকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। তপার ইচ্ছে করছে আলতো হাতে গোলাপের পাপড়ি গুলো ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু পায়ের যে নাজেহাল অবস্থা। পৃথার দিকে তাকিয়ে দেখল সে নির্বিকার। নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে সম্মুখপানে। তপা যে তার পাশে বসে আছে সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই তার।
পলক এসে অকস্মাৎ তপাকে কোলে তুলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। তপা নিজেকে ধাতস্থ করার আগেই দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল। তপা ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে দু’হাতে পলকের গলা আঁকড়ে ধরলো।
” আস্তে নামুন।”
পলক পায়ের গতি কমিয়ে বলল,
“কেন?”
“পড়ে যাব তো।”
“আমি থাকতেই?”
“আপনিও পড়বেন। সেজন্যই তো আস্তে নামতে বললাম।”
পলক ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“পড়ে গেলে তো ভালোই হবে। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে ধাপে পড়ার সময় তুমি লেপ্টে থাকবে আমার বুকে। দু’হাতে আঁকড়ে ধরবে আমার পিঠ। দুজনের শরীরে শরীর ছুঁয়ে দেবে। ছুঁয়ে দেবে দুজনের দেহের সমস্ত শিরা উপশিরারা।বেশ রোমান্টিক রোমান্টিক একটা ব্যাপার হবে তাই না?”
তপা কিছু বলল না। এখন কিছু বলা মানেই লজ্জার চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া।
তপা কে বিছানায় বসিয়ে পলকও পাশে বসল। তপা মৃদু স্বরে বলল,
“আমাকে এখন এখানে কেন নিয়ে এলেন?”
পলক শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
“বাসর বাসর পাচ্ছিল। তাই বাসর করতে তুলে নিয়ে এলাম। হবে নাকি একটুখানি?”
তপা মৃদু হেসে বলল,
“আপনি কি আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছেন? দুঃখিত। আমি এই মূহুর্তে ভয় পাচ্ছি না।”
পলক অবাক হয়ে বলল,
“সত্যি পাচ্ছো না? কিন্তু কেন? এত সাহসী তো তুমি নও।”
তপা মলিন হাসল।
“দানবের হাত থেকে বেঁচে ফিরেছি। আপনি তো মানুষ।”
পলক কিছু বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“মানে?”
তপা কথা ঘুরিয়ে বলল,
“কিছু না। কেন নিয়ে এলেন বললেন না কিন্তু।”
পলক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“নিজে তো প্রেমের ঘোর বিরোধী। নিজে নাহয় প্রেম করবেই না। সেটা তোমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু অন্য কারো প্রেমে ব্যাগড়া দেওয়াটা নিশ্চয়ই শোভনীয় নয় তাই না?”
তপা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“আমি কার প্রেমে ব্যাগড়া দিলাম?”
“সিজানের প্রেমে। তুমি জানো না ওরা এখন মান অভিমানের পালা শেষ করে ভালবাসা বাসি করবে।”
তপা অবাক হলো। পলকের দিকে তাকিয়ে সন্দীহান গলায় বলল,
“আপনি কি করে জানলেন ওরা দুজন দুজনকে ভালবাসে?”
পলক মুচকি হাসল।
“প্রেমিক পুরুষেরা চোখ দেখলেই বুঝতে পারে কে প্রেমে পড়েছে আর কে পড়েনি।”
তপা পলকের চোখের দিক থেকে নজর সরিয়ে নিল। তা দেখে পলক মৃদু গলায় গাইল,
“কাজল কালো ওই দুটি চোখ
ও চোখে জাদু আছে
চোখের আড়াল হতে গেলে
পড়ে যায় চোখের কাছে।”
” তুমি নজর সরিয়ে নিলেই কি আমি চোখ পড়তে পারব না? তোমার পা থেকে মাথা অবধি আমার মুখস্থ, কণ্ঠস্থ, ঠোটস্থ। বুঝলে?” বলে অন্য রুমে চলে গেল।
তপা অবাক হয়ে চেয়ে রইল। মুখস্থ, কণ্ঠস্থ, ঠোঁটস্থ। মানে কি? তবে কি তপার মনের উথাল-পাথাল ঢেউয়ের খবর রাখে পলক? এই যে এই মূহুর্তে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তপার অনূভুতি নামক গাছগুলো। এটা কি পলক টের পাচ্ছে। সর্বনাশ!
শার্ট বদলে টিশার্ট পড়ে তপার সামনে আসতেই তপা মৃদু স্বরে বলল,
“এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে দিবেন প্লিজ। তৃষ্ণা পেয়েছে।”
পলক বুকের বা পাশে হাত রেখে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
“চাইলে তো জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি। ”
তপা মুখ টিপে হেসে বলল,
“পানির অপর নাম জীবন। সেদিক থেকে জীবনটাই তো চাইলাম।”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি ভীষণ চালাক হয়ে যাচ্ছো কৃষ্ণময়ী।”
পানি এনে তপার হাতে দিতেই মৃদু আওয়াজে বেজে উঠল পলকের ফোন। ফোনটা কানের কাছে নিতেই ওপাশ থেকে পায়েল তাজওয়ার ঝাঁঝালো গলায় বললেন,
“বিয়ে করে কি সংসার পাতিয়ে ফেলেছো ওখানে?”
পলক তপার দিকে তাকিয়ে বলল,
“একা একা কি সংসার পাতানো যায় মা? যার সাথে পাতাতে চাইছি সে তো পাত্তাই দিচ্ছে না।”
পায়েল তাজওয়ার অবাক হয়ে বললেন,
“পলক তাজওয়ার কে পাত্তা দিচ্ছে না। কে সে? একবার দেখে চক্ষু সার্থক করার সুযোগ পাবো তো?”
পলক মৃদু হেসে বলল,
“দেখবে দেখবে। একসময় উঠতে, বসতে, খেতে, শুতে শুধু তাকেই দেখবে।”
“খুব সুন্দরী নাকি? নেতা সাহেব দিওয়ানা হলো যে।”
পলক মলিন কণ্ঠে বলল,
“আমি আর নেতা সাহেব নেই মা।”
পায়েল তাজওয়ার ছেলের যন্ত্রণা বুঝতে পারলেন বোধহয়। কথা ঘুরিয়ে বললেন,
” বল না। খুব সুন্দর দেখতে?”
পলক তপার দিকে অপলক তাকিয়ে বলল,
“হ্যা। একদম আমার মনের মত। স্নিগ্ধ, স্বচ্ছ, পবিত্র।”
তপা আঁতকে উঠল। স্নিগ্ধ, স্বচ্ছ, পবিত্র! কিন্তু সে তো পবিত্র নয়। শরীরটা যে পঁচে গেছে। গন্ধ ছড়ানোর অপেক্ষা মাত্র।
পলক কথা শেষ করে তপার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে পানির বাকি অংশটুকু গলাধঃকরণ করে গ্লাসটা পাশের টেবিলে রেখে তপার পাশে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল।
চোখ বন্ধ করে বলল,
“তুমি তো খুব চালাক হয়ে যাচ্ছো আজকাল।”
তপা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আবার কি করলাম?”
পলক ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,
“তুমি জানতে না ভাগ করে খেলে ভালবাসা বাড়ে? ইচ্ছে করেই পানি রেখেছিলে আমার জন্য তাই না? কিন্তু আমার দিক থেকে তো যথেষ্ট পরিমাণ ভালবাসা আছে। বরং তোমার আমার খাওয়া জিনিস বেশি বেশি করে খাওয়া উচিৎ। যাতে ভালবাসারা উপচে পড়তে পড়তে ছাদ থেকে তাজমহল পর্যন্ত আসে।”
তপা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল। এই মানুষটা একটা সাধারণ ব্যাপার কোথা থেকে ঠিক কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা আগে থেকে কেউ ধারণা করতে পারবে না। জিনিস এক পিস।
কিয়ৎকাল পর তপা মৃদু স্বরে বলল,
“আপনার কোনো ভাইবোন আছে?”
পলক একহাতে ভর করে মাথা উঁচু করে বলল,
“নাহ। আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। কেন বলো তো?”
তপা বিরবির করে বলল,
“ঠিকই ভেবেছিলাম। ওয়ান পিস মেড কারিগর ডেট। এক্ষেত্রে কারিগর বেঁচে থাকলেও প্রসেসিং বন্ধ আছে।”
পলক তপাকে বিরবির করতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি কি আবার আমার পিন্ডি চটকাচ্ছো?”
তপা হেসে ফেলল পলকের মুখে এহেন কথা শুনে।
“আসলে ভাবছিলাম।”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি?”
“এই যে আমার মত আর কতজনের কপাল পুড়ছে সেটা।”
পলক অবাক হয়ে বলল,
“আমি তোমার কপালে জুটে তোমার কপাল পোড়াচ্ছি?”
তপা মৃদু হেসে বলল,
“নিজেই ভেবে নিন। এইতো কিছুক্ষণ আগে বললেন আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপনার মুখস্থ, কণ্ঠস্থ, ঠোঁটস্থ। তাহলে নিশ্চয় মনটাও মুখস্থ। নিজেই বুঝে নিন।”
পলক ঠোঁট কামড়ে ধরে আবার সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল। মসৃণ কণ্ঠে বলল,
“এখন তো শুধু কপাল পোড়াচ্ছি। একবার আমার নামে দলিল করে নেই। তারপর তোমার সর্বাঙ্গ পোড়াবো।”
চলবে…
(কতটা গুছিয়ে লিখতে পেরেছি জানিনা। এক লেখা দুবার লিখলে অগোছালো হয়ে যায় মনে হয়।)