শবনম(পর্ব ৬) সায়লা সুলতানা লাকী

0
270

#শবনম(পর্ব ৬)
সায়লা সুলতানা লাকী

সকাল থেকেই শবনমের শরীরটা ভালো ঠেকছিল না। দুলাল গঞ্জে যাওয়ার পর থেকেই ওর শরীর খারাপ করা শুরু করল। থেকে থেকে ব্যথা হতে লাগল পেটে। কনকনে এক শীতের সকালে উঠানে বসেই রোদে পোহাচ্ছিল হঠাৎ এমন বিষ ব্যথার কামড় দিল পেটে যে সহ্য করতে পারল না। জোরে এক চিৎকার দিয়ে উঠল “ও আল্লাগো” বলে। ওর শাশুড়ি চিৎকার শুনেও না শোনার ভান করে ঘরে বসে কাঁথা সেলাইয়ে মন দিলেন। শ্বশুর অস্থির হয়ে উঠলেন
“ও জমিরের মা, একটু দেহ না মাইয়াডার কী অইল? এমন চিৎকারডা দিলো ক্যা? একটু খোঁজ লও না!”
“ক্যা আমি যামু ক্যা? আমার কী ঠেকা লাগছেনি? মাইয়ার না বড় তেজ, অহন হেই তেজই দেহুক। খবরদার আমারে কইবেন না দেখতে।”
“আহা, এমন সময় কী কেউ রাগ ধইরা রাখে? পোলাপান মানুষ, না বুইঝ্যা তোমার লগে বেদ্দবি করছে। অহন যাও না একটু।”
“বেশি দরদ থাকলে নিজে যান, আমারে কন ক্যা? আমিতো পঁচা শামুক। আমি গেলে ভালা মাইনষেগো পাও কাঁটব।”
কথাটা বলে মুখ ঝামটা দিয়ে তিনি অন্য ঘরে চলে গেলেন। শবনমের গোঙানির শব্দে ওর শ্বশুরের অস্থিরতা বেড়ে গেল। উনি গলা ছেড়ে সাধ্যমতো চিৎকার করে বাড়ির লোকজনকে ডাকতে লাগলেন।
এর আগেই মেঝ চাচিআম্মা দৌড়ে ছুটে আসলেন শবনমের কাছে। সবাই মিলে ধরাধরি করে শবনমকে ঘরে তুলল। বড় চাচিআম্মা বানুকে পাঠিয়ে দাই খালাকে ডাকতে পাঠালেন। আর নিজে বুঝতে চেষ্টা করতে লাগলেন এই ব্যথা কী আসল ব্যথা নাকি এমনি এমনি ব্যথা।
মেঝ চাচি আম্মা শবনমের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছেন বিভিন্ন প্রশ্ন। এর উত্তর দিতে শবনমের খুব কষ্ট হচ্ছে তা ওর চেহারার রং দেখেই বুঝে গেলেন বড় চাচিআম্মা।
বানু দাই খালাকে নিয়ে শবনমের ঘরে ঢুকতেই ওকে ওর শাশুড়ি বললেন
“বৌরে, মনডা কয় দুলালের বৌয়ের খালাসে সময় অইছে। আমি আইজ এইহানেই থাকি ভাউঝির লগে তুই আইজ রানদার কামডা করিস।”
শাশুড়ির হুকুম পেয়ে বানু নিজের ঘরে ফিরে এল কিন্তু মনটা পড়ে রইল শবনমের কাছে। ওরও ইচ্ছে ছিল শবনমের হাতটা ধরে বসে থাকতে কিন্তু মনের কথাটা বলতে পারল না। নিজের বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা নাই। ওর ধারনা শাহ আলম বাপ হওয়ার অক্ষম। ও জানে এ লোকের সাথে না কোনদিন বানুর সংসার হবে, না কোনদিন নারীত্বের পূর্ণতা মিলবে। তবুও মুখ বুজে পড়ে থাকে সমাজ সংসারের কথা ভেবে। খুব কাছ থেকে শবনমকে দেখে ওর পোয়াতি হওয়ার পর থেকে প্রতিমুহূর্তে অনুভূতিগুলো জানতে জানতে কখন যে শবনমের মাতৃত্ববোধটা ওর ভেতরকে জাগিয়ে তুলেছে তা ও বুঝতে পারেনি।
আজ শবনমের কষ্টটা হয়ত ও লাঘব করতে পারবে না তবে সামনে থেকে তার কিছুটা অনুভূতি অনুভব করার ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। কেন জানি ভেতরে থেকে থেকে দমকা হাওয়ার মতো কান্নার বেগ উপচে আসতে চাচ্ছে বাহিরে। থেকে থেকে শবনমের প্রতিটা চিৎকার ওর মনে লুকানো মাতৃত্বকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল। এরই মধ্যে দুইবার দৌড়ে গিয়েছে শবনমের ঘরের দুয়ারে। শবনমের মুখটা দরজার ফাঁক দিয়ে একটু দেখে আবার চোখ সরিয়ে নিয়েছে। ওর চোখ মুখ সাক্ষী দিচ্ছে ওর ব্যথার নির্মম কষ্টের। না চাইতেও বারবার আঁচলে চোখ মুছছিল বানু ঠিক তখনই নবজাতকের কান্নার শব্দ কানে এল। কেমন এক অচেনা প্রতিক্রিয়া ওকে আচ্ছন্ন কটে ফেলল। পাগলের মতো দৌড়ে ছুটে এল শবনমের ঘরে।
“কী অইছে আম্মা? কী অইছে? কেমন অইছে? বাচ্চা কান্দে ক্যা?”
“ও আল্লাহ, দুলাইল্যারতো কপাল ভালোরে বানু। ওর মনের খায়েশ আল্লাহ পূরণ করছে। ওর মা’য়েইতো আইছি দেহি।”
বড় চাচিআম্মার কথাটুকু শুনে বানু সত্যি সত্যিই খুশিতে পাগল হয়ে গেল। তাই হিতাহিত জ্ঞানটুকুও হারায় ফেলল। ও দৌড়ে বের হল গঞ্জের পথে দুলালকে খুশির খবরটা দিতে।

খবর পেয়ে দুলাল আর দেরি করে না, বেঁহুশের মতো ছুটে আসে বাড়ি। দরজা ঠেলে ঘরে ডুকে চিৎকার করতে করতে-
“কই আমার মায়ে কই ? কই আমার মা ? আমারে এত ছোট থুইয়া গিয়া নিজেও ভালা থাকতে পারো নাই। তাই আবার আজকা আমারে খুশি করতে আইছো? হ মা আমি অনেক খুশি অইছি। কত্তো খুশি তা তুমি বুঝতে পারবা না। আজকা আমার মনের কষ্ট বেবাক দূর কইরা দিলা মা তুমি। ও চাচিআম্মা দেন আমার মায়েরে একটু দেন আমারে আমি একটু দেহি। তারে দেহার লেইগ্যা আমার চক্ষু দুইডার আর তর সইতাছে না।”
কথাটা শেষ করে দাঁত বের করে ওর সেই সহজ সরল হাসিটাই হাসল।

“চুপ থাকত এহন। দেহস না তোর মাইয়ার দম নিতে কষ্ট অইতাছে। দুধ টানতে পারতাছে না। ভিতরে কেমন আৎকা আৎকা খিচ মারতাছে। –”

“ও আল্লাহ, এইডা কী কন আপনে? কী শুনাইলেন আমারে? ও আল্লাহগো অহন কী অইব?”

“আরে এমনে না চিল্লাইয়া শুধু আল্লাহ আল্লাহ কর।
ও ভাউজি গরম তেলডা বুকে পিডে আরও একটু ডলবেননি? তেল আরেকটু গরম কইরা আনুম?”

“নাহ আর ডলুম না, মাইয়াডারে দুলালের হাতে দে। একটু কোলে লউক। ওর মায়ের মুখটা একবার দেহুক। ”
কথাটা শেষ করে বড় চাচিআম্মা নবজাতক শিশুটাকে দুলালের হাতে তুলে দিল।
দুলাল কোলে নিয়েই বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। এরপর বাচ্চার কপালে গালে চুমু খেতে লাগল অনবরত।
“আহ! দুলাল এমন করিস না, এইবার থাম। বাচ্চাডা ওর মার বুকে দে। একটু উমে রাইখ্যা দেহুক কোন কাম অয়নি।”
বাচ্চা প্রসবের পর শবনম অচেতন হয় পড়ে। যখন জ্ঞান ফিরে তখন থেকেই শুনছে বাচ্চার বুকে কেমন চিচি শব্দ। জন্মের সময় একবার শুধু একটু গোঙানির শব্দ পেয়েছিল এরপর আর কোন শব্দ এখনও শুনেনি। এর মাঝে বড় চাচিআম্মা কয়েকবার বুকের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু বাচ্চা দুধ মুখেই নিতে পারেনি। জোর করেতো আর টানানো যায় না তারপরও তারা আশা ছাড়েনি। শবনমের দুধ টিপে কষের মতো একটু বের করে বাচ্চার মুখে দিয়েছিল কিন্তু তাও বাচ্চা খেতে পারেনি মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ে গেছে সবটা।
এখন যখন শবনমের হাতে দিল দুলাল তখনই শবনম কোলে নিয়ে বাচ্চার দিকে তাকিয়ে দেখল বাচ্চার মুখ ফ্যাকাসে হয়েগেছে। এতক্ষণ গরম তেলের মালিশে কেমন লাল হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন পরিবর্তন দেখে ওর ভেতর চমকে উঠলো।
“ও চাচিআম্মা বাবু দেহি সাদা অইয়া গেছে। ওর দেহি বুকে কোন শব্দ নাই। ওতো চোখ মেলে না।”
“ইন্না-লিল্লাহ, কই দেহি দেহি?” বলে দাই খালা এগিয়ে এল। তাকে থামিয়ে দিল মেঝ চাচিআম্মা।
“আহা, থাকবই না যহন তহন আইলো বা ক্যা? আল্লাহ এ তোমার কেমন বিচার, বুঝলাম না কিছুই। ”
“ও চাচিআম্মা আপনে এইডা কি কন, কী কনগো?” বলে দুলাল ঝাপিয়ে পড়ল বাচ্চার উপর। শবনম বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে উঠল
“আল্লাহগো তুমি এইডা কী করলা?”
বানু এতক্ষণে পা চালিয়ে হেটে বাড়ির সীমানায় পা রেখেছে মাত্র । শবনমের চিৎকারে ওর পায়ের জোর শূন্যে নামল। ও দপ করে মাটিতে বসে পড়ল।
এরপর কানে এল দুলালের আহাজারি
“আল্লাহগো তুমি আমারে আবারও এতিম করলা। আমিতো আমার মায়ের লগে একটু কতাও কইতে পারলাম না। আমিতো আমার মনের কষ্টগুলি মায়েরে জানাইতেও পারলাম না। এত তাড়াতাড়ি তুমি তারে আবার লইয়া গেলা কেমনে? আমার লেইগ্যা কী তোমার একটুও দয়া হইল না? আমি কী এমনই কপালপোড়া? ”
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না বানু। আবার উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল দুলালের ঘরের দিকে।
দুয়ারের কাছে এসে থেমে গেল।
“আহা! অবুঝ বাচ্চাডা বুকে পিডে কফ জইম্যা আছিল। জন্মাইয়া আর শান্তিতে দম নিতে পারল না। এমন ঠান্ডাডা কেমনে লাগল? আগে থেইক্যাই এডি খেয়াল রাখন দরকার আছিল।”
দাই খালার কথাটা কানে না গিয়ে সরাসরি বুকে গিয়ে বিঁধল বানুর।
শবনম ওর বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।
ও আল্লাহ তুমি একটু রহম কর। তুমি আমারে আমার মাইয়ারে ফিরায় দাও। আমু এই কয়দিন ওর আহনের পথ চাইয়া আছিলাম। ওরে আমি একটুও আদর দিতে পারলাম না। আল্লাহগো তুমি অহনই ওটে নিও না। একটু দয়া কর, ওরে তুমি ফেরত দাও।”
শবনমের কান্নায় পুরো বাড়ির আবহাওয়া স্থির হয়ে এক জায়গায় থেমে গেল।

এদিকে দুলালের বাপ নিজের ঘর থেকেই শুনতে পেল ছেলে আর ছেলের বৌয়ের আহাজারি। পাশে বসেই শাশুড়ি বলে উঠলেন
“আল্লার একটা বিচার আছে না? আল্লায় বিচার করছে। বেশি বাইড়া গেছিল ভালা মাইনষের ঘরে বিয়া কইরা।আল্লায় এক ধাক্কায় কমায় দিছে। এমনই অয়, বেদ্দবের লগে আল্লা এমনই করে।”
নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়েই চোখের পানিতে বালিশ ভেজাতে লাগলেন তিনি। তার মুখে আজ কোন কথা নাই, নিজের স্ত্রীকেও থামতে বললেন না আজ। এমন দিনটা তার কাম্য ছিল না।

শবনমের বুক থেকে মৃত বাচ্চাকে ছিনিয়ে আনল দাই খালা। অন্যকারো সাধ্য ছিল না বিধায় তাকেই এই গুরু দায়িত্বটা পালন করতে হল। বড় চাচিআম্মা আনতে গিয়ে শবনমের প্রশ্ন শুনে ফিরে এসেছেন সে আর দ্বিতীয়বার এগোয়নি। মেঝোজন আগেই মানা করেছেন তিনি আনতে পারবেন না। দাইখালাকেও শবনম প্রশ্ন করেছিল
“খালা অহনই নিবা? অহনওতো ওর মুখটা আমি ভালো মতো দেহি নাই। অহনওতো ও আমারে ভালোমতো দেহে নাই। বেহেশতে গিয়া চিনমু কেমনে আমরা দুজন দুইজনরে?
দাই খালা অকপটে উত্তর দিয়েছিল
“তোর চিনন লাগব না আল্লাই তোগো মিলায় দিব। দে অহন গোরস্থানে রাইখ্যা আহুক হাশরের দিন আবার দেহিস। তহন পরান ভইরা দেহিস। পাগলামি করিস না।মরা বাচ্চা এমনে ধইরা রাখিস না। ওর আত্মার কষ্ট অইব। তুই না মা, তুই কেমনে ওরে কষ্ট দিবি। দে, আমারে ছাড় ওরে।”
বলে একপ্রকার টেনেই নিয়ে নিলেন।
শবনমের গগনবিদারী চিৎকার তাকে থামাতে পারেনি।

দুপুরের পর পরই শবনমের বাবা, চাচা, ভাইয়েরা এল অনেক দই মিষ্টি বাজার-সদাই নিয়ে । এসে পুরো বাড়িকে স্তব্ধ অবস্থায় পেল। ঘরের দুয়ারেই দুলাল বসে ছিল শ্বশুরকে দেখে যেন ওর বুকটা ফেটে গেল
“ও আব্বাগো আপনে অহন আইলেন? কারে দেখতে আইলেন? হেয়তো ফাঁকি দিল এইবারও আমারে। আমার মায়েতো এইবারও আমারে এতিম কইরা গেলোগা।”
শবনমের বাবা মনে হল কিছু সময়ের জন্য ঘোরে চলে গেলেন। গঞ্জে থেকে বাচ্চা হওয়ার খবর পেয়ে তিনি আর দেরি করেননি। নাতনির জন্য জামা কাপড় বালিস লেপ তোশক, নানান জিনিসপত্র নিয়ে ভাইকে আর ছেলেদের সাথে করে এসেছেন মেয়ের সাথে আনন্দ ভাগ করতে। আর এসে তিনি এসব কী শুনছেন? শবনমের বড় চাচা এগিয়ে গিয়ে দুলালকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
স্বান্তনা দেওয়ার মতো কোন ভাষা খুঁজে পেলেন না তিনি।
সবুজ দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল ঘটনার সত্যতা জানার জন্য।
বিছানায় মরার মতো পড়ে আছে শবনম। চোখ থেকে শুধু পানি গড়িয়ে পড়ছে বালিশে। নিথর দেহটা নড়তে চড়তে ভুলে গেছে।
বুবু, এইডা কী শুনলাম? নতুন বাবু কই? হেরে দেখতেইতো আইছি আমরা। হেয় কই? আমি মামা অইছি হেই খুশিতে আর ঘরে থাকতে পারিনাই।”
সবুজের কথাতে শবনম আবার চিকন সুরে কেঁদে উঠল আঁচলে মুখ গুঁজে।

পাশ থেকে বানু আস্তে করে বলল
“হেয় গোরস্থানে শুইয়া আছে। যাও হেইহানে গিয়া দেইখ্যা আহো। হের দেহন পাইলে আমগো জানাইও হেয় কেমন আছে? কেমনে হেয় আমগো এমন ধোঁকাডা দিল? একটু জিগাইও।”

“কন কী ভাবি? এইডা কী অইল? মায়রে গিয়া কী কমু? আমগো দেহানের লেইগ্যা একটু দেরিও করলেন না আপনেরা ?”

“লাশ দেইখ্যা আর কী করবেন? হুদাই আত্মারে কষ্ট দেওন। বেহেশতের পাখিরে বেহেশতে গিয়াই দেইখ্যো।”
“ও বুবু, তুমি কতা কও না ক্যা? এইডি কেমনে অইল? হায় আল্লাহ, এইডা কী করলা আমগো লগে? ” কথাটা শেষ করতে পারল না সবুজও কেঁদে ফেলল।

শবনমের বাবা ঘরে ঢুকে শবনমের মাথায় হাত দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। এইবার শবনমও বুক চাপড়ায়ে কেঁদে উঠল
“বাবা অহন আপনে আইতে সময় পাইছেন? আমার দুর্দিনে কেন আইতে পারলেন না। আমার বুকটা ভরনের আগেই খালি অইয়া গেলোগাগো বাবা। আমি যে শেষ অইয়া গেলাম। আমারে কেউ মাইরা হালা৷ আমিও আমার মাইয়ার কাছে যাইগা। আমি ছাড়া ওরে কে পালবো? আমার বুকটা জানি কেমন করতাছে। এমন ফাঁপড় লাগে ক্যা আমার? ও আল্লাহ তুমি আমারেও লইয়া যাও আমার মাইয়ার লগে। আমার আর বাঁচনের শখ নাই।”
“মা কান্দিস না, সবই আল্লাহ ইচ্ছা। আল্লাহ যা করে তা তার বান্দার ভালোর লেইগ্যাই করে। ধৈর্য ধর। আল্লায় আবার তোর বুকটা ভইরা দিব। আল্লাহ রহমানুর রাহিম। আল্লাহ সব পারে। তুই চিন্তা করিস না আল্লাহ আবার তোরে শান্তি দিব। আবার তোর ঘর ভইরা দিব। কান্দিস না অহন ধৈর্য ধরনের সময়। বেশি বেশি আল্লারে ডাক মা, আল্লারে ডাক।”
কাঁদতে কাঁদতেই কথাগুলো বললেন তিনি।

মৃত্যুর খবর নিয়ে বাড়ি ফিরতেই শবনমের মা পাগল হয়ে উঠলেন শবনমের কাছে যাওয়ার জন্য। কেনজানি তখন তার কাছে ছোট মেয়েটাকে বিষ বলে মনে হল। চার মাসের বাচ্চাটা কাঁদছে তবুও তিনি কোলে নিচ্ছেন না। তার শাশুড়ি বারবার বললেন মেয়েকে দুধ দিতে কিন্তু তিনি ছুঁয়েও দেখলেন না। বারবার শুধু বলতে লাগলেন
“আল্লাহগো তুমি আমারে এমন শাস্তিডাই দিলা? আমি এই শাস্তি কেমনে সহ্য করুম। আমার শবনমের বুকটা তুমি কেন খালি করলা? কোন পাপে তুমি এমন শাস্তি দিলা দুলালরে? হেয়তো কোন দোষ করে নাই। দোষ করছি আমি, আমি না মাইয়ারে আমার কাছে আনি নাই। আমি না আমার দায়িত্বডা পালন করি নাই। হেই শাস্তি কেন ওরা পাইব?”

শবনমের বাবার বাড়িতেও মৃত্যুর মাতম চলল সারা রাত। সকাল হতেই শবনমের মা দুইটা কাপড় গুছিয়ে পালকির জন্য জরুরি তলব পাঠালেন।
শবনমের দাদি বুঝলেন তাকে আর আটকানো যাবে না। সে যাবেই। ইচ্ছে করেই ছোট নাতনিকে সাথে দিলেন না। হয়ত ছোট বোনকে দেখে শবনমের কষ্টটা আরও বেড়ে যেতে পারে। সবুজ একবার আগ বাড়িয়ে বলল
“মা তুমি গেলে কইলাম বাড়ির মাইনষে তোমারে অনেক শরম দিব। তুমি যাইও না।”
“বাপরে, পৃথিবীর আর এমন কোন শরমই পয়দা অয় নাই যে আমারে অহন বাইন্দা রাখে। আমার অহন যাওনই লাগব। নাইলে মরলেও যে শান্তি পামু না।”
মায়ের কথায় এমন কিছু ছিল যা আর সবুজ অগ্রাহ্য করতে পারল না। পালকিতে মাকে বসিয়ে ছুটে চলল বোনের শ্বশুর বাড়ির দিকে ।

চলব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here