শবনম(পর্ব ১০) সায়লা সুলতানা লাকী

0
291

#শবনম(পর্ব ১০)
সায়লা সুলতানা লাকী

মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে দুলাল শখ করে একটা স্টুডিওতে ঢুকে মেয়েকে কোলে নিয়ে ছবি তুলে নিল শবনম সহ। দুদিন অপেক্ষা করে সেই ছবিটা বড় এক ফ্রেমে বাঁধাই করে নিল। ধিরে ধিরে ঢাকার পাঠ চুকিয়ে নিতে শুরু করল। চারদেয়ালের বন্দি জীবনকে পেছনে ফেলে একদিন রওয়ানা দিল নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

মেয়ে নিয়ে বাড়িতে এসেই দুলাল প্রথমে গেল ওর বাবাকে নিজের মেয়েকে দেখাতে। এই প্রথম শবনম দেখল দুলালকে ওর শ্বশুরের সামনে যেতে । নিজেরও গেল দুলালের পেছন পেছন। ওর মনে ভয়, যদি সৎ মায়ের সাথে কোন ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে তখন না আবার মেয়ের কোন ক্ষতি হয়। এমনিতেই বাচ্চা পেটে থাকাকালেই শুনতে হয়েছিল শাশুড়ির মুখে এবারও বাচ্চাটা বাঁচবে না।

দুলাল ওর বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যখন ওর মেয়েকে দেখাল তখনই দুলালের বাবা ভেঁউভেঁউ করে কেঁদে উঠলেন। হাত উঠিয়ে নাতনির মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন
“মাশা আল্লাহ, হেয়তো দেহি এক্কেবারে হের দাদির রুপ লইয়া আইছে। আল্লায় যেন রুপের লগে লগে হের দাদির গুনডাও দেয় হেই দোয়াই করি। আল্লাহগো বইনরে আমি এমন খালি হাতে দেহুম এইডা কেমন কতা অইল? ওই দুলাল শোন বাপ, আমার পশ্চিম পাড়ার গাঙ ঘেইষ্যা যে পাট ক্ষেতটা আছে, হেইডা আইজ থেইক্যা আমার বইনের। বুঝছোসনি, কি কইছি আমি ?”

দুলাল কোন কথা বলল না ওর বাবার কথার উত্তরে। কিন্তু পাশের চৌকাঠ ঘেষে ওৎ পেতে দাঁড়িয়ে থাকা জমিরের মা এইবার চিৎকার দিয়ে উঠলেন কাল বিলম্ব না করে-
“জানতাম আমি জানতাম। বিয়া না অইতেই বাচ্চা বাচ্চা কইরা এত পাগলা অইছিল ক্যা? বাপেরে ভুলাইয়া ভালাইয়া সম্পত্তি লেইখ্যা নেওনের জোগান দিছে। বুঝিতো এগুলিতে কাগো বুদ্ধি আছে। ভালা মাইনষের ঝিয়েগো মাতায় খালি কুবুদ্ধি ভনভন করে। দিমু না। এক কানা কড়িও নিতে দিমু না। দেহুম কেমনে নেয় ওই পাট ক্ষেত। হাত লাগাইয়া দেহুক, এক্কেবারে হাত কাইট্যা রাখুম কইয়া দিলাম আগে থেইক্যাই। সবাই জানি বুইঝয়া লইয়া কামে নামে। দরকার অয় খুনাখুনি অইব। আমার ভাইগো খবর দিলেই কাম অইয়া যাইব। আমার জোর কেমন তা যেন সবাই জাইন্যা রাখে।”

দুলাল কিছুক্ষণ চুপ করে তার সব কথা শুনল এর পর কোন উত্তর না দিয়ে মেয়ে নিয়ে আবার ফিরে যেতে ঘুরতেই দুলালের বাবা বলে উঠলেন

“বাপ যাইছ না, যাইছ না বাপ। কত্তদিন পর তোর মুখটা দেখলাম, অহনই যাইছ না। জানিতো আর আইবি না এই অধম বাপরে দেখতে। কেন আইবি? আমি তোর কোন কামডা ভালা করছি? তোরে ভালোমতো দেখভালডাও করতে পারি নাই। আমি তোর কাছে অপরাধী। তুই গোস্যাতো করবিই। তোর মায়ের আমানত আমি ঠিক মতো রাখতে পারি নাই। জানি না হাশরের মাডে তারে আমি কী জবাব দিমু। বাপ একটু দাঁড়া, তোরে একটু দেহি। বুকটা যে তোরে দেহনের লেইগ্যা খা খা করে। বুঝবি, অহন বুঝবি, সন্তান কী জিনিস? বাপের অন্যায়ডাই খালি দেখলি বাপের পোড়া মনডা আর দেখলি না?”

“হ, মনতো হুদাই এই পোলার লেইগ্যাই পোড়ে। পোলার ঘরে গিয়া থাকলেই পারেন? বাইন্দা রাখছে কে? এহনও মরা বৌয়ের পিরিতে ডুইব্যা থাহেন। বেডি মইরাও আমার পিছ ছাড়ল না।”

“বৌ আহোতো, আর একটুও এইহানে থাকন ঠিক অইব না।”
শননমের হাত ধরে যখন টানল তখন শবনম আবার পেছন থেকে দুলালকে টেনে দাঁড় করাল ওর বাবার সামনে। ওর বাবার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে দেখে। এমন একটা করুন চেহারাকে পেছনে ফেলে যেতে শবনমের বুকটা কেঁপে উঠল।
“হ, যা বাপ যা, ওতো এইডাই চায়৷ এমন গলাবাজি কইরা তোরে সরায় রাখল সারাজীবন আমার থেইক্যা। জানি না মরনের আগে আর কোনদিন তোরে দেখতে পারুম কি না। তয় বাপ তুই আমারে মাফ কইরা দিস। তুই মাফ না করলে যে মইরাও শান্তি পাইব না এই পাপি আত্মায়।”
এইবার শবনমের চোখ ভিজে উঠল। দুলাল হঠাৎ করেই স্তব্ধ হয়ে গেল শেষ কথায়। এবার ও নিজের এক পা এগিয়ে এল ওর বাবার দিকে। মনটা টানতে লাগল যেন বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “বাবা আমি আপনেরে মাফ কইরা দিছি। আপনের উপর আমার আর কোন ক্ষোভ নাই। আপনেও আমারে মাফ কইরা দিয়েন।”
কিন্তু কেন জানি ও তা করতে পারল। মনে হল বহুদিনের অনাভ্যাসটাই তার কারন।
“হ মাফ চাইয়া লন। এইবার মইরা আপনেও বাঁচেন লগে আমরেও বাঁচান। আমার আর এইসব ঢংঢাং দেখতে ভাল লাগে না। এই বুইড়া মরেও না আমার পথও ছাড়ে না।”

এইবার আর দুলাল দাঁড়াতে পারলো না ওর সৎমায়ের কথার তাপে। মেয়ে নিয়ে সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ওর পেছনে শবনমও চলে এল, পেছন ফিরে একবার শ্বশুরের মুখটা দেখে নিল। ওর খুব মায়া লাগছিল শ্বশুরের জন্য।
নিজের ঘরে এসে দুলালকে একবার বলল শ্বশুরকে ওদের কাছে নিয়ে আসার কথা। সেই কথা দুলাল শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। বলল
“বৌ তুই বড় বোকা, ওরা মুখেই বলে এগুলা। আসলে কোনদিনও ওরা বাবারে ছাড়ব না। বাপ যতক্ষণ ওগো কাছে আছে ততক্ষণ ওরা রাজা। বাবার সব সম্পদ ওগো। বাবারে ছাড়া মানে সব সম্পদ ছাইড়া দেওয়া।”
“আপনে কইয়া দেন আমগো কোন সম্পত্তি লাগব না। শুধু আব্বারে দিয়া দেক।”
“তবু দিব না। ওরা কাউরে বিশ্বাস করে না। তুই বড় বোকারে বৌ, বড় বোকা। তোরে লইয়া আমার খালি চিন্তা হয়। তুই এই কঠিন দুনিয়া কেমনে চইল্যা খাবি।”
“ক্যা আপনে আছেন না? আপনে থাকতে আমার আবার এত চিন্তা কিয়ের? আপনে চালায় নিবেন।” বলেই খিলখিল করে হেসে উঠে শবনম।
কথা আর বাড়ে না। চোখ পড়ে ছবিটার দিকে। শবনম এইবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছবিটাকে ঘরের কোথায় টাঙিয়ে রাখবে তা নির্ণয়ে।

খাসি জবাই করে মেয়ের আকিকা দিল দুলাল।হুজুরের সামনে গিয়ে বলল
“হুজুর আমার মা মইরা গিয়া আমার জীবনডার সব তাল বেতাল কইরা দিয়া গেছিল। অহন আবার আমার মাইয়া আমার বুকে আইয়া আমার জীবনডারে নতুন এক ছন্দে মিলিয়া দিল। এমন মাইয়ার নাম আপনে “ছন্দা”ই রাখেন।”

ছন্দা নামটা হুজুরের মনপুত হল না। তিনি মুখটা কাচুমাচু করে বললেন
“ছোট বাচ্চার নামডা একটা ইসলামি নাম অওনই ভালো হয়, ওর নামডাও একটা ধর্মীয় নাম রাখনের প্রস্তাব দেই খানের বেডা খানেরে।”
হুজুরের কথায় দুলাল এক গাল হেসে বলল
“রাখেন হুজুর রাখেন আপনে আমার মাইয়ার নাম জগতের মা ফাতেমার নামডাই রাখেন। ফাতেমা খানম ছন্দা। নামডা আমার বড় পছন্দ অইল।
এবার হুজুর আর কোন কথাই বললেন না। আকিকা দিয়ে দুলালের মেয়ের নাম রাখা হল মোছাম্মত ফাতেমা খানম ছন্দা।
ছন্দা নামটা শুনেই শবনমের খুব পছন্দ হল। ও দুলালের চোখের দিকে তাকিয়েই একটা হাসি দিয়ে বলল
“ছন্দার বাপেরতো মনে দেহি এহন মেলা ছন্দ। ”

আকিকা খেতে এলেন ছন্দার নানা নানি নাতনির জন্য সোনার চেইন নিয়ে। বাড়ির সবাইকে সাথে দাওয়াতও দিয়ে গেলেন শবনমের বোন শিউলির বিয়ে উপলক্ষে। দুলাল প্রথমত আকস্মিকভাবে শিউলির বিয়ের কথা শুনে তাজ্জব হয়ে যায়। পরে ওর হবু শ্বশুরের নাম শুনে খানিকটা আশ্বস্ত হয়। গঞ্জে অনেক বড় আড়ৎদার এই ব্যাপারী। তার বড় ছেলে আবার দুলালের স্কুল শিক্ষক ছিলেন। পাত্রের ঘরবাড়ি নিয়ে কোন চিন্তা নাই, কিন্তু ছেলে নিয়ে তেমন একটা নিশ্চিত হতে পারল না। ব্যাপারীর আরেক ছেলে মাঝেমধ্যে গঞ্জে আসে তবে সেই ছেলে বড় আলস প্রকৃতির বলে দুর্নাম রয়েছে। তাই মনের মধ্যে চিন্তা চেপে না রেখে মুখে আনল প্রশ্নটা,
“আব্বা ছেলে সম্পর্কে ভালোমতো খোঁজ খবর নিছেনতো? ব্যাপারীর মেজ ছেলে কিন্তু একটু অলস, কাজ কামে তেমন মনোযোগ নাই।”
“হ বাবা, খোঁজ খবর যদ্দূর নিছি তাতে আমিও এমন কিছুই পাইছি, তয় ব্যাপারী সাব কইছে ছেলেরে আলাদা কারবার লইয়া দিব। কান্দে দায়িত্ব চাপলে বলে তার পোলা ঠিক অইয়া যাইব। জমিও কিছু লেইখ্যা দিব। কোনরকম চিন্তা করতে মানা করলতো হেয়।”
শ্বশুরের কথার উপর আর কোন বাড়তি কথা বলল না দুলাল।

শবনমরে সোনার গলার হার বানায় দিল দুলাল মেয়ে হওয়া উপলক্ষে । আর তা দেখে বানু সহ বাড়ির সবাই খুব খুশি হল। দুলাল জানাল যখন মেয়ে হওয়ার খবর দিতে গ্রামে এসেছিল তখন গঞ্জে গিয়ে ঘোষপাড়ার স্বর্ণকারগো দোকানে বসে ডিজাইন পছন্দ করে দিয়ে গিয়েছিল। এখন শিউলির বিয়েতে পরে যাওয়ার জন্য চাপ দিয়ে তাড়াতাড়ি করে বানিয়ে আনল। শবনমতো নতুন হার পেয়ে আনন্দে আত্মহারা।
পরের সপ্তাহে শবনম বাপের বাড়িতে গেল মেয়ে নিয়ে বোনের বিয়ে খেতে। ওর দাদিও বড় নাতনির সুখ দেখে অনেক খুশি হলেন। দুলালকে কাছে ডেকে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আর বললেন সব সময় যেন শবনমের প্রতি ওর মনটাকে এমনই রাখে।

সত্যি সত্যিই দুলালের জীবনে নতুন এক ছন্দ নিয়েই এল ছন্দা। এখন দুলাল আরও বেশি কর্মঠ হয়ে উঠল। দিনরাত মন লাগিয়ে নিজের কারবারকে আর সমৃদ্ধ করতে লাগল। শবনম মাঝে মাঝে বলে এত পরিশ্রমের কোন দরকার নাই। তিনবেলা খেয়ে পরে থাকতে পারলে আল্লাহর দরবারে হাজারকোটি শুকরিয়া জানায়।
কিন্তু সেই কথা দুলাল শুনে না। ওর এক কথা, ওর ছন্দা যেন জীবনে কোনদিন কোন কিছুর কষ্ট চোখে না দেখে। ছন্দার জীবনকে সুন্দর করতে ওর যা যা করা লাগবে ও তাই করবে।
সারাদিন পরিশ্রম করে রাতে ঘরে ফিরে শুরু করে ছন্দারে বুকে নিয়া খেলা। মেয়ে আর তার বাপের নিত্য নতুন রংঢং বড় তৃপ্তি নিয়া দেখে শবনম। কেন জানি তখন ওর মনটা শান্তিতে ভরে যায়। রাতে বেশিরভাগ সময় ছন্দা দুলালের বুকে শুয়ে ঘুমায়। শবনম যদি কখনও বলে ওরে আমার কাছে দিয়া আপনে ঘুমান। তখন দুলাল রেগে যায়। ও মুখ গোমড়া করে বলে
“বৌ সারাদিনে এই একটু সময়তো পাই মাইয়ারে আমার কাছে। ওই সময়ডা ও আমার কাছে থাক। তুমি বরং ওই সময়তে একটু আরাম কর। ঘুমাও, মাইয়া তার বাপের কাছেই থাকুক তুমি হের মইধ্যে
আর বাঁধা দিও না।”
শবনম আর বাঁধা দেয় না।

দিনগুলো বেশ ভালোই কেটে যেতে লাগল। ছন্দা আধো আধো বোলে কথা বলতে শুরু করল। দুলালকে দেখলেই বা…বা, বা…বা বলা শুরু করল। আর তা শুনে দুলালের সে কী আনন্দ। শবনমকে একদিন ঘুমের মধ্যে ডেকে তুলে শোনাল মেয়ের মুখে স্পষ্ট বাবা ডাকটা। শবনম দুলালের আনন্দ দেখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে নির্বাক হয়ে। দুলাল ওর চেয়ে থাকা দেখে জানতে চায়-
“বৌ তুমি এমনে তাকায় আছো ক্যা? কিয়ের চিন্তা কর? শুনো তোমার মাইয়া কেমনে বাবা, বাবা কইরা ডাকতাছে আমারে।”
“হ শুনছিতো! আমিতো মেলা আগেই শুনছি। কিন্তু আমার চিন্তাতো অন্য জায়গায়। আপনে না পরথমবার কইছিলেন, মাইয়া আপনেরে বাপ কইলে আপনে তারে মানা করবেন, ওরে শিখাইবেন আপনেরে দুলাল কইয়া ডাকতে। আপনে কী সব ভুইল্যা গেলেন কারবার কারবার কইরা?”

“হ বৌ, আমি তহন অমনই কইছিলাম। কিন্তু অহন আর তেমনডা মনে করি না। এ দুনিয়ায় আমার আর মায়ের সাধ মিটব না। এইডা আমি বুইঝ্যা লইছি। যারে আমি মা মনে করুম হেরেই আল্লাহ লইয়া যাইব। তাই অহন আর কেউ আমার মা অইব না ও আমার মাইয়া অইয়া আমার বুকে বাইচ্যা থাক তাতেই আমার সুখ, তাতে আমার শান্তি।”
দুলালের কথা শুনে শবনম আর কথা বাড়ায় না।

ছন্দাকে নিয়ে দুলাল আর শবনম যখন সুখের সাগরে ভাসছে তখনই শননম টের পায় ওর আবার পোয়াতি হওয়ার খবর । দুলাল জানার পর ওর দায়িত্ব যেন আরও বেড়ে গেল সংসারের প্রতি। তাই কাজে কর্মে আরও যত্নশীল হয়ে উঠল। আগে বেশির ভাগ সময় পাট স্থানীয় আড়ৎদারদের কাছেই বিক্রি করে দিত। নিজে পাট নিয়ে নারায়ণগঞ্জের বাজার ধরতে যেত না। কিন্তু এখন নিজেই যায় আর এতে লাভটাই বেশি হয়। দিনদিন দুলালের কারবারের সুখ্যাতি ছড়িয়ে গেল গঞ্জে। এরই মধ্যে নতুন কারবারের আভাস পেল বরিশাল থেকে। বরিশালেও যাওয়া শুরু করল বিভিন্ন আড়ৎদাররা মিলে। নিত্য নতুন পরিকল্পনা সাজায় এই কারবারের বিস্তার নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মন্দাভাবটা কেবল মাত্র এই পাট-শিল্পে এখনও আছর ফেলতে পারে নাই। বরিশাল থেকে বড় বড় কার্গো পাট বোঝাই করে বিভিন্ন বন্দরে চলে যায় সল্প খরচেই। এই জন্য এখন দুলালও সেই পথেই নিজের পাটের ব্যবসা সম্প্রসারিত করতে লাগল। যখন ওকে বরিশাল যেতে হয় তখন শবনমের কাছে বানু এসে থাকে। যদিও ওকে এভাবে রেখে যেতে ওর মন সায় দেয় না তবুও ও যায়, কারন ও ওর সন্তানদের ভবিষ্যতকে সুন্দর করতে চায়। নিজের যেমন শৈশব ছিল তা যেন ওর সন্তান না পায় সেই লক্ষ্যেই দিনরাত খেটে যাচ্ছে।

এদিকে শিউলির মেয়ে হল একটা। সেই খবর পেয়ে শবনম যেতে পারল না নিজের শরীর ভালো না বলে। এদিকে শিউলি ওর মায়ের কাছে থাকায় সেও এসে শবনমের পাশে থাকতে পারে না। আগে দুলাল যতটা ঘরে সময় দিত এখন কাজের চাপ বাড়ায় সেই সময়টাও দিতে পারে না। এদিকে ছন্দাকে কোলে নিয়ে নিজের পোয়াতি শরীর টেনে সংসার সামলাতে গিয়ে শবনম হিমশিম খেতে শুরু করল। ছোট বোন বকুলকে চেয়ে পাঠালো মায়ের কাছে। কিন্তু বকুল এল না, জবাকে রাখতে হয় ওকেই, আর সেই সুযোগে ওর মা গৃহস্থালি কাজকর্ম তদারকি করে। দাদি আর আগের মতো সবার দেখা শোনা করতে পারে না।
শবনমের কাছে মনে হতে লাগল এ এক জীবন যুদ্ধ। রাতে দুলালকে এসব কথা বললে ও হা হা হা করে হাসে আর বলে “আমার বৌডা বড় অইব কবে? এইটুকু কষ্টই সহ্য করতে পারো না, বাকি জীবনডা কাডাইবা কেমনে?”
তখন শবনমের গা’টা রাগে আরও বেশি জ্বলে।
এক এক সময় দুলালের হাসি দেখে নিজেই কেঁদে ফেলে, আর বলে “কেমন মানুষ আপনে, পরের কষ্ট দেইখ্যা এমন কইরা হাসেন কেমনে?”
দুলাল তখন হাসি থামিয়ে শবনমকে অনেক আদর করে। আর সেই আদর পেয়ে শবনমও সব কষ্ট ভুলে যায় নিমিষেই ।

নভেম্বর মাসে দুলাল আবার আড়ৎদারদের সাথে বরিশাল যায়। কথা থাকে এবার ফেরার পর শবনমকে নিয়ে আবার ঢাকায় চলে যাবে বাচ্চা প্রসবের জন্য। কারন দুলাল প্রথম সন্তান হারিয়ে এখন ভীতু হয়ে গেছে। আগের মতো আর মনের জোর নেই যে বৌয়ের এমন সময়ে কোন ধরনের রিস্ক নিবে। শবনমও সেই ভাবেই গোছগাছে ব্যস্ত রইল ও কয়টাদিন যখন দুলাল বরিশালে ছিল।

আজ রাতেই ফেরার জন্য রওয়ানা দিবে আর সকালে লঞ্চ ঘাটে এসে নামবে, এমনই কথা শবনমের জানা।
সারারাত এত বেশি ঝড় বৃষ্টি হল যে ছন্দা ভয়ে সারারাত চোখ দুইটা এক করতে পারল না। বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার শুরু করে দিতে লাগল। সেই যন্ত্রণায় রাতে এক ফোটাও ঘুম হয় নাই বানুরও সাথে শবনমেরও। ভোর সকালের দিকে চোখ লেগে গেল দুজনেরই।
হঠাৎ দরজায় ধাক্কা শুনে ঘুম ভাঙে দুজনেরই
“ওই দুলালের বৌ, ওই বানু কত্ত ঘুমান ঘুমাস তোরা? এই দুইডায় মিল্যা কী মরার ঘুমডাই না ঘুমাইতাসে। বেলা কই উঠছে খবর আছেনি ওগো? কীরে তোরা উঠ, দোর খোল।”
বড় চাচিআম্মার চিৎকারে বানু উঠে দরজা খোলে। আর অমনিই তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শবনমের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করেন
“কিরে দুলালের বৌ, আইজ না দুলালের ফিরনের কতা? হুনলাম আইজ বলে ঘাটে কোনো লঞ্চ ভিরে নাই। মাঝ গাঙের বলে অবস্থা খুবই খারাপ আছিল কাইল। আমারতো তেমন কিছু ভালো ঠেকতাছে নারে।”
“ও আল্লাহ চাচিআম্মা, এইডা আপনে কী শুনাইলেন, আইজইতো ছন্দার বাপের আহনের কতা। বেলা কত অইল? অহনওতো বাড়ি ফিরল না।”
কথাটা বলতে বলতে শবনম ধরমর করে পালঙ্ক থেকে নামল।

চলবে

***আসসালামু আলাইকুম, “শবনম” নাম করনের আগে এর নাম ছিল “একজন লৌহ মানবী”। প্লটটা যখন মাথায় আসে তখনই এর নামকরনটা ” একজন লৌহ মানবী” করেছিলাম। কিন্তু যখন পুরোটা আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক পাঠককে শুনালাম, সে মন্তব্য করল এই নামকরনে নাকি গল্পটা পাঠক নিবে না। মানে পছন্দ করবে না। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে রাখলাম “শবনম”। এখন মাঝ পথে এসে দ্বিধায় পড়ে গেলাম নাম কোনটা যথার্থ হবে তাই ভেবে। বেশি চিন্তা করতে চাইলাম না, তাই এই দায়িত্বটা আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম। পুরোটা পড়ে আপনারাই মন্তব্য করবেন কোন নামটা ঠিক হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here