#শবনম(পর্ব ২৩)
সায়লা সুলতানা লাকী
ঢাকায় এসেই শবনমের বাবা টের পেলেন যে তার মেয়ে এতদিন এই বাসায় ছিল না। মেয়েকে আগ বাড়িয়ে আর কিছু জিজ্ঞেসও করলেন না ছোটভাইয়ের বৌয়ের সামনে। এমনিতেই ভাইয়ের বৌ কেমন ব্যাঙ্গ করে জানাল যে শবনমের খোঁজে মজনু নামক একজন এসেছিল গতকাল। জিজ্ঞেস করেছিল যে শবনম ফিরলে কী ও মাতৃসদনে যাবে কি না?
চাচির মুখের প্রশ্নটা শুনে শবনমের মুখের রং উবে গিয়েছিল নিমিষেই । কেমন যেন আমতা আমতা ভাবে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়েছিল মেয়ে তার সামনে। তাই আর কিছু ইচ্ছে করেই জানতে চাইলেন না। যা গেছে যাক, এখন সামনের দিন নিয়েই ভাবতে চান তিনি। মেয়েকে ছায়া দিতেই তার ঢাকায় আসা। একবার মেয়ের মতের বিরুদ্ধে জোর করে দেখেছেন তার পরিনাম ভালো হয় নাই। তাই এই বার আর মেয়েকে একা করতে চান না। তাই যেভাবে মেয়ে চায় সেভাবেই চেষ্টা করছেন মেয়েকে সাপোর্ট দিতে।
সবুজের ওখানে একবার গিয়ে ছেলেকেও কী নিয়ে নিবেন কী না সাথে অফিসায়াল কার্যক্রমগুলো বুঝে নেওয়ার জন্য তা-ও ভাবলেন একবার তিনি ।
পরবর্তীতে ছোট ভাইয়ের উপরই পুরোপুরি আস্থা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লেন।
পরদিন সকালে শবনম বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ওর নতুন শাড়িগুলো থেকে একটা থানের ভাঁজ খুলল পরার জন্য। শাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে আনমনেই বলে উঠল , “স্বামী মইরা গেলে আত্মীয় স্বজন কিল্লাইগ্যা যে মাইয়াগো সব রং কাইড়া নিয়া জোর কইরা বিধবা সাজায় এই সাদা রংগের কাপড় গায়ে ফিন্দাইয়া তাই বুঝি না। গায়ে সাদা রং নিয়া ঘুরলেই কী একটা মানুষের মনের রং বেবাক হারাইয়া যায় জীবন থেইক্যা যেমনে স্বামী হারায় যায় তেমনে? মনের রং হারাইন্যা কী এত সহজ? এইহানে কেন মাইনষে এত জোর খাডায়? জোর করলেই কী রং যায়গা? না কি মাইয়া মাইনষের মনে নতুন কইরা আরও রং লাগাইন্যার বাসনা জাগাইতে চায়? কি জানি হইব কিছু একটা। তয় আর যাই হোক, আমার লেইগ্যা ভালোই হইছে। এই রংহীন শাড়ির একটা জোর আছে। হেই জোরডাই এই সময়ে আমার কাজে লাগব। পাশের মানুষটা বোঝব যে এই শাড়ি পরইন্যা মাইনষের জীবনে আর কোন রং নাই, তার লগে রংঢং কইরা কোন বিশেষ লাভ অইব না। আপাতত মাইনষের মনে যে সমবেদনা জাগব এই রং দেইখ্যা হের সাহায্য নিয়া একটু শান্তিতে সোজা অইয়া দাঁড়াইতে পারুম। ”
সকাল সকাল গোসল করে রেডি হয়ে গেল বাবা চাচার সাথে বের হওয়ার জন্য। ভেতরে এক অন্যরকম উত্তেজনা অনুভব করল কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারল না। বারবার চাচাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল সব কাগজপত্র সাথে নিচ্ছে কি না?
যখন সচিবালয়ের অফিসে এসে উপস্থিত হল তখন একবার মনে হল ওর ফিরে যাওয়া উচিত। এমন নতুন একটা পরিবেশে নতুন মানুষজনের সাথে মিলেমিশে কাজ কতটুকু ও করতে পারবে সে বিষয়ে পুরোপুরি সন্ধিহান ও। কিন্তু ওর বাবা আর চাচার উপস্থিতিতে নিজেকে সামলিয়ে নিল। একটা সময় সেই মহৎ ব্যাক্তির সাথে দেখা হল। তিনি অফিসিয়াল সব ধরনের ফর্মালিটি শেষ করে শবনমের চাকরিটা পাকাপোক্ত করলেন। আপাতত ও সেই মহৎ ব্যাক্তির ব্যাক্তিগত পিয়ন হিসেবেই থাকবে। কথার ছলে শবনমের বাবা তার হাত ধরে কেঁদে ফেললেন, নিজের মেয়েকে তার হেফাজতে দিয়ে গেলেন। নিজের বয়ানেই মেয়ের সাথে হয়ে যাওয়া বেইনসাফির কাহিনি ও শুনালেন তাকে। মেয়েকে এই চাকরিটা দিয়ে তিনি যে মেয়েকে নতুন এক জীবন দিলেন তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন বারবার।
চাকরিটা হয়ে যাওয়ায় বাড়ি ফেরার পথে শবনমের বাবা মিষ্টি নিয়ে ফিরলেন। রাতে তার আসা উপলক্ষে শবনমের চাচি বেশ ভালো রান্নাবান্নাও করলেন। সবুজও এল খবর পেয়ে। বড় বোনের চাকরি হয়েছে শুনেই খুব খুশি হয়ে গেল ও। শবনমের চাচি কথার ছলে একবার বলেই ফেললেন
“মেয়ে মানুষের আবার এই চাকরি বাকরির কী দরকার ছিল, ভাইসাব কী আর শবনমরে খাওয়াইতে পারতেন না? ওর কী আর অভাব হইত? ঢাকা শহরে ভালো কোন চাকরি করার মতো কোন যোগ্যতাতো ওর নাই। আর যা পাইব তাতে কি আর মান সম্মান থাকব আমগো? নানান জন নানান কথা শুনাইব এইসব নিয়া।”
শবনমের বাবা কিছু বলার আগেই সবুজ বলে উঠল
“কাকি, বুবুরে খাওনডা না হয় আমিই দিতাম, বাবার আর দরকার পড়ত না। আমি যা কামাই তা দিয়া ছন্দা স্বপ্নার খরচও চালাইতে পারতাম। সমস্যা ওইডা না। বিষয়ডা অন্য জায়গায়, আসলে বুবুর চাকরির কথা শুইন্যা আমি অনেক খুশি হইছি। কারনডা অইল যে বুবু নিজের দায়িত্বডা নিজেই কান্দে উডাইন্যা শিখছে। কারো উপর বোঝা হয় নাই। ছন্দা স্বপ্নার মন ছোট অইব না কোন সময়। ওরা কারো দয়া দক্ষিনায় বড় অইব না। মনে খুঁতখুঁতি থাকব না। বুবু যে দুলাভাই মরনের পর এত শক্ত অইব তা বুঝি নাই। আর চাকরির কথা কইয়েন না চাচি! বুবুর চাকরি কেউ পাইয়া দেহুক কত সহজে পাওন যায় এই চাকরি।বুবু তার মাইয়াগো ভাইগ্যে এত ভালো চাকরি পাইছে। চাকরি চাকরিওই এইডা ছোট কিংবা বড় হয় না। সম্মানের চাকরিই বুবু পাইছে। মাইনষে এহন বুবুরে এমনি এমনি সম্মান করব। আকথা করনের সুযোগই পাইব না। ”
সবুজের কথায় শবনমের মনে আরও সাহস আর শক্তির সঞ্চয় হল। ওর চাচিও চুপ হয়ে গেলেন, এই বিষয়ে আর কোন কথাই বললেন না। সবই ঠিক ছিল কিন্তু শবনমই পারছে না ওর বাবার সাথে সহজ হতে। নিজের ভেতর যুদ্ধ লেগেই থাকল বাবার সাথে সহজ হওয়ার জন্য ।
পরদিন সকালে তিনিও মেয়ের সাথে যাওয়ার জন্য রেডি হলেন। সাথে ভাইয়ের হাত দুটো ধরে অনুরোধ করলেন শবনম পথঘাট না চেনা পর্যন্ত যেন ওর চাচা ওকে সাথে নিয়েই যাওয়া আসা করে। এই কষ্টটুকু যেন সে শবনমকে নিজের মেয়ে ভেবেই করে। এছাড়া সবুজ চেষ্টা করবে শবনমের অফিস ছুটি হওয়ার পর ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে যেতে। সবুজ মেসে থাকে বলে শবনমকে ওর সাথে নিতে পারল না। একসাথে বসে ভাইবোন যুক্তি করল, সময় করে একটা বাসা ভাড়া করে একসাথে থাকবে বলে। এমনটা হলে অবশ্য ওদের বাবা মায়ের মনেও কিছুটা শান্তি মিলবে তাও জানাল ওর বাবা। সবুজ চলে গেল নিজের অফিসের উদ্দেশ্যে।
শবনম নিজেও তৈরি হয়ে এল অফিস যাওয়ার জন্য, নতুন কর্মজীবনের প্রথম দিনে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না বাবাকে কদমবুচি করতেই ওর বাবার মনে চেপে থাকা আবেগ হুহু করে বেরিয়ে এল। ওর বাবার কান্না দেখে এবার শবনমও সাহস করে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল । নিজের কৃত কর্মের জন্য মাফ চাইল সাথে বলল যে ও যেই টাকা নিয়ে এসেছিল তার কিছু খরচ হয়েগেছে তাই আর এখন ফেরত দিবে না। তবে সবটা একসাথে গুছিয়ে ও ওর বাবার হাতে পৌঁছে দিবে।
টাকার কথা শুনে এবার চাচাই জোর খাটিয়ে বললেন
“কিসের ফেরত দেওয়া দেওয়ি? কোন ফেরত নাই। বহুবার কইছি ঢাকায় বাড়ি কিনেন, কিন্তু দাদা রাজি হন নাই। অহন মাইয়া পোলায় ঢাকা থাকব, চাকরি করব। অহন ওরা মাইনষের বাড়িতে ভাড়া থাকবনি। দাদায় উলডা আরও কিছু টেকা দিয়েন আমি দেইখ্যা শুইন্যা বিহারিগো পরিত্যক্ত বাড়ি একটা কিইন্যা দিমুনে। ওইহানে নিশ্চিন্ত মনে থাকব ওরা। কেউ কিচ্ছু কওনের থাকব না।”
এই কথাতে শবনমের বাবাও সায় দিলেন। এই বিষয়টা তারও মনপুত হল। তিনি টাকা নিয়ে আসবেন বাড়ি কিনতে সামনে তাই বললেন।
শবনম চলে এল অফিসে। ওকে পৌঁছে দিয়ে ওর বাবা ফিরে গেলেন। বিদায় বেলা শবনম বাবার হাতদুটো ধরে বারবার বলল ওর মেয়ে দুইটাকে যেন সবসময় দেখে রাখেন তিনি।
শবনমের নতুন কর্মজীবন শুরু হল। প্রথমেই পরিচিত হল ওর সমমানের কয়েকজনের সাথে। তারা সবাই পুরুষ। কিন্তু আশ্চর্য হল শবনম, এত পুরুষ সহকর্মী দেখেও ভয় লাগল না ওর মনে। আপাতত ও ওর স্যারের দরজার ওপারে একটা টুলে বসবে। মাঝে মাঝে স্যার ডাকলে ভেতরে যাবে। আর কেউ স্যারের সাথে দেখা করতে এলে আগে ও ভেতরে গিয়ে অনুমতি আনবে পরে লোক পাঠায় দিবে। কাজটা তেমন কোন কঠিন না। তবে এখন ফাইলের উপরের লেখা পড়তে হবে। বাংলা হলে বানান করে পড়তে পারবে কিন্তু ইংরেজি হলে নতুন সমস্যার জন্ম হবে তা ও বুঝতে পারছে। নিজের এই কমতিটাকে আপাতত কাউকে বুঝতে দিল না। মনে মনে ঠিক করল সবুজের কাছে রাতে ইংরেজিটা একটু একটু করে শিখতে হবে না হলে চাকরি করাটা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এতদিন পড়ালেখা থেকে দূরে থাকার ফলে সবই ভুলতে বসেছে।এখন আবার কাজের প্রয়োজনে শিখতে হবে, নতুন করে শুরু করতে হবে।
দুপুরে অন্যরা টিফিনবাক্সে খাবার এনেছিল তাই খেতে বসল কিন্তু শবনম কিছু না আনায় আর খেতে গেল না। এদের মধ্যেই বয়স্ক একজন লোক অনেকটা ওর বাবার বয়সী, সে’ই ওকে ডেকে সামনে বসিয়ে খাবার খুলে দিয়ে খেতে বলল। শবনম খাবে না বলেও পরে তার স্নেহের জোরে কিছুটা খেয়ে নিল। খাওয়ার তালে তালেই তিনি শবনমকে অফিসে কিছু কিছু নিয়ম জানালেন। কাজ কোনটা কীভাবে কী করতে হবে তাও বললেন। অন্যদের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে বললেন তবে বেশি মাখামাখি করতে নিষেধ করলেন। এই সারা অফিসে একজন ম্যাডাম আছেন আর একজন মেয়ে মানুষ হল শবনম নিজে। এছাড়া সব পুরুষ। এদের সবার নজর যে ভালো তা আগে থেকেই ভাবতে নিষেধ করলেন। নিজের ইজ্জত সম্মান নিজেরই বাঁচায়ে চলতে হবে তাও বুঝালেন। প্রথম দিনই এতটা আদর স্নেহ পেয়ে বুঝল যে এখানকার কাজ করার পরিবেশ মাতৃসদনের মতো খারাপ না। প্রথম দিনই গনি মিয়াকে চাচা বলে সম্মোধন করে বেশ আপন করে নিল শবনম ।
এই অফিসে শোয়ার জায়গা নাই। এক জায়গাতেই বসে থাকতে হয়। মাঝে মাঝে হাঁটাচলা করা লাগে। এই রুম ওই রুম যাওয়া নিয়ে একবার বিপদে পড়ে গেল। রুম নাম্বার ধরে ধরে ফাইল পৌঁছে দিয়ে আসার সময় আর আগের জায়গায় ফিরে আসতে পারে না। বারবার মাথার ঘোমটা টেনে টেনে রুমের নাম্বার খুঁজতে লাগল। একটা সময় অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে গেল এক রুমের সামনে। চোখদুটো ছলছল হয়ে উঠল ভয়ে। ওরই মতো দুই তিনজন আড়চোখে ওকে দেখে আর মিটমিট করে হাসে তাও সাহায্যের হাত বাড়ায় না তারা। ওরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কি যেন বলে আর খিলখিক করে হাসে। ওদের এই হাসিটা আর শবনমের ভালো লাগে না। এদিকে শবনমকে ডেকে না পেয়ে ওর স্যার বিরক্ত হয়ে এক সময় লোক পাঠায় ওর খোঁজে যে ও কাজ রেখে কোথায় গেল তা দেখার জন্য। সেই লোক গিয়ে শবনমকে ওর জায়গায় ফিরিয়ে আনল। এরপর স্যারের রুমে যেতেই খেল স্যারের বকা এতটা দেরির জন্য। শবনমের গলা আটকে এল ও কিছু বলতে পারল না পরে পাশের লোকটাই বলল ওর পথ হারানোর কথাটা।
সবটা শুনে স্যারই এই লোককে বললেন ওকে অফিসের পথঘাট ভালো মতো চিনিয়ে দেওয়ার জন্য।
স্যারের রুম থেকে বের হতেই লোকটা বলে উঠল
“আমি যে তোমার জন্য কষ্ট করুম বিনিময়ে তুমি কি দিবা?”
প্রশ্নটা শুনে শবনমের চোখ কপালে উঠল। এমন উপকারের জন্য কেউ যে কিছু চাইতে পারে তাইতো ও জানতো না।
শবনম চোখ বড় বড় করে উত্তর দিল
“ভাই আপনে এইডা কী কইলেন ? একটু উপকার করবেন হের লেইগ্যা আবার কিছু দিতে অইব বুঝি? এইডা বুঝি কোন কতা অইল?”
ওর কথা শুনে এবার রীতিমতো লোকটা রেগে গিয়ে বলল
“এইসব ভাই টাই এখানে চলব না। আমি শহিদ। টেকা ছাড় কাম করি না। তুমিতো ভালো মতো সুন্দর মতো কথাও বলতে পারো না। চাকরি বাগাইছো কেমনে? টেকা দিয়া নাকি অন্য কিছু দিয়া….. ”
শবনমের এবার গা জ্বলে উঠল শহিদের কথা শুনে। মনে মনে বলল “ও আল্লাহ এই বান্দাতো মানুষ ভালো না। এরতো মতিগতি অনেক খারাপ। এর থেইক্যা দূরে থাকন লাগব।”
চলবে