শবনম(পর্ব ৮)

0
466

#শবনম(পর্ব ৮)
সায়লা সুলতানা লাকী

দুলাল সব কিছু গুছিয়ে নিল শবনমকে নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে যাওয়ার জন্য । সেই খুশিতে শবনমের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল। সারাদিন কাটালো ট্রাংক গোছাতে গিয়ে। নির্দিষ্ট দিন ভোর সকালে উঠেই পায়ে হেটে লঞ্চ ঘাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল।

শবনমকে কোলে নিয়ে ওর মা একবার ঢাকায় গিয়েছিল কিন্তু সেই স্মৃতির কিছুই ওর মনে নাই। এছাড়া আর কখনও গ্রামের বাহিরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। বরং আত্মীয়রা বিভিন্ন জায়গা থেকে সময় সুযোগ পেলে গ্রামেই এসেছে বেড়াতে। এ প্রথম গ্রামের বাহিরে পা রাখতে যাচ্ছে তাই নিজের আনন্দকে সামাল দিতে পারছিল না। লঞ্চে উঠতেই শবনমে আনন্দ উছলে পড়ল ওর চোখেমুখে। অনেকদিন পর দুলাল শবনমের এমন আনন্দ দেখতে পেয়ে তা তৃপ্তি সহকারে দেখল ।

লঞ্চ ছাড়তেই শবনমের চোখে মুখে ক্ষনিকটা ভয় দেখল দুলাল আর তাই নানান গল্প দিয়ে ভুলিয়ে রাখল কিছুক্ষন। এরপর যখন লঞ্চ এক গতিতে চলতে শুরু করল তখন ভয়টা কমে গেল ওর। দুলাল চিড়া ভাজা আর নারকেল কিনে দিল শবনমকে। ও খাওয়ার চেয়ে মনে হল নদী দেখায় বেশি মনোযোগী হল। দুই পাড়ের গ্রাম দেখতে দেখতে বেশ ক্ষানিকটা সময় যাওয়ার পর এবার তার ভেতর ক্লান্তি বোধটা বাসা বাঁধল। এবার সে লঞ্চের ভেতর গিয়ে থেঁতু হয়ে বসল। তখন মনে হল সময় যেন আর ফুরায় না। ঝালমুড়ির স্বাদও একটা সময় বিস্বাদ হয়ে উঠল। চারপাশে শুধু পানি আর পানি, কূলের কোন দেখা নাই। এই দৃশ্য এখন আর ভালো লাগল না বরং ভয় কাজ করতে লাগল মনে। দুলাল তা টের পেয়ে ওকে কাছে বসিয়ে ঘুমিয়ে যেতে সাহায্য করল। আর একটা সময় পর ও ঘুমিয়েও গেল।

যখন ঘুম ভাঙল তখন আবিস্কার করল লঞ্চ একটা বড় ঘাটে ভেরানো। চারপাশে অজস্র মানুষের কলরব। লঞ্চের ভেতর মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে কার আগে কে নামবে। দুলাল ওর ট্রাংকের চেয়ে বেশি যত্নশীল হল শবনমের হাত ধরে রাখায়। শবনমকেও বলে দিল যেন দুলালকে শক্ত করে ধরে রাখে, একটা মুহুর্তের জন্য যেন দুলালের হাতটা না ছাড়ে। শবনমের এই সময়টা ভয়ে গলা শুকিয়ে আসতে চাইল। কারন গতরাতেই দুলাল জানিয়েছিল শওয়ারীঘাট থেকে অনেকেই হারিয়ে যায়। তাদেরকে আর ফিরে পাওয়া যায় না।

আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে শবনম আর দুলাল ঠিকঠাক মতো ঘাট পেরিয়ে এসে একটা বাসে উঠে বসল। এই প্রথম বাসে চড়তে গিয়ে শবনমের হাত পা কেঁপে উঠল। দুলালের সাহায্যে উঠে সীটে বসতে পেরে এক অন্য রকম আনন্দ অনুভব করল নিজের ভেতর। বাস টান দিয়ে বেশিদূর যেতে পারল না শবনমের পেট মুচড়ে লঞ্চে বসে খাওয়া ঝালমুড়ি, মুরলী ভাজা, চিড়া নারকেল, সিদ্ধ ডিম গলা বেয়ে বমি হয়ে বাহিরে বেরিয়ে পড়ল। দুলালের গায়েও বমি পড়ল কিন্তু ও খুব যত্ন করে শবনমকে বাসের জানালার বাহিরে মুখ রেখে একটু বাতাস লাগাতে সাহায্য করল। বাসের কন্ডাকটরের গালাগালিগুলো খুব সহজেই হজম করে নিল কোন উপায় নেই বলে। তবুও শবনমকে কিছু বলল না বরং ওর কীসে একটু সুবিধা হবে তা নিয়েই ব্যস্ত রইল।

যখন খালার বাসায় এল তখন যেন শবনম জীবন্ত লাশ। বমিতে একেবারে কাহিল হয়ে গেছে। কোন কথা না বলেই দুলালের খালা ওকে বাথরুমে নিয়ে গেল গোসল করার জন্য। বুঝিয়ে দিল কীভাবে কল ছেড়ে পানি পাওয়া যাবে। শবনম লজ্জায় অনেকটা চুপসে গেল নিজের অবস্থা দেখে।

দিনের বাকিটা সময় শুয়েই কাটাল শবনম। শরীরে একটুও এনার্জি পেল না বের হতে। মাথার উপর সিলিং ফ্যানের বাতাস পেয়ে আরামে লম্বা একটা ঘুম দিল।
দুলালকে একা পেয়ে ওর খালা বাচ্চা হারানোর কষ্টের জন্য সমবেদনা জানাল। তিনি নিজেও এই ঘটনায় প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছেন তাও বলল। দুলাল সুবিধা বুঝে খালা কে নিষেধ করল শবনমকে এই বিষয়ে কোন কথা না বলতে। ওর সামনে এই প্রসঙ্গটাই তুলতে বারন করল। তাহলে ও আবার কান্নাকাটি শুরু করবে। অনেক কষ্টে সব কিছু স্বাভাবিক হয়েছে ওদের জীবনে।
খালা খুব খুশি হলেন শবনমকে নিয়ে ওর এত ভাবনা দেখে তবে ওকে নিয়ে আগামীকাল হাসপাতালে যাওয়ার বিষয়টা মনে করিয়ে দিতেই দুলাল খালার হাতদুটো ধরে বলল
“আমারতো মা নাই, তাই কারো কাছে আবদার করতে পারি না। কিন্তু আপনে মার বইন খালা তাই আপনের কাছে আমার একটা আবদার, আপনে ওরে ডাক্তার দেহানের ব্যবস্থা কইরা দিবেন। আমি তেমন কিছু চিনি না জানি না, হুদাই ওরে লইয়া কোন জায়গায় ঘুরুম।”
“তুই বললেও আমি যাব, না বললেও আমি যাব। তোর মাঝে যে আমি আমার বোনকে দেখি তুই কী তা বুঝিস না বোকা? তুই শবনমকে নিয়ে এসেছিস এখন সব দায়িত্ব আমার।” বলে খালা একটা হাসি দিলেন আর তাতেই দুলালের মনটা খুশি হয়ে গেল সাথে একটা বড় রকমের দুশ্চিন্তাও দূর হল।

রাতে গল্পের ছলে জেনে নিল ঢাকায় কী কী ঘুরে দেখার রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল যখন শুনল সেসব জায়গায় যেতে হলে আবার বাসে উঠতে হবে তখনই আবার চুপসে গেল শবনম। একবারতো বলেই উঠল এই বাসে উঠলে এমন লাগবে জানলে ও কখনোই উঠতো না দরকার হলে হেটেই চলে আসত। আর তা শুনে খালা খালু আর খালাতো ভাইবোনগুলো জোরে হেসে উঠল। হলে গিয়ে সিনেমা দেখার কথা বলতেই খালা জানালো দারুন এক হাসির সিনেমা লেগেছে হলে “১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন” নাম তার। এক কথায় ঠিক হল আগামীকাল সন্ধ্যা ৬/৯ টার শোতে গুলিস্তান হলে গিয়ে সবাই দেখতে যাবে।খালারা যাবে শুনে দুলালও কিছুটা আশ্বস্ত হল, কারন কীভাবে কী করতে হয় তা ও নিজেও জানে না।
সারারাত সেই উত্তেজনায় শবনমের দুচোখ এক করতে পারল না।

সকালে খালার সাথে নিজেও নাস্তা বানাতে সাহায্য করল। শহরের রান্নার ব্যবস্থা বড়ই সুবিধাজনক। এখানে মাটির চুলার ঝামেলা নাই।
কল চেপে পানি ভরতে হয় না। কল ছাড়লেই পানি পাওয়া যায়। খালাতো ভাইবোন দুজনের সাথে কাপড় মেলতে ছাদে উঠে শবনম প্রথম ঢাকা শহরকে একসাথে অনেকটা জায়গা দেখল। ইট পাথরের দালান কোঠায় সাজানো ঢাকা শহর মুখে শোনা আর নিজ চোখে দেখা যেন আকাশ পাতালের হেরফের। কালো পিচঢালা পথটাকেও শবনমের চোখে সুন্দর লাগল। গ্রামের কাদামাটি ছাঁদে উঠে নিচের ঢাকা শহরে দেখতে পেল না। রিকশা, বাস আর ছোট ছোট গাড়িগুলো যেগুলো চোখের পলকে আসছে আর যাচ্ছে সব কিছুই যেন স্বপ্নের মতো মনে হল।
সন্ধ্যায় সিনেমা হলে গিয়ে টিকেট কেটে সবাই বসল ভেতরে। হলের লাইট অফ করতেই শবনম দুলালের হাতটা শক্ত করে ধরল। দুলালের তখন আরও আপন লাগল শবনমকে। সিনেমার পুরোটা সময় সবাই বেশ উপভোগ করল। একটু পরপর সবাই হাহাহা করে হেসে উঠে, আবার ভাড়াটিয়া পরিবারের কষ্টের কথা শুনে শবনম কেঁদেও ফেলল।
রাতে ঘুমের আগে দুলাল জিজ্ঞেস করল সিনেমা কেমন লাগল? শবনম সেই আগের চপলতা বিদ্যমান কিশোরীর মতো ব্যঙ্গ করে গেয়ে উঠলো “কে বিদেশি বাঁশেরও বাঁশি বাজাও…..” আর তা শুনে দুলালও হা হা হা করে হেসে উঠল।

পরেরদিন সকাল বেলাতেই নাস্তা সেরে ছোটখালা সহ বেবিট্যাক্সি করে দুলাল শবনমকে নিয়ে হাসপাতালে চলে এল। এখানে এসে পড়ে গেল আরেক বিপদে শবনম। যে কথা খালা শাশুড়িকে লজ্জায় বলতে পারেনি সেই কথা কীভাবে একজন অচেনা পুরুষকে বলবে? পুরুষ ডাক্তার যখন বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলেন তখন দুলালও ছোট খালার সামনে লজ্জায় পড়ে কোন উত্তর দিতে পারছিল না। ডাক্তার কোনভাবেই ওদের কাছ থেকে সঠিক তথ্য বের করতে পারলেন না। একটা পর্যায়ে ছোট খালা নিজেই শবনমকে নিয়ে বের হয়ে এলেন যাতে দুলাল নিঃসংকোচে ডাক্তারকে ওদের সমস্যাগুলো বলতে পারে। বের হয়ে শুধু শবনমকে জিজ্ঞেস করলেন “তোমার সমস্যাগুলো দুলাল ভালোমতো সব জানেতো? নাকি ওকেও লজ্জা পেয়ে সব সমস্যা গোপন কর?”
খালার প্রশ্ন শুনে শবনমের চোখমুখ লাল হয়ে গেল। কী উত্তর দিবে বুঝতে পারল না। ও খেয়াল করল ওর মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছে না। উপায়ন্তর না পেয়ে মাথা নেড়ে হ্যা সূচক উত্তর দিল।

বেশ কিছু টেস্টও দিয়েছিল ডাক্তার। পরে ওগুলো সেরে বাসায় ফিরতে ফিরতে ওদের দুপুর গড়িয়ে গেল। তিনজনই এতটা ক্লান্ত হল যে আর কোথাও সেদিন বের হল না।

পরেরদিন দুলাল চলে গেল নিজের কাজে আর শবনম সারাদিন খালার সাথে ঘুরে বেড়াল নিউ মার্কেটে। শবনমের বেগতিক অবস্থা দেখে তিনি ওকে নিয়ে রিকশায় ঘুরলেন। শবনম শক্ত করে ছোটখালার হাত ধরে রাখল। ওর বেশ মজা লাগছিল ইট-পাথরের এই দালানকোঠার ভীড়ে।

রিপোর্ট নিয়ে আবার যেদিন ডাক্তারের কাছে যেতে হল সেদিন ওদের এখন কী করতে হবে আর কী করা ঠিক হবে না তা সুন্দর মতো বুঝিয়ে দিলেন ডাক্তার। সাথে বেশ কিছু ঔষধের নাম লিখে দিলেন নিয়ম মতো খাওয়ার জন্য। এতেই নাকি শবনম সুস্থ হয়ে যাবে। সব কথাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে নিল শবনম আর দুলাল। তবে শবনম বুঝল এখনই কোন বাচ্চা নিতে বারন করায় দুলালের মুখটা মলিন হয়ে গেল।
বাসায় এসে খালাও ওদেরকে বাকিটা বোঝাল। শবনমের বয়সটা কম বলে নিজের অপুষ্টিতে ভোগছে সাথে পেটের বাচ্চাও সঠিক পুষ্টি পেয়ে বেড়ে উঠতে অক্ষম হয়েছে। আগে নিজের যত্ন বুঝে তবেই বাচ্চা নেওয়া উচিৎ। মায়ের বয়সটা অতি জরুরি একটা সুস্থ বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য।
খালার কথাটা শবনমের মনে ধরল না। ও যখন হয়েছে তখন ওর মায়ের বয়সটা ওর মতই বা এরও কম ছিল তাই বলে কী ও বেঁচে থাকেনি? ও সুস্থ বাচ্চা হয়নি?
মনের প্রশ্ন মনেই রেখে খালার সামনে চুপ হয়ে রইল। এটা একটা সমস্যা শবনমের, অনেক কথাই ও পেটে চেপে রাখে। সহজেই কোন বিষয় নিয়ে আশেপাশের কারো সাথে খোলামেলা আলাপ করতে পারে না। ওর মা বলতেন শবনম এক ধরনের হীনমনতায় ভোগে যার কারনে আশেপাশের সবাইকে নিজের করে ভাবতে ভয় পায়।
এরজন্য ওর মা ওকে এরআগেও বহুবার বকেছে কিন্তু তেমন কোন লাভ হয়নি। যেই লাউ সেই কদুই রয়ে গেছে।

এরপর আর কয়েকটাদিন থাকল খালার বাসায় তবে মনটা উতলা হল বাড়ির জন্য। ঘোরাঘুরি বলতে একদিন নবাব বাড়ি ঘুরে এসেই ক্ষান্ত দিল। পরিশেষে দুলাল আবার ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরল।

এবার লঞ্চ ঘাটে পালকি নিয়ে অপেক্ষায় ছিল সবুজ। সরাসরি শবনম ওর মায়ের বাড়িতেই গিয়ে উঠল। শহর বেড়িয়ে আসার আনন্দের গল্পগুলো ভাই বোনদের সাথে ভাগাভাগি করতে করতেই দুইদিন পেরিয়ে গেল এমনি এমনিই। বোনদের জন্য মালা চুড়ি ক্লিপ, দাদির আর মায়ের জন্য শাড়িও কিনেছিল ওগুলো দিতেই দাদির আনন্দ দেখে কে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি নাতিন জামাইয়ের দেওয়া শাড়ি দেখাতে লাগলেন। নতুন বোন পেয়ে শবনম বেশ খুশি হলেও দুলালের মনটা কেনজানি উদাস হয়ে গেল। আর তা শবনমের চোখ এড়াতে পারল না। শবনমের দাদি খুব করে বুঝিয়ে বললেন এবার পোয়াতি হওয়ার সাথে সাথে এখানে চলে আসতে। তখন অবশ্য শবনম ডাক্তারের পরামর্শগুলো বলল ওর দাদিকে। তিনি সেসব কথা আমলে নিলেন না। উলটা বললেন ওই সব কিছু না তাদের এমন বছর বছর বাচ্চা হইছে না তাতে কার কি সমস্যা হইছে? দাদির কথাটাই শবনমের মনে ধরল।

বাপের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরে নিজের ঘরে ফিরল শননম পালকি চড়েই।
সবুজ এখন ফাইনাল পরীক্ষা, তাই ও পড়ার চাপে আছে। এবার শবনমের মেঝভাই এল সাথে ও পড়ালেখা করে না, এখন থেকেই বাবা চাচাদের সাথে ঘুরে বেড়ায় । ও বড় চুপচাপ। তেমন কারো সাতেপাচে নাই।
নরম পেয়ে জহির নানান ধরনের কথা শুনাল। ইনিয়েবিনিয়ে জেনে নিল দুলাল এবার ঢাকা থেকে শ্বশুর বাড়িতে কী কী দিয়ে এসেছে।
পালকির সাথে আবার ভাই চলে গেল। শবনম কিছু সময় নিয়ে নিজের ঘরের কাজ গুছিয়ে বের হল চাচিআম্মাদের হিস্যার উদ্দেশ্যে। ঢাকা থেকে ভাসুরের মেয়েদের জন্য মালা চুড়ি, ক্লিপ কিনে এনেছে, এগুলো দিতেই বাচ্চারা নয়া চাচিকে খুশিতে জড়িয়ে ধরল। রাতে বানুকে আলাদা করে ডেকে একটা লিপস্টিক আর নেলপালিশের শিশি ধরিয়ে দিতেই বানু আনন্দে কেঁদে ফেলল। স্বামী নাই বাড়িতে, তাই আর ওর তেমন একটা সাজা হয় না। চুলগুলোও ভালোমতো চিরুনি করা হয় না। বেশিরভাগ সময়ই একটা বড় হাত খোঁপা করে রাখে। তাতেও আশেপাশে থেকে হেসেডেসে কত কথা বলে পাড়াপ্রতিবেশিরা!

সকাল হতেই শুরু হল শবনমের শাশুড়ির চিৎকার চেচামেচি। পুরো বাড়ি মাতিয়ে ফেললেন তিনি বিলাপ পেড়ে পেড়ে।
দুলাল ব্যবসার পুঁজি সব শ্বশুর বাড়িতে লুটাইয়া ফেলতেছে অথচ অসুস্থ বাপের খরচের এক টাকাও দেয় না। জমির নাকি বলছে এখন থেকে দুলালকেও ওর বাপের খরচের টাকা দিতে হবে।
দুলালও ছাড়ার পাত্র না, ও নিজের গলা ছেড়ে ওর সৎ মা আর ভাইদের সাথে অনেক ক্ষন ঝগড়াঝাটি করল। এরপর গঞ্জে চলে গেল আর শবনমকে বলে গেল ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকতে, তাদের কোন কথার জবাব না দিতে।

বানু সঙ্গ দেওয়ায় আর শবনমের কষ্ট হল না। সিনেমার গল্প করতে করতে সময় কোনদিক দিয়ে গেল তা টের পেল না।

রাতে বাড়ি ফেরার পর শবনম একটু রাগ দেখিয়েই বলল
“বাপের খরচের টেকা দিতে আপনে অস্বীকার করলেন ক্যা? এইডাতো আপনের দায়িত্বের মইধ্যে পড়ে।”
“বৌরে তুমি এগুলা বুঝবা না। আমার বাপের খরচের টেকা আমার বাপেরডা দিয়াই চলে। ওরাই উলডা আমারে আমার বাপের টেকার কোন ভাগ দেয় না। আমি বহুত কষ্টে এই কারবারডা আইজকার এইহানে আইন্যা দাঁড় করাইছি। ওরা অহন ওইডার ভাগ চায়। জমিরা কয়দিনই কইছে ব্যবসার লাভের টেকার ভাগ দিতে। কও বৌ আমার কষ্টের টেকা ক্যা আমি ওগো দিমু? অহন একটা ভেগ ধরছে বাপের খরচের টেকা কইয়া যদি কিছু নিতে পারে। ওরা আমারে একলা পাইয়া আমার লগে বাটপারি করে, তুমি এইগুলা বুঝবা না।”

মনে হল আসলেই শবনম কিছু বুঝল না। সব কিছু কেমনজানি এলোমেলো লাগল।

শবনম ওর সৎ শাশুড়ির তাল বুঝে চলতে লাগল। তার সামনে যাতে পড়তে না হয় তেমনভাবেই চলে যেমবটা ওর মা ওকে শিখিয়ে গিয়েছেন ।

দুপুরে দুলাল খেয়ে চলে যেতেই শবনম নিজের ঘরে ভাতঘুমের জন্য শুয়ে ছিল। ঔষধগুলো খেলে কেবল ঘুমঘুম লাগে। একটু আলসেমি ধরেছে আজকাল।
হঠাৎ বানুর চিৎকার চেচামেচি শুনে ধরমর করে উঠে বসল। ঘটনা কী তা বোঝার চেষ্টা করতে লাগল।

“ক্যা আমি কী বুড়ি হইয়া গেছিনি? আমার সাজনে মাইনষের এত জ্বলে ক্যা? আমার কোন লাংগে আইন্যা দিছে তা কইতে আমি বাইধ্য না কারো কাছে? আমার কষ্ট কে দেহে যে হেরে আমি এত পিরিতের কতা কমু? পাইছে কী আমারে মানুষেরা?”

শবনম বুঝে গেল ওর দেওয়া জিনিস নিয়েই কিছু একটা হয়েছে। তাই নিজের কাপড় ঠিক করছিল বের হতে ঠিক তখনই শুনল-

“হ, কে তোর লাং, হেইডা বুঝতেতো আমগো কষ্ট অয়। কত্ত পিরিতরে আল্লাহ! বাচ্চা অইতেই বাড়ির বৌ বেপর্দায় দৌড়াইয়া গঞ্জে যায়গা কিয়ের টানে, তা কি আর আমরা না বুঝিনি? আমরাতো দুলালের বৌ, যে এত কচি, এক্কেবারে নাক টিপলে দুধ পড়ে।”
কথাটা দুলালের সৎ বোনের তা গলার স্বর শুনেই বুঝতে পারল শবনম। কিন্তু শেষ কথাটায় কী ইংগিত করল তা বুঝতেই একটু সময় নিল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here