অভিশপ্ত_জীবন পর্ব ১০,১১

0
338

#অভিশপ্ত_জীবন
পর্ব ১০,১১
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno
১০

ধাক্কা দেওয়ার সাথে সাথে মুহিতের মাথা,, চেয়ারের কোনা লেগে কেটে যায় এবং উঁচু বারান্দা থেকে নিচের উঠোনের পড়ে যায়। আকস্মিক এমন ঘটনায় আমিও ঘাবড়ে গেলাম। আমি কখনো চাইনি এমন কিছু ঘটুক। মুহিতের হাত কিভাবে যেন মুচড়ে গিয়ে পড়েছে, হাতের কুনুই নাড়াতে পারছে না। আমি সাথে সাথে মুহিত কে টেনে তোলার চেষ্টা করি কিন্তু মুহিত ব্যাথা পেয়ে হিংস্র বাঘের মতো রেগে যায় আর অনেক জোরে চিল্লাচিল্লি করে। এতো রাতে কোন বাড়িতে চিল্লাচিল্লি মানে নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু তাই আশেপাশের কয়েকটি বাড়ির মানুষ চলে এসেছে। রুনার বাবা মা রুনা সবাই আসছে। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে এখন,, সবার বুঝা শেষ কি হয়েছে, রুনা আর বড় ভাবি মুহিতের ফুলে যাওয়া হাতে পানি দিয়ে দিচ্ছে। পাড়া প্রতিবেশী সবাই যে যার ইচ্ছে মতো আমাকে কথা শোনাচ্ছে। আমি নির্বাক দর্শক দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছি আর সবার কথা শুনে যাচ্ছি।

মুহিতের হাত ফুলে গেছে তাই সকালে মেডিক্যাল নিয়ে গেছে। বেহায়া মন বারবার মুহিতের কি অবস্থা তা জানতে চাইছে কিন্তু লজ্জায় কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। তাছাড়া আমার সাথে কেউ কথাও বলছে না। মুহিতের হাত বেন্ডেজ করে ও মাথায় সেলাই দিয়ে নিয়ে আসছে। পাড়ায় সবাই বলাবলি শুরু করলো আমি নাকি মুহিতকে রাতে মেরে ফেলার চেষ্টা করছি। এজন্যই লোকে বলে,, “কিছু টা বটে কিছু টা রটে”।
মুহিতের সাথে ওইদিনের পরে থেকে আর কোন কথা বলি নি মুহিত ও বলে নি।

রুনার ব্যাথা হচ্ছে, কোন প্রকার রিক্স নিতে চাই না। তাই সাথে সাথে রুনাকে মেডিক্যাল নিয়ে গেলো। দুই ব্যাগ রক্ত লাগবে। আমার সাথে ব্লাড ম্যাচিং হয় বলে আমি রক্ত দিলাম। যদি ও আগে থেকেই জানতাম ছেলে হবে। ছেলে টা কি সুন্দর। রুনার মায়ের কোলে আছে। আমি কোলে নিলাম অনেক আদর করলাম।বাড়িতে হাঁস মুরগী গরু আছে তাই আমি সন্ধ্যার আগে চলে আসছি। চার দিন ছিলো ওরা মেডিক্যাল, আমি প্রতিদিন রান্না করে দিতাম রুনার বাবা বা ভাই খাবার নিয়ে যেতো। বাচ্চা নিয়ে মুহিত বাসায় আসার পরে সব সময় বাচ্চাকে অনেক কিছু বলে আদর করে। কত্ত রকম খেলনা কিনে আনে।

এখন প্রতিদিনের সমস্ত কাজ আমাকে করতে হয়। রুনা একটা কাজও করে না। নিজের অবস্থা অনেক খারাপ, শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছি,চোখ গুলো বড় বড় হয়ে গেছে। যেহেতু নিজে রান্না করি তাই কোন কিছু খেতে বাঁধা নেই কিন্তু মুখে রুচি না থাকলে খাবার পেটে যাবে কিভাবে।

শামিম ফোন দিয়ে বললো আমি নাকি ফুপি হবো। অনেক খুশি লাগছে, পপির ছেলে হয়েছে, আমাকে আদর করে মাম্মা ডাকে। শামিমের ও যেন একটা ছেলে হয়। দুইদিন পরে আমি আব্বার বাড়িতে আসি। যদিও আসার সময় রুনার বকবকানি শুরু হয় বাড়ির কাজ করা নিয়ে কিন্তু আমি সেইসবে কান না দিয়ে চলে আসছি। আমার শরীরের অবস্থা দেখে সবাই মুহিতের কাছে যেতে নিষেধ করে। আমার নিজের ও ওই বাড়িতে কেমন চাকরানী চাকরানী মনে হয়।

আজ মুহিতের মোবাইল থেকে কল আসছে, রিসিভ করতেন রুনার কান্নার আওয়াজ পেলাম। সামির( মুহিত ও রুনার ছেলের নাম সামিউল ইসলাম সামি, নামটা আমার সাথে মিলিয়ে রেখেছে) নাকি খুব জ্বর। মনটা কেমন যেন করছে,, ছোট মানুষ হয়তো অবস্থা খুব খারাপ তাই পরের দিন সকালে বাড়ি গেলাম। সামির নিউমোনিয়া হয়েছে অথচ আমি রুনাকে পানিতে হাত দিতেই দিই না, বাচ্চার শরীর খারাপ হবে ভেবে । অথচ সব দোষ পড়লো আমার উপর।

বাড়িতে আসতে না আসতেই রুনা খোঁচা মেরে বললো,
আমার ছেলে তাই সব কিছু আমার করা লাগে, শীতের সময় সকাল বেলা বাচ্চার সব প্রসাবের কাথা, জামা কাপড় সব কিছু ধুই, বাড়ির কাজ না করলে আরেকজনের মুখ কালো দেখতে হয় বলে, সারাদিন এটা সেটা করি,, নিজের ছেলের যত্ন নেওয়ার সময় থাকে না তাও পুরো পাড়াতে আমার নামে গীবত গেয়ে বেড়ায়,, আমি নাকি কাজ করি না।

আর সহ্য করতে পারলাম না, সাথে সাথে আমিও উত্তর দিলাম,,
বাচ্চার কাঁথা কতদিন আগে ধুইছিস বল,আর বাড়ির কোন এটা সেটা কাজ তুই করিস সেটাও বল,বাচ্চার নিউমোনিয়া হয়েছে তোর বাড়ির কাজ বা অন্য কিছু করার জন্য না, হয়েছে প্রতিদিন রাত-বিরেতে গোসল করার জন্য। বর কে হাতের মুঠোয় রাখার জন্য কানের কাছে ফুসমন্তরের পাশাপাশি এমন কোন কাজ আছে যা তুই করতে বাকি রাখছিস??

মুহিতের সামনে ঝাড়ু পড়ে ছিলো,, সেটা দিয়ে আমাকে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করে। হতভম্ব হয়ে গেলাম এমন আচরণ দেখে। মুহিত চিল্লায়ে বলছে,

বাজী(বন্ধা মেয়েকে গ্রামের ভাষা বাজী বলে) মা*গী,,সব সময় বাপ ভাইয়ের টান টানিস,, বাড়িতে এতো কাজ ফেলে রেখে ভাইয়ের সাওয়াল হওয়ার উৎসব পালন করতে গেলি কেন? তোর বাপ ভাই তোকে খাওয়ায় নাকি পড়ায়? মাসের মধ্যে কয়বার তোর বাপের বাড়ি যাওয়া লাগে? নাকি পুরান না/ঙ্গের কথা মনে পরে তাই অজুহাত পেলেই ছুটে যাস??

ঘিন্নায় বমি আসছে এমন কথা শুনে।
আমিও বললাম, যে যেমন, তার চিন্তা ভাবনা ও তেমন। যদি না/ঙ্গ থাকতো তাহলে তোর সংসারে এতো অশান্তি সহ্য করে পড়ে থাকতাম না। আর আমি বন্ধা কার জন্য হলাম সেটা একটু ভেবে দেখ, উত্তর পেয়ে যাবি। আর হ্যাঁ আজ বন্ধা বলেই ভাতারখাকি এক সাওয়ালের মাকে তোর বউ হিসেবে পেয়েছিস।

মুহিত কয়েকটা লাথি মারে আমার মুখে,, ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে আমার,ইচ্ছে করছিলো পড়ে থাকা ঝাটা দিয়ে আমি দিই কয়টা। যেহেতু এর আগেকার স্বামী কে মারার দুর্নাম আছে আমার তাই নিরবে সহ্য করলাম। বড় জা এসে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলো। ঝাটার খিলাল গুলো আমার হাতে ফুটেছে। বিনা অপরাধে মার খেয়ে খুবই রাগ হলো। আর না এখানে, দরকার হয় মানুষের বাড়িতে একবেলা কাজ করে একটা পেটের ভাত জোগাড় করবো তবুও নিজের অস্তিত্ব খোয়াইয়ে এখানে থাকবো না। রাতেও বাড়িতে যায় নি।

পরের দিন সকালে শামিম এসে থানায় নারী নির্যাতন মামলা দেবে বলে আমাকে নিয়ে যায়। এইসব কোট-কাচারি আমার ভালো লাগে না। তাই গ্রামের মেম্বার চেয়ারম্যান নিয়ে বসার আয়োজন করা হয়। যেহেতু সমস্যা টা সেই শুরু থেকে তাই কোন কিছু শোনার আগেই সব দোষ মুহিতের বলে সাবস্ত হয়।
ওই বৈঠকে আমার যাবতীয় কিছু ফেরত দিয়ে আমাকে ডিভোর্স করে।

আমি আবারও অভিশপ্ত জীবন নিয়ে সংগ্রাম শুরু করি। মা আব্বার বয়স হয়েছে,, শামিমের উপর সংসারের সমস্ত দ্বায়িত্ব। প্রথম প্রথম ৩/৪ মাস শামিম এত বউ (ফাহিমা) আমার সাথে খুব মিলে মিশে ছিলো। কি রান্না করবে না করবে আমাকে জিজ্ঞেস করতো। বুঝতাম ফাহিমা আমাকে বেশ ভয় করে।

শামিমের বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামে,, মাঝেমধ্যে মাঝে শশুর বাড়ি থেকে এ ও আসে। কিন্তু আমার সাথে কেমন ভাবে কথা বলে। যদি আমি তাদের জিজ্ঞেস করি কেমন আছেন তাহলে শুধু উত্তর দেয়। ফাহিমা ও রাগ রাগ করে আমার সাথে। যাওয়ার কোন যায়গা নাই তাই সব কিছু বুঝেও না বোঝার মতো থাকি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন। প্রায়-ই দিনের মতো আজও, মায়ের সাথে ফাহিমার ঝগড়া হয়। কোন মেয়ের সামনে যখন মায়ের সাথে ভাইয়ের বউয়ের ঝগড়া হয় তখন প্রতিটি মেয়েই মায়ের পক্ষ নিবে। আমিও তার ব্যাতিক্রম নই। তখন ফাহিমা আমার মুখের উপর বলে, সতীনের জীবন জ্বালিয়ে খেয়ে হয় নি এখন মায়ের সাথে মিলে আমার জীবন তছনছ করতে আসছে।

সাথে সাথে শামিম ফাহিমাকে থাপ্পড় মারে আমিও শামিম কে থাপ্পড় দিলাম। কেন সে গর্ভবতী মেয়ের গায়ে হাত তুলবে। আমি বাইরের বাগানে বসে কান্না করছি। ফাহিমা হয়তো ঘরে সুয়ে আছে। মা এখনো থামেনি,, শাশুড়ীরা একটু বেশিই বলে ছেলের বউদের। হোক না সে নিজের মা, কিন্তু সেও অন্য মেয়ের শাশুড়ী। ফাহিমার-ই বা দোষ কই, নিজের সংসারে আমার মতো উটকো ঝামেলা কেউ-ই চাই না।

কোন রকম কেটে গেছে আরো কিছু দিন। ৮ মাস শেষ না হতেই হঠাৎ এক রাতে ফাহিমার খুব ব্যাথা উঠে। গ্রাম থেকে রাতের বেলা মেডিক্যাল যাওয়া সম্ভব না তাই সকালের অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু রাত শেষ না হতেই শামিমের মেয়ে হয়েছে। শামিমের শাশুড়ী, চাচি শাশুড়ী সহ কয়েকজন মেয়ে মানুষ সকালে এসে তিনদিন পরে ফাহিমা কে উনাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে বলে সন্ধ্যার আগে চলে যায়। যেহেতু পাশের গ্রাম তাই কোন প্রব্লেম নাই। কিন্তু যাওয়ার সময় উনারা নাকি আমাদের পাড়ার একজনের কাছে কি কি সব বলে গেছে,,

ওদের নতুন সংসার, আবার বাচ্চা হলো এখনই আয় উন্নতি করার সময় কিন্তু সুমি এসে বোঝা হয়েছে। একটা মানুষের কত খরচ, এখন সংসার টানবে নাকি বউ বাচ্চা টানবে নাকি বোন বাপ মাকে চালাবে, এইরকম অনেক কথা।

এই কথা গুলো ওই মহিলা আবার আমার মা কে বলে দিয়েছে।এই নিয়ে মা শুরু করেছে তুলকালাম। ফাহিমার সামনে ওর মাকে ইচ্ছে মতো বলে যাচ্ছে। মায়ের এইসব চিল্লাপাল্লাতে আমার সম্মান গুলো তুঙ্গে উঠছে। আমি যতই থামতে বলছি মা ততই আরো জ্বলে উঠছে, ফাহিমা সাথে সাথে ওর মায়ের কাছে ফোন দিয়ে সব বলে দেয়। সন্ধ্যার পরে পপিও এসেছে। মা রাতে বসে থেকে যা কিছু বাড়িতে হয়েছে সব কিছু বলে পপিকে।

আজ ফাহিমা কে নিতে আসবে। সকাল থেকে ব্যাস্ত সময় পার করছি। ওখান থেকে ৫০ জন লোক এসেছেন। সবার খাওয়া দাওয়া শেষে মা আর পপি সেই কাহিনী গুলো নিয়ে লেগে যায় আবারও ঝগড়া। যে যাদের ইচ্ছে মতো বলে যাচ্ছে। এভাবে আর বাঁচা সম্ভব না। আমি যেখানে যাবো সেখানেই এমন অশান্তি হবে তাই সিদ্ধান্ত নিলাম সেই মহাপাপ করার জন্য যা করলে কখনো জান্নাত পাবো না। জমিতে দেওয়া অনেক রকম কীটনাশক বাড়িতে সব সময় থাকে আমি সেগুলো থেকে,,,,,,

চলবে,,,,

#অভিশপ্ত_জীবন
পর্ব ১১
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno

জমিতে দেওয়া অনেক রকম কীটনাশক বাড়িতে সব সময় থাকে, আমি সেগুলো থেকে এক বোতল নিয়ে আম বাগানের শেষ প্রান্তে চলে যায়। বি/ষ খাওয়ার পরে ছটফট করতে লাগলে যেন কেউ দেখতে না পায়।বুকের ভেতর হার্টবিট এর ধকধক শব্দ বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে । পৃথিবীর মায়া অদ্ভুত, বারবার ইচ্ছে করছে এমনটা না করতে। কিন্তু এইভাবে অন্যের ঘাড়ে চেপে আর কত,, অন্য ৮/১০ জন মেয়ের মতো আমার জীবন না। হাটতে হাটতে বাগানের শেষে ঝোপের পাশে বসেছি। জীবনের ব্যাথা-কাতুর পরিত্যক্ত অতীত গুলো কে মনে করছি, যেন আত্মহত্যার মতো পাপ করার সাহস পায়। না আর দেরি করা যাবে না, বুকে সাহস এনে একবারে বোতলের সব বি/ষ খেলেই সবার অশান্তি দূর হয়ে যাবে। হয়তো সবাই কয়েকদিন কান্নাকাটি করবে কিন্তু কালের বিবর্তনে সবাই দিব্বি আমাকে ভুলে যাবে।

বাড়ির ভিতর থেকে এখনো কোলাহল শোনা যাচ্ছে। এটাই শেষ কোলাহল আমাকে নিয়ে,, দম বন্ধ করে বোতলের মুখ খুলে এক সাথে সব গুলো বি/ষ ঢকঢক করে খেয়ে ফেললাম। নিঃশ্বাস ফেলতেই কেমন বিশ্রী গন্ধ লাগছে। বোতল টা একটু দূরে ফেলে দিলাম। শুধু গন্ধ লাগছে অন্য তেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না। তাহলে কি আমি ভুল ঔষধ খেলাম। এটা খেলে কি মানুষ মরে না? এখন যদি আমি না মরি তাহলে তো নতুন কেলেঙ্কারি সৃষ্টি হবে। দৌড়ে আবারও বোতলের কাছে গেলাম কি কি লেখা আছে দেখার জন্য। খুব ভালো করে স্বতর্কীকরণ দেওয়া আছে, “বিষ শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন” এবং স্প্রে করার সময় কি কি সমস্যা হতে পারে সেইসব। আমি বোতলের বাকি দুই এক ফোটা যা ছিলো সেগুলো ও খেয়ে নিলাম।

ভাগ্য খারাপ হলে বি/ষ ও বেঈমানী করে,, হয়তো আরো কিছু বাকি আছে জীবনে তাই এমন হচ্ছে। আমি উঠে দাড়াতেই গন্ধে মুখ ভর্তি বমি উঠে এলো,, সাদা সাদা দুধের মতো কি সব মুখ দিয়ে বের হচ্ছে। বমি হওয়ার সময় বুঝতে পারলাম বুক এবং গলায় জ্বালা করছে। হয়তো বি/ষে কাজ শুরু হয়েছে। হ্যাঁ সত্যিই শুরু হয়েছে, পেটের নাড়ীভুঁড়ি মনে হচ্ছে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে ঝাঁঝালো নিঃশ্বাস বের হচ্ছে। বমির গন্ধের জন্য আবারও বমি পাচ্ছে,হাত পা কাপছে, উয়াক উয়াক করে বারবার শব্দ করছি কিন্তু আর বমি বের হচ্ছে না তবে মনে হচ্ছে এখনই বের হবে। যতই কষ্ট হোক জোরে চিৎকার বা বাড়ি যাবো না, এখানেই অভিশপ্ত জীবনের ইতি টানবো। উফফ কেমন যেন গোঙ্গানি আসছে ভেতর থেকে,, না চাইতেও এমন শব্দ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

হঠাৎ আমাদের এলাকার একটা চাচা এইদিক দিয়ে যেতে গেলে আমার গোঙ্গানি শুনতে পায়। উনি আমার কাছে দৌড়ে এসে, সামনে এমন সাদা বমির দৃশ্য আর গন্ধ দেখে বুঝতে পারে আমি নিজের সাথে কি ঘটিয়েছি। উনি চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে থাকে, সুমি বি/ষ খেয়েছে তোরা কে কোথায় আছিস এদিকে আয়, সুমি বি/ষ খেয়েছে। মাঠের মধ্যে থেকে দুজন লোক ছুটে আসে তারাও চিল্লাচিল্লি শুরু করে, এভাবে একে একে অনেক লোকজন আসছে,আব্বা মা পপি এসেই কান্না শুরু করেছে।

আমার বুকের ভেতর মনে হচ্ছে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এখন বাঁচার আগ্রহ জাগছে কিন্তু কিছু বলার মতো শক্তি নাই, মুখে শুধু উয়াক উয়াক শব্দ,, চাইলে ও কথা বলতে পারছি না। শামিম কোথায় থেকে যেন একটা ভ্যান গাড়ি নিয়ে এসে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া শুরু করে। চোখে সব কিছু ঝাপসা দেখতে পাচ্ছি, কারো মুখই স্পষ্ট না, মা আমার মাথার কাছে বসে বুকের সাথে হেলান দিয়ে রাখে আমাকে, পিছনে পপি সহ কে কে যেন ভ্যান ঠেলে রাস্তায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। শামিমের পায়ে সেন্ডেল নাই অন্য এক পায়ে আমার বমি গুলো লেগে আছে, হয়তো আমাকে ভ্যানে উঠাতে গিয়ে লেগেছে কিন্তু সেদিকে শামিমের খেয়াল নেই।

অনেক যন্ত্রণা হচ্ছে, আমি মরতে চাইনা, আল্লাহ আমাকে বাচিঁয়ে দাও। বাঁচার আর্তনাদ বাড়ার সাথে সাথে মৃত্যুর ভয় ঘিরে নিয়েছে আমাকে। মনে মনে কালিমা পড়ছি সব সময়, মৃত্যুর সময় মুখে কালিমা আসলে নাকি জান্নাত পাওয়া যায়। আমি চাইনা মারা যেতে,, সবার এমন ভালোবাসা দেখে বুঝতে পারছি আমি আবারও অনেক বড় ভুল করছি। সবার কান্নার আওয়াজ আমার কানে আসছে কিন্তু ভয়ে চোখ খুলছি না, কারণ মৃত্যুর আগে নাকি আজরাইলকে দেখা যায়। আমি চাইনা উনাকে দেখতে , বাঁচতে চাই। সবাই তারাতাড়ি আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাক,হে আল্লাহ তুমি একবার আমার জীবন ভিক্ষা দাও। আমি আর কখনো আল্লাহর দেওয়া জীবন কে নিজ হাতে শেষ করতে চাইবো না।

আমাকে নিয়ে ডাক্তারের বাড়িতে আসছে, উনি বি/ষ খাওয়া রোগীর চিকিৎসা করেন শুধু। আমি মায়ের হাত নিজের শেষ শক্তি দিয়ে ধরে আছি, শামিম কোলে করে ভ্যান থেকে নামিয়ে, পা নিচে দিয়ে বারান্দার খুটি এবং শামিমের বুকের সাথে আমাকে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো। কি যেন দিয়ে মুখ হা করিয়ে অনেক বড় পাইপ মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। আমার কাছে মানে হচ্ছে উত্তপ্ত লোহার শিক দেওয়া আছে গলার ভেতর। ডাক্তার হালকা কুসুম গরম পানি ঢেলে দিচ্ছে আর কিছুক্ষণ পরপরই পাইপ দিয়ে ওয়াশ করে করে বের করছে। কেন যেন ডাক্তার কে আমার আজরাইল মনে হচ্ছে।

সবাই মনে করে মৃত্যু খুব সহজ কিন্তু আল্লাহর দেওয়া জীবন কে নষ্ট করা এতোটাও সহজ ব্যাপার না। হয়তো আল্লাহ এমন কঠিন শাস্তি দেন তার নিয়ামত কে অগ্রাহ্য করার জন্য।

না এখন আর পানির সাথে সাদা ওইসব বের হচ্ছে না। কি কি সব ইঞ্জেকশন দিলেন এবং একটা স্যালাইন দিলেন। আগামী দুইদিন আমাকে কিছু খেতে দিবেন না। ডাক্তারের বাড়িতে এমন ক্রিটিকাল রোগী রাখার জন্য আলাদা ঘরে ৩ টা বেড রাখা আছে। আমাকে ওখানে দুই দিন রাখবেন তারপর রিলিজ দিবেন। মনে মনে অনেক আগেই তওবা করেছি, জীবনে যতই কষ্ট আসুক আর কখনো এমন সিদ্ধান্ত নিবো না। আল্লাহ জীবন দিয়েছেন উনিই আবার ফিরিয়ে নিবেন মাঝখানে থেকে বান্দার এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া আল্লাহ কে অবমাননা করা।

( প্রিয় বন্ধুরা,, আমার কিন্তু বিষ খাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই,,আমি একবার বিষ খাওয়া রোগীকে দেখেছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই লিখলাম)

বাড়িতে আসার পরে সব কিছু স্বাভাবিক। আর ঝামেলা নেই আপাতত। কিন্তু সবার সাথে কথা বলতে বা মিশতে লজ্জা করছে,মানিয়ে নিতে হালকা সময় লাগবে। নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে পার হলো আরো কিছু দিন। কোন বাবা মা বা ভাই চাইবে না তার মেয়ে বা বোন কে বাবার বাড়িতে রাখতে। হয়তো দুই চার বছর পরে দুষ্টু মানুষের খারাপ নজর বা আবারও সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হবে এই আশংকায় থাকেন তারা।আর মেয়ে জাতির নিরাপদ স্থান হলো স্বামীর বাড়ি। নিজেকে দিনে দিনে প্রস্তুত করেছি নতুন সংসার করার জন্য মানিয়ে নিতে। এদিক সেদিক থেকে বিভিন্ন বিয়ের প্রস্তাব আসে এখন। পাত্র অবশ্য বউ মারা যাওয়া, তালাক দেওয়া বা দ্বিতীয় বউ করবে এমন। ঠিক এমনই একটা প্রস্তাব এসেছে আজ। পাত্রের আগের বউ নাকি বাড়ির পাশে কসমেটিকস এর দোকানদারের সাথে পালিয়ে গেছে। তাদের ৭ বছর এবং ৩ বছরের দুটো মেয়ে আছে। ভাবছি কিভাবে একটা মেয়ে স্বামী সন্তান রেখে অন্য কারো সাথে পালাতে পারে। আসলে কি তারা মেয়ে নাকি মেয়ে জাতির কলঙ্ক।

আমাকে দেখতে আসা লোকজনের মধ্যে থেকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, ওখানে কতদিন সংসার করেছি??

উনার কথায় ভাবনার জগৎ থেকে বের হলাম।আমি বিনয়ী সুরে বললাম,,,

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here