#অভিশপ্ত_জীবন
পূর্ব ১২,১৩ শেষ
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno
১২
“” বর্তমান “”
আমি বিনয়ী সুরে বললাম,,
জ্বী প্রায় ১৬ বছর, কেন ছাড়াছাড়ি হয়েছে তা নিশ্চয়ই আপনারা জেনেশুনেই এখানে এসেছেন। আমার সম্পর্কে অজানা কোন প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন তবে জানা বিষয় গুলো নিয়ে কথা বলতে ইতস্তত বোধ করি আমি।
পাশে থেকে অন্য একজন বলেন,, ছোট দুটো মেয়েকে মায়ের ভালোবাসা দিতে হবে,, তুমি কি পারবে মেয়ে দুটো কে নিজের মেয়ে বলে মানিয়ে নিতে??
আমি যতই চেষ্টা করি-না কেন, অন্যের কোন কিছুই নিজের হয় না,, দিন শেষে তা পর-পরই হয়ে থাকে। তবে চেষ্টা করবো আমার নিজের মতো করে তাদের আদর যত্নে বড় করার। আমি আমার দ্বায়িত্বে বিন্দু পরিমাণ অবহেলা করবো না।
ইদানিং আমি কোন কথা মনের মধ্যে চেপে রাখি না বা ভাবি না এই কথার জন্য অপর ব্যাক্তি কষ্ট পাবে। যেখানে যা বলার প্রয়োজন সেখানে ঠিক সেই কথা অকপটে বলে দিই। উনারা আপাতত চলে গেছেন পরামর্শ করার জন্য। ছেলের দুটো মাটির দেওয়ালের ঘর এবং চারিদিকে ঘেরানো বাড়ি আছে। টয়লেট গোসলখানা সব বাড়ির ভিতর আর সবচেয়ে বড় কথা হলো ছেলে টা আমার চেয়ে ৬/৭ বছরের বড় হবে। অন্য সবগুলো প্রস্তাব আসতো অনেক বয়সী বুড়ো মানুষের সাথে। আমার পরিবার রাজি, উনারাও রাজি হলেন। সামান্য কিছু আয়োজনের মধ্য দিয়ে আবারও নতুন কারো ঘরে গেলাম।
সন্ধ্যার পরপরই নতুন স্বামীর বাড়িতে চলে আসছি। যেহেতু আমার বর্তমান স্বামী (আনিস) এর আগের বউ পাশের দোকানদারের সাথে পালিয়ে গেছে এবং আনিস আবারও বিয়ে করে ফিরেছে এই খবর যার কানে যাচ্ছে সে-ই নতুন বউ দেখার জন্য ছুটে আসছে। সবার মুখে একই কথা,,, স্বভাব আক্কেল খাটিয়ে সংসার করো, আনিস অনেক ভালো, গোটা পাড়ার একজন মানুষ ও আনিসের কোন দোষ দিতে পারবে না।
আনিসের বউ চলে যাওয়ার পরে আনিস এবং মেয়ে দুটোর (রজনী এবং নিশি) দেখা শোনা আনিসের মা বাবা করতো যদিও উনাদের বাড়ি আলাদা। রজনী হয়তো বুঝতে পারছে আমি সৎ মা, আর সৎ মায়েরা অনেক খারাপ হয় সেজন্যে রজনী আমার থেকে দূরে দূরে আছে কিন্তু নিশি আমার কোলে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরে সবাই খাওয়ার জন্য পাশেই শশুর শাশুড়ী যে বাড়িতে থাকে সেখানে গেলাম রাতের খাওয়া শেষে রজনী নিশি ওদের দাদির সাথে ঘুমাবে বলে দাদির ঘরে চলে গেছে।
আনিস একটা টর্চ লাইট জ্বালিয়ে আমাকে বললো, চলো আমরা বাড়িতে যায়।
উনার বলা এতোটুকু কথাতেই আমার বুকের মধ্যে ধক্ব করে উঠলো। আনিস আগে আগে যাচ্ছে আর আমি পিছনে। বিধাতার নিয়ম, তিন কবুল বলার পরে চাইলেও না করা সম্ভব না। এখন পর্যন্ত মন কে শান্ত রাখতে পারিনি,, যা যা করছি সব কিছু মনের বিরুদ্ধে করছি। বাড়িতে আসার পরে গেইটের তালা খুলে আমার হাতে দিয়ে আনিস বললো, আজ থেকে এই বাড়ি, দুই মেয়ে এবং আমার সব দ্বায়িত্ব তোমার হাতে দিলাম। যত্ন করে তুমি তোমার সব কিছু আগলে রাখবে।
আমি কোন উত্তর না দিয়ে বাড়ির ভিতর গিয়ে আবারও ভিতর থেকে তালা লাগিয়ে দিলাম। ঘরের আসবাবপত্র গুলো খুব সুন্দর করে গোছানো, দেখে মনেই হচ্ছে না এ বাড়িতে কোন মেয়ে মানুষ থাকে না। আনিস আগেই ঘরে ঢুকে বিছানায় খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। এই মুহূর্তে আমার কি করনীয় তা বুঝতে পারছি না। আনিস বিছানায়, মানে দরজায় খিল আঁটতে হবে আমাকে। না পারছি খিল আঁটতে না পারছি বিছানায় যেতে, লজ্জায় পা অবশ হয়ে গেছে। তখন আনিস বলে,,
দেখো সুমি, আজকের রাতকে তোমার যেমন বিষন্ন লাগছে ঠিক আমারও,, আমিও চাইনি কখনো এমন কিছু ঘটুক,, বারবার নিজের সংসার আর মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে রজনীর মা-কে বোঝাতাম কিন্তু তাতে কোন ফল হয় নি। তোমার সাথে যা যা ঘটেছে তাতে তুমি যেমন কষ্ট পেয়েছো তেমন আমিও রজনীর মায়ের জন্য কষ্ট পেয়েছি। তোমার সম্পর্কে সব খোঁজখবর নিয়েছি, তোমার যেখানে বিয়ে হয়েছিল সেখানে আমার একটা বোনের বাড়ি আছে। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছি, তোমার কেন ছাড়াছাড়ি হয়েছে? উনারাও তোমার খুব প্রসংশা করেছে, তুমি অনেক ভালো অনেক কষ্ট সহ্য করে ছিলে সেখানে, আমি চাইনা আমার জন্য তুমি আর কোন কষ্ট পাও বা তোমার জন্য আমি কষ্ট পায়।
উনার কথা শুনে মনে হচ্ছে উনি অনেক বুঝদার এবং ভালো মানুষ। আমি দ্বিধা দ্বন্দ্ব বাদ দিয়ে দরজায় খিল এটে বিছানায় বসি। ঝিঝি ডাকা রাতে, নির্জন বাড়িতে দুজন মানুষের উপস্থিতি মন কে অটোমেটিক অন্য দিকে নাড়া দিবে। এই মুহূর্তে আনিস এবং সুমির মনের অবস্থাও তেমন। (বাকিটা বুঝে নিন)
দুজন সংসার বিরাগী মানুষের কথোপকথন চলে প্রায় সারারাত। দুজনের সুখ দুঃখের কথা এক রাতে শেষ হবার না। সারাজীবন যেন এইভাবে একজন অন্য জনের পাশে থাকে সেই আশায় ঘুমিয়ে গেলো। পরেরদিন সকালে শামিম পপি সহ আরো দুই একজন আপন আত্মীয় কল করে আমার খবর নেই। সময় যাচ্ছে তার আপন গতিতে। রজনী ক্লাস ওয়ানে, প্রতিদিন সকালে রান্না করে খাইয়ে রজনীকে স্কুলে পাঠায়। রজনী ছোটমা বলে কিন্তু নিশি মা বলে ডাকে আমাকে। আমি স্বার্ধমত চেষ্টা করছি মেয়ে গুলোর মায়ের অভাব পুরোন করতে।
সত্যিই আনিস অনেক ভালো মানুষ, বাড়ির কাজ গুলোতে আমাকে অনেক সাহায্য করে, রান্না, ঘর বাড়ি পরিষ্কার করা বা কাপড় ধোয়া সব কিছুতেই আনিসের হাত থাকবেই। আমার মা আব্বা বা শামিম কখনোই রজনী নিশি কে পর মনে করে না। নিশিকে কাঁধে করে নিয়ে আব্বা দোকানে যায়। মুহিতের দেওয়া কষ্ট গুলো আনিসের আগমণে ভুলে গেছি।
সংসারে অশান্তি বা অভাব অনাটন বলে কিছু নাই। রজনী এখন আর আমারকে সৎ মা মনে করে না কিন্তু প্রথম দিনের ডাক ছোটমা টা আর মা হয় নি। মেয়েদের জন্য আমি আমার পছন্দ মতো জামা কাপড় কিনে দিই। শশুর শাশুড়ীও আমাকে ভিষণ ভালোবাসেন। হয়তো আমার অভিশপ্ত জীবনটার ইতি হয়ে গেছে।
কিছুদিন পরে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শশুর শাশুড়ী এবং আমার আব্বা মা শামিম ফাহিমা সহ সবাইকে জামা কাপড় দিবে আনিস। কাকে কি দেওয়া যায় কি কি খাবার রান্না হবে এইসব নিয়ে আমাদের মাঝে কথা হচ্ছিলো। এমন সময় রজনী মুখ গোমড়া করে বাসায় আসে। কেন জানিনা বুক টা ছ্যাক করে উঠলো আমার ,,হঠাৎ করে কি হলো মেয়েটার? রজনীকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে, সে কোন উত্তর না দিয়ে ঘরে গিয়ে সুয়ে পড়েছে। পাড়ার কোন বাজে মানুষ রজনীকে কিছু বলেছে নাকি এইসব ভেবে ভয় হলো। আমি রজনীর কাছে গিয়ে চিরুনি বের করে বলি, আসো তোমার চুল আঁচড়ে দিই। কিন্তু রজনীর চোখের কোণা দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে,, মেয়েটা এভাবে গুমড়ে গুমরে কাঁদছে কেন? আমার কোন ব্যবহারে কি কষ্ট পেয়েছে?
আমি শান্ত স্বরে আবারও জিজ্ঞেস করলাম,, পাড়ার কেউ কিছু বলেছে? কি হয়েছে বলো একবার? শুধু নাম বলো, তার জিভ টেনে ছিড়ে দিবো।
অমনি রজনী আমাকে গর-মড়িয়ে জড়িয়ে ধরে ফোফাতে ফোফাতে হ্যাচকি তুলে কান্না করা শুরু করে। আনিস ও ঘরে দৌড়িয়ে আসে, বুঝতে পারছি না কি হয়েছে মেয়েটার। আপাতত কান্না করার জন্য কিছু সময় দিলাম। কান্না করলে কষ্ট কমে অনেকটা-ই।
একটু শান্ত হয়ে রজনী আমাকে বলে, আমি তো উনাকে মা বলে সেইদিন ই অস্বীকার করেছি যেদিন উনি আমার সামনে ওই দোকানদাকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে ছিলো।সে যদি আমাকে আর নিশিকে ভালোই বাসতো তাহলে কিভাবে আমাদের রেখে অন্য কারো সাথে পালিয়ে গেলো,, সারাক্ষণ মোবাইলে কথা বলতো, আমরা কি খেলাম,কি পড়া দিয়েছে স্কুলে,খেলতে গিয়ে কেউ আমাদের মারলে সেই কথা উনাকে বললেও কখনো মোবাইলে কথা বলা বন্ধ করতো না।সব সময় আমাদের মারধর করে বাইরে খেলতে পাঠাতো। কেন পাঠাতো তা বুঝতাম কিন্তু বললে আবারও মাইর খাবো তাই কিছুই বলতাম না।
আমি এখনো বুঝতে পারছি না মেয়েটা হঠাৎ করে এইসব কথা কেন বলছে!!আমি বললাম কি হয়েছে মা, কেন এইসব কথা বলছো?
রজনী বললো, আজ ওই বে** এসেছিলো রহিম কাকুর বাড়িতে,, আমাকে চাচি ডেকে নিয়ে যায়, গিয়ে দেখি জামা ফলমূলসহ অনেক গুলো জিনিস কিনে আনছে। আমি চলে আসতে লাগলে রহিম কাকুর বউ আমাকে জোর করে কাছে নিয়ে গেছে, আমি ওই বে**কে মা মানি না। স্কুলের সবাই আমাকে বে**র বিটি বলে গালি দেয়। উনি চলে যাওয়ার পরে নিশি পায়খানা করার পরে কতদিন ওইভাবে থেকেছে তার হিসাব নাই। আব্বা কাজে যাওয়ার পর আমার খিদা লাগলে না খেয়েই থাকতাম। মাঝে মাঝে তরকারি কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলতাম। একদিন খুব ইচ্ছে করছিলো ডিম ভাজি খাবার কিন্তু আব্বা কাজে গেছে তাই আমি ভাজতে গিয়ে দেখো এখানে তেল পড়ে পুড়ে গেছে। আব্বা বাড়িতে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করে সেদিন। নিশি প্রতিদিন মায়ের হাত ধরে ঘুমাতো কিন্তু চলে যাওয়ার পরে মাঝে মাঝে পুতুল জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরে,, পাড়ার সবার মা কি সুন্দর করে পানি গরম করে গোসল করিয়ে দেয় কিন্তু আমরা দুই বোন কোন দিন চেয়েও আমাদের গোসল করায় দেয় নি। প্রতিদিন রাতে খারাপ স্বপ্ন দেখার পরে খুব ইচ্ছে করে মা-কে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু,,,,,,,
আমি আর কিছু বলতে দিলাম না, বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি রজনীকে,, এতো ছোট মেয়ের এতো কথা মনে আছে। আনিস মেয়েদের মতো কান্না করে তা আজ প্রথম দেখলাম,, বাপ মেয়ের কান্নার সাথে আমারও কান্না চলে এসেছে। হঠাৎ করে মনে হলো নিশি কোথায়? আনিস সোজা রহিমের বাড়িতে চলে যায়। গিয়ে দেখে নিশি ওর মায়ের কোলে বসে থেকে চিপস খাচ্ছে। আনিস রহিম এবং ওর বউকে গালাগালি করতে শুরু করে আর আমার শাশুড়ী এসে নিশিকে নিয়ে চলে যায়। নিশির মা ও তর্কবিতর্ক করছে কিন্তু আমি নির্বাক দর্শক চেয়ে চেয়ে দেখছি আর ভাবছি আবারও সুখ হারাম হলো আমার জন্য।
আনিসের আগের বউ পালিয়ে এতোদিন ঢাকায় ছিলো। ঈদ করার জন্য গ্রামে এসেছে। যার সাথে পালিয়ে গিয়েছিল উনার পরিবার নাকি মেনে নিয়েছে এখন। এতোদিন পরে গ্রামে এসে আনিসের বিয়ের কথা শুনে হয়তো মা-য়ের দরদ উথলে ওঠেছে। আনিস চিৎকার করে বলে আর কখনো যদি মেয়েদের সাথে দেখা করার জন্য এসেছিস তাহলে ঠ্যাং ভেঙে দিবো, আর যারা দেখা করাতে সাহায্য করবে তাদের ও দেখে নিবো।
সারাদিন রোজা রেখে এইসব অশান্তি আর ভালো লাগছে না। হালকা কিছু রান্না করলাম। বাড়িতে তেমন কারো সাথে কেউ কথা বলছে না। হঠাৎ এমন ঘটনার জন্য সবাই হিতাহিতজ্ঞান শুন্য হয়ে গেছে। আনিস কিছু ইফতারি কিনে এনেছে আমি রজনী আর নিশি কে মাঝখানে বসিয়ে এক পাশে আমি আর অন্য পাশে আনিসকে বসতে বলি। রজনীকে আজ নিজের হাতে খাইয়ে দিলাম (যদিও নিশিকে মাঝে মাঝে খাইয়ে দিতাম কিন্তু রজনী কে আজ প্রথম)। মেয়েটা আবারও কান্না করছে। রাতে আনিস আমাকে বলে,,
আমি জানি তুমি মনে মনে খুব ভয়ে আছো,, আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারো, যে থুথু একবার ফেলেছি তা আর কখনো মুখে নিবো না। চরিত্রহীনদের কখনো ক্ষমা করা যায় না, এতে তাদের চরিত্র আরো নষ্ট হয়।
আস্তে আস্তে পরিবেশ স্বাভাবিক হলো। ঈদের পরেরদিন বেশ কিছু আত্মীয়দের দাওয়াত করেছি। সবাইকে নিয়ে খুব মজা করে ঈদ শেষ করলাম। আনিস প্রতিদিন সকালে কাজে যায়। এদিকে আনিসের বউ যে দোকানদারের সাথে পালিয়েছিলো উনি এখন আবারও ওই দোকান চালু করেছেন। দোকানটা আমাদের বাড়ির পাশেই,, মাঝে মাঝেই দেখি আনিসের বড় বউ খাবার নিয়ে আসে দোকানে।
ভয় করতে না চাইলেও ভয় মনে দানা বাধে,, কারণ সে আনিসের দুটো বাচ্চার মা, বারবার দেখা হওয়াতে যদি ঘৃণা গুলো শেষ হয়ে আবারও নতুন ভাবনা বাসা বাঁধে তখন আমার কি হবে। রজনীকে কোন ভাবেই ওর মায়ের কথা বলা যায় না। কিন্তু নিশি ছোট ভালো মন্দ বুঝে না তাই ওর মায়ের দেওয়া এটা সেটা সে খায়।
আসছে অন্তীম পর্ব,,,,,
#অভিশপ্ত_জীবন
অন্তীম পর্ব
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno
তাই ওর মায়ের দেওয়া এটা সেটা সে খায়। রজনীর স্কুলে নাকি মাঝে মাঝে যেয়ে রজনীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু রজনী পাত্তা দেয় না। বাড়ি ফিরেই ওর আব্বাকে সব কিছু বলে দেয়। আজ বিকালে আনিস ওই দোকানদার কে বলে,ভালোই ভালো তোর বউ কে সামলে রাখ নয়তো আমার হাতে মাইর তুইও খাবি সাথে তোর বউও খাবে। তখন আনিসের সাথে ওই দোকানদারের এক কথা দুই কথা হতে হতে হাতাহাতি শুরু হয়। হইহট্টগোল শুনে আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি আনিসের হাত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। নিজের মধ্যে চেপে রাখা রাগ কে আর সংযত রাখতে পারলাম না। পাশেই দেখি গাছের কিছু মোটা ঢাল পড়ে আছে, কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই আমি ঢাল টা নিয়ে দোকানদারে পিঠে দুই/তিন বাড়ি মেরে দিই। উপস্থিত লোকজন আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে কিন্তু আমি উনার দোকানের আসবাবপত্র গুলোতে ইট পাটকেল মারতে থাকি।
মানুষের সহ্যের একটা সীমা আছে,, কি মনে করেছে আমাকে সবাই, যখনি একটু সখ আমাকে ধরা দিবে আর তখনি কেউ তা কেড়ে নিতে আসবে কেন? না আর চুপ থাকবো না। নিজের সুখ কে মুঠো বন্দী করে রাখতে আমি এখন সব কিছু করতে পারি। প্রয়োজনে এই দোকান কেউ ভেঙে তুলে দিবো এখান থেকে। আমি চিৎকার করে বলতে থাকি আর কখনো যদি তোর বউ আমার মেয়েদের বা স্বামীর দিকে নজর দেয় তাহলে সাথে সাথে চোখ তুলে ফেলবো। তোর দোকান দুইদিনের মধ্যে এখান থেকে সরায় নিয়ে যাবি নয়তো আমি আগুন লাগিয়ে দিবো, মনে রাখিস। রাগ যেন কোন ভাবেই কমছে না, মনে হচ্ছে খুন করে ফেলি ওই দুজন কে।
কয়েকজন লোক আমাকে আর আনিসকে টেনে নিয়ে বাড়ির ভিতর গেছে।আনিসের হাত কেটে গেছে, ঘর থেকে ডিটল এনে হাত পরিষ্কার করে বেধে দিলাম। আনিসের বউ আবারও ফিরে আসার জন্য নয়,, শুধু মাঝে মাঝে বাচ্চাদের সাথে দেখা ও কথা বলার জন্য একটু সুযোগ চাইতো এর ওর মাধ্যমে, কিন্তু আনিসের পরিষ্কার কথা, যদি এতোই মায়া থাকতো তাহলে ছেড়ে যেতো না। আমাদের সাথে এমন মারামারি হওয়ার মাসখানেক পরে ওই দোকানদার দোকান বন্ধ করে আবারও ঢাকায় চলে গেছে।
আনিস আজ পর্যন্ত কখনো আমার মন খারাপ হবে এমন কোন কিছু করে নি। আমি ও সর্বদা চেষ্টা করেছি, আমার তরফ থেকে যেন এমন কিছু না হয়, যাতে আনিসের মন খারাপ হয়। দুজন দুজনকেই যথেষ্ট পরিমাণ সম্মান করি। স্বামী স্ত্রী সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্মান অত্যন্ত জরুরি বিষয়। প্রথম প্রথম ভাবতাম আনিস হয়তো আবারও ওই বউকে নিবে কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই আনিসের প্রতি আমার আস্থা বেড়ে যাচ্ছে। এমন একটা ভালো মানুষকে ছেড়ে কোন মেয়ে চলে গেছে তা ভাবতেও অবাক লাগে।
দেখতে দেখতে মেয়ে দুটো বড় হয়ে গেছে, রজনী এইবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে। মেয়েটার পড়াশোনার প্রতি খুবই আগ্রহ। নিশি ক্লাস সেভেনে পড়ে। একদিন বিকাল বেলা বসে রজনীর মাথায় তেল দিয়ে চুল গুলো আঁচড়ে দিচ্ছিলাম আর পাশেই নিশি বই নিয়ে বসে পড়ছিল। এমন সময় আনিসের ওই প্রতিবেশী বোন আসে (যার বিয়ে মুহিতের গ্রামে হয়েছে) উনি আমাদের এমন সুখি পরিবার দেখে খুবই খুশি হোন। আর বলেন,, আল্লাহ কখনো ভালো মানুষের কষ্ট গুলো কে চিরস্থায়ী করে না। উনি কথায় কথায় বললেন যে, আমাকে তালাক দেওয়ার ৫/৬ বছর পরে রুনার জরায়ুতে টিউমার ধরা পরে। তাই অপারেশন করা লেগেছিল। অপারেশন করার বছর খানেক পরেই নাকি সামি পানিতে পড়ে মারা গেছে। যেহেতু জরায়ু অপারেশন করার পরে আর বাচ্চা হয় না তাই তারা নিঃসন্তান জীবন পার করছে। শিহাবকে নাকি এখন মুহিতই লালন পালন করে নিজের ছেলের মতো।
সামি মারা গেছে কথা টা শুনে খুব খারাপ লাগছে,, কত আদর যত্নে রেখেছিলাম,, সামির ছোট ছোট হাত পা চোখ সব কিছু আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠেছে। আমি কখনো চাইনি মুহিতের শাস্তি এইভাবে হোক।বাবা মায়ের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হলো সন্তানের জীবন দিয়ে। খুব কান্না পাচ্ছে কিন্তু কিছু কিছু মুহূর্তে কান্না করাটা দৃষ্টিকটু তাই কোন রকম নিজেকে সামলিয়ে নিলাম। উনি আরো কিছুক্ষণ গল্প করলেন। রজনী কে বিয়ে দিবো নাকি জিজ্ঞেস করলেন। রজনী কে অনেক পড়াশোনা করানোর সখ আমার। যদি কখনো বিয়ে দিই তাহলে আমি যাচাই-বাছাই করে বিয়ে দিবো। উপরের সৌন্দর্য দেখে না।
আমার জীবনে মুহিত ছিলো মাকাল ফল,, এমন অন্য কোন মাকাল ফলের হাতে রজনী বা নিশি পড়ুক তা আমি মা হয়ে কখনো চাই না।
অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য আনিসের শরীর অত্যন্ত দুর্বল,,, সব সময় কোন না কোন অসুখ লেগেই থাকে। এদিকে রজনীর বয়স প্রায় ২০ বছর পার হয়ে গেছে। অনার্স ২য় বছরের ছাত্রী। মেয়েটা তার সব গোপন কথা গুলো আমাকে বলে। রজনী একটা ছেলে কে খুব পছন্দ করে। আনিস ও চাই রজনী কে বিয়ে দিতে, কারণ নিশি ও বড় হয়ে গেছে। হায়াত মওতের কথা তো বলা যায় না। আল্লাহ না করুন যদি আনিস মারা যায় তাহলে মেয়ে দুটো কে নিয়ে আমি মহা সাগরে পতিত হবো। আমি রজনীকে বললাম তার পছন্দের ছেলে কে দেখতে যাবো।দিন তারিখ ঠিক হলো, আমাদের মাথা মুরোব্বি কিছু লোকজনদের সাথে নিয়ে আমি আর আনিস ও গেলাম।
ভাগ্যের চাকা বড়ই নির্মম। ছেলেটার বাড়ি মুহিতের গ্রামেই কিন্তু পাড়াটা ভিন্ন। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে বিয়ের আলোচনা হওয়ার কথা কিন্তু পাত্র পক্ষের তেমন কোন মানুষ নেই। আমি ছেলের বাবা কে জিজ্ঞেস করলাম,, কোন লোকজন দেখছিনা,, কেউকে জানান নি?? তখন তিনি বললেন, সবাই আসবে, উত্তর পাড়ায় একটা ঝামেলা হয়েছে তাই সবাই ওখানে গেছে। উত্তর পাড়া শুনতেই কেন যেন ইচ্ছে করছে কার কি হয়েছে তা শোনার। তাই জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে?
তিনি বলেন,, মুহিতের পালিত ছেলে শিহাব কে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। বদমাশ ছেলে সারাদিন গাজা খায় আর গাজা কেনার টাকা দিতে না চাইলে মুহিত আর ওর বউকে মেরে টাকা নিয়ে যায়। বেটা চোরও আছে,, গ্রামের মানুষের কোন কিছু বাইরে রাখার জো নাই ওর জন্য। উচিত শিক্ষা হয়েছে শালার।
মনে মনে হাসি পাচ্ছে,, এটাই আল্লাহর বিচার ,, শুনেছিলাম মুহিত যখন ঢাকার ওই মেয়েকে বিয়ে করে বাড়িতে এসেছিল তখন বউয়ের কথায় মা কে মেরেছিল। আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।
রজনীর বিয়ে হয়েছে,, জামাইয়ের স্বভাব চরিত্র মাশাল্লাহ, দেখতে ও খুব সুন্দর। কোম্পানিতে চাকরি করে। প্রতি ঈদে আমাদের সমস্ত দ্বায়িত্ব পালন করে জামাই। নিশি কে বিয়ে দিয়ে বাড়িতে রাখতে চাচ্ছি। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছে।
দোয়া করবেন সবাই,, নিশির ভাগ্যটা যেন ভালো হয়।
আল্লাহ হাফেজ 💔