গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে – পর্ব ৪৪

0
514

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৪

“যদি প্রিয়জনদের ভালোর জন্য সেই প্রিয়জনকে ভুলে যেতে হয় তাহলে এই কাজটা করাই শ্রেয়।”

হাফ ছেড়ে আনমনে কথাগুলো বলল নির্জন। মেহরাজ শুনে খুব একটা সন্তুষ্ট হলো না। এই প্রথম তার স্যার কি-না প্রেমে পড়েছে! কাউকে ভালবাসতে পেরেছে। কোনো নারী তার মনে জায়গা করতে পেরেছে। সামান্য একটা সিক্রেট অফিসার হওয়ার কারণে কিনা সব শেষ হয়ে যাবে? এটা কিছুতেই মানতে পারল না সে। মুখ কালো করে বলল,
“আমার মনে হয় রাগিনী ম্যাডামের বাবা একটু বেশি বেশি করছেন।”

“নাহ। উনি ঠিক করছেন। আমিও তো একই কাজ করেছি নয়নের সাথে।”

স্থির চোখে তাকাল মেহরাজ। চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময়। কৌতূহলী হয়ে রইল নির্জনের মুখের দিকে চেয়ে। নির্জন ধীরগতিতে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে টেবিলে হাত রাখল।
“যখন আমার মা-বাবা দুজনেই মা’রা গেলেন তখন থেকে আমার মাথায় শুধুমাত্র একটা চিন্তাই ঘুরত আর তা হলো নয়নকে আমি কীভাবে নিরাপদে রাখব। আমার বাবা পুলিশ হওয়ার কারণে শত্রুর কমতি ছিল না। তারপর আমি সিক্রেট টিমে জয়েন করার পর ভয়টা বাড়ে। নয়ন তখন খুব একটা বড় নয়। মাত্র স্কুল পাশ করেছিল। ওর কথা ভেবে আমি তো ওকে দূরে করে দিয়েছি। ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি ওকে লন্ডন পাঠাই। ও প্রথম কয়েকদিন কল করে বেশ কান্নাকাটি করে। কিন্তু আমার মনকে গলতে দিই নি। কারণ জীবনে নয়ন আমার একমাত্র দুর্বলতা ছিল। যাকে আমি কোনো মতেই হারাতে চাইছিলাম না। আমার জীবনে নয়ন ছাড়া আর কেউ অবশিষ্ট ছিল না। তাই প্রয়োজনে ওকে আমার থেকে দূরে করে দিয়েছি। সে মেনে গেল ঠিকই। কিন্তু গত এক বছর ধরে সে বারবার দেশে আসার সুযোগ খুঁজছে।”

“তার কারণটা বোধহয় ইন্সপেক্টর রায়ান স্যার।”

মাথা চুলকে ফট করে কথাটা বলে ফেলল মেহরাজ। নির্জন তাকে সম্মতি জানিয়ে বলল,
“হুমম। ঠিক যে কারণে ওকে আমি লন্ডনে পাঠিয়ে দিয়েছি। ও আবারও সে আতঙ্কের দিকে ছুটছে। দেশে এত এত ছেলে থাকতে তার ইন্সপেক্টর রায়ানকে পছন্দ হলো‌। ও ভাবে আমি ওর পছন্দ করা মানুষকে পছন্দ করি না। নয়ন জানেনা আমি সব সময় ওর সুরক্ষা নিয়ে কতটা ডেসপারেট। মেয়েটা এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। নিজে নিজে পছন্দ করা শিখেছে। সে এখন নিজের ভাইকেও বলে দেয় নিজের ভালবাসার মানুষকে কিভাবে কনফেস করতে হয়।”

“স্যার আপনার একটা ডিসিশন কিন্তু উনার মন ভেঙে দিতে পারে।”

“আমি শুধু চাই ও ভালো থাক। আমার উপর যে আগুনের আঁচ আসে সেটা যেন কখনো ওর উপর না পড়ে। আমি ভাই হয়ে তার সঙ্গে এমনটা করছি। তাহলে একজন দায়িত্বশীল বাবা হয়ে কেন রাগিনীর বাবা এ কাজ করবে না বলতে পারো।”

মেহরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এজন্যই সে বোধহয় অফিসার নির্জন আহমেদকে এতটা সম্মান করে। কারণ মানুষটা সব থেকে আলাদা। নির্জনের কড়া গলা শোনা যায় এবার।
“কাজে মন দাও মেহরাজ। ঘটনা কতদূর এগোল?”

“মাওয়া ঘাটের নদীর নিচে একটা বি’স্ফোরণ ঘটেছে স্যার। এই ঘটনা গতকালকের। অভিরূপ আর ওই মেয়েটাও কালকে ওই সময়ের আশেপাশেই ওখানে উপস্থিত ছিল। তারা বিদায় নেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই এই কাহিনী হয়।”

নির্জন কিছুটা আশ্চর্য হয় বটে। কী হচ্ছে এসব? কেনই বা হচ্ছে? অভিরূপকে মা’রবে বলে রাগিনীকে সরানো হলো। কিন্তু ঘটল ঠিক উল্টোটা! অভিরূপের কোনোরূপ ক্ষতি হলো না। নির্জন চুপ করে ভাবনায় ডুবেই রইল। মুখে এলো না কোনো কথা। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা পালনের পর সে শক্ত গলায় বলল,
“শহরে যতগুলো প্রাইভেট হসপিটালে প্লাস্টিক সার্জারি করা হয় সেগুলোতে খোঁজ নাও। আর নেওয়া যাচ্ছে না। সবকিছু এক জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এর একটা বিহিত হতে হবে। শহরের কেউ সেফ নয়।”

“ইয়েস স্যার।”

নির্জনের কথায় বাধ্য মতো উত্তর দিল মেহরাজ। বেরিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। তার যাবার পরেই ড্রয়ারটা একবার খুলল নির্জন। চকচক করে উঠল ঘড়ি। গ্লাসে যেন আবারও রাগিনীরই প্রতিচ্ছবি। কী সুন্দর হাসছে! ঘড়ির গ্লাসে সুন্দর করে হাত ছুঁইয়ে দিল আরো একটা বার। নিজ মনেই বলল,
“তুমি আমার সামনে থাকলে তো পাগল করে দাও। আর এখন না থাকলে দেখছি আরো বেশি পাগল করে দাও। তোমার থেকে কি পরিত্রাণ নেই?”

মানুষ যত বড়োই হক না কেন! মনটা সবসময় অবুঝের ন্যায় থেকে যায়। যখন সেখানকার উন্মাদনার পরিমাণ বাড়ে তখন নিজেকে সামলানো দায় হয়ে যায়। বিশেষ করে মন সবসময় চেয়ে বসে নিষিদ্ধ জিনিস! যার প্রতি হক নেই। যার প্রতি অধিকার ফলানো কখনো সম্ভব নয়। নির্জনের ক্ষেত্রেও তাই। রাগিনীকে সে নিজ অধিকারে কখনো পাবে না। আর এভাবে পেতে চায়ও না। মস্তিষ্ক কথাগুলো ঠিকঠাক বুঝলেও মনকে কীভাবে বোঝানো যায়?

একই ব্ল্যাঙ্কেটের নিচে উপুড় হয়ে গভীর ঘুমে নিমগ্ন অভিরূপ আর নোমান। দুজনেই বেশ ক্লান্ত। গতকাল একটা কনসার্টের আয়োজন হয়েছিল অভিরূপ এই দেশে আসার উপলক্ষ্যে। সেখানে এটেন্ড করতে হয়েছি আর কি! অভিরূপ যাবে না আর নোমান ছাড়বে না। শেষমেশ দুজনে ফিরেছিল রাত বারোটার পরপর। তখন থেকে দুজন ঘুমিয়েই চলেছে। ঘড়িতে সকাল দশটা ছুঁইছুঁই। দরজায় টোকা পড়ল। এমন ঠকঠক শব্দে অভিরূপ নড়েচড়ে ওঠে। ঘুমটা হালকা হয়ে আসে। ফের এমন শব্দে ঘুমটা ভেঙেই যায় তৎক্ষনাৎ। পিটপিট করে দরজার দিকে চেয়ে আবারও সটান হয়ে শুয়ে পড়ে। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে নোমান এখনো ম’রার মতো ঘুমাচ্ছে। শয়তানি বুদ্ধিটা খেলে যায় অভিরূপের মাথায়। তার ঘুম তো ভেঙেছে। তবে কি নোমান শান্তিতে ঘুমোতে পারবে? কখনোই না। কোনোমতেই না। সে আবারও ঘুমের ভান ধরে চোখ বুজল। পা দিয়ে নোমানকে ঠেলা দিয়ে বলল,
“দেখ তো কে এসেছে!”

ঘুমন্ত নোমান বেশ বিরক্ত হয়। ঘুম জড়ানো আর ঝিমানো কণ্ঠে প্রতিত্তোরে বলে,
“তুই দেখ না!”

“আমি ঘুমাচ্ছি। তুই দেখ।”

“তো কথা বলছিস কীভাবে? আমার শরীর চলছে না। উঠে গিয়ে দেখ।”

দুজনেই দুজনের কথায় অটল। তাদের কথোপকথনের মাঝে আবারও দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। নোমান নির্বিকার ভঙ্গিতে তখনও ঘুমে। মুখ হালকা হা করে ঘুমাচ্ছে সে। অভিরূপ এবার জোরে লা’থি মা’রতেই চোখমুখ জড়িয়ে অন্যপাশ ফিরে নোমান। অভিরূপ এবার হাফ ছেড়ে পুরো ব্ল্যাঙ্কেট নিজের গায়ে টেনে নেয়। নোমানের ঘুম এবার পুরোপুরি ভাঙে। অভিরূপের দিকে তাকিয়ে তার চুল ধরে টান মে’রে ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,
“জীবনে কি ভালো হবি না?”

অভিরূপ ব্ল্যাঙ্কেটে মুখ লুকিয়ে গুনগুন করে বলল,
“উমম…বাংলাদেশের ট্রেন্ডিং এ একটা গান শুনেছিলাম জানিস। মনে পড়ছে না। ওহ ইয়েস, ‘আমি তো ভালা না ভালা লইয়াই থাইকো।’ তুই তোর ভালা নিয়েই থাক। যা গেট খোল।”

অভিরূপের কণ্ঠে এমন আঞ্চলিক ভাষায় গান শুনে বেশ হাসি পায় নোমানের। ছেলেটা আর শুধরাবে না। না পেরে সে উঠে গেল দরজার দিক। দরজার লক খুলতেই আবিষ্কৃত হলো এক স্নিগ্ধ মুখ। রাগিনীকে দেখে নোমান বিনয়ের সাথে বলল,
“গুড মর্নিং।”

“গুড মর্নিং। ঘুম ভাঙেনি বুঝি আপনাদের?”

“এইতো! গতকাল রাতে আসতে অনেক দেরি হলো না! তাই ঘুমটা দেরিতেই ভাঙছে।”

রাগিনী হালকা হাসল। অতঃপর বলল,
“অনেক দেরি হচ্ছিল তো। ব্রেকফাস্ট নিয়ে বসে ছিলাম। তাই ভাবলাম একটু দেখে আসি।”

রিনরিনে গলা শুনে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে অভিরূপ। উঁকি দিয়ে তাকায় কণ্ঠ ভেসে আসার পথে। রাগিনীর মুখের একাংশ দেখা যাচ্ছে। নিজের চোখমুখ হাত দিয়ে কচলাতে লাগল সে। মুখ পুরোটাই তৈলাক্ত হয়ে গিয়েছে। দ্রুত সে টাওয়াল নিয়ে ছুটল ওয়াশরুমে।

“আপনার বন্ধুর বোধহয় ঘুম ভাঙেনি এখনো!”

রাগিনীর প্রশ্নে বড় শ্বাস নিয়ে নোমান জবাবে বলল,
“সে আর বলতে! তুমি দরজায় নক করছো আর ও রুমে আমার সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছে দরজা কে খুলবে তার জন্য। আমার ঘুমটা নষ্ট করে এখন নিজে হয়ত আবার ঘুমাচ্ছে।”

রাগিনীর হাসিটা প্রগাঢ় হয়। হাতে থাকা চায়ের কাপ আর প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলে,
“উনার জন্য আদা আর তুলসীপাতার চাও এনেছিলাম। গলা ভালো রাখার জন্য নাকি এটা অনেক দরকার।”

“সেটা তো ঠিক আছে। শুধু গায়ক সাহেবের কথা ভাবলে হবে? তোর বন্ধুর কথা মাথায় আসেনি বুঝি?”

রাগিনী তড়িঘড়ি করে পাশের চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে নোমানের উদ্দেশ্যে মিষ্টি কণ্ঠে বলে ওঠে,
“কেন নয়। আপনার জন্যও চা নিয়ে এসেছি।”

“তাও ভালো। আমি তো ভেবেছিলাম সবাই আমার কথা ভুলেই গিয়েছে।”

দুজনের কথোপকথনে এবার অন্য এক কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। গলাটা অভিরূপের। স্পষ্ট ব্যস্ত কন্ঠ।
“কে এসেছে রে নোমান? তুই উঠে পড়েছিস! যাক তোকে ঘুম থেকে উঠানোর জন্য কারোর আসা সার্থক হয়েছে।”

নোমান কিছুটা চটে গিয়ে তাকায় অভিরূপের দিকে। কিছু বলার আগেই অভির ভেজা চোখমুখ, ঘাড়ে টাওয়াল দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। এটা তো আশ্চর্যজনক কান্ড! ম্যাজিক হয়ে গেল নাকি? কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বুঝতে হলো ব্যাপারটা। রাগিনীর দিকে আঁড়চোখে তাকাল সে। চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করল,
“ব্যাপার কী? ঘুম থেকে কখন উঠলি কখন আর ফ্রেশ হলি কখন?”

টাওয়াল দিয়ে হাতমুখ মুছতে থাকা অভিরূপ বাঁকা হেঁসে বলে,
“আমাকে কি তোমার মতো অলসের দোকান মনে করিস? তোকে তো আমি কখন থেকে ডাকছি! তুই-ই তো ওঠার নাম নিচ্ছিস না।”

নোমান বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! হতবাক! কী সুন্দর করে ছেলেটা পাল্টি খাচ্ছে। কেউ দেখলে বলবে সে মিথ্যে বলছে? ভাবলেশহীন হয়ে চেয়েই রইল সে। কথা বলার আর সুযোগ পেল না। অভিরূপ রাগিনীর উদ্দেশ্যে বলে বসল,
“সরি রাগিনী! আসলে ওকে ঘুম থেকে ওঠাতে গিয়ে দেরি হয়ে গিয়েছে তার কারণে তোমাকে কষ্ট করে আমাদের ঘরে আসতে হলো।”

আরেক দফা বিস্মিত হলো নোমান। এই ছেলে যদি গান করা বাদে অ্যাক্টিং-এ চান্স নিতো এতদিনে হয়ত আরো বেশি ফলোয়ারস করে ফেলত! কী মা’রাত্মক অভিনয়! নোমানের বেশ ইচ্ছে করল এরই মাঝে তার অভিনয়ের দফারফা করতে। কিন্তু কী আর করবে! ছেলেটা খুব আশা নিয়ে অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে পানি ঢেলে না দেওয়ায় ভালো। শুধুমাত্র সে অভিরূপের ঘাড় থেকে টাওয়াল টেনে নিয়ে চোখ গরম করে টাওয়ালের ঝাপটা লাগিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলল।

তখন সন্ধ্যে। পাখির সব নীড়ে ফেরার ব্যস্ততা। অফিসে দিনরাত পরিশ্রম করা মানুষগুলোও ক্লান্তি শেষে নিজের বাড়ি এবং বিছানা খুঁজে চলেছে। সকলেই শান্তি চায়। এক ফালি চাঁদ দেখা দিয়েছে। তার কিছুটা দূরত্বেই জ্বলজ্বল করছে সন্ধ্যাতাঁরা। রাস্তার দুপাশে হলুদ রঙের সোডিয়ামের আলোয় আলোকিত। দেখা যাচ্ছে হরেকরকমের গাড়ি। নির্জন গাড়িটা ঘুরিয়ে মেইন গেট দিয়ে বাড়ির নিচে পার্ক করে। গাড়ির দরজা খুলে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বাড়ির সদর দরজার কাছে গিয়ে কলিংবেল প্রেস করে। কিছুক্ষণের মধ্যে খুলে যায় দরজা। ভেতরে দুই ধাপ রাখতেই হুড়মুড়িয়ে দুর্যোগের মতোই আগমন ঘটে নয়নতাঁরার। বাচ্চাদের মতোই নির্জনের গলার পেছনটা আঁকড়ে ধরে ভাইয়ের সাথে ঝুলে পড়ে সে। প্রথমে থতমত খেয়ে পড়তে নিলেও নিজেকে সামলে উঠে ধাতস্থ হয়ে রাগি চোখে নয়নের দিকে তাকায় সে। কিন্তু সে জানে মেয়েটার কোনো ভ্রুক্ষেপ হবে না। তাই সোজা চলতে শুরু করে আর গমগমে সুরে বলে,
“এখন আর ছোটো আছো? বড় হয়েছো, বয়স হয়েছে। ওজন বেড়েছে তো। এভাবে গলায় ঝুলে পড়লে চলে আগের মতো?”

“তুমিও বড় হয়েছো। আগের থেকে দেহ বেড়েছে। ওজন বেড়েছে তাহলে সমস্যা কোথায়?”

“তোমাদের দুজনের সঙ্গে কথায় আমি কখনোই পেরে উঠব না।”

অতিষ্ঠ হয়ে জবাবে বলল নির্জন। চাবিটা ড্রয়িংরুমের একটা টেবিলের উপর রাখল। নয়ন দাঁত বের করে হেঁসে বলল,
“একজন তো আমি। আরেকজন বুঝি রাগিনী ভাবি?”

“কী ভাবি ভাবি করছো! বিয়ে হয়েছে এখনো?”

“ইউ নো না বিগ ব্রাদার! আমি এডভান্সড। তুমিই তো বলো আমি ডেলিভারি ডেটের দুই দুই মাস আগে পৃথিবীতে হাজির হয়েছিলাম তোমাকে জ্বালানোর জন্য।”

নির্জন হাফ ছেড়ে পকেট থেকে বড় চকলেটের প্যাকেটটা বের করে নয়নতাঁরাকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে তা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“ঘাট হয়েছে আমার। এখন রেহাই দাও।”

নয়ন হেঁসে প্যাকেটটা সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে চকলেট বের করে কামড় দিয়ে মুখ দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ বের করে খেতে খেতে। যেন অমৃত খাচ্ছে। নিজের গা থেকে কোট খুলে সোফায় রাখে নির্জন। হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে,
“তোমাকে ফোন করেছিলাম কয়েকবার। ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে কেন?”

থতমত খেয়ে তাকায় নয়নতাঁরা। চোখে দেখা যায় রাজ্যের আতঙ্ক। খাওয়াটা বন্ধ হয়। আমতা আমতা করায় নির্জন ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকায়। নয়ন জোরপূর্বক হেঁসে বলার চেষ্টা করে,
“চার্জ দিই নি হয়ত।”

“ফোন অন্যের কাছে থাকলে চার্জ দেবে কী করে?”

এবার মুখটা বেলুনের মতো চুপসে যায় নয়নতাঁরার। খাওয়াটা যেন জন্মের মতো বন্ধ হয়। ঢক গিলে কিছু বলার আগেই নির্জন থমথমে সুরে বলল,
“মনের সঙ্গে ফোনও দান করে দিচ্ছো আজকাল? ফোনের চার্জারটাও দিয়ে আসতে ইন্সপেক্টর রায়ানকে।”

“আসলে ভাইয়া…”

“আসলে নকলে কিছু বুঝি না আমি। তোমার ভার্সিটি থেকে কল এসেছিল আমার কাছে। ক্লাস করছ না। কয়েকদিন পর এক্সাম। এক্সামে কী লিখবে?”

ভাইয়ের ধমকে চোখমুখ ছোট হয়ে এলো নয়নতাঁরার। নির্জন থামল না। অনবরত বলতে শুরু করল,
“নিজের ভালোটা বুঝতে শিখো নি আমি জানি। অন্তত আমাকে তোমার ভালো নিয়ে ভাবতে দাও। কালকে তোমার জন্য আমি ফ্লাইটের টিকিট বুক করব।”

নয়নতাঁরার মুখটা ভার হয়ে যায়। কাঁদো কাঁদো হয়ে নির্জনের দিকে তাকায়। যেদিন রায়ান তাকে বখাটে ছেলেদের সামনে থেকে সরিয়ে এনেছিল সেদিনই সে ইচ্ছে করে ফোনটা গাড়িতে রেখে চলে এসেছিল যাতে রায়ানের সঙ্গে আবারও তার দেখা হয় ফোনটা দিতে এসে। মনে মনে রায়ানকে বেশ বকতে থাকে নয়ন। লোকটা তো বেশ ব’জ্জাত! পেটে পেটে শ’য়তানি লুকিয়ে। তার ভাইকেই কেন ফোনের কথাটা বলতে হবে? সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল! তবে এই মূহুর্তে বুদ্ধিমানের কাজ তার বিগ ব্রাদারকে গলানো। সেই অনুযায়ী অসহায় হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল,
“এমনটা করতে পারবে তুমি? তোমার বিয়েটা অবধি আমায় খেতে দেবে না? এটা আমার সঙ্গে অবিচার হচ্ছে না?”

ভ্রু কুঁচকালো নির্জন। বিস্ময়ের সুরে বলল,
“বিয়ে! কীসের বিয়ে?”

“তোমার আর ভাবির বিয়ে! আমি তোমার একমাত্র সিস্টার। আমি না থাকলে বিয়ে জমে? নাকি লুকিয়ে বিয়ে টিয়ে সেরে ফেলেছো?”

“আজেবাজে কথা বন্ধ করবে তুমি?”

বিরক্ত হয়ে বলল নির্জন। নয়নের মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে নিজের মতোই বলল,
“এখন কিন্তু আমার ডাউট হচ্ছে। দেখো! আজ কিন্তু আমি তোমার ল্যাপটপ থেকে একটা সুন্দর দেখে লেহেঙ্গা অর্ডার দিয়েছি তোমাদের বিয়েতে পড়ব বলে।”

বি’স্ফোরিত চোখে তাকায় নির্জন। মেয়েটার মাথায় সত্যি কোনো সমস্যা আছে। অস্ফুটস্বরে বলে,
“কী বলছো!”

“হু বেশি না। আট হাজার দাম। আস্তে আস্তে সব কিনে রাখতে হবে তো। বলা যায় না কখন কোনদিক থেকে সুসংবাদ আসে। তাছাড়া আমার একাউন্ট তো ব্লক করে রেখেছো এখনো।”

“আমি কোনো টাকা দিতে পারব না। তবে হ্যাঁ এখন ইচ্ছে করছে তোমায় পা’গলাগা’রদে রেখে আসতে। ওটার জন্য টাকা ইনভেস্ট করতে পারি!”

চোখ দুটো সরু করে নয়নতাঁরা। বুকে হাত জড়িয়ে ভাইয়ের পাশে বসে ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“পাগ’লামির কী দেখলে?”

“বিয়ে বিয়ে করে পাগ’ল হচ্ছো। কীসের বিয়ে নিয়ে এত ভাবছ?”

“তোমার আর রাগিনী ভাবির বিয়ে!”

নির্বিকার হয়ে উত্তরে বলল নয়নতাঁরা। সঙ্গে সঙ্গে নির্জন বলে উঠল,
“কোনো বিয়ে হবে না।”

বলেই মূহুর্ত না থেমে উঠে দাঁড়াল সে। হনহনিয়ে যেতে লাগল নিজের ঘরের দিকে। নয়নও কী কম যায়? সেও ধড়ফড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফের তার ভাইকে জ্বালাতে পেছন পেছন ছুটল।

রাতটা কম হয়নি। প্রায় সাড়ে দশটা। বাতাসের বেগটা বেড়েছে। তীব্র হয়েছে। গাড়ির জানালা খোলা থাকার ফলে বাতাস ছুঁতে পারছে নির্জনকে। পাশেই ড্রাইভিং সিটে মেহরাজ। সে নির্বিঘ্নে গাড়ি ড্রাইভ করতে ব্যস্ত। নির্জন অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করে,
“কোথায় যাচ্ছি আমরা বলো তো! আমাকে বললে কাজ আছে। খুব ইম্পরট্যান্ট কাজ। আমি না এলে হবেই না। তাই এলাম। সেই তখন থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমায়?”

“স্যার, কখনো কখনো তো ভরসা করুন আমায়। সঠিক জায়গায় যাচ্ছি আমরা।”

“জায়গার নামটা বলতে সমস্যা কোথায়?”

মেহরাজ সহজ গলায় বলল,
“ওখানে গেলেও তো দেখতে পাবেন।”

নির্জন দাঁত চেপে বসে রইল। এমনিতেই তার ভালো লাগছে না। তার ওপর মেহরাজের এমন কান্ড! সহ্য হয় এসব? গাড়িটা যখন রাগিনীদের বাড়ির রাস্তায় মোড় নিল তৎক্ষনাৎ চকিতে তাকাল নির্জন। পাশ ফিরে মেহরাজের দিকে কপাল কুঁচকে তাকাল। মেহরাজ নীরব। নির্জন অস্থির হয়ে বলল,
“এটা তো রাগিনীদের বাড়ির রাস্তা।”

মেহরাজ তবুও কিছু বলল না। গাড়ি থামল। রাগিনীদের বাড়ির ঠিক পেছনদিকে। নির্জন তড়িঘড়ি করে বলল,
“এখানে কেন নিয়ে এলে? গাড়ি ঘুরাও।”

“না স্যার। আপনি রাগিনী ম্যাডামের সাথে দেখা করে আসুন।”

“মাথা খারাপ নাকি তোমার?”

আশ্চর্য হয়ে বলে নির্জন। মেহরাজ বরাবরের মতো মুখ ফস্কে বলে ফেলে,
“একদমই না। আপনার মাথা যেন খারাপ না হয় সেই ব্যবস্থা করছি।”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। অনিয়মিত হবার কারণে অনেকে রেগে আছেন আমার ওপর। আমিও নিয়মিত হবার চেষ্টা করছি। বেশিদূর এগোবে না আর গল্প। কারণ রেস্ট্রিকশন করে দেওয়া হয়েছে আমার আইডি। প্রথম পরিচ্ছেদ দ্রুতই শেষ করব। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ নিয়ে যখন আসব তখন নিয়মিত হয়ে আসব।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here